- 05 September, 2021
- 0 Comment(s)
- 782 view(s)
- লিখেছেন : শহীদুল ইসলাম
১৮৯৭। গোটা মহারাষ্ট্র জুড়ে ভয়ঙ্কর প্লেগের থাবা। আক্রান্ত রোগীদের সেবা করতে করতে নিজেই প্লেগের ছোবলে ৬৬ বছর বয়সে পুণে শহরে ১০ মার্চ মারা যান ভারতের এক মহিয়সী নারী সাবিত্রী বাই ফুলে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দু’দিন পরে।
অনেক মহামানুষের জন্মদিন শুধু নয়, মৃত্যুদিনও পালন করি আমরা। কিন্তু সাবিত্রীর মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করার মধ্যে রয়েছে এক গভীর উপলব্ধি, যা আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করে, আঘাত করে। সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে মানুষকে ভালবাসতে শেখায় এই মৃত্যু। কন্টক-পথে হাঁটতে হাঁটতে পরিশ্রান্ত এই পথিকের মৃত্যু বড়ই বেদনাদায়ক।
উনিশ শতকে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া জাতিভেদ প্রথা এবং শূদ্র ও নারীদের সীমাহীন দুর্দশায় মহারাষ্ট্রের জনজীবন বিপর্যস্ত। ঠিক এই সময় ১৮৩১ সালের ৩ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বোম্বে প্রেসিডেন্সির নাইগাঁওয়ে, বর্তমানে সাতারা অঞ্চলে এক কৃষক (মালি) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সাবিত্রী। খাণ্ডোজী নেভেশ পাটিল এবং লক্ষীবাঈ-এর প্রথম কন্যা সাবিত্রী। তখন বাল্যবিবাহের চল ছিল। ১৮৪০ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সী জ্যোতিবা রাও ফুলের সঙ্গে। পরবর্তীতে জ্যোতিবা রাও ফুলেও হয়ে ওঠেন একজন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক। ‘মহাত্মা’ উপাধিও অর্জন করেন।
সাবিত্রীবাঈ এমন এক সময়ের মহিলা যে সময়ে মেয়েদের স্বাধীন কণ্ঠ শোনা যেত না। সেখানে দাঁড়িয়ে লিঙ্গসাম্য, বর্ণবৈষম্যের মত ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তিনি। বর্তমান ভারতে যা আজও প্রাসঙ্গিক।
সাবিত্রী কৃষক (মালি) পরিবারের মেয়ে। তখন মহারাষ্ট্রে মালিরা অষ্পৃশ্য না হলেও নিচু জাতি বলে বিবেচিত হত। ব্রাহ্মণদের চরম ফতোয়ায় তারা পড়াশোনার সুযোগ পেত না। উঁচু জাতির—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্যদের সেবা করায় তাদের কাজ বলে বিবেচিত হত। ফলে শিশু-সাবিত্রীর কোনও লেখাপড়া শেখা হয়নি। তাই বিয়ের আগে কোনও অক্ষরজ্ঞান না হলেও ওই বয়সেই সাবিত্রী কিন্তু ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী এবং তাঁর বুদ্ধি ছিল প্রশংসনীয়।
সাবিত্রীর পড়াশোনা শুরু বিয়ের পর থেকে। প্রকৃত জহুরি নিখাদ হীরে চিনতে ভুল করে না। জ্যোতির পিসি সগুনাবাঈ ৯ বছরের সাবিত্রীর মধ্যে দেখেছিলেন তেজ আর সাহসের সংমিশ্রণে গড়া এক নারীকে। দেরি করেননি সগুনাবাঈ। নিজেই সাবিত্রীকে লেখাপড়া শেখাতে শুরু করেন। শিক্ষা এবং জ্ঞানার্জনে সাবিত্রীর উৎসাহ দেখে জ্যোতিবা রাও তাঁকে পড়ানোর দায়িত্ব নিলেন। তবে লেখাপড়াটা চলত অতি গোপনে। কারণ তখন নিচু জাতির লোকেদের পড়াশোনার চর্চা বর্ণ হিন্দুরা মেনে নিতে পারত না। প্রতিপদে অত্যাচার নেমে আসার ভয় ছিল। তাই-ই হল। সাবিত্রীর পড়াশোনার খবর গোপন রাখা গেল না। ব্রাহ্মণরা জ্যোতির বাবা গোবিন্দরাও ফুলের ওপর চাপ বাড়াতে থাকল।
ব্রাহ্মণদের চাপের কাছে হেরে গেলেন গোবিন্দরাও। জ্যোতিকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেন। জ্যোতির পাশেই দাঁড়ান সাবিত্রী। বাস্তুচ্যুত জ্যোতির বয়স তখন বাইশ, আর সাবিত্রীর আঠারো। লেখাপড়া কিন্তু বন্ধ হয়নি। বরং তার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের স্বপ্নও লালিত হতে থাকে। আহমেদনগরে মিসেস ফারহার মার্কিন মিশনারি স্কুলে শিক্ষিকা হওয়ার প্রশিক্ষণ নেন সাবিত্রী।
১৮৪৭ সালে সাবিত্রী সাগুনাবাঈয়ের সঙ্গে মিলিত ভাবে একটি স্কুল স্থাপন করেন মাহারওয়াড়াতে। এরপর ১৮৪৮ সালে ভিডেওয়াড়াতে দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়, যার প্রধান শিক্ষিকা মনোনীত হন সাবিত্রী। সে যুগে যখন নারীশিক্ষাকে হিন্দু ধর্মের পরিপন্থী বলে মনে করা হত, তখন এক সাধারণ কৃষক পরিবারের মহিলা শিক্ষিকা নিযুক্ত হওয়া এক বিস্ময়কর ঘটনা বললেও বোধহয় কম বলা হয়। সেই পথ চলা। পরে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যকে তোয়াক্কা না করে সাবিত্রী এবং জ্যোতির প্রচেষ্টায় অন্তত ১৮টি মেয়েদের স্কুল স্থাপিত হয়।
সেই সময় স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়েদের চুল কেটে ফেলার রেওয়াজ ছিল। এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সাবিত্রী ক্ষৌরকর্মীদের সমর্থনে ধর্মঘটের ডাক দেন, যাতে তাঁরা চুল কাটেন। এতেই শেষ নয়। সেই সময়ে মেয়েদের বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল, এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের বৃদ্ধ স্বামীদের মৃত্যুর পর তাঁরা বিভিন্ন ভাবে নিপীড়িত হতেন। এর মধ্যে যৌন নিপীড়নের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অনেক সময় এই মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে পড়তেন ও ভ্রূণহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হতেন। এই মেয়েদের জন্য সাবিত্রীবাঈ একটা আশ্রম স্থাপন করেন, যেখানে তাঁরা ও তাঁদের গর্ভস্থ সন্তানেরা স্থান পেতেন।
সাবিত্রীবাঈয়ের জীবনে এমন ঘটনার অভাব নেই। অস্পৃশ্যতার প্রকোপ যে সময় মারাত্মক, ঠিক সেই সময়েই সাবিত্রী তাঁর বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে একটি জলের কুয়ো স্থাপন করেন, যেখানে ‘নিচু’ জাতের মানুষ কোনো অসম্মান ছাড়াই জল নিতে পারতেন।
সাবিত্রী আর জ্যোতিবা রাও নিঃসন্তান ছিলেন। ১৮৭৪ সালে তাঁরা এক ব্রাহ্মণ বিধবার সন্তানকে দত্তক নিয়েছিলেন। নাম রাখেন যশবন্ত। পরবর্তীকালে যশবন্ত ডাক্তার হন। প্লেগ মহামারির সময় রোগী-সেবায় সেই যশবন্তই মা সাবিত্রীর পাশে দাঁড়ান। সেবা করতে করতেই ওই প্লেগেই জীবনাবসান হয় সাবিত্রী বাঈ ফুলের।
সাবিত্রী নিজেকে সমস্ত সঙ্কীর্ণ চিন্তার ঊর্ধ্বে রেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষা সমাজের সব ব্যাধি দূর করতে পারে। দুঃখের বিষয়, এ যুগে এসে আমরা তাঁর কথা এবং ভারতের নারীবাদী চিন্তনে তাঁর অবদানের কথা ভুলে গেছি। আমরা ক’জন বুঝতে চেষ্টা করেছি তাঁর মর্মস্পর্শী কবিতার ভাষা—
স্বনির্ভর হও, পরিশ্রমী হও,
কাজ কর, শিক্ষা নাও, বিত্তশালী হও।
বিদ্যা ছাড়া সব নষ্ট
জ্ঞানহীন মোরা পশু
কর্মহীন আর নয়, যাও শিক্ষা নাও।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment