এদেশের জলজ নারীদের কথা!

  • 14 May, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 152 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
জলজ বোধহয় এঁদেরই বলা চলে। সামুদ্রিক তীব্র লবণের ঝাঁজ এঁদের চোখের অশ্রু শুকিয়ে দেয়। এঁদেরকে নিয়ে কোনও রকম রোমান্টিসিজম চলে না। কেবল আমরা যাঁরা লিখি, বা লিখতে চেষ্টা করি, অবাক বিস্ময়ে অনুভব করি, কতটুকুই বা দেখার বিস্তার আমাদের। অর্ধেক আকাশের গল্প দূরে থাকুক, এই পৃথিবীর প্রতিটি পরিসরে মেয়েদের সদর্প উপস্থিতি ছিল, আছে, থাকবে। সমাজ কখনও পিতৃতন্ত্র অথবা মাতৃতন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হয় না। সমাজে কেবল চলে মানবতন্ত্রেরই শাসন, সমস্ত কাল।

নারীস্বত্ব আমাকে সুযোগ দেয় গতানুগতিক ধাঁচের বাইরে গিয়ে লিখতে। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে কোনও আন্দোলনের চলন নদীরই মতো হওয়া উচিত। একদিকে তা যেমন ভাঙবে, অন্যদিকে গড়বে। কাজেই আন্দোলনে যেমন আমরা ভাঙার কথা বলব, প্রতিবাদের কথা বলব, সংগ্রামের কথা বলব, তেমনই গড়ে ওঠার কথাও বলব। গড়ে ওঠারই যে সংগ্রাম, তারই যে নাম আন্দোলন। বিবিধ পেশার মেয়েদের বিষয়ে আমরা জেনেছি। আজ যাদের কথা লিখব, তাঁদের বিষয়ে দু’দিন আগে অবধিও জানতাম না কিছুই। বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত এক আলোচনায় তাঁদের বিষয়ে জেনেছি। জানা মাত্রই মনে হয়েছিল এঁদের বিষয়ে লেখা প্রয়োজন। আমাদের জানা প্রয়োজন এই মেয়েদের বিষয়ে। একই সঙ্গে আরও জানা প্রয়োজন সামুদ্রিক শৈবাল, যাকে কি না ইংরেজিতে আমরা seaweed বলে উল্লেখ করে থাকি, তারও যে রীতিমতো ঈর্ষণীয় বাজারমূল্য রয়েছে, ইদানীং কালে সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে তারও যে রীতিমতো চাষ বা farming হয়ে থাকে, সেই বিষয়টিকেও।

সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহৃত হয় খাদ্য হিসেবে। এশিয়া, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নির্দিষ্ট কিছু সামুদ্রিক শৈবালকে খাবার, অথবা খাবারের মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়াও কিছু শৈবাল ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন প্রসাধনী দ্রব্য তৈরিতে, আরও কয়েকটিকে ব্যবহার করা হয় পশুখাদ্য হিসেবে, এমনকি কৃষিকার্যে সার হিসেবেও সামুদ্রিক শৈবালের ব্যবহার রয়েছে। সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে শৈবাল চাষ করলে পরে জলে তা কার্বনশোষক হিসেবে কাজ করে, বিবিধ সামুদ্রিক প্রাণীর বসবাসের জায়গা হিসেবেও তা সুবিধাজনক। এছাড়াও ভূমিক্ষয় রোধ, সমুদ্রের জল থেকে বিভিন্ন দূষিত রাসায়নিককে শুষে নিয়ে জলকে দূষণমুক্ত করা, ইত্যাদি নানা দিক দিয়েই উপকূল অঞ্চলে সামুদ্রিক শৈবালের উপস্থিতি অথবা কৃষিকাজের মাধ্যমে তার প্রজনন ঘটানো, আজকের এই বিশ্ব উষ্ণায়ন ও আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়ে দাঁড়িয়ে দেখতে গেলে পরে, তা পরিবেশ ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে রীতিমতো উপকারী ও প্রয়োজনীয়ও বটে। ব্যবসায়িক মূল্য দিয়ে বিচার করতে গেলে দক্ষিণ ও বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ২০২০ সাল অবধি সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবসার পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৪০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৫ সালের মধ্যেই যা কি না বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮৬০ কোটি মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। বিস্তীর্ণ উপকূলরেখার কারণে ভারত স্বভাবতই সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদনে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। গোয়া, তামিলনাড়ু, কেরালা ও অন্ধ্রপ্রদেশের মতো উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে ইতিমধ্যেই সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন বা farmingএর কাজ শুরু হয়েছে। তামিলনাড়ুর উপকূলবর্তী অঞ্চলে কিন্তু বহুদিন ধরেই সেখানকার মেয়েরা, বিশেষ করে মেয়েরাই স্বাভাবিক ভাবে উপকূল অঞ্চলে পাওয়া যায়, অথবা গজিয়ে ওঠে এমন সব সামুদ্রিক শৈবাল সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বিদেশি সেই জার্নালের কল্যাণে তাঁদেরই পেশার অন্দরমহলে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেছি।

