- 26 December, 2021
- 0 Comment(s)
- 444 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
[১১]
এবার দেখবি খেলা, আমিই হব বিজয়ী : সুমন
রিমা নেই বাসায় পাঁচদিন। বাইরের খাবার সুমনের সহ্য হয় না। ফ্রিজে এক সপ্তাহের তরকারি বাটি বাটি করে তোলা। শুধু ভাতটুকু রাঁধতে হয়। বরাবর তাই হয়। এবার সুমন একবারও ফ্রিজ খোলেনি। ভাত রাঁধেনি। খিদেই নেই তেমন, তাই খাবারের তাড়া নেই। দুপুরে হোটেলে খায়। সকাল-রাত পার করে চিড়া-মুড়ি-বিস্কুট দিয়ে। তিনদিনের মধ্যে দ্বিতীয়দিন ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিল এক ঘণ্টার জন্যে। এছাড়া ঘরের বাইরে বের হয় না। লেখার টেবিলে বসে না। অস্থির হয়ে এ ঘর ও ঘর ঘূর্ণিপাক খায় শুধু। যেন দরকারি কিছু হারিয়ে ফেলেছে, হন্যে হয়ে খোঁজে ঘরে ঘরে। কথা বলে একা। নিজের সঙ্গে নিজে। শূন্যতা আর একাকিত্বের দীর্ঘ ভারাক্রান্ত মানুষের মতো চেহারায় বিষাদ আর ক্লান্তি ভর করেছে। কি দিন কি রাত, ঘুম নেই দু’চোখে। এক মুহূর্তের জন্যেও ঘুমায় না। ভয় তাড়া করে ফেরে। রিমাকে নিয়ে ভয়। বড্ড জেদি মেয়ে। যদি একটা কিছু...ভাবনার দাড়ি টানে সুমন। কিন্তু ভাবনাগুলে আমন্ত্রিত মেহমানের মতো ঘরে প্রবেশ করে সোফায় বসে পা দোলায়।
একবুক অভিমান নিয়ে এবার ঢাকায় গিয়েছে রিমা। দিন পনের না থেকে ফিরবে না। এদিকে পাঁচদিনেই বেসামাল সুমন। একটি দিন যেন একটি বছর। বাধা দিয়ে পারেনি। অস্থির হয়ে ওঠে আরও একটি কারণে। ঢাকার রাজপথ যুদ্ধাংদেহী। কেয়ারটেকার সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো সশস্ত্র হয়ে মাঠে এখন। চ্যানেলে চ্যানেলে লাইভ চলছে। ভাঙচুরের ভয়াল তাণ্ডবে কম্পমান রাজধানী। ভয়ার্ত মানুষগুলোর ছুটোছুটি পঁচিশে মার্চের রাতের মতো। লাশের পর লাশ। অতঃপর উল্লাসের হর্ষধ্বনিতে কম্পমান রাজপথ। রাজতখ্ত দখলের লড়াই। এ দুর্যোগের মধ্যে রিমা ঢাকায়। ওর স্বভাব যা, সারা ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ায়। যদি পিকেটারদের ছোঁড়া একটা বোমা পড়ে শরীরে, অথবা যে গাড়িতে উঠবে সেই গাড়িটায় যদি গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়, তাহলে পুড়ে ছাই। ও তো আর একা নেই। দু’জন পুড়বে। গতকালই একটা গাড়িতে আগুন লাগিয়েছে। ১২জন যাত্রী একসাথে পুড়ে এখন ছাই-কয়লা।
ও মরবে, আমার বাচ্চাটাও মরবে। উত্তেজনায় খাঁচাবন্দি বাঘের মতো গর্জন করে ওঠে সুমন। ননস্টপ মোবাইল টেপে। নেটওয়ার্ক বিজি। মাগি আবেগে চলে। মাস্তানি করে চলে গেল। নন্সেন্স নিয়ে আমার হাড়মাংস এক হয়ে গেল। দেশের নাজুক সিচুয়েশন। এত করে হাতেপায়ে ধরলাম। না, ওর যেতে হবেই। এখানে নাকি দম আটকে আটকে আসে। কত চটাং চটাং কথা শুনিয়ে গেল। শালী আমাকে বিশ্বাস শিখাতে আসে। ধূর্তামির একটা সীমা আছে! গেছে মৌজ করতে। অয়ন শালা কার্তিক মাসের কুকুরের মতো মাগিটার পেছনে লেগে থাকে। ভয়ানক উত্তেজনায় কাঁপছে সুমনের শরীর। হাত কাঁপছে ভীষণ। চোখ দুটি লাল হয়ে উঠেছে। কম্পমান হাতে পাগলের মতো মোবাইল টিপছে। এমন অস্থিরতা নিয়ে মোবাইল টিপছে, যেন টিকেট কাটা ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, এক মুহূর্ত বিলম্বেই মিস। জোরে নিশ্বাস ফেলার সাথে সাথে বুকের খাঁচা নড়ে উঠছে। ও যা ভেবেছিল, তাই বোধহয় সত্য হতে যাচ্ছে, অথবা এ কয়দিনে হয়েই গেছে। বেড়ানো বাহানা মাত্র। পেট খালি করাই উদ্দেশ্য। মোবাইল লক কেন? কল ঢোকে না কেন? আমি সব বুঝি। সুমন গাঙ্গুলিকে ভোদাই মনে করে মাগি। ভোদাই! বাঘ যেভাবে শিকারির ঘাড়ে হিংস্র থাবা বসায়, ঠিক সেভাবে হাতের থাবাটাকে প্রস্তুত করে সুমন, ঘাড়ের রগগুলো ফুলে ওঠে, দাঁতে দাঁত ঘষে শব্দ তৈরি করে, মাগির বুক ফাঁইড়া কলিজা বাইর করে না আনছি তো আমার নাম সুমন গাঙ্গুলি নয়। তোর তাজা কলিজা ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে চিবাবো আমি। আগে পেট খালাস করে দেখ না দেখি। দুনিয়ায় তুইও থাকবি না, আমিও থাকব না। আগে তোর জান খালাস করব, তারপর আমি। বুকে পাথর বেঁধে চারবার সয়েছি। এবারের খেলা শেষ খেলা। হয় জয়, না হয় বিনাশ।
একবার একটি মাত্র রিং হয়ে কেটে গেল রিমার দিক থেকে। সুমন হিস্ করে ওঠে, ঠিক কেটে দিচ্ছে, ওটিতে পেট খালাস করছে নির্ঘাত!
আর একবার কল ঢোকে। ও প্রান্তের রিসিভারের কণ্ঠ রিমার নয়, গুরুগম্ভীর কোন নারীকণ্ঠ। সুমনের পিলে চমকে ওঠে। এ কার কণ্ঠ? ক্লিনিকের ডাক্তার-নার্সের না তো? কে আপনি? আমার স্ত্রী রিমা কোথায়? আপনার হাতে রিমার মোবাইল কেন? সুমনের কণ্ঠ কাঁপছে। কট করে লাইন কেটে গেলে সাপের মতো হিস্ করে ওঠে প্রচণ্ড জোরে লাথি মারল বাতাসে। ।
রিমার নম্বরে কল আর ঢুকছে না কিছুতেই। বারবার দুঃখিত বলছে।
অস্থির সুমন কিছুক্ষণ পায়চারি করে। ষড়যন্ত্র! শালী ষড়যন্ত্রে নেমেছে। আমাকে ফলহীন বৃক্ষের মতো নিঃস্ব দুর্বল অসহায় করে বিজয়িনী হতে চায়। বড্ড সুখি হওয়ার লোভ তোর? দাঁড়া? কী ভেবে হঠাৎ, আলনার উপরে রাখা রিমার একটি শাড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিল। অবশ্য নিজেই আবার তুলে ভাঁজ করে রাখল। অয়নকে ইদানিং মির জাফরের চেয়েও ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রকারী বলে মনে হয় সুমনের। কলেজ জীবনের বন্ধু অয়ন। নির্বন্ধু সুমনের বন্ধু এখন একজন-ই। দৈনন্দিন যোগাযোগ হয়। বাইরের পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। মানুষের মুখের দিকে তাকালেই মনে হয় ঠক, প্রতারক। প্রচলিত সব ভণ্ডামির মুখোশ পরে আছে। মুখোশটা খুলে নিলেই জন্তু-জানোয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়। বরাবরই অয়ন সাংসারিক বিষয়ে নাক গলায়। সুমনের অবশ্য সায় থাকে। দুজনের সংসার, কত কথাই তো জমা হয়। কত বিচিত্র অভিমান আর অভিযোগ জন্ম নেয় প্রতিদিন; কত রকমের পাগলামি, এসব বলার জন্য অন্তত একজন মানুষ প্রয়োজন। অয়ন ধৈর্য ধরে শোনে। পক্ষে-বিপক্ষে রায় দেয়। মাঝে মাঝে বলে, তোদের বাচ্চা নেই, তাই তোরা নিজেরাই শিশু হয়ে গেছিস, কী সব পাগলামিতে মজে থাকিস!
অয়ন এখন বড় ডাক্তার। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। অবশ্য এ কথা ওর নিজেরই বোধহয় মনে থাকে না। দিন-রাত পড়ে থাকে প্রাইভেট ক্লিনিকে। ডাক্তারির ব্যস্ততার ফাঁকে বছরে একদিনের জন্য হলেও সুমনের বাসায় সময় কাটায়। রিমার প্রতি অয়নের কিঞ্চিৎ দুর্বলতা আছে। এ সন্দেহটা সুমনের দীর্ঘদিনের। খুব স্বাভাবিক ও সহজভাবেই নিয়েছে সুমন। বন্ধুর বউয়ের উপরে এরকম দুর্বলতা সবারই থাকে, না থাকলেও ধীরে ধীরে জন্মে। এতকাল ভাবেনি, এখন সুমন ভাবতে শুরু করেছে। রিমা বারবার এবরশন করার জেদ ধরে কার উৎসাহে? মুখে অয়ন ঠিকই বলে বাচ্চা নে বাচ্চা নে, এদিকে আড়ালে কলকাঠি নাড়ে। ওরা দুজনে একসাথে জোটবদ্ধ হয়ে ষড়যন্ত্র করছে সুমনকে নিঃস্ব, অসহায়, শেকড়হীন ও ফলহীন করে ফেলতে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে নিজেক শান্ত করে সুমন। উত্তেজিত হয়ে কথা বললে, অয়ন ধরে ফেলবে ওর সন্দেহটা। শালা মির জাফরের কান বড় শেয়ানা! মুখ হা করলেই কী বলছি ধরে ফেলে। বেশি উত্তেজিত হলে প্রতিবেশীর কাছে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাবে। বিশেষ করে তিনতলার অশীতিপর বৃদ্ধা কমলিকা ব্যানার্জির শকুন চোখ সব সময়েই কামানের মতো তাক করে রাখে এদিকে। বাতাসে যেন বুড়ি কান পেতেই থাকে। সামান্য পান থেকে চুন খসলেই দৌড়ে আসে। বেশি থাবদারি বুড়ির। রিমার সাথে পেটে পেটে ভাব। গুজুর গুজুর করে দিনরাত। দুইজনে খালি শলাপরামর্শ করে। বুড়িকে দেখলেই গা জ্বলে সুমনের।
অয়নের নম্বরে কল ঢুকেছে এবার। ‘যাও পাখি বলো তারে সে যেন ভোলে না মোরে’। সুমন হাসে। ছেলেটার রোমান্টিক ভাব এখনো আছে। সুখের দিনগুজরান তো। অসুস্থ মানুষের পকেট কেটে টাকার পাহাড় জমাচ্ছে। জনগণের টাকায় লেখাপড়া করে, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে, প্রাইভেট প্র্যাকটিসের নামে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি খুলে বসেছে। ডাক্তারি তো নয়, স্রেফ ডাকাতি। এক মিনিটও দেখে না রোগী। হাজারটা টেস্ট দেবে, আবার হাজার টাকা ভিজিট। বন্ধু! এত সুখ তোর। গাড়ি-বাড়ি-টাকার সুখে টইটম্বুর। নাদুসনুদুস বউ। দুটা দেবশিশুর মতো ছেলে। আর আমি করি মাস্টারি। অল্প পুঁজির জীবন। আমার ছোট্ট সুখে এভাবে দাঁত বসাতে চাস কেন? তোর বুকে একটু দয়ামায়া নেই। সেই ছেলেবেলা থেকে তুই আমার বন্ধু। টানা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমন।
হ্যালো সুমন। অয়নের ব্যস্ত কণ্ঠ। জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললি মনে হয়। কী হয়েছে?
তুই কোথায়? সুমন বলে।
কেন? ক্লিনিকে।
এই দুপুর বেলা ক্লিনিকে! তুই যে সরকারি ডাক্তার ভুলে গেছিস নাকি?
অয়ন হেসে দিল। বুঝতে পারছি, তুই এখন জ্ঞান দিবি। বন্ধু হলেও প্রফেসর তুই, তোদের মাথায় জ্ঞান ওভারলোড হয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই জ্ঞান বিতরণ করছিস। আমাদের কোনো জ্ঞান নেই, আমরা রোগীদের সাথে ওঠাবসা করি। রোগীদের বাঁচার আর্তি আমাদের চব্বিশ ঘণ্টা অস্থির করে রাখে। তোরা শুধু দেখিস, আমরা রোগীদের পকেট কেটে নিচ্ছি, এটি একবারও ভাবিস না, আমারা মানুষ না রোবট? সেই সকালে বেরিয়ে রাত ১২টায় বাসয় ফিরি। সবই কী টাকার লোভে! এই মুহূর্তে দু’জন রোগী ওটির অপেক্ষায়। আজই, এমনকি এখনি অপারেশন না করলে মানুষ দু’টো বাঁচবে না? আমি কী এই রোগীদের ফেলে চলে যাবো? সব পেশাতেই শ’তে দু’চারজন বেনিয়া থাকে। তোদের প্রফেসরদের নেই? প্রজেক্টের নামে ভাঁওতাবাজি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে না? তোর সহকর্মীরাই নিচ্ছে।
রাজপথের মানুষরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে জীবন হাতে নিয়ে। পুলিশ, সরকারি দল, বিরোধী দলের ক্যাডার বাহিনী মিলেমিশে ছেলেদের মার্বেল ছোঁড়ার মতো গুলি ছোঁড়ার খেলাধুলা করছে। আর তুই এখন প্রাইভেট ক্লিনিকে বসে মানুষের রক্তচোষা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিস! শালা পুঁজিবাদের দালাল! পেচ্ছাব করে দিতে ইচ্ছে করে এসবে। গিয়ে দেখ কত নিরীহ পথচারী গুলি খেয়ে মুখগুঁজে পড়ে আছে তোর হাসপাতালে করিডোরে। রাস্তায় চলছে ক্ষমতার যুদ্ধ। রাস্তা থেকে গুলি খেয়ে ক্ষুধার্ত নিরীহ মানুষগুলে লড়ছে যমের সাথে। লাশ কাটাঘরেও নাকি ঢুকেছে কিছু। চ্যানেলগুলো লাইভ দেখাচ্ছে। এ তোদের রাষ্ট্রযন্ত্রের খেলাধুলা!
অয়নের কণ্ঠ এবার ঝাঁঝালো। তুই প্রফেসর মানুষ। তোর কাজ নেই। বাসায় বসে গল্প-উপন্যাস পড়, রিসার্চ আর্টিকেল লেখ, আর না হয়, ভারত-পাকিস্তানের টেস্ট খেলা দেখ, নেতাদের টক শো দেখ, দেশ নিয়ে বেশি বেশি ভাব, আর যদি পারিস এসব ভাবনা দিয়ে কলাম লিখে ফেল। তোরা বুদ্ধিজীবীরা তো রাস্তায় নামবি না, তোরা শুধু ভাববি। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাববি, সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে তোদের চিন্তার শেষ নেই। বড়জোর তোরা নিজেকে বাঁচিয়ে বিবৃতি দিবি, কলাম লিখবি। আমার হাতে এত সময় নেই রাষ্ট্র নিয়ে ভাববার। মানুষ মরে যাচ্ছে। যারা অস্ত্র-বোমা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে তারা জীবন হাতে নিয়ে বেরিয়েছে। তারা আর যাই হোক, তোদের মতো এতো ভাবছে না। তারা কাজে নেমে পড়েছে।
একবার ভেবে দেখ অয়ন, সুমনের কণ্ঠ ভারী হয়ে অসে, গুলি পেটে বা বুকে নিয়ে লাশ কাটা ঘরে মুখগুঁজে আছে যে মানুষগুলো, ওরা বেরিয়েছিল নিজের কাজে, ওদের বউরা হয়ত কিচেনে বেগুন ভাজিতে তেল ছিটাচ্ছে তড়িঘরি করে। স্বামীরত্ন এসে খাবে। বাচ্চারা হয়ত বাবার অপেক্ষায়। এক সাথে খাবে। বাবা আসার ফাঁকে রং পেন্সিল নিয়ে কায়মনে আঁকছে সবুজস্বপ্নের বাংলাদেশ, স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, আটচল্লিশ হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশের মানচিত্র! বাবাকে দেখিয়ে বাহবা নেবে।
সন্তানদের কথা মনে পড়ল অয়নের। চমকাল। রিয়েলি দোস্ত! দেশটার যে কি হাল হল? এত সবের জন্যে বরং তোরই লজ্জা পাওয়া উচিত। তোর জাত ভাই, এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তো এসবের নাটের গুরু। এজন্যই বলে, বন্যরা বনে সুন্দর। তোদের, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের রাজনীতির দৌড় ভিসি প্রভোস্ট প্রক্টর চেয়ারম্যান এসব স্বার্থোদ্ধার পর্যন্ত; দেশের রাজনীতির অ আ ক খ জ্ঞানও নেই তোদের। অথচ বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে তোদেরই এদেশের নেতৃত্ব দেবার কথা ছিল। ব্যাটা তুই রাষ্ট্রের পতি হয়েছিস, তুই কেন একটা দলের হয়ে রশি টানাটানি করবি? তুই থাকবি নিরপেক্ষ।
সুমন লজ্জাই পেল বোধ হয়। সরি দোস্ত, আর লজ্জা দিস না।
অয়ন হো হো করে হেসে ওঠে। তোর হুঁশ-জ্ঞান কিছু অবশিষ্ট আছে দেখছি!
রিমা কি তোর ওখানে গিয়েছিল? সুমন ঢেকুর গেলে।
গতকাল এসেছিল। তবে বসেনি। কী যেন বলবে বলবে ভাব করেছিল। শেষপর্যন্ত না বলেই চলে গেল। কেমন বিমর্ষ দেখাচ্ছিল ভাবিকে। নতুন কোন ঝামেলা পাকিয়েছিস নাকি?
সুমন হাসে, টিপ্পনী কাটে, তোর সাথে প্রায়ই দেখা করতে যায় কিনা। ঢাকা শহরে থাকিস। অঢেল টাকা, গাড়ি-বাড়ি সবই আছে। রিকশা-ভ্যানের শহরে কি কারো ভালো লাগে?
অয়ন খেঁকিয়ে ওঠে, কী বলিস আর কার সম্বন্ধে বলিস, এসব হুঁশজ্ঞান ইদানিং আর তোর নাই দেখছি। মাস্টারি ছে ঁড়ে দে। আলু-পটল বেঁচে খা, তবু তোর মন সুস্থ থাকবে।
কট করে লাইন কেটে দিল সুমন। এই প্রথম আকারে ইঙ্গিতে হলেও অয়নকে বুঝিয়ে দিয়েছে, রিমার সাথে মাখো মাখো ভাব ওর না পছন্দ। এবার যদি রিমা... বন্ধু বলে ছেড়ে দেবে না। প্রয়োজনে খুন তিনটাই হবে। আগে মাগিকে, তারপর তোকে, শেষে আমি। শালা মির জাফর! ষড়যন্ত্র শুরু করেছিস। ষড়যন্ত্রের গুয়ায় এবার বাঁশ ঢোকাবো। দেখি আগে, কোথাকার জল কোথায় যায়। যদি বন্ধু তুই এবার আমার সর্বনাশ করিস, তোর সুন্দরী বউয়ের ইয়ে ধরে...ক্রোধ, প্রতিহিংসা, ঘৃণার উত্তেজনায় সুমনের শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে সজারুর মতো।
ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে সুমন। সংঘর্ষময় চিন্তার লুডু খেলা কাটিয়ে নিজেকে তাজা করে নেবার জন্যেই প্রিয় কিছু গান শোনে। ‘ওগো নিঠুর দরদি, এ কী খেলছো অনুক্ষণ! তোমার কাঁটায় ভরা বন, তোমার প্রেমে ভরা মন।’ ‘আমার সকল প্রদীপ জ্বেলে দিবস এলে করব নিবেদন’, গান শোনার ফাঁকে চোখ বোঁজে। ভাবে। যে জীবনছন্দ পায়ে পিষে এসেছি তার জন্যে এত হা পিত্যেশ কেন আর! রিমাও তো কারেক্ট। ওর বুকের ভেতরে আতঙ্ক আশংকা ঘূর্ণিপাক হয়ে আছে। যে রক্তপিণ্ড মানুষ আকৃতি নেবে তারও তো মুখ হবে। ভাষা হবে। সেও চাইবে জীবনছন্দ। ছেলে হলে নারী, মেয়ে হলে পুরুষ সঙ্গী চাইবে, বন্ধন চাইবে, সন্তান-সংসার-সমাজ চাইতে পারে। পায়ে পায়ে তখন দাবড়িয়ে বেড়াবে পিতৃপুরুষের ছায়া। কী হবে পরিচয়? কী অধিকারই বা আমার আছে তার জীবনছন্দ কেড়ে নেবার? সে তো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একজন মানুষ হবে। তারও প্রজন্ম হবে। কী আইডেন্টিটি হবে তাদের? আমি মানি না। রিমা মানে না। অন্যে কেন মানবে না? নিজের মধ্যে লীন হতে হতে রিমাকে কাছে ডাকে সুমন, আমরা হারিয়ে যেতে চাই না, চিরদিনের জন্য নিঃশেষ হয়ে যেতে চাই না; সমূলে বিনাশ হই তুমি কি তাই চাও রিমা? একটা সন্তান রেখে যেতেই হবে, ওর পৃথিবীটা ওর নিজের মতো করে সাজিয়ে নেবে।
[চলবে...]
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)
0 Comments
Post Comment