শাপিতপুরুষ (চতুর্থ কিস্তি)

  • 19 December, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 519 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পূর্বকথা- রিমার বাবা শুনলেন তার মেয়ের বিয়ের খবর, সেদিন কোনো বাড়তি প্রতিক্রিয়াই দেখা যায়নি তার মধ্যে। তাতেই বোঝা গেল তীরটা বিঁধেছে কতটা গভীরে। মেয়ের মা কিন্তু কাঁদল ঘরদোর ফাটিয়ে। ভাইটা ঘর থেকে বের হয়নি। আশেপাশের গ্রাম রাষ্ট্র হয়েছে বিয়ের কথা। বাড়িতে হিড়িক পড়েছিল মেয়ের বাবাকে দেখতে। যে মেয়ে পরকাল বিশ্বাস করে না, আল্লাহ রসুল মানে না, কলমা না পড়েই বিয়ে করেছে, সেই মেয়ের বাপ তো গাঁয়েগঞ্জে ভুরি ভুরি মেলে না। মুসলিম মেয়ের হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করার কারণে নানান সামাজিক প্রতিক্রিয়া শুরু হলো।

[৯]

আলো-বাতাস কমে আসছে : রিমা

ছোট্ট এ জীবন, একবার এলোমেলো হয়ে গেলে গুছিয়ে ওঠা কঠিন। নতুন করে শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়, সময়ের টানাটানি পড়ছে। হাতে সময় নেই। পেছনে ফেরার পথও অবরুদ্ধ। বিগত জীবনের দিকে যৌবন ক্ষুধাতুর বৃদ্ধের মতো অক্ষম ও নির্বিকার চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। জীবনের কোন সংজ্ঞা নেই। জীবন একটা জ্যান্ত মোহ। মোহটা মরে গেলেই জীবনটা ফানুস। অন্ধমোহের মধ্য দিয়ে জীবনটা কাটে বলেই এত মোহনীয়, এত লোভনীয়, এত স্বপ্নকাতর! অর্থ-ক্ষমতার বিনিময়ে একটি মুহূর্তও যদি কিনে ফেলা যেত, হয়ত মৃত্যুর মুখে পতিত মানুষটি তার সর্বস্ব বিলিয়ে তাই কিনে নিত। বেঁচে থাকার আনন্দই তো জীবন। এর বাইরে জীবনে সুমনের বিশ্বাস নেই। জীবনের চারপাশের মানুষগুলোর সঙ্গে এবং তাদের স্বার্থ লোভ ও বিশ্বাসের সঙ্গে জুয়ারির মতো বাজি ধরে, লড়ে জীবনকে জিতিয়ে দিতেই রিমাকে সঙ্গে নিয়েছে। মানুষের পরাজয়ে বিশ্বাস নেই, তাই এই অনঢ় শপথ, নিজের উপরে বিশ্বাস হারাবে না, লড়াই থামাবে না, পথ হারাবে না ।

রিমা ভেঙে পড়েনি বটে, কিন্তু ওর বিশ্বাসটা ঠিক স্থির নেই। নানান ঝড় এসে উপড়ে ফেলে দিতে যায় রিমার বিশ্বাসের খুঁটি। তখনি দিশেহারা হয়ে সুমনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুমন শক্ত খুঁটি হয়ে ওর বিশ্বাসটাকে তখন বাঁচায়। উল্টো স্রোতে খাবি খেয়ে খেয়ে ভেঙেচুরে নিশ্চিহ্ন সে আর কোনোদিনই হবে না। টিকে থাকার মন্ত্রে এখন পাকা সুমন। কিন্তু টিকে তো অনেকেই আছে। কা কা রব তুলে নীরব সকাল অশান্ত করে তুলেছে এই মুহূর্তে যে কাকটি—সে কি টিকে নেই? সুমন লম্বা নিশ্বাস ফেলে ভাবছে। বেলা তো অনেক হলো। চশমা উঠেছে চোখে। এবার শেষ বিপ্লবটা ঘটিয়ে চলে যাবে। অসমাপ্তটা সে-ই করবে সমাপ্ত। তার প্রজন্ম করবে। বিভ্রান্তির জালটা ছিঁড়বে।

আমি মরে যাইনি, আমি এখনো বেঁচে আছি, আমি হেরে যাইনি। রিমা আমাকে একটা বাবু দেবে? সুমনের এই দাবি শক্তভাবে প্রত্যাখ্যান করে রিমা। এবং সেই মুহূর্তে সুমন যতোই দুই হাত প্রসারিত করে বুকের পাঁজর বন্দি করার জন্য ততোই রিমা স্বতন্ত্র মানুষ হয়ে ওঠে।

প্রত্যাখ্যাত সুমনের ভেতরে সন্তান-আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সমস্ত অস্তিত্ব তখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। নিজের আত্মবিকাশ কে না চায়। প্রকৃতি রাজ্যে এই যে কাড়াকাড়ি হানাহানি খুনোখুনি সবই তো নিজের আত্মবিকাশের স্বার্থে, অস্তিত্বনাশের বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করে।

আমার কী অপরাধ? আমার অস্তিত্ব কেন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? আমি কেন মানব? আমি কী অপরাধ করেছি? আমি সন্তান চাই, এই পৃথিবীতে আমি আমার অস্তিত্ব রোপণ করতে চাই, আমি নিশ্চিহ্ন হতে চাই না, আমার  সন্তান চাই। কতো অবাঞ্জিত পরিত্যাক্ত বংশবৃদ্ধি করে চলছে, তুচ্ছ পিপীলিকাও এই জীবনের এই দাবি ছাড়ে? বলো রিমা? এই প্রসঙ্গ উঠলেই তুমি পাথরের মতো নীরব হয়ে যাও, পালিয়ে বেড়াও। পথের শেয়াল-কুকুরও তো এই দাবি ছাড়ে না। আমি কেন ছাড়ব? 

পাথরের মতো স্থির ও নির্বিকার থাকা রিমার বুকের ভেতরে সুমনে প্রতিটি প্রশ্ন করে এক একটি বিষাক্ত ছুরি হয়ে, যন্ত্রণায় কাতর রিমার হাতড়ে ফেরে সুমনের প্রশ্নের উত্তর। নেই, কোথা নেই, কিছুই নেই, সবকিছুতেই কালো পর্দা। উত্তর নেই, যুক্তি নেই, জেদ নেই, ক্রোধ নেই, আছে একটিই মাত্র প্রশ্ন। সেই প্রশ্নচিহ্নিত চোখে তাকায় সুমনের দিকে। গাঢ় লম্বা একটা শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে, ফের সুমনের মুখের দিকে তাকায় কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে, মানুষটির ভেতরের প্রকাণ্ড ঝড় বইছে, এই সর্বনাশা ঝড় থামবে না শেষ না দেখে। একদম চোখের উপরে চোখ ফেলে একমাত্র প্রশ্নটি  ছুঁড়ে মারে সুমনের ঝড়োবুকে।

সন্তান! সন্তান!! কী পরিচয় হবে বলতে পারো তোমার সন্তানের? কী নাম দেবে তার?

কেন! মানুষ। মানুষের আবার পরিচয় কী? দড়ি ছেঁড়া ষাঁড়ের মতো গর্জন করে লাফিয়ে উঠতে প্রস্তুত হয়, কিন্তু রিমার সঙ্গে এই মুহূর্তে সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে কী কী ঘটতে পারে ক্রমেই শীতল ও দুর্বল হয়ে আসে সুমন।  

রিমার ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি, মানুষ! মানুষ!! মানুষের সংজ্ঞা জানো সুমন? এত বিদ্যাবুদ্ধি তোমার, এতো বই পড়ো, লেখো, এতো বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করো, চারদিকে তোমার পাণ্ডিত্যের সুনাম শুনি, দাও তো দেখি, আমাকে মানুষের একটি সংজ্ঞা দাও? অথবা না পারো, বর্ণনা দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দাও, মানুষ কী জিনিস?

