ভাঙা-গড়া

  • 15 December, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 469 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
মা যেন এখন আর আগের মতো নেই। তাঁর বয়স কমে গেছে তিরিশ বছর। নিজেকে ভেঙে তিনি আবার যেন নতুন করে গড়ে তুলতে চাইছেন। মুক্ত হতে চাইছেন সমস্ত বাধা-নিষেধ, পিছুটান থেকে। মাঝে অনেক আত্মীয় পরিজনেরা এসে মাকে অনেকরকম উপদেশ দিয়ে উপকার করার চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু তাতে তেমন কোন ফল মেলেনি। মা এখন পার্লারে গিয়ে মাঝেমধ্যে সাজগোজ করে আসেন। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের মুক্ত জীবনের আনন্দ দেখে সন্তানের নব উপলব্ধি এই গল্পের বিষয়।

ময়ূখের বাবা মারা যান মাত্র দু’দিন আগে। ভোর রাতে হাসপাতাল থেকে বাবার কোভিডে মারা যাওয়ার খবরটা এসে পৌঁছায়। মা বোধহয় তখন শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। ময়ূখ হাসপাতালে গিয়ে সমস্ত কাজ সেরে এল। ওয়ার্ড বয়রা বাবাকে একবার মাত্র দূর থেকে দেখিয়েই নিয়ে চলে যায় সৎকারের উদ্দেশ্যে। শেষবারের মতো বাবাকে আর মায়ের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হল না। একটা মৃত্যু ঝোড়ো হাওয়ার মতো সবকিছু তছনছ করে দিয়ে চলে গেল ময়ূখের জীবনে। অনেকগুলো স্বপ্ন যা সে স্তরে স্তরে জমিয়ে রেখে ছিল, একটা ঝড়ের দাপটে সেসব ভেঙে গুড়িয়ে গেল।

হাসপাতালে দাঁড়িয়ে ময়ূখ শুধু জ্যেঠু আর মামাকেই খবরটা দেয়। তারপর বেলা বাড়ার সাথেসাথে সেটা ফোন বেয়েবেয়ে নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে যায় অনেকের কান পর্যন্ত। বিধ্বস্থ অবস্থায় সকালবেলা ময়ূখ যখন ফ্ল্যাটে ফেরে তখন দেখে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা মাকে একেবারে ছেঁকে ধরেছে। ময়ূখের মাথাটা গেল চট করে গরম হয়ে। সে ঘরে পা দিতেই চিল্লিয়ে ওঠে, ‘কেন এসেছেন এখন আপনারা? বিপদের সময় একজনেরও মাথার টিকিটি খুঁজে পাওয়া যায় না। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখন এসেছেন আসমানে ফয়দা দিতে? বেরিয়ে যান সকলে এক্ষুনি।’ অনেকেরই কথাগুলো ঠিক হজম হয়না। তারা মায়ের ভাবলেশহীন মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যান। কেউ কেউ আবার ওদের সান্ত্বনা দিতে আসার চেষ্টা করেন কিন্তু ময়ূখের চোখের দিকে তাকিয়ে সাহস না পেয়ে চলে গেলেন। মা তখনও নির্বিকারভাবে একাএকা চেয়ারের ওপর বসে রইলেন। দুপুরে ময়ূখ স্নান সেরে অপটু হাতে কোনোরকমে ভাত, আলুভাজা রেঁধে ঘি দিয়ে মাখিয়ে মাকে খাওয়াতে যায়। কিন্তু মা কিছুতেই খেতে চাননা। ময়ূখ তাকে অনেক করে বোঝায়, তারপর পীড়াপীড়ি করতে যেতেই মা ময়ূখের হাত থেকে খাবারটা ছিটকে ফেলে দেয়। অন্নের অপমান ময়ূখ সহ্য করতে পারেনা। সে বিরক্ত হয়ে মায়ের মুখের সামনে টেবিলের ওপর ভাতের থালাটাকে আওয়াজ করে রেখে উঠে চলে যায়। কিছুই ভাল লাগছিল না সেদিন। কোনোভাবেই কাজে মন বসাতে পারছিল না ময়ূখ। বিকেলে অফিসের বসকে ফোন করে ময়ূখ বাবার মৃত্যুর খবরটা জানায়। বস বললেন, ‘ঠিক আছে, এখন তো কাজের তেমন চাপ নেই। তুমি প্রয়োজনে দু’দিন ছুটি নিয়ে নিতে পার।’

তারপর থেকেই অফিসের কলিগদের একটার পর একটা ফোন আসতেই থাকে। ময়ূখ সেইসমস্ত উপদ্রব একেএকে সামলে রাতের দিকে ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখে মা সেখান থেকে উঠে গিয়ে নিজের ঘরে বিছানার ওপর জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন। ময়ূখ গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী হয়েছে মা?’

মা বললেন, ‘ভয় লাগছে।’

—‘কিসের?’

—‘জানিনা।’

—‘রাতের খাবার তাহলে অর্ডার দিয়ে দিই?’

