মেয়েটা

  • 24 November, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 668 view(s)
  • লিখেছেন : ​​​​​​​নার্গিস পারভিন 
মেয়েটা ভয়শূন্য। তার অভিধানে ভয় শব্দটা একটা অলীক শব্দ মাত্র। আর সাহসী হয়ে ওঠা তার সহজাত স্বভাব। তবে নিয়মের বেড়াজালে তাকে আটকে রাখা দুষ্কর। নিয়ম সে ভাঙে না, আপনা থেকেই তার বেলা নিয়মের গণ্ডিটা বড় হয়ে যায়। এই গল্প এমনই এক মেয়েকে নিয়ে।

মেয়েটা হাসিখুশি। হাসি দিয়েই সে জগৎ জয় করে নেয়। তার ছোট্ট পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে তার শত্রু হতে পারে; বা বলা ভাল মেয়েটা তার অতি বড় বিপক্ষকেও নিমেষে জয় করে, বন্ধু বানিয়ে তোলে। মেয়েটা সঙ্গীত পাগল। তার কণ্ঠে গান আর কথা কখন যে মিলেমিশে এক হয়ে যায়! হাসি, কথায় ও সঙ্গীতে সে সারা স্কুল একেবারে মাতিয়ে রাখে। মেয়েটা ভয়শূন্য। তার অভিধানে ভয় শব্দটা একটা অলীক শব্দ মাত্র। আর সাহসী হয়ে ওঠা তার সহজাত স্বভাব। তবে নিয়মের বেড়াজালে তাকে আটকে রাখা দুষ্কর। নিয়ম সে ভাঙে না, আপনা থেকেই তার বেলা নিয়মের গণ্ডিটা বড় হয়ে যায়। তাই স্কুলে সবাই যখন নিজের নিজের ক্লাসে নিয়মের ছকে বন্দি হয়ে হাঁসফাস করে, মেয়েটা তখন হৃদয়ে সংগীতের মাধুর্য ভরে নিয়ে, আর পায়ে নৃত্যের ছন্দ তুলে এদিক-সেদিক ঘোরে। তার আসা-যাওয়ার পথে কোনও মাস্টারমশাই বা দিদিমনি যদি দেখতে পেয়ে  জানতে চান, সে ক্লাসে নেই কেন, সে কথার জবাব দেওয়ার তার সময় কোথায়! সে তখন হয়তো ছুটছে অফিসের দিকে। অসাবধানে পড়ে গিয়ে হয়তো পা কেটেছে কোনো ছাত্র, তাকেই নিয়ে অফিসে যাচ্ছে ফার্স্ট এইড করাতে, কিংবা হঠাৎ পেট ব্যথায় ছটফট করছে কোনো ছাত্রী, যার আই কার্ড দেখে, ফোন নম্বর মিলিয়ে নিয়ে বাড়িতে ফোন করার জন্য ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে। টিচার তাকে বকবেন কি উল্টে বলতে থাকেন, 
ওরে আস্তে যা, পড়ে যাবি! মেয়েটাকে স্কুলের প্রায় সবাই জানে। না চিনলেও তার নাম শুনে থাকবে নিশ্চয়। স্কুলের দিদিমনি, মাস্টারমশাইরা তাকে স্নেহস্বরে ডাকেন পাগলী বলে। 

সেদিন টিফিনের শেষে, মেয়েটা তার ক্লাসরুমে ঢুকে দেখে পুরো ক্লাস থমথম করছে। বাচ্চাদের সবার মুখে ভয় ছড়িয়ে আছে কালো মেঘের মত। একজন বললে, অঙ্কের স্যার বিশুকে স্টাফরুমে নিয়ে গেছেন! অঙ্কের পরীক্ষায় বিশু নাকি একশোর মধ্যে আশি নম্বর তুলেছে, এটাই তার দোষ। স্যারের ধারণা বিশু টুকলি করেছে। বিশু অস্বীকার করায় স্যার আরও রেগে গেছেন। 
বলেছেন, টিউশনি পড়িসনা, সাহায্য করার কেউ নেই, এমনকি তাঁর ক্লাসের ব্যাখ্যাও বিশুর মাথার উপর দিয়ে যায়! তাই প্রত্যেকবার অংকে সে টেনেটুনে পাস করে। তাহলে এবার সে আশি পেলে কোত্থেকে! স্যার চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, বল ব্যাটা বল কার খাতা দেখে টুকলি করেছিস? না হলে আজ তোর পিঠেই এই বেত আমি ভেঙে ফেলব!

মেয়েটার আর শোনার ধৈর্য্য নেই। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল সে স্টাফরুমে। সে জানে বিশু কীভাবে আশি পেয়েছে। আগের পরীক্ষায় যখন বিশুর খুব কম নম্বর এল, সবাই যখন বিশুকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল, আর বিশু লুকিয়ে কাঁদছিল, তখন মেয়েটার বুক মোচড় দিয়ে ওঠে। সেদিন থেকে মেয়েটা রোজ একটা সময়ে, সবার অলক্ষে বিশুকে অংক শেখাতে লাগল। আজ বিশু ভালো ফল করেছে। তাকে নিয়ে সবাই কোথায় মাথায় তুলে নাচানাচি করবে, তা না তার পিঠে বেত ভাঙা!

স্টাফ রুমের সামনে একদণ্ড দাঁড়াল মেয়েটা, তারপর সাহসে বুক ভরিয়ে নিয়ে সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। মেয়েটা দেখলে, অস্বস্তি আর উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অন্য টিচাররাও। সকলের মনের ইচ্ছা, ছেলেটা অংকের স্যারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাক। কিন্তু সামনে গিয়ে বলার রেওয়াজ নেই যে! মেয়েটা সোজা চলে গেল অঙ্কের স্যারের উদ্ধত ছড়ির সামনে। বিশুকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, মারবেন না স্যার, ওর কোন দোষ নেই। বিস্ফারিত নেত্র, অংক স্যারের ক্রোধ ঝরে পড়লো মেয়েটার ওপর। হুঙ্কার তুললেন, কে তুমি? কি নাম তোমার? 

আমার নাম, নন্দিনী। 

স্যারের হাতের মুষ্টি আলগা হয়ে বেতটা মাটিতে পড়ে গেল!

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৬ জুলাই ২০২১ 

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও ছোট গল্পকার

ছবি: সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment