- 22 November, 2021
- 1 Comment(s)
- 623 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
কিছু কিছু অভিজ্ঞতার কোনও শুরু হয় না। শেষ হয় না। তারা কেবল সমৃদ্ধ করে। বিগত বেশ কিছু মাস ধরেই যে ধারাবাহিক রচনাগুলিকে লিখেছি, সেগুলি পাঠকদের কতখানি ভালো লেগেছে জানি না – শুধু বলতে পারি এ ছিল আমার কাছেই বরং এক সমৃদ্ধিকর যাপন। নিজেকে বিজ্ঞানের ছাত্র বলতে সঙ্কোচ বোধ করি, কিন্তু বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির সীমানার ভিতরে জীবনের বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছি বলেই হয়তো বা – এই সমগ্র পরিকল্পনাটিকে যে বাস্তবে রূপায়িত করা গেল, তা আজ ভারী আনন্দের বলে মনে হচ্ছে। লিখলাম বলব না, এক্ষেত্রে বলা উচিত শিখলাম। জানলাম। উপলব্ধি করলাম। সত্যি করেই এই ধারাবাহিকের কোনও শুরু হয় না, শেষও হয় না। গার্গী, মৈত্রেয়ী, খনা, হাইপ্যাশিয়া অথবা এ্যাগনোদিসকে দিয়ে শুরু করে, মেরি এ্যানিং, সোফিয়া ব্রাহে, এলেনা পিসকোপিয়া, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জীবনকে স্পর্শ করতে করতে কখন যে মারী কুরি, রেবেকা ক্রাম্পলার, কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, র্যাচেল কারসনের পথ বেয়ে কল্পনা চাওলা অথবা সারা গিলবার্টের পৃথিবীতে এসে পড়েছি, সত্যি করেই ঠাহর করে উঠতে পারিনি। অন্তবিহীন এই যাত্রাপথে কেবলই কুড়িয়ে নিয়েছি বিস্ময়। জেনেছি অচেনা, অল্প চেনা – এমনকি খুব চেনা নামগুলোর সঙ্গেও জড়িয়ে থাকা একেকটা অজানা ইতিহাস। একেকজন মানুষের মহীয়সী হয়ে ওঠার গল্প।
এই ধারাবাহিক শেষ হওয়ার নয়। পুরষ্কারের মাপকাঠিতে দেখলেই বোঝা যাবে, অন্ততপক্ষে ২০জনেরও বেশি মহীয়সী আজ অবধি বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান-ভিত্তিক বিষয়ে নোবেল পুরষ্কার জিতে নিয়েছেন। তাঁদের কজনকে নিয়েই বা আমরা এই ধারাবাহিকে আলোচনা করতে পেরেছি ? যদিও সেই সূত্রে একথাও বলা উচিত, পুরষ্কার কখনও উৎকর্ষের মাপকাঠি হতে পারে না। বরং এই ধারাবাহিকের পরিকল্পনার সময় আমাদের যে উদ্দেশ্য ছিল— বিশাল একটি সময়ের বিস্তৃতিকে কালানুক্রমে তুলে ধরা, আমরা সেই কাজে বোধ করি অনেকটাই সফল হতে পেরেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নারীর উৎকর্ষকে তুলে ধরা, সেই উৎকর্ষকে অর্জন করতে গিয়ে নারীর যে ধারাবাহিক সংগ্রাম তাকে লিপিবদ্ধ করা। এই লিপিবদ্ধকরণের ক্ষেত্রে সময়, এবং সময়ের সাথে সাথে নারীর অবস্থার বিবর্তন — এমনভাবে এই ধারাবাহিকটিকে সাজানো জরুরি ছিল। সেকারণেই আমরা হাইপ্যাশিয়া থেকে শুরু করে অথবা গার্গী-মৈত্রেয়ী’র সময়কাল থেকে শুরু করে ক্রমানুসারে ২০২১ অবধি পৌঁছতে চেয়েছিলাম। এই বিপুল বিস্তৃতির ভিতরে একেকটি মাইলফলককে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। কেবল সেই সমস্ত বিজ্ঞানী নয়, যাঁদের পুরষ্কারপ্রাপ্তি আমাদেরকে আপ্লুত করেছে — বরং তেমন একেকজন মানুষ যাঁরা নারীত্ব, মনুষ্যত্ব এবং বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষকে সমাজের চোখে প্রকৃতরূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সমাজকে, নারীকে, মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। আমরা তাঁদের কথাই বলতে চেয়েছিলাম।
সংখ্যাতত্ত্বের কিছু হিসেব এই ধারাবাহিকের একেবারে প্রথম পর্বে দিয়েছিলাম। শতাংশের হিসেবে আজকের পৃথিবীতে গবেষক বা বিজ্ঞানীদের কত শতাংশ নারী অথবা কত শতাংশ পুরুষ, সেই সংক্রান্ত নানা পরিসংখ্যানকে হাজির করেছিলাম। (আপাত দৃষ্টিতে) অন্তিম পর্বে দাঁড়িয়ে আজ সেই পরিসংখ্যানের কচকচিকে পুনর্বারের জন্য হাজির করতে ইচ্ছে করছে না। বরং কিছু ব্যক্তিগত মুহূর্ত, ব্যক্তিগত কথাকেই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেব। ওই যে বলেছি, বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে সঙ্কোচ হলেও সৌভাগ্যবশত আমি তেমনই এক পরিমণ্ডলে বড় হয়ে উঠতে পেরেছি যেখানে গবেষণা, উৎকর্ষ, বিজ্ঞানের প্রতি অনুসন্ধিৎসুতা ইত্যাদি বিষয়কে বড় আদরের চোখে দেখা হয়। গভীর এক পবিত্রতার সঙ্গে দেখা হয়। সেই পরিমণ্ডল থেকে বড় হয়ে উঠেছি বলেই হয়তো বা উৎকর্ষ শব্দটাকে এতখানি গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করতে পারি।
সময়টা ২০০৫ কি ২০০৬। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রনিক্স এঞ্জিনিয়রিং বিভাগে স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষা সেদিন। একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা পরিপাটি পোশাকে হলঘরে ঢুকলেন। তাঁর বয়স খুব কম করে হলেও পঞ্চাশের উপর। অল্প অল্প করে মাথার চুল সাদা হতে শুরু করেছে। তিনি ঢুকতেই ছাত্রেরা একবাক্যে সকলে তড়িঘড়ি দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “ম্যাডাম, এখন তো সবে সাড়ে দশটা, পরীক্ষা তো এগারোটা থেকে শুরু হবে!” সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই মহিলা উত্তর দিয়েছিলেন, “জানি সেটা। আমি ইনভিজিলেটর নই। আমি তোমাদেরই মতো একজন পরীক্ষার্থী।” ভদ্রমহিলা উইমেনস পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা করেছেন। গ্র্যাড আই. ই. টি. ই. পরীক্ষায় ৬০%এর উপরে নম্বর থাকার সুবাদে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু শর্ত ছিল তাঁর উপর। পরপর দুটি সেমেস্টারের মধ্যে স্নাতকোত্তর স্তরের অন্তত তিনটি কোর্সের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে হবে। তবেই মিলবে পিএইচডি রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ। তাই, পঞ্চাশ বছর বয়সে — অন্তত পনেরো বছর ধরে বিবাহ-সংসার ইত্যাদিকে সামলানোর পরেও, সেই মহিলা আজ ক্লিপবোর্ড, কলম, এ্যাডমিট কার্ড হাতে পরীক্ষার হলঘরে এসে পৌঁছেছেন। তিনঘন্টার মধ্যে ১০০ নম্বরের লম্বা প্রশ্নপত্রকে শেষ কবে তিনি সমাধান করেছেন, হয়তো বা তাঁর মনেও পড়ছে না। কিন্তু ... শেষ অবধি তিনি পেরেছিলেন। পরপর দুটি সেমেস্টারের মধ্যেই স্নাতকোত্তরের তিনটি পত্রের পরীক্ষাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে আদায় করে নিয়েছিলেন পিএইচডি রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ। ২০০৭ সালের ২৪শে ডিসেম্বর যখন তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর হাত থেকে তিনি পিএইচডির শংসাপত্র গ্রহণ করছেন, ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে আমার ঠিক কেমনটা মনে হয়েছিল বলতে পারি না। আমার তখন ক্লাস নাইন। পিএইচডি কি জিনিস তখনও বুঝি না। শুধু এটুকু বুঝি, এত বয়সে এসেও আমার মা আবার আমার মতো করেই পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। বাবার মতোই আমার মায়ের নামের পাশেও এখন বসবে ডক্টরেট। আমার কাছে নারীর বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস তো আমার মাকে দিয়েই শুরু হয়েছিল ... নয় কি ?
