তিন পেরিয়ে আরও চার

  • 02 August, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 543 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মেরি পুটন্যাম জ্যাকোবিই হলেন পৃথিবীর মধ্যে প্রথম সেই মহিলা চিকিৎসক, যিনি কি না প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন। তারও আগে ব্ল্যাকওয়েল বোনেরা এবং লিডিয়া ফোলজার ফাউলার আমেরিকা থেকে প্রথম মহিলা হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জনের নজির গড়েছিলেন। নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক (পর্ব ২২)

১৮৭৫ সালে জনৈক আমেরিকান চিকিৎসক এডোয়ার্ড এইচ. ক্লার্ক ‘সেক্স ইন এডুকেশন - অর, এ ফেয়ার চান্স ফর গার্লস’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটিতে তিনি লিখেছিলেন যেহেতু মেয়েরা ঋতুমতী হয়, বিশেষত সেই কারণেই মেয়েদের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা বা ভারী কাজকর্ম মোটেই নিরাপদ নয়। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী ঋতুমতী মেয়েরা যদি মানসিক বা শারীরিক চাপের শিকার হয় (যার কারণ হিসেবে তিনি উচ্চশিক্ষা অথবা ভারী কাজকর্মকে মনে করেছিলেন), তাহলে অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি তাঁদের গর্ভধারণের ক্ষমতা অবধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সময়টা ১৮৭৫। আমেরিকার স্বাধীনতারও প্রায় একশো বছর অতিক্রান্ত। অথচ সেই সময়েও মেয়েদের সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঠিক এমনটাই ধারণা ছিল। নিন্দুকেরা অবশ্যই বলবেন, তারপরেও তো প্রায় আড়াইশো বছর পেরিয়েছে। কিন্তু মেয়েদের সম্পর্কে পুরুষজাতির সেই ধারণাগুলির মধ্যে কতটুকুই বা রদবদল হতে পেরেছে ? এখনও যে কান পাতলেই শোনা যায় ২০১৬তে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপরীতে যদি ডেমোক্র্যাট পার্টির সদস্যেরা একজন পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে অন্তত দাঁড় করাতেন, তাহলে হয়তো ট্রাম্পসাহেবকে আর শেষ অবধি হোয়াইট হাউজের দরজা পেরুতে হত না। পরিবর্তন বড় সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি। আবার সমাজের ভিতর থেকে সঠিক ভাবে সেই পরিবর্তনের লক্ষ্যে তাগিদটুকুকে না দেখা গেলে পরে – সেই প্রতীক্ষাই আরো দীর্ঘতর হয়ে ওঠে।

এডোয়ার্ড এইচ. ক্লার্ক তাঁর বক্তব্যকে খণ্ডিত হতে দেখেছিলেন। বিতর্কিত সেই বইটি প্রকাশের মাত্র একবছরের মধ্যেই মেরি পুটন্যাম জ্যাকোবি নামে এক মহিলা চিকিৎসক তীক্ষ্ণ একটি ডাক্তারি প্রবন্ধ লিখে এডোয়ার্ড ক্লার্কের দাবিকে নস্যাৎ করেন। এই মেরি পুটন্যাম জ্যাকোবিই হলেন পৃথিবীর মধ্যে প্রথম সেই মহিলা চিকিৎসক, যিনি কি না প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন। ইতিপূর্বে ১৮৬৩ সালে তিনি নিউ ইয়র্ক কলেজ অব ফার্মাসি থেকে স্নাতক হন। আমেরিকার কোনও ফার্মাসি স্কুল থেকে স্নাতক হওয়া ছাত্রদের মধ্যে মহিলা হিসেবে তিনিই প্রথম এই কৃতিত্ব অর্জন করেন। তারও আগে ব্ল্যাকওয়েল বোনেরা এবং লিডিয়া ফোলজার ফাউলার আমেরিকা থেকে প্রথম মহিলা হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জনের নজির গড়েছিলেন। তাঁদের সেই ইতিহাসকেই আজ এই স্বল্প পরিসরে কিছুটা ফিরে দেখতে চাইব।

লিডিয়া ফোলজারের জন্ম ১৮২৩এ, নানটাকেট, ম্যাসাচুসেটসে। ম্যাসাচুসেটসের হুইটন ফিমেল সেমিনারি থেকে স্কুলশিক্ষার পাঠ শেষ করে লিডিয়া সেখানেই শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। স্বামী লোরেঞ্জো নাইলস ফাউলার ছিলেন সেই সময়ের একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ ফ্রেনোলজিস্ট, অর্থাৎ কিনা মানবকরোটি-বিশারদ। ডাক্তারিশাস্ত্রের আওতায় এই বিষয়টি সে সময়ে কতখানি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে স্বীকৃত ছিল জানা নেই, তবে এই লোরেঞ্জো নাইলস ফাউলার এবং তাঁর ভাই অরসন স্কোয়্যার ফাউলারের কাছে করোটি পরীক্ষা করাতে চার্লস ডিকেন্স, এডগার এ্যালান পো থেকে শুরু করে ব্যারন রথসচাইল্ড এমনকি স্যার হেনরি আরভিংয়ের মতো মানুষেরাও ‘মাথা নুইয়েছিলেন’। স্বামীর উৎসাহে ইস্কুলে পড়াতে পড়াতেই লিডিয়া ফোলজার ফাউলার দুটি বই লিখে ফেলেন। বইদুটির নাম যথাক্রমে, ‘ফ্যামিলিয়ার লেসনস অন ফিজিওলজি’ এবং ‘ফ্যামিলিয়ার লেসনস অন ফ্রেনোলজি’। বইদুটি বন্ধু ও পরিচিতমহলে সমাদর লাভ করে। যদিও পরবর্তী কালে ফ্রেনোলজিকে মোটেও পুরোপুরি ভাবে বিজ্ঞানের আওতায় ফেলা যায়নি – তবু এই ফ্রেনোলজি ও স্বামীর নানাবিধ কাজকর্মের অনুপ্রেরণাতেই মানবশরীর ও চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে লিডিয়ার মনে আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। অবশেষে ১৮৫০ সালে লিডিয়া ফোলজার ফাউলার নিউ ইয়র্কের সিরাকুসে সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজে ছাত্রী হিসেবে ভর্তির ছাড়পত্র লাভ করেন। আরও আটজন মহিলা (যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম অবশ্যই মায়রা কিং মেরিক এবং সারা এ্যাডামসন ডলি) – তাঁদের সঙ্গে একত্রে মিলে, লিডিয়ারাই প্রথম আমেরিকাতে এই কোএড মেডিকেল কলেজের ছাত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

সিরাকুসের সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ থেকে ১৮৫২ সালে এমডি পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন লিডিয়া। পরে তিনি এই একই কলেজে অধ্যাপিকা হিসেবে কিছুদিন পড়ালেও, কলেজটি তার পরের বছরই কোনও অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৮৫২ সাল থেকে ১৮৬০ সাল অবধি তিনি নিউ ইয়র্কেই চিকিৎসক হিসেবে প্র্যাকটিস করেন। ১৮৬০ সালে তিনি রচেস্টার একলেক্টিক মেডিকেল কলেজের অধ্যাপিকা হিসেবে নিযুক্ত হন। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি শল্যচিকিৎসাতেও সমান দক্ষ ছিলেন। এর আগে ১৮৪৯ সালে এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল, জেনেভা মেডিকেল কলেজ (বর্তমানে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক আপস্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি) থেকে এমডি ডিগ্রিতে সম্মানিত হলেও – মনে রাখতে হবে যে তিনি ছিলেন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মহিলা চিকিৎসক হলেও, লিডিয়া ফোলজার ফাউলারই ছিলেন প্রথম স্বীকৃত ভূমিকন্যা যিনি আমেরিকাতে এম. ডি. ডিগ্রিতে উত্তীর্ণ হন। এছাড়াও যে কোনও পেশাদার আমেরিকান মেডিকেল কলেজের নিরিখে তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা অধ্যাপক। পেশার পাশাপাশি নিজের সাফল্যকে তুলে ধরে সমাজের মহিলাদেরকে উৎসাহিত করতে লিডিয়া ফোলজার ফাউলার বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠনেরও অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। মেয়েদের ভোটাধিকারের দাবিতে তিনি একাধিক সংগঠনের তরফে সরব হন। পরবর্তীতে ফাউলার পরিবার লন্ডনে প্রবাসী হলেও, তিনি ব্রিটিশভূমিতে নারীবাদ এবং নারীমুক্তির পক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ১৮৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি প্রয়াত হন। লন্ডনের হাইগেট সমাধিস্থলে লিডিয়া ফোলজার ফাউলারকে সমাধিস্থ করা হয়। কেবল চিকিৎসাশাস্ত্রই নয়, অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তিনি কবিতা এবং উপন্যাস রচনাতেও নিজের কৃতিত্ব রেখেছেন। এমন একেকজন মানুষকে দিয়েই বোধহয় যুগ পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

যদিও, রক্ষণশীলতার বেড়া ভাঙাটা সবসময়ই কঠিন। যার উদাহরণ আমরা দেখবো ব্ল্যাকওয়েল বোনেদের ক্ষেত্রে। ব্রিটিশ রক্ষণশীলতাকে ভেঙে বেরুবার প্রভূত চেষ্টা করলেও, প্রথম পদক্ষেপেই তাঁরা হয়তো ততখানিও সাহসী হয়ে উঠতে পারেননি। তবুও, এখানে তাঁদের অবদানকেও আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত। এলিজাবেথ এবং এমিলি ব্ল্যাকওয়েলের জন্ম যথাক্রমে ১৮২১ এবং ১৮২৬এ। তাঁদের অভিভাবকেরা প্রচলিত ব্রিটিশ রক্ষণশীলতার বিপরীতে এলিজাবেথ, এমিলি এবং অন্যান্য কন্যাসন্তানেদের জন্যও পর্যাপ্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৮৩২ সালে ব্ল্যাকওয়েল পরিবার আমেরিকা পাড়ি দেয় এবং ১৮৩৭ সাল থেকে তারা পাকাপাকি ভাবে ওহাইও’র সিনসিনাটিতে বসবাস করতে শুরু করে। সেই সময়ে জেনেভা মেডিকেল কলেজে এলিজাবেথ পড়বার সুযোগ পেলেও, এমিলি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। আসলে সেদেশের সমস্ত কলেজেই মেয়েদেরকে চিকিৎসাশাস্ত্রের মতো একটি বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ দিতে গিয়ে, কলেজ কর্তৃপক্ষেরা চিরকালীন সামাজিক প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে (এবং নিজেদের পুরুষসুলভ অহংকারকে অক্ষুণ্ণ রাখতে) দোটানায় ভুগছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৮৪৯ সালে জেনেভা মেডিকেল কলেজ থেকে এলিজাবেথ এবং ১৮৫৪ সালে ক্লিভল্যান্ড মেডিকেল কলেজ, ওহাইও থেকে এমিলি এম. ডি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অন্তিম পরীক্ষার প্রয়োজনে এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের লেখা টাইফুসের উপরে একটি গবেষণাপত্র সেই সময়কার ‘বাফেলো মেডিকেল জার্নাল’এ প্রকাশিত হয়। ব্ল্যাকওয়েল বোনেরা দুজনে মিলে এর পরবর্তীতে নিউ ইয়র্ক ইনফার্মারি ফর উইমেন এ্যান্ড চিলড্রেনের প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, এগজিকিউটিভ কমিটি থেকে শুরু করে চিকিৎসকেরা প্রত্যেকেই ছিলেন মহিলা। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকওয়েল বোনেরা এমন যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত নেবার কথা ভাবতে পেরেছিলেন।

এরপর, ১৮৬১ সালে আমেরিকাতে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে পরে সেই যুদ্ধেও ব্ল্যাকওয়েল বোনেরা চিকিৎসক হিসেবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। এইসময় এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল একাধিক বারে ইংল্যান্ডে যান এবং সেখানেও নিউ ইয়র্কে তাঁদের হাসপাতালের আদলে কোনও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় কি না সে ব্যাপারে খোঁজখবর করতে শুরু করেন। ১৮৬৬ সালের হিসেব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, সেই বছর অবধি নিউ ইয়র্কে ব্ল্যাকওয়েল বোনেদের হাসপাতালে বছরে প্রায় ৭০০০ রোগীর চিকিৎসা করা হত। দুর্ভাগ্যবশত এই সময়েই ব্ল্যাকওয়েল বোনেদের মধ্যে নানা ব্যাপারে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়, যার ফলস্বরূপ শেষ অবধি এলিজাবেথ পাকাপাকি ভাবে আমেরিকা ছেড়ে আবারও ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ইংল্যান্ডে এসেও তিনি সোফিয়া জেক্স-ব্লেকের সঙ্গে যৌথ ভাবে লন্ডন শহরে লন্ডন স্কুল অব মেডিসিন ফর উইমেনের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোফিয়া ব্লেক ইতিপূর্বে নিউ ইয়র্কে ব্ল্যাকওয়েল বোনেদের হাসপাতালে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেছিলেন। যদিও সোফিয়ার সম্পর্কে এলিজাবেথের তেমন একটা উচ্চাশা ছিল না, তবু তাঁরই সঙ্গে তিনি লন্ডনে তাঁর কাজ শুরু করেন। এই সময়েই এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের কিছু কিছু রক্ষণশীলতার বিষয় প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। তিনি ল্যাবরেটরিতে গবেষণার প্রয়োজনে প্রাণী ব্যবচ্ছেদের বিরোধিতা করেন। এমনকি গর্ভনিরোধক ওষুধের বিষয়েও তাঁর রক্ষণশীলতার মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টীকাকরণের বিষয়েও তিনি স্পষ্ট করে মতামত জানাতে ব্যর্থ হন। যৌবনে বিশেষ একটি চোখের ওষুধকে নিয়ে গবেষণার সময়, একটি বিষাক্ত দ্রবণ এলিজাবেথের চোখে গিয়ে পড়েছিল। এরফলে তিনি সম্পূর্ণভাবে বাঁ চোখের দৃষ্টি হারান। যার কারণে আর কোনোদিনই তাঁর শল্যচিকিৎসক হয়ে ওঠা হয়নি। এই সময় ইংল্যান্ডে থাকাকালীন এলিজাবেথের সঙ্গে চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োগ নিয়ে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলেরও মতবিরোধ ঘটে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের রক্ষণশীলতা ও মাত্রাতিরিক্ত ধর্মাসক্তি প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এলিজাবেথ বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে চিকিৎসাশাস্ত্র কেবল সমাজের ‘নৈতিক’ শুদ্ধিকরণের একটি হাতিয়ার মাত্র। এমনকি তিনি এই মনোভাবও পোষণ করেন যে, নারীর ‘লালিত্যময় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি’র জন্যই কেবল সে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের অধিকারী। এই মতেরই কড়া বিরোধিতা করেন এক কালে নিউ ইয়র্কে এলিজাবেথেরই ছাত্রী মেরি পুটন্যাম জ্যাকোবি। তিনি সরাসরি জানান নারীজাতি তাঁর মেধা, উৎকর্ষ এবং সক্ষমতার জোরেই পুরুষদের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র প্রয়োগের ক্ষমতা রাখে। এর সঙ্গে লালিত্য বা মানবিকতার কোনও সম্পর্ক নেই। এমিলি ব্ল্যাকওয়েল শেষ জীবন অবধি আমেরিকাতেই কাটান, এবং মেইন শহরে ১৯১০ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এলিজাবেথ লন্ডনে থাকতে থাকতেই শেষ জীবনে নিজের একটি আত্মজীবনী লিখতে চেষ্টা করেন, যদিও তা পাঠকমহলে সমাদৃত হয়নি। পরে বোন এমিলির সঙ্গে একই বছরে কয়েক মাসের ব্যবধানে তিনি স্কটল্যান্ডে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

যে কয়েকজনের নাম এই আলোচনায় উঠে এল তার মধ্যে নিঃসন্দেহে যে নামটি বিজ্ঞানসাধিকা হিসেবে ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ করেছে – সেই নামটি মেরি পুটন্যাম জ্যাকোবি’র। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, কর্মপদ্ধতি, কাজের ক্ষেত্র সবকিছুকে ছাপিয়েও তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি একনিষ্ঠতা তিনি তাঁর সমগ্র অস্তিত্বের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। লন্ডনে জন্ম, নিউ ইয়র্কে শিক্ষা, এমনকি এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের অধীনে চিকিৎসাশাস্ত্রে হাতেখড়ি – সবশেষে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মহিলা হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ, মেরি পুটন্যাম জ্যাকোবি’র জীবৎকাল ১৮৪২ থেকে ১৯০৬ সাল অবধি। তারই মধ্যে তাঁর মেধার দীপ্তি, দৃপ্ত আত্মবিশ্বাস এবং পুরুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস সমগ্র নারীজাতিকেই অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৮৭৬ সালে তাঁর প্রবন্ধ ‘দ্য কোয়েশ্চেন অব রেস্ট ফর উইমেন ডিউরিং মেনস্ট্রুয়েশন’ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বয়েলস্টন পুরষ্কারে ভূষিত হয়। ১৮৭৫ সালে ডাক্তার এডোয়ার্ড এইচ. ক্লার্কের প্রকাশিত বক্তব্য, ঋতুমতী হয় বলেই মেয়েদের শারীরিক বা মানসিক চাপ নেওয়া (সেই কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ বা ভারী কাজকর্ম) অনুচিত – এই উদ্ভট দাবিকে জ্যাকোবি’র প্রবন্ধ সরাসরি যুক্তির মাধ্যমে খণ্ডন করে। সমগ্র কর্মজীবনে মেরি পুটন্যাম জ্যাকোবি ১২০টিরও বেশী গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত আরও ৯টি বইয়েরও রচয়িতা ছিলেন। বিজ্ঞান এবং যুক্তি ভিন্ন তাঁর জীবনে আর কোনোকিছুকেই তিনি সত্য বলে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে কেবল মেধা এবং উৎকর্ষের জোরেই নারীজাতি সম্পূর্ণ ভাবে পুরুষদের সমকক্ষ হিসেবে কাজ করবে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও তিনি বিজ্ঞানের প্রতি এবং গবেষণার প্রতি যে লৌহ-মানসিকতার উদাহরণ রেখেছিলেন তার কথা বলেই আজ শেষ করতে চাইব।

শেষ জীবনে দুরারোগ্য ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হলে পরেও বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতা থেকে তিনি সেই রোগের সমস্ত বিবরণ, লক্ষণ প্রভৃতিকে লিখে রাখতে শুরু করেন। এমনকি এই বিষয়েই তিনি তাঁর জীবনের শেষ গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন যার শিরোনাম ছিল, ‘ডেসক্রিপশনস অব দ্য আর্লি সিম্পটমস অব দ্য মেনিনজিয়াল টিউমার কমপ্রেসিং দ্য সেরেবেলাম’। প্রবন্ধটি প্রকাশের সময় এই শিরোনামের সঙ্গে এই কথাটিও জুড়ে দেওয়া হয়, ‘ফ্রম হুইচ দ্য রাইটার ডায়েড, রিটেন বাই হারসেলফ’। এর চেয়ে বড় কৃতিত্ব বোধহয় একজন চিকিৎসকের জীবনে আর কিছুই নয়। ১৯০৬ সালে মেরি জ্যাকোবি’র জীবনাবসান হয়। জীবনের শেষ গবেষণা প্রবন্ধটিকে লিখতে লিখতেও তিনি নিজের নশ্বর জীবনকে বিজ্ঞানের বেদীমূলে উৎসর্গ করে গেছেন। প্রমাণ করেছেন কবির উক্তিকেই। দৃপ্তকন্ঠে হয়তো বা তিনিও তাঁর মাতৃভাষাতেই মনে মনে উচ্চারণ করেছিলেন, “যত বড় হও, তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড় নও ...” মানুষ মৃত্যুর চেয়ে বড়।

মানুষের মেধাই পারে মৃত্যুকে মিথ্যে প্রমাণিত করে উৎকর্ষের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে। লিডিয়া ফাউলারের কৃতিত্ব, ব্ল্যাকওয়েল বোনেদের প্রথম পদক্ষেপ এবং সবশেষে অনন্তের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মেরি জ্যাকোবি’র জীবনের মাধ্যমেই যে শ্রেষ্ঠত্বের চিরকালীন উদযাপন।

সূত্রঃ

[১] মারিয়ন সয়েরব্যেয়র, ‘লিডিয়া ফোলজার ফাউলার’, ক্রুকেড লেক রিভিউ, অক্টোবর, ১৯৮৮

[২] ‘নোটেড ফ্রেনোলজিস্ট ডেডঃ লোরেঞ্জো এন. ফাউলার সাকাম্বস টু এ প্যারালাইজিং স্ট্রোক’, অবিচুয়ারি, নিউ ইয়র্ক টাইমস, সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬

[৩] লিলিয়ান ফেডারম্যান, ‘টু বিলিভ ইন উইমেন’, মেরিনার বুকস, ২০০০

[৪] ‘ডক্টর এমিলি ব্ল্যাকওয়েল ডেড’, নিউ ইয়র্ক টাইমস, সেপ্টেম্বর, ১৯১০

[৫] স্যামুয়েল সেনস, ‘এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলঃ হার ফার্স্ট মেডিকেল পাবলিকেশন’, ব্যুলেটিন অব দ্য হিস্ট্রি অব মেডিসিন, খণ্ড ১৬, নম্বর ১, ১৯৪৪

[৬] ন্যান্সি এ্যান সাহলি, ‘এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল, এমডি, (১৮৭১-১৯১০) – এ বায়োগ্রাফি’, নিউ ইয়র্ক, আর্নো প্রেস, ১৯৮২

[৭] এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল, ‘পায়োনিয়র ওয়ার্ক ইন ওপেনিং দ্য মেডিকেল প্রফেশন টু উইমেনঃ অটোবায়োগ্রাফিক্যাল স্কেচেস’, লংম্যান গ্রিনস, ১৮৯৫

[৮] মেরি পুটন্যাম জ্যাকোবি পেপার্স, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি

[৯] র‍্যাচেল স্যবি, ‘হেডস্ট্রং – ৫২ উইমেন হু চেঞ্জড সায়ান্স এ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’, ব্রডওয়ে বুকস, ২০১৫

লেখক: প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষক, প্রাবন্ধিক

ছবি: (বাঁ দিকে) মেরি পুটন্যাম জ্যাকোবি, (মধ্যে) লিডিয়া ফোলজার ফাউলার, (ডান দিকে) এমিলি ব্ল্যাকওয়েল। সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment