- 27 September, 2021
- 0 Comment(s)
- 611 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সুন্দরী, স্পষ্টবক্তা, উচ্ছ্বাস এবং তীক্ষ্ণতায় পরিপূর্ণ – রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন। জীবন-রহস্যের উৎস সন্ধানে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া এই বিজ্ঞানী ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে নিষ্ঠাবান ইহুদী হলেও, তাঁর মাকে খুব ছোটবেলায় তিনি নাকি কোনও একদিন সটান জিজ্ঞেস করে বসেছিলেন, “পিতা কেন ? সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যে মাতৃরূপে নেই এমনটাও কি হলফ করে আমরা বলতে পারি ?” প্রশ্ন, প্রশ্ন এবং আরও প্রশ্ন! মানবশরীরের যে প্রাথমিক গঠন-একক, সেই ডিএনএ’র গড়ন সম্পর্কে যুগান্তকারী গবেষণার মাধ্যমে তিনি এই বিষয়টিকে পৃথিবীর সামনে এনেছিলেন – তাঁর জীবনে শুধু প্রশ্ন এবং তাদের উত্তর খোঁজা ব্যতীত আর কোনও কিছুরই অবকাশ ছিল না। অনন্ত জ্ঞানের উদ্দেশ্যে তিনি ছিলেন এক অক্লান্ত অভিযাত্রী। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে এক অপার বিস্ময়ের আধার।
শুরুটা হয়েছিল এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি দিয়ে, কয়লার অন্তর্গঠনের উপরে পিএইচডি – সেখান থেকে ডিএনএ’র গঠন আবিষ্কার, এমনকি পোলিও ভাইরাস নিয়ে গবেষণা। মহীয়সীর জীবন যেন সত্যি সত্যিই এক রোলার-কোস্টারের বয়ে যাওয়া, জন্ম হয়েছিল যাঁর ১৯২০ সালের ২৫শে জুলাই, লন্ডনের নটিং হিল এলাকাতে। সম্ভ্রান্ত, ধনী পরিবার হিসেবে ফ্র্যাঙ্কলিন পরিবারের সুনাম ছিল। তাঁর এক পূর্বপুরুষ এককালে ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ, আন্দোলন, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ফ্র্যাঙ্কলিন পরিবার জড়িত ছিল। শ্রমজীবী মানুষদের শিক্ষার প্রয়োজনে লন্ডনে যে ‘ওয়ার্কিং মেনস কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, রোজালিন্ডের বাবা সেই কলেজে শিক্ষকতা করতেন। এছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানী থেকে আগত ইহুদী শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্যও ফ্র্যাঙ্কলিন পরিবারের সদস্যরা উদ্যোগী হয়েছিলেন। কাজেই শিক্ষা এবং প্রগতির পরিমণ্ডলেই রোজালিন্ডের বেড়ে ওঠা। মেধাবী ছাত্রী হিসেবে তিনি ১৯৩৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এইসময় তিনি তাঁর নিজস্ব, পারিবারিক একটি বৃত্তির জন্যও নির্বাচিত হন। কিন্তু তাঁর বাবা তাঁকে বলেন বৃত্তিটি সে যেন নিজে না নিয়ে এক দুঃস্থ ইহুদী শরণার্থী ছাত্রকে সেটি দিয়ে সাহায্য করে। রোজালিন্ড তাই করেছিলেন।
নিউহ্যাম কলেজ, কেমব্রিজ থেকে কেমিস্ট্রি নিয়ে তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। এখানেই মারী কুরির ছাত্র আদ্রিয়েন ওয়েলের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। এই আলাপ তাঁকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষ করে নোবেলজয়ী রসায়নবিদ রোনাল্ড জর্জ রেফোর্ড নরিশের কাছে তিনি গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু অধ্যাপক হিসেবে নরিশকে পছন্দ হয়নি তাঁর। নরিশের আচারব্যবহার ক্রমশই রোজালিন্ডের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠতে থাকে। কোনও নির্দিষ্ট গবেষণায় তাঁকে নিয়োগ করতে বা পথ দেখাতে নরিশ ব্যর্থ হন। এছাড়াও, এর সঙ্গে যোগ হয় নরিশের মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যাস। সবকিছু মিলিয়ে রোজালিন্ড অবশেষে নরিশের কাছ থেকে অব্যাহতি নিয়ে লন্ডনের ব্রিটিশ কোল ইউটিলাইজেশন রিসার্চ এ্যাসোসিয়েশনে সহকারী গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানেই তিনি হিলিয়াম গ্যাসের সাহায্যে কয়লার অন্তর্গঠন সম্পর্কে জানতে সচেষ্ট হন। কয়লার ভিতরকার যে স্তরবিন্যাস, এবং তার ভিতরে যেভাবে বায়বীয় পদার্থ থাকার কারণে গুঁড়োভাব তৈরি হয় সেই নিয়েই রোজালিন্ড গবেষণা করেছিলেন। এরপর, মারী কুরির সেই ছাত্র আদ্রিয়েন ওয়েলের সহযোগিতায় ফ্র্যাঙ্কলিন ফ্রান্সের জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র (সিএনআরএস)-এর সঙ্গে যুক্ত হন। এখানেই তিনি এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির মাধ্যমে কয়লার অন্তর্গঠন সম্পর্কে আরও গবেষণা করেন। কয়লার পাশাপাশি অন্যান্য কার্বন যৌগের গঠন সম্পর্কেও তাঁর গবেষণা প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে রোজালিন্ড তিন বছরের একটি বৃত্তি জোগাড় করে লন্ডনের কিংস কলেজে চলে আসেন।
কিংস কলেজের মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের বায়োফিজিক্স বিভাগে সহযোগী গবেষক হিসেবে রোজালিন্ড কাজে যোগ দিয়েছিলেন। এখানে তাঁর উপদেষ্টা ছিলেন জন র্যান্ডাল। এই জন র্যান্ডালই রোজালিন্ডের সহকারী হিসেবে স্নাতকোত্তরের ছাত্র রেমণ্ড গসলিংকে নিয়োগ করেন। ১৯৫২ সালের মে মাসে এই রেমণ্ড গসলিংয়ের সাথেই এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন পদ্ধতির মাধ্যমে রোজালিন্ড ‘ফটো৫১’ নামের সেই বিখ্যাত ছবিটিকে ক্যামেরাবন্দী করেন। এই ছবিটি থেকেই প্রথম ডিএনএ’র প্যাঁচালো গড়নটির সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। জীবন-রহস্য উদ্ঘাটনের পথে এক দিগন্তকে সেদিন উন্মোচিত করেন রেমন্ড ও রোজালিন্ড। ১৯৫৩ সালে রোজালিন্ড কিংস কলেজ ছেড়ে বিরবেক কলেজে যোগদান করেন। এইসময় ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরিতে আরও দুইজন বৈজ্ঞানিক ডিএনএ’র গড়ন বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা প্রকাশ করেন। এগুলির সঙ্গে রোজালিন্ডের বক্তব্যের প্রাথমিক ভাবে কিছুটা হলেও ফারাক ছিল। রোজালিন্ড স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নিজের কাজকেই সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত বলে দাবি করেন। পরবর্তীতে ডিএনএ’র গঠন সম্পর্কে রোজালিন্ডের বক্তব্যগুলিই মূলত মান্যতা পায়।
বিরবেকের অভিজ্ঞতা রোজালিন্ডের পক্ষে সুখকর হয়নি। নারী বৈজ্ঞানিকদের প্রত্যেককেই যে প্রতিনিয়ত একটা না একটা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতেই হয়। বিরবেক কলেজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে রোজালিন্ড আদ্রিয়েন ওয়েলকে বলেছিলেন, “মনে হল যেন স্বর্গ থেকে আমি একেবারে বস্তির ভিতরে এসে পড়েছি।” এই কলেজের পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধানকেও সরাসরি তিনি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে লেখা ছিল, “আমার ডেস্ক এবং গবেষণাগার ফোর্থ ফ্লোরে, আমার এক্স-রে টিউবের সরঞ্জাম বেসমেন্টে, এবং আমার সহযোগী গবেষকেরা ফার্স্ট এবং সেকেন্ড ফ্লোরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করেন। ...”
