- 24 April, 2022
- 1 Comment(s)
- 403 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
[৩১]
সুমনদা, তোমার অস্তিত্বই রইল দেহে, এখন আমি নিঃস্ব : চৈতি
মনের ক্রেজি ভাব মিইয়ে আসতে আসতে একেবারেই লীন হয়ে আসে যখন ঢাকায় ল্যান্ড করেছে শ্যামল। তিনটা বছর তো নেহায়েত কম সময় না। এরি মধ্যে ঢাকার বেশ কিছু পরিবর্তন চোখে পড়েছে শ্যামলের। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ চালাচ্ছে। টানা দুই বছর নাকি মোটে দশজন আমলাগোছের মানুষ ১৬কোটি মানুষকে শাসাবে। রাজনীতিবিদদের চোখ বুঝি বা এখন টাটাচ্ছে। পথে ঘাটে পুলিশের লাঠি-গুলি খেয়ে, ছাত্রজীবন হতে আঙুল টিপে টিপে, কত সাধ্যি-সাধনা করে জনগণের মন জুগিয়ে তবে গিয়ে বসতে হয় মন্ত্রীর চেয়ারে। আর এরা একজন একাই দশটা পাঁচটা করে মন্ত্রণালয়ের শেঠ। আগে দেশের মাটিতে পা ফেললেই গা ছমছম করত। এবার শ্যামল স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ছেঁচড়া পকেটমার থেকে শুরু করে বড় বড় টপ চোর এখন ঘাপটি মেরে আছে। অনেকেই শ্রীঘরে। কবে কবে ধরা হল, কে কত কোটি টাকা কোন ব্যাংকে, বালিশের চিপায়, বিদেশে পাচার করেছে সব এখন বমি করে বের করছে। শ্যামল কানাডা বসেই এসব খবর পেয়ে থাকে। এয়ারপোর্ট হতে বের হয়ে সোজা কল্যাণপুর এসে কুষ্টিয়ার কোচের টিকেট নিল।
শ্যামলের পাশের সিটে আছেন মধ্য বয়সী এক ভদ্রলোক। পত্রিকায় মুখগুঁজে এমন ভাবে পড়ছে। কালো কালো হরফগুলো যেন লোভনীয় খাদ্য! একটা বিশেষ খবরের প্রতি তার গভীর মনোযোগ। আদি কালের পুঁথি পাঠের স্টাইলে সুর করে করে পড়ছেন। খবরটা শ্যামল কানাডা থেকে শুনে এসেছে। এ তো পুরনো খবর। ভদ্রলোক নিউজটা এত বুঁদ হয়ে কেন পড়ছেন? হাসছেন-ই বা কেন!
ভাই সাহেব কুষ্টিয়া যাবেন? উপযাচক হয়েই আলাপ জমাতে জিজ্ঞেস করে শ্যামল।
জ্বি। পত্রিকায় মুখগুঁজেই উত্তর দিলেন ভদ্রলোক।
কী লেখা নিউজে? আপনি হাসছেন এমন করে?
ভদ্রলোক মুখ তুলে চনমনে হাসি দিয়ে বলে, হাসবো না! এই দেখেন, এখন কত মিল দুই নেত্রীর! পাশাপাশি ঘরে থাকেন! একই হাঁড়ির ভাত খান উনারা! সংবাদের হেড লাইনটা দেখেন।
শ্যামল হেসে ওঠে, ওহ্! এ কথা। এই বিষয়ে আর কথা বলতে আগ্রহ বোধ করল না শ্যামল। ধনুকভাঙা পণ করে বসে আছে! প্রয়োজনে কথা না বলতে বলতেই মরে যাবে! তবু কেউ কারোর দিকে সাহায্যের হাত বাড়াবে না! দেশের ১৬ কোটি মানুষ হা-ডু-ডু খেলার মতো দুই ভাগে বিভক্ত এখন। তালগাছকে যদি দলের নেতা আমগাছ বলে, তার শিষ্যরা সকলেই সমস্বরে চিল্লিয়ে মিছিল করে, এমনকি রক্তারক্তি ঘটিয়ে ঠিকই প্রমাণ করে ছাড়ে যে, ওটা আমগাছ-ই, তালগাছ নয়। কেউ কারও কথা শুনবে না, কেউ কারও দিকে তাকাবে না, কেউ কারও ভালো দেখবে না, সম্মান দেবে না—এসব যেন বাজেট করার মতো বছরের প্রথম দিনেই ঠিক করে ফেলে এদেশের রাজনীতিবিদরা। স্বাধীনতা, জাতীয়তা নিয়েও কী সব বিশ্রী কথা বলে! ক্ষমতায় থাকলে হুঁশজ্ঞান থাকে না। ছিটকে পড়লে রাধাবিলাপ জুড়ে দেয়। চেঁচিয়ে একশেষ করে দেশ গেল দেশ গেল বলে। হাজার টাকার নোট ভাঙিয়ে খুচরো করার মতো স্বাধীনতাকে খুচরো করে যারা ক্ষমতা পেয়েছে তারাই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। অথচ কী ভয়ানক পরিহাসের বিষয়! মুক্তিযোদ্ধাদের হাঁড়ি চুলায় উঠল কি উঠল না—এ খবর কেউ নেয় না। এদিকে রাজাকারের গাড়িতে লালসবুজ পতাকা পত্পত্ করে ওড়ে। কাজেই এসব বাজে কথা খরচ করার কী দরকার? ভদ্রলোক কিছু বলবে বলবে ভাব করেন। কিন্তু শ্যামল মুখ ফিরিয়ে নিল।
প্রায় তিনবছর পর শ্যামল দেশে ফিরছে। সিডিউলের বাইরে ফেরা এবার। হুট করে আসা। বউটাকে একনজর দেখবার জন্যে, নাড়তে চাড়তে গা গতর চনমন করে উঠলে হঠাৎ এই ডিসিশন। অনেক গচ্ছা দিতে হচ্ছে এর জন্যে। ছেলেটা তিন বছরে বেশ বড় হয়েছে। ছবি দেখে কথা শুনে মন ভরছে না।
বিয়ের পর শ্যামলের এই নিয়ে তৃতীয়বার দেশে আসা। কানাডার গ্রিন কার্ড পেয়ে যাবে হয়ত বড়জোর দু’বছরের মধ্যে। কিন্তু পেয়ে কী লাভ? শ্যামল জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কানাডা যেতে মারাত্মক অনীহা চৈতির। ক’পয়সার একটা চাকরি। তার জন্যে কী মায়া! কানাডা যাওয়ার জন্যে দেশের চোখ ধাঁধানো সুন্দরীরা কানা-খোঁড়ার গলায় পর্যন্ত ঝুলছে বাঁদুর ঝোলা হয়ে। নইলে চোখ টেরা মামুনের এমন বউ!
মামুনের বাড়ি মাদারীপুরে। একটা দোকান করেছে কানাডায়। শ্যামলের সাথে একই রুমে থাকত। বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই। আধা-পাকা হাতেগোনা চুল মাথায়। তাও আবার মাথার অর্ধেকটাই নির্ভেজাল টাক। লম্বায় টেনেটুনে খুবজোর পাঁচ ফুট। এক চোখ টেরা। অবশ্য, শ্যামলের ঘোরতর সন্দেহ—মামুন জন্মটেরা নয়, ইচ্ছে করে শয়তানি করে চোখ টেরা করে রাখে।
গত মাসে দেশ থেকে বিয়ে করে বউ নিয়ে গেছে মামুন। বউ দেখে শ্যামলের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। সদ্যফোটা গোলাপের মতো শুভ্র সতেজ একটা মেয়ে। পুরো হিন্দি ছবির নায়িকাদের মতো দেহের একহারা গড়ন। লালফর্সার মিশেল রঙ শরীরের। উচ্চতায় মামুনকে ছাড়িয়ে শ্যামলের মাথা ছুঁই ছুঁই। বয়স একুশ কি বাইশ হবে। অনার্স পড়ত। মেয়েটার রসালো গাল, খাড়া নাক, লোভনীয় চিবুক, স্টাইল করা চুল, টানা হাত সবই শ্যামলকে টানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। মেয়েটির এমন রূপ ঐশ্বর্য চোখ টেরা মামুনের মতো আধা-বুড়ো খাবলে খাবে! শ্যামলের মন বিষাদে ভরে ওঠে। একেই বলে পাকা আম দাঁড় কাকে খায়। হাসতে হাসতে বলেছিল শ্যামল, শালার মালটা ভাই! কী করে বাগালেন গো মামুন ভাই?
মালের আর কি দেখলেন শ্যামলদা। দেশে না যেতেই লম্বা লাইন ধরে খাতায় নাম লিখিয়ে রেখেছিল সুন্দরীদের গার্ডিয়ানরা। কিছু সুন্দরী কমিনিকেট করেছে নিজেরাই। যদি ধর্মে বারণ না থাকত, বুঝলেন শ্যামলদা, দেশের সব সুন্দরী আমি একাই বউ করে আনতে পারতাম। কানাডা যে কী মওকা ওদের কাছে ভাবলেই তাজ্জব!
লোভে চকচক করে উঠেছিল শ্যামলের চোখ। রসালো জিভ নাড়তে নাড়তে বলেছিল, কিভাবে বাছাই করলেন?
সে এক তুঘলকি কাণ্ড। আমার মা’র পছন্দ এটা। ওর বাবা গত নির্বাচনে এমপি প্রার্থী ছিলেন। আমার চয়েস অবশ্য ছিল অন্যটা। মেয়েটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ে। কিন্তু মেয়েটার বাবা কলেজের মাস্টার। মা কিছুতেই মাথা পাতলেন না। একটা দুঃখ রয়ে গেল দাদা...
শ্যামল হেসে ওঠে, দুঃখ তো থাকবেই। এতগুলো ঠাসা মাল থেকে পেলেন মাত্র একটা।
মামুন বিষণ্ন মুখ করে বলে, তা তো দুঃখই বটে। তবে সবচেয়ে বড় দুঃখটা অন্য জায়গায়। আমার বড় ভাই। ফারুক ভাই। মেডিকেলে চান্স পেয়েছিল কিন্তু পড়েনি। পড়েছে মৈমনসিংহ এগ্রো ইউনিভার্সিটিতে। ফিশারিজে। বর্তমানে চাকরি করে একটা ফরেইন প্রজেক্টে। পোস্টিং নড়াইলে। ভাইয়াকে বিয়ে দিতে তিন বছর ধরে পাত্রী খুঁজছি, কিন্তু একটাও মানানসই মেয়ে পাওয়া গেল না। অথচ দেখেন কি নিয়তি! থার্ডক্লাস পাওয়া সিম্পল বি এ পাস ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে সিনেমার টিকেট কাটার মতো লাইনে দাড়াতেও বাঁধে না সুন্দরীদের। তাদের দাম্ভিক বাবাদের। এম পি মন্ত্রী কী ছাড়! সবচেয়ে মজার ব্যাপার, তারা কেউ জানতেও চাইল না কানাডায় আমি কী করি? বামে ঘাড় ঘুরিয়ে থুতু ফেলে মামুন। মামুনের থুতু কিছুটা দূরে বসে থাকা বাঙালি তন্বীর চোখে মুখে পেটে ঢুকে পড়ছে। সেই থুতু নিয়েই এই তন্বী গর্ভে ধারণ করবে বাংলা-কানাডা মিশ্রিত হাইব্রিড শিশু।
পাশের মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের মৃদু ধাক্কায় শ্যামলের দিবাস্বপ্ন টুটে যায়। ঠিক চৈতিকে না। চৈতির দু’টাকা দামের চাকরির মোহকে এবং দেশে থাকার নিচু মনটাকে উদ্দেশ্য করে চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে থুতু ছিটায় শ্যামল।
গাড়ি যমুনা ব্রিজে উঠতেই কানাডা কানাডা গন্ধ পেল শ্যামল। বেশ পরিপাটি কেতাদুস্তর ঝকমকে দীর্ঘ সেতু। পাশে রেল লাইন। দেশটা কিছুটা আধুনিক হচ্ছে মনে হয়। তাতে কি হবে? অন্যেরা যখন হাঁটছে ত্বড়িতবেগে বাঙালিরা তখন মাজা ভাঙার মতো হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
শ্যামলের গাড়ি যখন কুষ্টিয়ায় পৌঁছায় তখন প্রায় সন্ধ্যা। রাস্তার লাইটগুলো জ্বলে উঠছে এক এক করে। অসুস্থ চৈতি। এয়ারপোর্টে যেতে পারেনি। তাই বলে থানাপাড়া থেকে এটুকুও আসতে পারেনি! কেন আসেনি? কোন সমীকরণ মিলছে না।
রিক্সা একটানে বাসার গেটে এসে দাঁড়ায়। লাগেজপত্র বলতে একটি বড় স্যুটকেস। আর একটি সাইড ব্যাগ। হুট করে ভাবা এবং আসা তো।
কলিং বেল টেপে শ্যামল। সাড়া না পেয়ে ফের টেপে। সাথে দরজাও খটখটায়। জনমানবের সাড়াশব্দ পাচ্ছে না। এবার চৈতির মোবাইলে কল ঢোকায়। ভেতরে রিং বাজছে। ফের দরজা খটখটায়। সাড়া পাচ্ছে না। মুহূর্তেই শ্যামলের ভেতরের সব দ্বিধা অভিমান ক্রোধে রূপ নিল। চেঁচিয়ে ওঠে, সব মরেছে নাকি!
শায়িতা চৈতির নিথর শরীর মুহূর্তেই বল প্রাপ্ত হয়ে দাবড়িয়ে ওঠে। বেদম কাঁপছে শরীর। কাঁপতে কাঁপতে খট করে দরজা খুলেই লুটিয়ে পড়ে। শ্যামল ব্যাগ ছুঁড়ে কোলমাজা করে তুলে শোয়ালো বিছানায়।
ছেলে দু’হাতে শক্ত করে রিমোট ধরে নীরবে তাকিয়ে আছে টিভির স্ক্রিনে। একটা খাবার নিয়ে টম এন্ড জেরির হরদম কাড়াকাড়ি দেখছে। শ্যামলের আগমন যেন ওর কাছে উপদ্রবই মনে হল। আব্বু বলে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতেই ঢেকুর তুলে কাঁদতে শুরু করে। শ্যামল ছেলের চোখ মুছে দিল রুমাল দিয়ে। চকলেট, কেক, জামা, খেলনা, কানাডার প্রাকৃতিক দৃশ্য, পশু-পাখির একটা বড় বাঁধাই করা বই সব পাগলের মতো একটা একটা করে ছেলের সামনে ধরে ধরে দেখায়। অন্য কিছুর দিকে ওর নজর নেই। গোগ্রাসে খেতে লাগল কেক, চকলেট।
ছেলেকে শান্ত করে শায়িত বিধ্বস্ত বউয়ের দিকে নিবিড়ভাবে তাকায় শ্যামল। ভেতরের রগরগে অনুভূতিগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে ছিড়েখুঁড়ে একাকার। একটা টনটনে ক্ষুধা নিয়ে এসে এ কী দেখছি! অপার সুযোগ কানাডায়। কিলবিল করে যুবতী। বিছানায় আসতে ওদের কী কাকুতি-আকুতি! রমণে তারা কি খুশি! অথচ দাঁতে দাঁত কূটে শ্যামল নিজেকে সংবরণ করে মন্ত্রের পবিত্রতা রক্ষার্থে, চৈতির সরল মুখটা চোখে ভাসিয়ে, মিলন মুহূর্তগুলোর জ্যান্ত পরশগুলো নেড়েচেড়ে।
চৈতি নিজের সমস্ত শরীর কাফনঢাকা লাশের মতো মুড়িয়ে ফেলেছে বিছানার চাদরে। ফোঁটা ফোঁটা টলমলে অশ্রু গড়াচ্ছে বালিশে। শ্যামল হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেই ভয়ানক শব্দে খাট কাঁপিয়ে কুঁকিয়ে ওঠে।
শ্যামল ক্রোধে ফেটে পড়ে, এসব কী! এ কোন নাটক! কী হয়েছে তোমার?
ছেলে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। একবার দেয়ালের ছবির দিকে, একবার বাবার দিকে, আর একবার মায়ের দিকে তাকায় বোবা চোখে। কেমন যেন বিস্ময় খেলা করে যাচ্ছে ওর মনে। বাবার কোল ঘেঁষে দাঁড়ায়।
ছেলের হাত ধরে নীরবে সরে আসে শ্যামল। সোফায় সাট হয়ে শুয়ে পড়ে। সব কিছু যেন চরম বিষাদ বিষাদ ঠেকছে। কোথায় দাঁড়াই আমি? কে আছে আমার এই দেশে? এসব প্রশ্ন আর্তনাদ হয়ে শ্যামলের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে।
শেকড় ছেঁড়া মানুষ শ্যামল। মায়ের মৃত্যুর সময় শ্যামল নিজের ছেলের বয়সী। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পরে এক অবাঞ্চিত জীবন কাটে। বাবার দ্বিতীয় বউ ছিল টগবগে এক যুবতী। ঘটনাক্রমে যুবতী সন্তান ধারণে অক্ষম ছিল। কার্যত, কিছুদিনের মধ্যেই বাবার মতি ফেরে ছেলের দিকে। কিন্তু যুবতী ছিল চরম উগ্র প্রকৃতির, লোভী এবং আত্মাভিমানী। শেষপর্যন্ত বাবাকে বাঁচতেই দিল না। চোখের সামনে তিলে তিলে বাবাকে মরতে দেখেছে শ্যামল। তখন সে নবম শ্রেণিতে পড়ে। যুবতী তিনবার ফাঁদ পাতে শ্যামলকে মারতে, কিন্তু ভাগ্যের জোরে প্রতিবারই বেঁচে যায়।
এক ঝলক গ্রামের কথা ভাবে শ্যামল। ফিরে গেলে কেমন হয়? পরক্ষণেই মতি ফিরিয়ে নেয়। বাবার সব সম্পতি এখন শ্যামলের বে-হাত। ঐ মহিলার ভাইদের দখলে। শ্যামল সে সম্পতির আশা আর করে না। মামলা মোকদ্দমা করার রুচিও নেই। এদেশে একবিঘা জমি উদ্ধারের মামলা করলে বিশ বিঘা জমি ঢুকে পড়ে উকিল-দালালদের পেটে। তবু সে জমি অধরা-ই থাকে। জীবন ক্ষয় হয় কোর্টের বারান্দায়। একদিন এ প্রসঙ্গে কথা উঠলে মামুন বলেছিল, একাধারে আট বছর মামলা চালিয়ে নাকি ওদের দশ কাঠার একটি জমি উদ্ধার করতে পারেনি ।
সে হিসাব দিয়েছিল, লাখ পাঁচেক টাকা গচ্ছা গেছে মামলার পেছনে। জমির দাম বড়জোর হাজার পঞ্চাশ হবে। শালার উকিলরা এমন ছেঁচড় আর ধান্ধাবাজ! আট আনা পয়সা পর্যন্ত থাপায়াথুপায়া কেড়ে নেয় মক্কেলের হাত থেকে। উকিলরা কেমন হারামি আর বে-রহমের হতে পারে মামুন-ই একদিন বলেছিল।
এক আশীতিপর বৃদ্ধা আবেগের বশে নিজের যক্ষ্মের ধন বাড়িটা লিখে দিয়েছিল একমাত্র ছেলেকে। এখন ছেলে আর ছেলের বউ ভাত দেয় না। বরং বাড়ির বাইরে একটা বাঁশঝাড়ে ডেরা বেঁধে থাকতে দিয়েছে। এখন মামলা করেছে ছেলের বিরুদ্ধে। বৃদ্ধা বাড়ি ফেরত চায়। জীবনের আর কত প্রহরই বা বাকি! তবু আত্মজের বিরুদ্ধে মামলা! বেঁচে থাকার ধর্ম বড় কঠিন ধর্ম।
বৈশাখ মাস তখন। বৃদ্ধা বেদম হাঁপাচ্ছে কোর্টের বুড়ো বটগাছ তলে বসে। অমনি কালো গাউন পরিহিত কয়লাপোড়া কালচে বিদঘুটে এক উকিল এসেই বৃদ্ধার কাছে হাত পাতে, কই বুড়ি, দাও টাকা একশো। তিন মাস পরে ফের ডেট।
বৃদ্ধার মাথা কাঁপছে বেদম। কাঁপা কাঁপা হাতে আঁচলের গিঁট খুলে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে দিল।
আরও দেও। উকিল ধমক মারে।
বৃদ্ধা তখন আর এক আঁচল থেকে খুচরা তিন টাকা বের করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, হাইটা আইছি। এই তিন টেহা দিয়া বাসে যামু। আর হাঁটতে পারমু না। পাও দুইডা ফুইলা তাল গাছ হইছে। ফোলা পা দেখায় উকিলকে। বৃদ্ধার পা দুটি সত্যি বেশ ফোলা ছিল। উকিল কোন কথা বলেনি। শুধু বৃদ্ধার হাতের মুঠো হতে তিন টাকা থাপিয়ে নিয়ে চলে গেল। বৃদ্ধাও ফোলা পা টেনে তুলে কাঠফাটা রোদে পা বাড়ায়।
শ্যামল মামুনকে বলেছিল, খামাখা মামলা কেন করে? ঝুলিয়ে রেখে লাভ কী? খাক না জোর যার আছে। এভাবেই তো চলছে দেশ! মগের মুল্লুকের বাকি কি!
মামুন তখন জোরে শ্বাস টেনে আপসোসের কণ্ঠে বলেছিল, জেদ দাদা! জেদ! জেদাজেদিতেই এত সব হচ্ছে। আমলারা এখন শেঠ সেজে বসে আছে। রাজনীতিবিদদের এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। নিজেদের তৈরি ফাঁদে নিজেরাই পড়েছে। বউ বাচ্চাদেরও সাথে নিয়ে ঢুকেছে জেলহাজতে।
শ্যামলের মাথা কপালে ওঠে। কেমন ফাঁদ?
আপনি দেখছি দাদা ওদের মতোই মাথামোটা।
তার মানে? শ্যামল ভ্রূ কুঁচকায়।
পরস্পরের অবিশ্বাসের ভেতরে যার জন্ম তাকে আমরা কী বলি? তেমনি আর কি। পৃথিবীর কয়টা দেশে দেখেছেন এমন আজব সরকার! মামুনের মুখে নিষ্ঠুর শ্লেষের হাসি। শ্যামলের বুকের গহিনের যৎসামান্য দেশপ্রেম মুহূর্তেই উধাও! এখন অহর্নিশি ধ্যান-স্বপ্ন একটিই—কানাডার গ্রিনকার্ড। চৈতির মতি ফেরানো। দেশে ফিরবে না ভেবে রেখেছে। ক্ষমতার কাড়াকাড়ি, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, লুঠতরাজ, খুনখারাবি থেকে বেঁচে যাবে বাকি জীবন। ছেলেও পাবে একটা সুস্থ জীবন।
হঠাৎ শ্যামলের বুক কাঁপিয়ে অন্ধকার নেমে আসে। বিদুৎ গেল! বাবা বলে চমকে ওঠে ছেলেকে ধরতে হাত বাড়ায় শ্যামল। ছেলে বাবাকে ছোট্ট দু’হাতে পেঁচিয়ে ধরে।
বাবা, মোমাবাতি আনি। ছেলে বলে।
অন্ধকার এতটা ভূতুড়ে! শ্যামল অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। বড় করে শ্বাস ফেলে বলে, বাবা, তুমি জানো কোথায় মোম?
জানি, বলেই এত জোরে দৌড়াল ছেলে, তাজ্জব শ্যামল! হাও ইট পসিবল! নিজের হাতটাই যেখানে অদৃশ্য! হেসে ওঠে শ্যামলই উত্তর দেয়। পারবেই বা না কেন? পারতে যে হবে-ই। দিন-রাতে বিদুৎ নিশ্বাসের মতো যাওয়া আসা করে। লোডশেডিং হবে-ই। হতে-ই হবে। মানতে-ই হবে। সেদিন খোদ কানাডা বসেও শ্যামল রাগে গজগজ করেছিল। দেশের একজন মিটার রিডার কোটি টাকার মালিক! ঢাকায় একাধিক ফ্লাটবাড়ি! আর দফতরের মিয়া বাবুদের তো পোয়াবারো!
ছোট্ট দু’হাত কাঁপিয়ে একটা ক্ষীণ আলোর মোমবাতি নিয়ে এলো ছেলে। দু’হাতে ছেলেকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে শ্যামল।
জানো বাবা, আমরা রাজশাহী গিয়েছিলাম।
কেন? রাজশাহী কেন?
সুমন আঙ্কেলের ওখানে গিয়েছিলাম।
সমস্ত শরীর ঝাঁকিয়ে ওঠে শ্যামলের। মাথা চক্কর মারে। বারান্দা যেন লম্বাটে ট্রেনের মতো দৌড়াচ্ছে। বাসর রাতে মুখ ফসকে সু পর্যন্ত বলেছিল চৈতি। অগ্রচ্ছেদা ছিঁড়ে ছোপ ছোপ রক্তে যখন বিছানা সয়লাভ, তখন আর সু নিয়ে মাথা খাটাবার প্রয়োজন ছিল না শ্যামলের। বউ কুমারী। আট বছর ধরে শ্যামলের এই কৃচ্ছ্র সাধনের পেছনে সেই রক্তের গন্ধ। শ্যামলের অসম্ভব এক অহংকার। কুমারীর সতীচ্ছেদ করার দুর্লভ ভাগ্য জুটেছে তার।
ঘুমে হাই তুলছে ছেলে। রাত প্রায় বারোটা ছুঁইুছঁই।
ঘুমে চোখ বুঁজে আসা ছেলের মুখে তড়িঘড়ি করে এক পিছ কেক তুলে দিল। কেক অর্ধেক মুখে নিয়েই ছেলে ঘুমের দেশে চলে যায়। কোলে তুলে নিয়ে চৈতির পাশে শোয়ালো ছেলেকে।
দেয়ালের ঘড়ির কাঁটা এখন ঠিক বারোটার ঘরে। নিজেকে জিজ্ঞেস করে শ্যামল, কে হতে পারে এ সুমন? চৈতির প্রেমিক? আমার অনুপস্থিতে চৈতির দেহের জিম্মাদারিত্ব ছিল তার? নিজের উপরেই চরম বিরক্তিতে হিস্ করে। এত বছর পরে এসব কী বাজে চিন্তার চর্চা করছি মগজে!
আচমকা ঘরের নৈঃশব্দ্য কাঁপিয়ে নড়ে ওঠে চৈতি। মাটির নিচে থেকে মূলা উপড়ে তোলার মতো এক হাত ধরে হেঁচকা টানে ভয়ার্ত চৈতিকে তুলে বসাল শ্যামল। ফোলা ঝোলা চোখ। নিস্ক্রিয় হাত পা। চোখ দু’টি যেন স্থির সাদা পাথর। শরীরে আস্থার স্পর্শ করতেই মধ্যরাত্রির শূন্যতা ফাটিয়ে শ্যামলকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে চৈতি, আমাকে বাঁচাও শ্যামল! আমাকে বাঁচাও তুমি। আর কে আমাকে বাঁচাবে?
একগাদা বমি ঠেলে বেরিয়ে আসে চৈতির বুকের ভেতর থেকে। ওয়াক ওয়াক শব্দের মাতম তুলে বমি করে। ভরা কলস থেকে যেন জল ঢালছে! বিপুল পরিমাণ বমি শ্যামলের শরীর ও বিছানা ভাসিয়ে দিল।
বুক খামচে ধরে শ্যামল। টাল খেয়ে ওঠে শরীর। বুক চেপে ধরে ব্যথায়। নিঠুর কাঠপোকার মতো শ্যামলের শক্ত কলিজা কেটে এভাবে শত টুকরো করে ফেলল কে! জীবনের এ কী নিষ্ঠুর উপহাস! পরাজয়ে বিশ্বাস নেই শ্যামলের। আঙুল টিপে টিপে জীবনের বর্তমান পজিশনে। ফিক করে হেসে ওঠে জ্যান্ত একটি মিথ্যা সরল করে উপস্থাপন করে চৈতির কাছে, ওহ্! এই তুচ্ছ কারণে! তোমাকে বলিনি এতদিন। একটা গোপন কথা। চৈতির কানের কাছে মুখ নিয়ে ভূতের মতো নাকে নাকে বলে, আটজন। আটজন!
চৈতির কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
আরে বুঝলে না! আটজন মানে! মৌজ করতে গিয়ে আটজন মেয়েমানুষের পেট বাঁধিয়েছি। সে পেট ঝাড়তে কত গচ্চা! উফ! বাঙালি মেয়ে তুমি, তাই তোমাকে বলিনি। কী ভাবো শেষে।
ঠোঁট আলগা করে কাঠ হাসি দিল চৈতি।
হাসির অর্থ শ্যামল বুঝেছে।
ছেলেকে নিয়ে যাও তোমার সাথে।
আর তুমি?
চৈতি জোরে নিশ্বাস ফেলল। অন্য কোন পুরুষ হলে কী হত ভাবতেই পারছি না। এতক্ষণে হয়ত আমাকে খুন-ই করে ফেলত। তুমি মহৎ। তোমার এই মহত্ত্বকে আমি শ্রদ্ধা করি। তোমার মহত্ত্ব-ই আমার বাকি জীবনের পথচলার সম্বল। আর থাকল সুমনের হিংস্রতার স্মৃতিচিহ্ন। এই দুই প্রাপ্তি নিয়েই কাটবে আমার অবশিষ্ট জীবন। এটুকু একটা জীবন! আর বাকি আছে কত?
নির্বাক শ্যামল নিঃশব্দে চোখ বোঁজে।
ছেলেকে নিয়ে যাও কানাডা। দু-এক বছর পরে বলো, অপঘাতে না হয় জটিল রোগে আমি মরে গেছি।
ঠিক তিনদিনের মাথায় সব কিছু গুছিয়ে শ্যামল রেডি। কানাডা ফিরবে। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে চায় না। বাস্তববাদী মানুষ শ্যামল। ব্যাগ হাতে বেরোবার মুহূর্তে চাপা কর্কশ কণ্ঠে বলে, চিরজনমের মতো দেশ ছাড়ছি। দেশে আর ফিরব না। এদেশে আমি জন্মেছি ঠিকই, কিন্তু আজ থেকে এদেশ আমার না। আমার সাথে তো নয়-ই, ছেলের সাথেও, কোন দুর্বল মুহূর্তেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না। সত্যিটা তখন আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তখন ছেলে থুতু দেবে তোমার পেটে-বুকে-মুখে। তোমার পেটের সন্তানের মুখে থুতু দেবে।
বেহুঁশ চৈতির ভেতর থেকে উগলে আসা বমির কিছু পরিমাণ ছিটকে পড়েছে শ্যামলের শার্ট-প্যান্টে। গন্ধ শ্যামলের শরীরেও যেন ছড়িয়ে গেল! বমির এই গন্ধ কানাডায় পৌঁছুবে। যুবতী বউ ঘরে রেখে যারা কানাড়ায় এখন, তারাও যেন বমির গন্ধ পেতে পারে শ্যামলের শরীর হতে, এ ব্যবস্থা-ই যেন করে দিল চৈতি।
[চলবে...]
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)
1 Comments
Agniswar Chakraborty
01 May, 2022
খুব ভালো লেখা...
Post Comment