আমার মায়ের কাছেই শুনেছিলাম তাঁর মায়ের গল্প। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার আগেকার চরিত্র। প্রবাসী বাঙালী, এবং ডাকসাইটে ধনী পরিবারে মানুষ। বিয়ের পরে নাকি ছেলেকে (আমার বড়োমামাকে) ইস্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে তবেই নাকি বাধ্য হয়ে বাংলা শিখেছিলেন। কারণ বিয়ের আগে অবধি তাঁর জীবন কেটেছিল দিল্লিতে নয়তো আজমীরে। বাংলার স্বাদ নেবার সুযোগ ছিল না। বাংলার কথা যদি বাদও দিই, আমার দিদিমা ছিলেন অঙ্কের প্রতি আকৃষ্ট। সিনিয়র কেমব্রিজের অঙ্ক পরীক্ষাতে একশোর মধ্যে একশো নম্বর পেয়েছিলেন। স্নাতক পড়বেন বলে ম্যাথেমেটিকস অনার্সে ভর্তিও হয়েছিলেন। বিয়ের পর আর সেই পড়াশোনাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু আত্মীয়পরিজন সকলের মুখেই শুনেছি আমার দিদিমার অঙ্কের গল্প। সিনিয়র কেমব্রিজের পরীক্ষায় একশোর মধ্যে একশো নম্বর পাওয়ার গল্প শুনলেই পেটের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠত। আমার বন্ধুরা অনেকেই সে কৃতিত্বের অধিকারী হলেও, আমার কপালে অঙ্কে একশোয় একশো পাওয়ার স্বপ্ন কখনোই সত্যি হয়নি। সেই নিয়ে যে মৃদু একটা আপসোস নেই ভিতরে ভিতরে — সে কথা বললে মিথ্যে বলা হবে। কাজেই দিদিমার অঙ্কের নম্বর শুনলেই মনের ভিতরটা কেমন জানি প্রজাপতি ওড়বার মতো করেই আজও যেন উদাস হয়ে যায়। পরবর্তীতে আমার এক মামা যখন আইআইটিতে এঞ্জিনিয়রিং পড়ার সুযোগ পেলেন, বাড়ি বয়ে এসে বলেছিলেন আমার দিদিমার কাছে তাঁর অঙ্ক শেখার বৃত্তান্ত। তাঁর কথায়, “ছেকুমাসির জন্যই আইআইটিতে সুযোগ পেয়েছি।” মা থেকে শুরু করে সকলেই আমার দিদিমার অঙ্কের প্রতি দক্ষতাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। আমি সেই অনুপাতে অঙ্ক শিখতে পারিনি। কেবল আজকের দিনে দাঁড়িয়ে হয়তো বা মনে হয় হঠাৎ, বিবাহ-পরবর্তীতে গ্র্যাজুয়েশনটা যদিও বা তিনি শেষ করতে পারতেন, আরেকটুখানি হলেও হয়তো বা অন্যরকম হতে পারত সবকিছুই। আমার কাছে এও তো নারীর বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস। এঁদের কথাও তো আরো একটু বেশি করে লিখতে পারতাম, সে সুযোগ আর এল না।
কাজেই এই ধারাবাহিকের অনুপাতে যত না লেখা হল, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে লেখা বাকি থেকে গেল। বাকি থেকে গেল শতসহস্র মহীয়সীদের না বলা ইতিহাস, তাঁদের না দেখা যুদ্ধ, তাঁদের না জানা সংগ্রাম এবং তাঁদের অপ্রকাশিত বিজ্ঞানচর্চার বৃত্তান্ত। কেবল গবেষণাগারে দাঁড়িয়েই কি বিজ্ঞান? ক্লাসরুমে যে অঙ্কের দিদিমণি আমাদেরকে সেই ছোটবেলায় প্রথম দুইয়ে দুইয়ে চার করে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের হিসেব শিখিয়েছেন, তাঁদের কথা বলব না আমরা ? প্রত্যেকজন মহিলা গবেষক, আজকে যাঁরা দেশবিদেশের গুচ্ছ গুচ্ছ ল্যাবে নিজেদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা-আবিষ্কারে মগ্ন, স্নাতকোত্তর অথবা পিএইচডি থিসিসের প্রয়োজনে —তাঁরা খ্যাতিমান হোন বা না হোন —তাঁদের অধ্যবসায়, তাঁদের মেধার উদ্ভাসকে আমরা কুর্নিশ করব না ? নারীর বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস তো আমাদের চারপাশেই।
... হাজার-দু’হাজার বছরের ইতিহাসে নারী বা পুরুষের কি সত্যিই আর পরস্পর পরস্পরের কাছে নতুন করে কিছু প্রমাণ করতে বাকি আছে ? আজ মনুষ্যত্ব এগোক, কেবল উৎকর্ষের পথ ধরেই। পুরুষ বা নারীর বিজ্ঞান, একদিন মানুষের বিজ্ঞান হয়ে উঠুক। অস্ফূটে বলতে চাইব,
অসত্য থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে আলোয়, মৃত্যু থেকে অমৃতে— ঋষিবাক্যে বর্ণিত যাত্রাপথ ...
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মাধুরী চ্যাটার্জির ছবি সংগৃহীত
1 Comments
Suryadyuti
23 November, 2021
অসাধারণ একটা সিরিজ। সমৃদ্ধ হলাম।
Post Comment