তামিলনাড়ু উপকূলে পাম্বান দ্বীপের কাছে যে মান্নার সামুদ্রিক জাতীয় উদ্যান রয়েছে, তারই বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বিন্দুর মতো দ্বীপেরই সৈকতভূমিতে অথবা পাম্বানেরই উপকূল অঞ্চলে এমন সমস্ত মহিলারা সামুদ্রিক শৈবাল সংগ্রহের কাজ করে থাকেন। উপকূল অঞ্চলে কাজ করেন যাঁরা, তাঁরা তুলনায় বয়স্ক। একটু কমবয়সী যাঁরা, তাঁরা নৌকো ভাড়া করে পাড়ি দেন গভীর সমুদ্রে, দ্বীপগুলির তটভূমিতে। একবাক্যে স্বীকার করেন সকলেই, “এই কাজ দুর্বলচিত্ত কারোর জন্য নয়,” পাশ থেকে আরও কোনও বয়োজ্যেষ্ঠা শৈবাল-সংগ্রাহক টিপ্পনী কেটে বলে ওঠেন, “সেজন্যই এখানে পুরুষদের দেখবেন না।”

উপকূল অঞ্চলে যে মেয়েরা কাজ করেন, তাঁদের বয়স ৫০ থেকে ৬০এর কোঠায়। বংশপরম্পরায় এখানকার মেয়েরা সামুদ্রিক শৈবাল সংগ্রহের কাজ করে এসেছেন। পরনের শাড়ির উপর তাঁরা গলিয়ে নেন টি-শার্ট অথবা হাতওলা গেঞ্জির মতো জিনিস। যাতে করে জলে ভিজে শাড়ি একবারেই অতিরিক্ত ভারী না হয়ে ওঠে। সকাল আটটার আশেপাশেই রাত-ফুরনো জোয়ারের জল কমে আসে যখন, তখনই এঁদের জলে নামার সময়। শৈবাল সংগ্রহ চলে বিকেল তিনটে বা চারটে অবধি, যতক্ষণ না অবধি আবারও জোয়ারের জল বাড়তে শুরু করে। জলে ডুব দিয়ে দু’মিনিট, তিন মিনিট অবধি এঁরা দম বন্ধ করে রাখতে পারেন। তারই মধ্যে একডুবে তুলে আনেন শৈবাল-শস্য, দুহাতের মুঠিতে সাজিয়ে। হাত বেঁধে নিতে হয় রুমালে, নয়তো বা পাথরে ঘষা লেগে হাত কেটে যাবার ভয়। এছাড়াও বিষাক্ত জেলিফিশ অথবা স্টারফিশের আক্রমণ তো আছেই। তাছাড়াও বিষাক্ত শঙ্করমাছ বা ওই গোত্রেরই কাঁটাওলা অন্য মাছেদের থেকেও সাবধানে থাকতে হয়। এমন বিষাক্ত কাঁটার আঘাতের ফলে মাসাধিক কাল অসুস্থতা তো বটেই, এমনকি সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে, এর কারণে মৃত্যু অবধি ঘটে যেতে পারে। চাঁদের অবস্থান, পূর্ণিমা অমাবস্যার উপরে নির্ভর করে এঁদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। কারণ পূর্ণিমা বা অমাবস্যার কাছাকাছি সময়ে সমুদ্রে জোয়ারের তো বটেই, এমনকি এমনি সময়েও জলের স্রোত তীব্রতর হয়ে ওঠে। কাজেই মাসে ১২ দিনের বেশি এই কাজ করা সম্ভব নয়। এতকিছু করেও উপার্জন কত এঁদের? যে মেয়েরা কম বয়সী ও শারীরিক ভাবে অতিরিক্ত সক্ষম হওয়ার কারণে দল বেঁধে বোট ভাড়া করে তুলনামূলক ভাবে গভীরতর সমুদ্রের দ্বীপগুলিতে গিয়ে শৈবাল সংগ্রহ করতে পারেন, তাঁদের দৈনিক আয় মাথাপিছু ৫০০টাকার কাছাকাছি। এরজন্য অবশ্য বোটভাড়া হিসেবেও তাঁদের গুণতে হয় মাথাপিছু ১০০টাকা। উপকূলে শৈবাল সংগ্রহ করা বয়স্কা মহিলারা পান দৈনিক ২৫০-৩০০টাকা। সমস্যার এখানেই শেষ নয়।

প্রকৃতির চেয়েও নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো পুরুষ। একাকী কোনও শৈবাল সংগ্রাহককে সৈকতে পেয়ে অনেক সময়েই পুরুষরূপী পশুরা তাঁদের আক্রমণ করে। ধর্ষণ এবং মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে গিয়েছে একাধিকবার। সরকারি তরফে স্বীকৃতি পাননা বেশিরভাগ সংগ্রাহক। ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ জুন, প্রতি বছরই এই সময়টা সংগ্রাহকদের কাছে সবচেয়ে কঠিন সময়। কারণ এই সময়টুকুতে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রাকৃতিক ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠা ও প্রজননের জন্য সময় দেবার কারণে, সমুদ্রে মোটরবোট চলাচল অথবা যে কোনও ধরনের সামুদ্রিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে। শৈবাল সংগ্রাহকদের অধিকাংশেরই বাড়ির পুরুষ মৎস্যজীবী হওয়ার কারণে এই সময়ে তাঁদেরও কাজ থাকে না। কেবল মদের তেষ্টা থাকে প্রচুর। সেই অত্যাচার মেয়েদেরই সহ্য করতে হয়। এছাড়াও মৎস্যজীবী হিসেবে সে সমস্ত পুরুষদের অনেকেরই সরকারি স্বীকৃতি থাকার কারণে, এই সময়ে মৎস্যশিকার বন্ধ থাকার জন্য সরকার থেকে তাঁদের এককালীন ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫০০০ টাকা করে দেওয়া হয়ে থাকে। শৈবাল সংগ্রাহক মেয়েদের কপালে জোটে না তাও। কেবল সমুদ্রের নোনা জল, অন্ধকার, বিষাক্ত সামুদ্রিক জীবের আনাগোনা, মাসে ১২ দিনের রোজগার, আর তারই সঙ্গে ‘শ্রেষ্ঠতর’ (ব্যাঙ্গার্থে!) পুরুষজাতির সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন টানাপোড়েন – এই নিয়েই তাঁদের বারোমাস্যা চলে। অবাক বিস্ময়ে আমরা সমুদ্রের গভীরে তাকিয়ে রই।

জলজ বোধহয় এঁদেরকেই বলা চলে। সামুদ্রিক তীব্র লবণের ঝাঁজ এঁদের চোখের অশ্রু শুকিয়ে দেয়। এঁদেরকে নিয়ে কোনও রকম রোমান্টিসিজম চলে না। কেবল আমরা যাঁরা লিখি, বা লিখতে চেষ্টা করি, অবাক বিস্ময়ে অনুভব করি, কতটুকুই বা দেখার বিস্তার আমাদের। অর্ধেক আকাশের গল্প দূরে থাকুক, এই পৃথিবীর প্রতিটি পরিসরে মেয়েদের সদর্প উপস্থিতি ছিল, আছে, থাকবে। সমাজ কখনও পিতৃতন্ত্র অথবা মাতৃতন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হয় না। সমাজে কেবল চলে মানবতন্ত্রেরই শাসন, সমস্ত কাল।

সূত্রঃ

[১] https://www.npr.org/sections/goatsandsoda/2023/05/07/1129895843/its-not-for-the-faint-hearted-the-story-of-indias-intrepid-women-seaweed-divers

[২] https://frontline.thehindu.com/social-issues/article10107835.ece

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

 

0 Comments

Post Comment