কিংস কলেজ, বিরবেক কলেজের অভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করে রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন ১৯৫৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার আমন্ত্রণ পান। পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং মার্কিনী স্বাস্থ্যদপ্তরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রোজালিন্ড বিরবেক কলেজেই পোলিও ভাইরাসের গঠন-সংক্রান্ত একটি গবেষণা শুরু করেন। তিনি মৃত ভাইরাসের বদলে সজীব পোলিও ভাইরাস ব্যবহার করেই গবেষণা করতে চাইলে সেই নিয়ে তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত হয়। শেষমেশ লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের কড়া তত্ত্বাবধানে রোজালিন্ড ও তাঁর সহযোগীরা পোলিও ভাইরাসের গঠন সংক্রান্ত গবেষণার কাজে নেমে পড়েন। যদিও, শারীরিক অসুস্থতার কারণে রোজালিন্ড তাঁর এই গবেষণাটিকে শেষ অবধি দেখে যেতে পারেননি।
সুন্দরী ও স্পষ্টবক্তা – রোজালিন্ডের সম্পর্কে প্রত্যেক পরিচিতেরই এটিই ছিল প্রাথমিক অভিমত। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে চলেছেন এটা অনুমান করেও সেই আশঙ্কাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন রোজালিন্ড। ১৯৫৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর পেট ও নিম্নাঙ্গ অস্বাভাবিক ভাবে ফুলতে শুরু করে। ডাক্তার মজার ছলে জিজ্ঞেস করেন, “গর্ভবতী নাকি ?” রোজালিন্ড সপাটে জবাব দিয়েছিলেন, “হতে পারলে তো খুশিই হতাম খুব!”জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষায় ধরা পরে তিনি জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। ১৯৬২ সালে ডিএনএ আবিষ্কার ও সেই সংক্রান্ত গবেষণার জন্যই রসায়নের নোবেলে ভূষিত হন ফ্রান্সিস ক্রিক, জেমস ওয়াটসন এবং মরিস উইলকিনস। তিনজনেই স্বীকার করেছিলেন যে, এই পুরষ্কারের সবচেয়ে বেশি দাবিদার ছিলেন স্পষ্টবক্তা সেই রোজালিন্ড, যিনি ততদিনে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাড়ি দিয়েছেন অনেকদূর।
ক্যানসারের সঙ্গে যুঝতে যুঝতেই টোব্যাকো মোজেইক ভাইরাসের গঠন নিয়ে রোজালিন্ড তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান। রোগশয্যাতে শুয়েই ১৯৫৬ এবং ১৯৫৭ সালে এই বিষয়ে রোজালিন্ডের তত্ত্বাবধানে অন্তত ১৩টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ১৭ই এপ্রিল ব্রাসেলসের আন্তর্জাতিক মিলনোৎসবে তাঁর হাত দিয়েই এই টোব্যাকো মোজেইক ভাইরাসের সামগ্রিক গঠনতন্ত্রটির উদ্বোধনের কথা ছিল। কিন্তু সেই শুভ অনুষ্ঠানের মাত্র ২৪ ঘন্টা আগে, ১৬ই এপ্রিল ১৯৫৮ সাল – এই তারিখে রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন মাত্র ৩৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। অনেক পরে, ১৯৮২ সালে এই টোব্যাকো মোজেইক ভাইরাস সংক্রান্ত্র গবেষণার জন্যই শেষ দিন অবধি রোজালিন্ডের পাশে থাকা সহযোগী গবেষক ও তাঁর ছাত্র এ্যারন ক্লুগ রসায়নের নোবেলে সম্মানিত হন। নোবেল রোজালিন্ডের ঝুলিতে আসেনি। তাঁর ছাত্রেরাই সেই অপ্রাপ্তিকে পূরণ করেছে।
তাঁকে মলিকিউলার বায়োলজির সিলভিয়া প্লাথ বলে অভিহিত করা হয়। ৩৭ বছরের এক দুর্ধর্ষ জীবন কাটিয়ে অনেক উচ্চতাকে করায়ত্ত করলেও স্বীকৃতির দিক থেকে অনেকটা অপ্রাপ্তি নিয়েই মহাকালের পথে পা বাড়িয়েছিলেন রোজালিন্ড। জীবন রহস্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে এক দিগন্তকে তিনি উন্মোচন করেছিলেন। আজ তাঁকে নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, আরও আলোচনা করব। মনে রাখবো সেই দৃপ্ত, আত্মবিশ্বাসী মানুষটিকে – মেয়েদের কথা বলতে গিয়ে যিনি স্পষ্ট সরলতায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, “পিতা কেন ? সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যে মাতৃরূপে নেই এমনটাও কি হলফ করে আমরা বলতে পারি ?”
সূত্রঃ
[১] দ্য রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন পেপার্স
[২] ব্রেন্ডা ম্যাডক্স, ‘দ্য ডবল হেলিক্স এ্যান্ড দ্য রঙড হিরোইন’, নেচার, খন্ড ৪২১, সংখ্যা ৬৯২১, ২০০৩
[৩] আন্দ্রেজ স্তাসিয়াক, ‘দ্য ফার্স্ট লেডি অব ডিএনএ’, ইএমবিও রিপোর্টস, খন্ড ৪, সংখ্যা ১, ২০০৩
[৪] জেনিফার গ্লিন, ‘রিমেম্বারিং মাই সিস্টার রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন’, দ্য ল্যানসেট, খন্ড ৩৭৯, সংখ্যা ৯৮২১, ২০১২
0 Comments
Post Comment