শাপিতপুরুষ (ত্রয়োদশ কিস্তি)

  • 20 February, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 398 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পূর্বকথা- র্কিকর্তব্যবিমূঢ় রিমা কিছুক্ষণ বসেই রইল। কোন কথা না বলে নিঃশব্দে উঠে রান্নাঘরে গেল। কেক কাটার চাকু হাতে নিয়ে ফের বিছানায় গেল। চাকুটি লুকিয়ে রাখে বালিশের তলায়। অন্তত আত্মরক্ষার চেষ্টা তো করা যাবে। বিছানায় সাপকুণ্ডলি হয়ে শুয়েছে। দম আটকে আসছে। নিশ্বাস ফেলছে ছোট্ট করে। মনে হয়, এখনি ছুটে এসে গলা টিপে ধরবে সুমন। গলায় সুমনের অদৃশ্য আঙুলের ফাঁস লেগে-ই আছে।

[২১]

রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে, সকাল কদ্দূর রিমা 

জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে এখন রিমা। বুকের মধ্যে একলেমসিয়া রোগীর মতো ভয়ের কাৎরানি। ভাবছে, না, আর সম্ভব নয়। দিনের আলো ফুটতেই সরে পড়ব। একান্ত নিজস্ব একটা ঠাঁই খুঁজে নিতে হবে। ভালোবাসার অধিকারে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলতে পারি আমি নিজেকে, কিন্তু যে শিশু পেটে, রীতিমতো পূর্ণ মানুষে রূপ নিয়েছে, ওকে হত্যার অধিকার আমার নেই। 

ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল সুমনের নিশ্বাস ফেলার শব্দ। এক হাতে চাকুটা শক্ত করে ধরে রাখে রিমা। হুড়মুড়িয়ে বিছানা হতে ওঠার সময় মোবাইল কোথায় যেন ছিটকে পড়েছে। অন্ধকারে দিকশূন্য হাতড়ে পায় না। রাতের কত প্রহর কাটল ধারণা করতে পারে না। ড্রইংরুমে লাইট জ্বললেও দুই রুম ডিঙিয়ে আলো আসতে পারে না বেডরুম অবধি। নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে বুকে মৃত্যু ভয় নিয়ে রাত জাগে রিমা। আরও গাঢ় অন্ধকারে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায় কেন্নোর মতো। মাটিকাটা শ্রমিকের মতো বেঘোর ঘুমে বেহুঁশ সুমন। দেয়াল ঘড়ির কাঁটার টকটক শব্দ রিমার ভেতরের নৈঃশব্দকে জাগিয়ে রেখেছে।

বাজারের বড় মসজিদে আযান পড়ছে। রুমে তবু ঘুটঘুটে অন্ধকার। লাইট জ্বালায় রিমা। আলোর ঝিলিক পড়তেই হুঁ হুঁ করে বোবা চাপা গুমরানোর শব্দ উঠে আসছে রিমার ভেতর হতে। সুমন লুটিয়ে আছে মেঝেতে। মৃতবৎ এ মানুষ, এ সংসার ফেলে কোথায় পালাব আমি! আমি ছাড়া আর কে আছে এ মানুষটির? ডুকরে কেঁদে ওঠে ঘুমন্ত সুমনের উপরে লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। টাল সামলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিছানায়। ভোরের শান্ত নিঃশব্দতা যেন মুখ টিপে ধরেছে রিমার। বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ে শেষে।

একটি নতুন সূর্যের প্রথম হাসির ঝলক বারান্দা অতিক্রম করে বেডরুমে এখন। ঘুমন্ত সুমনের মুখের উপরে পড়েছে সকালের সোনারোদ। হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সুমন। নিজের দিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে। এ কী! এভাবে মেঝেতে পড়ে আছি কেন আমি? নিজের মধ্যে নিজেই ঝিম মেরে ঠাঁই বসে ভাবে সুমন। ভেতরে হার্টবিটের আপডাউন অস্বাভাবিক। বিধ্বস্ত রিমা। বেহুঁশ ঘুমে। তবে কি আজ রাতেই হত্যার চেষ্টা করেছে? ব্যর্থ হয়ে এ দশা! ধস্তাধস্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারেনি বোধ হয়। তারই এক পর্যায়ে....। অহ্! ভাবতে পারি না। চুল টেনে ধরে সুমন। রাগে ঘৃণায় রি রি করে উঠলেও নিজেকে শান্ত রাখে। ধীর শান্ত ও বিনীত কণ্ঠে ডাকে, রিমা, ওঠো! ওঠো লক্ষ্মী!

রিমা লাফিয়ে উঠতে গেলে সুমন ধরে ফেলল। ধীরে! ধীরে সোনা! তোমার শরীর একের ভেতরে দুই। হা হা করে প্রাণবন্ত হাসি দিল সুমন। ভেতরে জমাট বাঁধা ভয় অনেকটাই সরে গেল রিমার। হাত উঁচিয়ে শরীর আড়মোড়া দিতে দিতে দেখে নিল সুমনকে। আত্মীয়-পরিজনহীন নির্বন্ধু এই মানুষটির সব আশ্রয় রিমা।  ওকে ছেড়ে যাবে কোথায়? ক’মাসের ব্যবধানে সুমনের ভেতরে বাইরে আমূল পরিবর্তন। চেহারায় সেই মাধুর্য নেই। রুক্ষ রুক্ষ ভাব। বুড়িয়ে গেছে এ বয়সেই। চোয়াল গর্তে ঢুকেছে। চোখের নিচে গাঢ় কালি। কথায় কথায় সেই হাসি নেই। সেই প্রাণ চাঞ্চল্য নেই। আত্মমগ্ন থাকে। কী একটা ভয় ওকে তাড়া করে ফিরছে। ও যেন ঘোষিত ফাঁসির আসামি। জীবন হারানোর ভয়ে পালাবে কোথায় সে জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। 

কী ভাবছো? নতুন কোন ফাঁদ? ফোস করে মুখ থেকে কথাটা বের করেই এমন ভঙ্গি করে বসে রইল সুমন, যেন কথাটি অন্য কেউ বলেছে। 

কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় রিমা, হোয়াট!

বিব্রত চোরের মতো মাথা চুলকায় সুমন, না, মানে, কিছুই বলিনি। তোমাকে বড্ড অড্ দেখাচ্ছে। ফ্রেস হয়ে নাস্তা টাস্তা করো।

রিমা বাথরুমে ঢুকে গেল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এটাস্ট বাথ। খাটে বসে রিমার খুঁড়িয়ে হাঁটার দৃশ্য দেখে সুমন। জড়ানো আছড়ানো বালিশ-বিছানার দিকে তাকাতেই হঠাৎ চোখ পড়ে গেল বালিশের নিচে। সাদাটে কিছু একটা জিনিসের কোণা বেরিয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে বালিশ তুলেই চমকে ওঠে সুমন—চাকু। জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল সুমনের কাছে। আজ রাতেই খুন করার এটেম নিয়েছিল রিমা। আর এজন্যই এমন অস্থির হয়ে বারবার ছুটে গিয়েছিল ড্রইং রুমে। কিন্তু কায়দামাফিক পায়নি বলে চাকুটা বুকের বা পেটের ভেতরে ঢোকাতে পারেনি।

সহসা সুমনের চোখ হতে একফোঁটা তপ্ত অশ্রু পড়ল চাকুতে। মুক্তোর মতো টলমল করছে অশ্রুফোঁটা। অকস্মাৎ হেসে ওঠে, চাকু তোর কত বড় রাজ কপাল! একজন অধ্যাপকের পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি ব্যবচ্ছেদ করবি। গভীর মমতায় চাকুতে একটি চুমু দিল সুমন। বাথরুমের দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দে চকিত হয়ে চাকু রেখে দিল পূর্বের স্থানে।

প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলে রিমা বলে, কার সাথে বিড়বিড় করে কথা বলছো?

সুমন শিশুর মতো অভিমানী মুখ করে বলে, যমদূতের সাথে, সে রাতে এসেছিল কি না। কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারেনি।

ধ্যাত্! ফালতু বকো না তো সকাল করে।

আমি দিব্যজ্ঞানী, আমি সব দেখি, আমি সব জানি। মুমূর্ষু মানুষের মতো শ্বাস ফেলে সুমন।

রিমার মনের ক্ষণিক প্রশান্তি উড়ে গেল।

[২২]

এই যুবতী কে, বাবা : সুমন

ঝড়ো সফরে নাটোরে সুমন। নতুন টার্মিনালে বাস থেকে নেমে একটা রিক্সা নিয়ে সোজা লালবাজারে। নোনাধরা ধ্বসে পড়া পোড়োবাড়িটা এখন সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। বাড়ির গেট খোলাই থাকে। শহরের পেটে এমন একটা পরিত্যক্ত জীর্ণ লাল বাড়ি এখনো আছে! অনেকের কাছেই বিস্ময়। বাড়ির কি মালিক নেই? উঁকিঝুঁকি মারে, কিন্তু ভেতরে প্রবেশের সাহস হয় না। বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছুর অভয়ারণ্য। বাড়িটার উত্তরাধিকার সুমনের একার নয়। তার কাকাতো ভাইরাও এ বাড়ির অংশীদার। ওদের দুইজন থাকে কলকাতা, বাকিরা উত্তর দিনাজপুরে। বাড়িটা বিক্রির ইচ্ছে নেই সুমনের। কিন্তু এভাবে কতদিন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। শত্রুসম্পত্তি দেখিয়ে প্রভাবশালী কেউ বাড়িটা সহজেই দখল করে নিতে পারে। সারাদেশে তো এখন তাই চলছে। এরমধ্যেই বাড়িটার উপরে অপরাধ জগতের কিছু মানুষ এবং শহরের টপ নেতাদের দু-একজনের শকুনচোখ পড়েছে।

বাড়ির গেটে রিকশা থেকে নেমেই পা টাল খেয়ে ওঠে সুমনের। স্মৃতিগুলো বুকের ভেতরে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ে বোবার মতো চাপা কান্না জুড়ে দিল বুঝি। হুটোপুটি খেলার সেই শৈশব, কৈশোরের দিনগুলি পায়ে পায়ে বেঁধে ভারি হয়ে উঠছে পা দুু’টো। অস্পষ্ট স্বরে ডাকে, বাবা! ভেতরে ঢোকার পূর্বে কিছুটা ভয়ও হয়। সাপ-বিচ্ছুর ভয়। পা দুটির স্থান হয় এমন নিরাপদ একটু জায়গা পেল উঠোনে। দেয়ালের নোনা মিশ্রিত বাতাস শোঁ শোঁ শব্দ করে সুমনকে  ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।

মুহূর্তের জন্য ভাবে সুমন। জঙ্গল সাফ ও কিছু মেরামত করে বাড়িটা ভাড়া দিলেও হয়। ভেতর থেকে প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু কার জন্যে? কী হবে এসব করে? জীবনই যার মৃত্যুমুখে! পেছনে তাড়া করে ফিরছে আততায়ী! যে কোন মুহূর্তে আততায়ীর ছোরা না হয় গুলি বুক ছ্যাদা করে ফেলবে, তখন আর কী  মূল্য এ বাড়ির! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমন। জীবনের সব ছকই এখন উপহাস মাত্র। রিমাকে অনুরোধ করবে কি না ভাবে, হ্যাঁ, আমি তো এ সামান্য অনুরোধ করতেই পারি—খুন করার পরে আমার রক্তাক্ত দেহটা যেন এ বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করে। আমার এই অনুরোধটুকু রাখবে না রিমা?

পায়ের আঙুল টিপে টিপে সুমন প্রবেশ করে বাবার ঘরে। মেঝেতে পা রাখার জায়গা নেই। ছাদ ধসে পড়েছে প্রায়। দেয়ালের নোনাগুলো মুষলধারে বৃষ্টির মতো ঝরছে। বাবার শোবার জায়গাটাতে ছোট ছোট গাছ গজিয়েছে। বেশিক্ষণ থাকা কঠিন। বিশ্রী গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে। সুমন হন্যে হয়ে বাবার কোন স্মৃতি খোঁজে। কোন ছবি। ব্যবহারের জিনিস। একটা কিছু পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছে। খোঁজাখুঁজির স্থান খুবই সামান্য। কিছুই চোখে না পড়ায় যারপরনাই হতাশ সুমন। কেমন নিষ্ঠুর সন্তান আমি! এ দেহটি ছাড়া বাবার কোন স্মৃতিচিহ্নই রাখিনি। ঘর হতে বেরুবার মুহূর্তে উপরে চোখ গেল। নোনা খসে বের হয়ে পড়া ছাদের জংধরা একটি রডে সুতোয় বাঁধা কিছু একটা ঝুলছে। জিনিসটির উপরে নোনার গাঢ় আস্তরণ। রডের একমাথা সামান্য নিচে, হাতের নাগালে। টেনে রডটিকে নিচে নামাল। জিনিসটি নিজেই সুতা ছিঁড়ে পড়ে গেল। কিছু নোনা সরে গেলে সুমন বুঝতে পারে এটা একটা ছবি।  প্রথম হাতে, তারপর রুমাল দিয়ে একটু একটু করে ছবির চুল, কপাল, নাক বের করতে পারলেও আঁচ করতে ব্যর্থ হয় ছবিটি কার? ছবিটি একটি পূর্ণ অবয়বের যুবতীর ছবি। কে এই ছবির যুবতী? চিনে উঠতে পারে না। যতদূর মনে পড়ে, মায়ের চেহারার সাথে ছিটেফোঁটা সাদৃশ্যও নেই ছবির যুবতীর।

সুমন ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠে। ছবি নিয়ে বেরিয়ে আসে। রিকশা নিয়ে নতুন টার্মিনালে পৌঁছে চলন্ত একটি বাসে লাফিয়ে চড়ে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছায় বাসায়।

[চলবে...]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) 

0 Comments

Post Comment