সুমন তখন নিজের ভেতর-বাইরে চিরুনি অভিযান চালায়, মানুষের সংজ্ঞা খোঁজে। রিমাকে বোঝানো যায় এমন একটি সংজ্ঞা পৃথিবীতে আজও কেউ দেয়নি। অবশেষে নিজেই একটি সংজ্ঞা দেয়, মানুষ মানুষ। আমার সন্তান মানুষ হবে। তারপর বড় হয়ে নিজের বুদ্ধি বিচার দিয়ে যা সত্য বলে জানবে তাই গ্রহণ করবে। আমার মতো।

বড় হতে আলো বাতাস লাগে, পায়ের নিচে মাটি লাগে, মাথার উপরে আকাশ লাগে, এসব কার দখলে তুমি জানো না? কোথায় পাবে তোমার সন্তান এসব? তোমার আছে? আর আমার?

সুমন যুক্তি খোঁজে, বিশ্বাসের গাছটি ধরে ঝাঁকায়, নিজের দিকে তাকায়, কিন্তু সবখানে এখন প্রশ্নবোধক চিহ্ন। এই চিহ্নটাই রিমার চোখে ঘর বেঁধেছে। যুক্তিতে হেরে যায় সুমন। যুক্তি এখানে বাতাসে উড়ে আসা ধুলোবালির মতো। 

টানা চারবার কনসিভ করে রিমা। খুব জোর চার মাস পেট পূর্ণ রাখে। এ সময়টায় রিমার নিজের মধ্যে কী যে ভয়ানক লড়াই চলে! রীতিমতো আত্মঘাতী রণাঙ্গণে নামে। প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে, প্রতি মুহূর্তে হারে। হারতে হারতে অবশেষে আর না পেরে পেট ফাঁকা করতে মরণ কামড় দিয়ে বসে। সুমনের তখন আর কিছুই করার থাকে না। বেদিশা হয়ে রিমাকে বাঁচায়। ওর বুকের ভেতরটা দখল করে নেয় একটা দীর্ঘশ্বাস। এ দীর্ঘশ্বাস লুকানো সম্ভব হয় না। একদিকে মুক্তি একদিকে অপরাধ, দুই দিক থেকেই তখন রিমা দিশেহারা। সুমনকে সান্ত্বনা দেবার কথা ভাবলেই মনে হয় অন্যায় হবে। সুমনের ক্রোধ, হতাশার মুখোমুখি হতে তখন ভীষণ ভয়।

চতুর্থবার কনসিভের পরে টানা বেশ কিছু বছর রিমা কনসিভ করেনি। সুমন ভয় পেয়েছিল। বারবার এবরশনের কারণে বোধহয় আর কনসিভ করবে না। এছাড়া বয়সও চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। পঞ্চমবার কনসিভের খবর রিমা লুকিয়ে ছিল। মুখের চেহারায় পরিবর্তন, লুকিয়ে বমি করা, মাথা ধরা নিয়ে শুয়ে পড়া ইত্যাদি সিমটম দেখেই সুমনের সন্দেহ হয়। এক বিকেলে ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরে দেখে রিমা নেই। সন্দেহটা আরও শক্তি পায়।

বড় একটি তরকারি ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসায় ফেরে রিমা।  দরজা খোলেই সরাসরি হাত পাতে সুমন, আল্ট্রাসনোর রিপোর্টটা দাও।

রিমা চমকে ওঠে কিন্তু সামলে নেয় নিজেকে। কী বলছো! আগে রুমে ঢুকতে দেবে তো। বাসায় শাক-সবজি-মাছ নেই, তাই বাজারে গিয়েছিলাম। উফ্! তরকারির যা দাম এখন।

সুমন আবারও হাত পাতে, আল্ট্রাসনোর রিপোর্টটা দাও।

রিমা কিছু না জানার ভান করে, কিসের রিপোর্ট?  দেখছো না, আমি বাজারে গিয়েছিলাম।

সুমনের চোখ তখন রিমার সর্বশরীর প্রদক্ষিণ করে, আজ পর্যন্ত কোন জিনিসটি লুকিয়ে পার পেয়েছ, বলো?

তা বটে, তুমি হলে ঝানু শিকারি, বলে রিমা হেসে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে আবার বিমর্ষও হয়ে যায়। কী ঘটতে পারে ভেবে।  এবার সুমন বেয়াড়া জেদকে ঠেকাবে কী করে? শরীর দুর্বল হয়ে আসছে। একা কিছুই করার নেই। ব্যাগ থেকে রিপোর্ট বের করে দিল কাঁপা হাতে।

রিপোর্ট এক নজর দেখেই হিমালয় বিজয়ীর মতো আঙুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সুমন, জিতে গেছি, আমি জিতে গেছি রিমা।

রিমার শরীর কাঁপছে ভয়-ত্রাসে। পালানোর সব পথ বন্ধ হয়ে গেলে চোর যেমন অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক তেমনি রিমা নিঃসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দেখে সুমনের উল্লাস।

সুমনের মনে জেগে ওঠা এবারের পিতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা অন্য যে কোন বারের চেয়ে আলাদা। রিমা লক্ষ করে, সুমনের চেহারায় নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠছে। কিছু মুখ ফুটে বলেনি বটে, কিন্তু হাবভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, এবার অনুরোধ নয়, এবার সন্তান এবরশন করলে ভয়ঙ্কর খেসারতের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। এছাড়া রিমা নিজেও নেতিয়ে এসেছে। লড়াই করার পুঁজি কমে এসেছে। এবারই বোধহয় শেষ কনসিভ। চল্লিশের পরে মেয়েরা খুব কম কনসিভ করে। এছাড়া, সুমনকে বাধা দেওয়ার মতো শক্তি ভেতরে অবশিষ্ট নেই।

একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ সুমনের কানে আসতে থাকে রান্না ঘর হতে। এরকম গোঙানির শব্দ নতুন নয়। স্বাভাবিক সময়েও রিমার ভেতরে গোঙানি থাকে। মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা যখন তীব্র হয়ে জাগে মনে তখন রিমা গোঙায়। শত হলেও নারী তো! কতদিন বুকের জ্যান্ত স্বপ্নকে কবর দেবে? তবে কনসিভ সময়কালীন গোঙানি আলাদা। বেহুঁশ গোঙানি।

বাইরে শান্ত-সৌম্য সুমন গাঙ্গুলি। তাই বলে কি সুমন গাঙ্গুলির ভেতরের গোঙানির শব্দ কোনোদিন পৌঁছাবে না রিমার কানে? কোনোদিনই কি জানবে না রিমা? কী উত্তুঙ্গ বাসনা নিয়ে প্রহর কাটে তার! লুকিং গ্লাসের ভেতরের সুমনের সাথে কথা বলে সুমন। আর একটা সুমন গাঙ্গুলি রেখে যেতে পারব না আমি? কী বল তুমি? কী আমার অক্ষমতা? ঘরময় ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটবে একটি দুরন্ত শিশু। একটা দুরন্ত শৈশবের সাথে পরিচয় হবে না আমার? অপরাধ কোথায়? দিনে দিনে বেড়ে ওঠা, পায়ে পায়ে হাঁটতে শেখা, কিছুই দেখব না আমি! হিস্ করে চুল টেনে ধরে সুমন। নিজের সত্তাকেই নিজে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। গ্লাসের প্রতিমূর্তিকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে, সুমন গাঙ্গুলি হারবে না, হারতে পারে না।

অপ্রকৃতিস্থের মতো চিল্লিয়ে ওঠে সুমন, রিমাকে শুনিয়ে বলে, এবার যদি আমার বাচ্চা খুন করো! মায়ের দুধের কসম খেয়ে বলছি, আমি কিন্তু...।

পূর্ববৎ বেহুঁশ রিমা হতবিহবল। জলাতঙ্ক রোগীর মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে সুমনের চিল্লানোর চোটে। আর তখনই পেট খামচে ধরছে নিজের থাবাতেই। সুমনের একটি জীবিত ভ্রুণ এবার পণ করে ঢুকেছে পেটের ভেতরে, এবার বাঁচবে-ই! এত সতর্ক ব্যবস্থার পরেও কী করে ঠাঁই নিল পেটে!

সোফায় মাথা হেলিয়ে বেহুঁশ রিমার কথা ভাবে সুমন। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। সামান্য ছোঁয়ায় গুড়িয়ে যাবে ঘুণেধরা কাঠের মতো। তবু এই মেয়েমানুষটার কী জেদ! হার মানবে না। ঝড়ে পাল ছেঁড়া নৌকোর মতো সুমন এখন দিকহারা। তারুণ্যের বর্ণিল আবেগময় দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। জীবনের আরও গভীর চাওয়া থাকতে পারে, এ দূর কল্পনাতেও ছিল না। রিমাকে ছাড়া আরও চাইবার আছে রিমার কাছে, রিমার দেহ ফেঁড়ে আর একটা দেহ! উফ্! অসহ্য! বুক চাপড়ায় সুমন। কোথায় ঘাপটি মেরে ছিল এ চাওয়া! এ লোভ! এ লোভের জন্য এখন ভেতরে-বাইরে এত রক্তারক্তি!

[১০]

আমার ভীষণ ভয় করছে : রিমা

বছরান্তে একবার অন্তত শিপার সাথে দেখা করে রিমা। গ্রীষ্মের ছুটিকেই বেছে নেয়। ক্যাম্পাস লাইফের বন্ধুরা কে যে কোথায় এখন? উত্তরায় থাকে শিপা। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে ওর হাজবেন্ড। শিপা নিজে কিছু করে না। একটা স্কুলে কিছুদিন চাকরি করে ছেড়ে দিয়েছে। এখন রাধো, খাও, ঘুমাও, বাচ্চা স্কুলে নাও, আনো—এ করে কাটে দিন। দু’জনের বন্ধুত্বের আঁটুনি এখনো মজবুত। বিশেষত, শিপা রিমার কষ্টটাকে স্পর্শ করতে পারে। হেয়ালি করে রিমা বলে, দোস্ত, আর জন্মে তুই আমার মা ছিলি নির্ঘাত। নইলে কী করে পড়িস আমার মনের সব কথা!

বুকের ভেতরটা উচাটন হয়ে ওঠে রিমার, মাকে দেখতে ইচ্ছে করে, মায়ের কোলে একবার মাথা রাখতে ইচ্ছে করে। শুনেছে, বাবা নাকি বাঁচা-মরার লড়াইয়ের সন্ধিক্ষণে। যেতে বড় ইচ্ছে হয়, কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরে ছোট ভাইটা চিঠি লিখে জানিয়েছিল, মা-বাবা দু-জনেই দিব্যি কেটেছে, ইহজীবনে আর মেয়ের মুখ দেখবে না। গ্রামের লোক ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ত্যাজ্য করেছে মেয়েকে। এছাড়া গ্রামে টিকতে পারত না। দীর্ঘশ্বাস কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে যখন ভেতরে দাহ শুরু হয়, মনের ভেতরে প্রকাণ্ড ভার জমে ওঠে, তখনি রিমা ছুটে যায় উত্তরায়। শিপাকে সব বলে মনকে ভারমুক্ত হয়। ভেতরের দাহ ঠাণ্ডা করে।

সুমন সাধারণত বাধা দেয় না। বরং উৎসাহ দেয় বরাবর। উত্তরা ঘুরে এলে রিমা বেশ চনমনে আর ফ্রেশ হয়ে ওঠে। এবারই প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়াল, এবার তোমার ঢাকায় যাওয়া হবে না। রিমা বিস্ময় প্রকাশ করে, কিন্তু কেন! সুমন মুখ ভার করে বলে, এভাবে পরের বাসায় গিয়ে থাকাটা ভালো দেখায় না। তোমার বান্ধবীকে তো দেখলাম না একবারও আমাদের বাসায় আসতে।

হঠাৎ গ্রীষ্মের রোদজ্বালা দুপুরের তপ্ততাপ লাগে রিমার ফুসফুসে, তাই মৃদু শ্বাসকষ্ট অনুভব হয়। কিন্তু এখনি বের হবার তাড়া, গাড়ির টিকেট কাটা, দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বলে, এ জগতে কে-ই বা রিমার আপন আছে? শিপা একটু প্রশ্রয় দেয়। তাই যাই আর কি।

ঢাকার সিচুয়েশন ঘোলাটে। মিছিলের শহর এখন। রাস্তায় গাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। টানা হরতাল আসছে। রিমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করায় সুমনের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে।

এদেশে এসব কবে থাকবে না, বলো তো সুমন? সত্যটা বলো না কেন? অবিশ্বাস! অবিশ্বাসের রোগে ধরেছে তোমাকে। ভয় ভয় ঠেকছে, ঠিক না? রিমার চোখে-মুখে রহস্যভরা হাসি।

রিমার চোখের দিকে তাকাতেই ভয় সুমনের। মেয়েমানুষটার চোখে যেন সূর্য জ্বলছে। অনির্দিষ্ট দিকে তাকিয়ে রুষ্ট কণ্ঠে বলে সুমন, কিসের অবিশ্বাস? কাকে অবিশ্বাস? ভয় কিসের? আমি কাউকে ভয় পাই না। তুমি কি ভাবছো, আমি অয়নকে ভয় পাই?

বিদ্রূপের হাসি রিমার ঠোঁটে, এখন তুমি অয়ন ভাইকেও সন্দেহ করো। এ মানুষটা ছাড়া বিপদে-আপদে তোমার-আমার পাশে কে দাঁড়ায়? মানুষকে চেনার তো শেষ নেই। তবু আমি দাবি করতে পারি, তোমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধি পর্যন্ত আমি ধরে ফেলতে পারি। 

ক্রুর চোখে তাকায় সুমন। কিন্তু মুখে হাসিহাসি ভাব ফুটিয়ে বলে, যতোই দেনদরবার করো সোনা, এবার কিন্তু আমি কিছুই মানছি না। অবশ্য কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে।

তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াও, লেখালেখি করো, নিজেকে বুদ্ধিজীবী দাবি করো, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও দেখি—একটা বিশ্বাসের আয়ু কত দিন বা কত মাস অথবা কত বছর কিংবা কত ঘণ্টা? কত মিনিট বা সেকেন্ড?

সুমনকে কথার জালে আটকে ফেলেছে রিমা। বাইরে শান্ত হলেও ভেতরে ভয়ানক অশান্ত সুমন। সত্য ভয়টা মুখ ফুটে বলা যাচ্ছে না, আবার না বলার খেসারতও দিতে হচ্ছে। রিমার এ মূর্তি সুমনের সম্পূর্ণ অচেনা।

মানুষের বিশ্বাস একখণ্ড জমাটবদ্ধ বরফ। অবিশ্বাসের তাপ লাগলে তা আর ঠেকানো যায় না। গলে নিঃশেষ হয়ে তবে থামে। এ কথাগুলো তোমার সুমন। তুমিই বলেছিলে একদিন। সুমনের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে কথা বলে রিমা। পালাই পালাই ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুমন।

কী মাত্রায় যে বদলে গেছ তুমি, আমি তাই ভাবছি। রিমাকে এখন আর তোমার দরকার নেই। দরকার তার পেট ছিঁড়েফেঁড়ে বেরোবে যে ফল তার। ঠিক কাঁঠালের মতো—ভেতরের কোষগুলো টেনে তুলে কাঁঠালের পেটটাকে যেমন ডাস্টবিনে ফেলে মানুষ।

এবার রিমা সুমনের নিশ্বাসের কাছাকাছি পৌঁছায়। বুকের উপরে মাথা ফেলে। দুই হাতে জাপটে ধরে সুমনকে। তোমাকে কথা দিয়েছি সুমন, তুমি বিশ্বাস রাখ, এবার আমি মা হব। এতকাল তোমাকে ঠকিয়েছি, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ঠকেছি আমি। সুমনের লোমশ বুকে উটপাখির মতো মুখগুঁজে বিলাপ করে রিমা, দেখো তুমি, বিশ্বাস করো তুমি, তোমার বুকে মাথা রেখে দিব্যি কেটে বলছি। এখানেই আমার স্বর্গ। এখানেই আমার জীবন-মরণ, এখানেই আমি জমা রেখেছি আমার সমস্ত বিশ্বাস। আমি দিব্যি কেটে বলছি, এবার আমি মা হব সুমন, এবার আমি মা হব...

[চলবে]

লেখক  : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)

 

 

0 Comments

Post Comment