—‘না ঘরে বানা।’

ঘর থেকে বেরোনোর সময় ময়ূখ পা ঘষে মাকে আরও একবার জিজ্ঞাসা করে, ‘তাহলে খাবার বানাব?’

মা ঘাড় নেড়ে সায় দেন। আসলে ময়ূখের রান্না-বান্না করতে একদমই ভাল লাগেনা। এর আগে কোনোদিনই তাকে রান্না করতে হয়নি। বাবা বেঁচে থাকাকালীন ঘরের সমস্ত কাজকর্ম মা একা হাতেই সামলেছেন। একটা অস্বস্তি নিয়ে আর এক প্রকার বাধ্য হয়েই ময়ূখ রান্না ঘরে ঢুকল।

পরের দিন সকালবেলা ময়ূখ ঘুম থেকে উঠে দেখে মা তাঁর নিজের ঘরটুকু গোছাচ্ছেন। বহু পুরনো কিছু জামাকাপড়, কাগজপত্র বের করে এনে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। ময়ূখ জিজ্ঞাসা করলো, ‘কী খুঁজছ?’

মা কোন উত্তর দিলেন না। কতক্ষণ তাঁর এই গোছ-গাছ, ঝাড়-পুছ চলবে বলা যায় না। ঘরের সমস্ত কাজের দায়িত্ব বোধহয় এখন ময়ূখের ঘাড়ে এসে পড়ল। ঘর-দোর গুছিয়ে পরিষ্কার করে এসে ময়ূখ ল্যাপটপে বসে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল। দুপুরের দিকে মা চুপিসারে ময়ূখের ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাত করবি না?’

ল্যাপটপ থেকে চোখ না তুলেই ময়ূখ গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল, ‘অর্ডার দিয়ে দেব। রান্না করতে ভাল লাগছে না।’

মা মুখ কাঁচুমাচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন তারপর আস্তে আস্তে চলে গেলেন। ময়ূখের ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলতে ইচ্ছে করল, ‘কেন, এতদিন তো তুমিই খাবার বানাতে এখন গিয়ে বানাচ্ছ না কেন?’

কিন্তু কথাটা আর মুখ থেকে বের করতে পারল না সে। বাড়িতে তেমন কিছু বাজার করা ছিল না। শপিং মল থেকে ময়ূখ মাছ কিনতে গেল ভাজা করবে বলে। বাড়ি ফিরে এসে সে দেখে মা বসে বসে নেইল পালিশ পরছেন। মায়ের ওপর তার অস্বস্তিটা ক্রমে বিরক্তির পর্যায় পেরিয়ে রাগে পরিণত হতে শুরু করল। তবে রাগটা বিস্ময়ে পরিণত হতেও বেশি সময় লাগল না।

মা সকালের বেশিরভাগ সময়টা এখন নিজের ঘরেই কাটান। মাঝে একবার বেরিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেন। কখনো ইচ্ছা করলে হেঁসেলের কাজে ময়ূখের সঙ্গে হাতও লাগান। হঠাৎ হঠাৎ এক একদিন বিকেলে রঙচঙে সালোয়ার কামিজ পরে কাউকে কিছু না বলে সেজেগুজে বেরিয়ে যান। ঘণ্টা দুয়েক পর আবার ফিরেও আসেন। ময়ূখ একদিন মা ঘরে ফিরে আসতেই প্রচণ্ড বকাবকি শুরু করে দিল, ‘কোথায় গিয়েছিলে তুমি এতক্ষণ?’

মা অবোধ শিশুর মতো মুখ করে বললেন, ‘পার্কে, হাওয়া খেতে।’

—‘তা জানিয়ে যেতে পারো না, আমার চিন্তা হয় না বুঝি?’

মা এর কোনো উত্তর দিলেন না। সেদিন রাত্রে খেতে খেতে মা বললেন, ‘তুই আমাকে একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে পারবি?’

ময়ূখ খ্যাচম্যাচ করে বলল, ‘কেন, আমি যা রোজগার করছি তাতে তোমার চলছে না?’

মা কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু বোধহয় আর সাহস পেলেন না। ময়ূখের কেমন যেন একটা খটকা লাগতে শুরু করল। প্রতিদিনই মা সন্ধ্যেবেলা কোথাও না কোথাও বেরিয়ে যান। একদিন সন্ধ্যেয় তিনি নিজের একটা নতুন জামা আর ময়ূখের জন্যে একটা পারফিউম কিনে এনেছিলেন শপিং মল থেকে। মা যেন এখন আর আগের মতো নেই। তাঁর বয়স কমে গেছে তিরিশ বছর। নিজেকে ভেঙে তিনি আবার যেন নতুন করে গড়ে তুলতে চাইছেন। মুক্ত হতে চাইছেন সমস্ত বাধা-নিষেধ, পিছুটান থেকে। মাঝে অনেক আত্মীয় পরিজনেরা এসে মাকে অনেকরকম উপদেশ দিয়ে উপকার করার চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু তাতে তেমন কোন ফল মেলেনি। মা এখন পার্লারে গিয়ে মাঝেমধ্যে সাজগোজ করে আসেন, বলেন, ‘সাজার আবার কোনো বয়স আছে নাকি? যখন ইচ্ছা সাজলেই হল।’

ময়ূখ তার এক পুরনো বন্ধুকে ফোনে সবটা খুলে বলল। ওর বন্ধু বলল, ‘তুই কাকিমাকে একটু বেশি করে সময় দে। বোঝার চেষ্টা কর ওনার মনের মধ্যে এখন ঠিক কী চলছে। এটা পাগলামো নাও হতে পারে।’

ময়ূখ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কী বুঝব? সে তো আমাকে কিছু বলতেই চায় না। কোন একটা কথা বলতে গেলেই সে তার ছোটবেলাকার কিংবা বিয়ের আগেকার গল্প শোনাতে শুরু করে দেয়।’

বন্ধুটি বলল, ‘তুই সেটাই শুনবি। তবে তো আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারবি।’

—‘কী বুঝবো এখানে? আমার অত ধৈর্য্য নেই।’

—‘তোর দ্বারা যদি না হয় তুই কাকিমাকে বরং সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যা। আমার পরিচিত একজন আছেন। আমি যোগাযোগ করিয়ে দেব।’

—‘সাইকিয়াট্রিস্ট, মানে পাগলের ডাক্তার?’   

—‘আঃ পাগলের ডাক্তার নয়, মনোবিশেষজ্ঞ। কাকিমার মনের যে কথাটা তুই ধরতে পারছিস না, সেটা উনি ঠিক ধরে ফেলবেন।’

—‘ঠিক আছে, তুই তাঁর কন্ট্যাক্টটা সেন্ড করে দে তারপর দেখি কী করা যায়।’

—‘বেশি দেরি করিস না কিন্তু, তাতে কাকিমার মেন্টাল প্রেশার আরও বেড়ে যাবে।’                                                                                         

পরের দিন বিকেলে ময়ূখ মাকে আর কোথাও যেতে দিল না। সে মাকে বলল, ‘একটু চুপ করে বসতো তোমার সাথে কথা আছে।’

—‘কী কথা?’

—‘তুমি খুব দুঃখ পেয়েছ তাই না, বাবা চলে যাওয়াতে?’

—‘মোটেও না।’

—‘কী?’

—‘আমি ঈশ্বরের কাছে এটাই চেয়েছিলাম।’

—‘কী বকছ পাগলের মতো?’

—‘পাগল নই। এটাই সত্যি। আমি কোনোদিনই চাইনি যে তুই পৃথিবীতে আসিস।’

ময়ূখ চুপ করে বসে রইল, মা বলে চলেছেন, ‘প্রথমে একটা অচেনা অজানা মাতাল লোকের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল বাবা। তারপর শাশুড়ির সাথে ঝগড়া অশান্তি করে আলাদা চলে আসা, দিনরাত হাড়মজ্জা এক করে গাধার খাটুনি খেটে যাওয়া, মানুষের জীবনে শখ-আহ্লাদ বলে যে একটা জিনিস থাকে সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম।’

তারপর একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আবার বললেন, ‘এখন আমি একটু মুক্তি চাই। পড়ে থেকে থেকে লোকের কথা শোনার থেকে মুক্তি। একটু নিজের মতো করে বেঁচে দেখতে চাই, জীবনটাকে ঠিক কেমন লাগে। আর ঠিক এই কারণেই আমি তোকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে চাই না। যাকে সম্মান করতে পারবি তাকেই বিয়ে করিস। না হলে শুধু শুধু নিজে কষ্ট পাস না বা অন্য কাউকেও কষ্ট দিস না। জানিস পার্কে আমার অনেক বন্ধু জুটে গেছে। আমরা পার্কের বেঞ্চিতে বসে আড্ডা দিই, একসাথে শপিং মলে যাই, রেঁস্তরায় যায় খুব ভাল লাগে ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে।’

—‘আমার নামটা তোমার ফ্রেন্ডলিস্টে অ্যাড করে নেবে?’

মায়ের মুখে একটা নির্মল হাসি ছড়িয়ে পড়তে দেখে ময়ূখ বলল, ‘তোমাকে একটা টিউশনি জোগাড় করে দেব। আমার এক কলিগ তার মেয়ের জন্য প্রাইমারি ক্লাসের টিচার খুঁজছিল। অল সাবজেক্ট বাড়িতে গিয়ে পড়িয়ে আসতে হবে, পারবে তো?’

ময়ূখ দেখলো তার মায়ের কপালে এবার একটা গভীর আত্মপ্রত্যয়ের রেখা দেখা দিয়েছে।

রাতের বেলা ময়ূখ তার সেই পুরনো বন্ধুটাকে ফোন করে বলল, ‘আমার মা একদম সুস্থ আছেন রে, আর সাইকিয়াট্রিস্টের দরকার নেই।’

—‘কাকিমা এখন একটু ফ্রি হতে পারছেন তোর সাথে?’

—‘হ্যাঁ, কালকে জানিস তো ঠিক করেছি মাকে নিজের হাতে চিকেন রেঁধে খাওয়াবো।’

লেখক: ছাত্রী, গল্পলেখক

ছবি: সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment