ভর

  • 20 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 213 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
একদিন হঠাৎ শুনলাম ঘোষেদের মেজবউকে ভূতে ধরেছে। সে নাকি এখন আর কারো কথা শোনেনা। মেজবউ যেন ভুলে গেছে সে কালো, ভুলে গেছে যে ঘোষেদের কুলপ্রদীপকে সে বাঁচাতে পারেনি। দিনের পর দিন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে মেজবউ। মেজবউয়ের সন্তান মারা যাওয়ার প্রায় একমাস পর থেকে প্রতিদিন গভীর রাত্রে ঘোষেদের বাড়ির ছাদে কাকে যেন ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।

‘এমন শিক্ষা তোমায় দেব না যে সাত জন্মেও ভুলতে পারবে না।’ কথাটি নিজের জীবদ্দশায় শোনেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। লোকে বলে বটে কিন্তু এমন শিক্ষা দান করা বা লাভ করা খুব একটা সহজ নয়। ঘোষেদের মেজ বউ এমনই উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে তার শ্বশুরবাড়ির সকলকে।

আমাদের প্রতিবেশী ঘোষেদের মেজবউটি ছিল ভারি নিরীহ।  চুপচাপ সারাদিন পরিবারের সকলের ফাইফরমাশ খাটার পর তার দু’বেলা দু’মুঠো আহার জুটতো। তার মানে এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে ঘোষেদের অবস্থা খুব খারাপ। আর্থিক দিক থেকে তারা সচ্ছ্বলই বটে। ঘোষেদের পারিবারিক বড় মিষ্টির ব্যবসা আছে। কলকাতা শহরের এদিকে ওদিকে ওদের বেশ কয়েকটা মিষ্টির দোকান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। উচ্চশিক্ষা লাভ করে সরকারি চাকরির জন্য ছোটাছুটি করা কিংবা তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করার প্রয়োজন ঘোষবাড়ির ছেলেদের এ পর্যন্ত কখনও হয়নি। তারা সকলেই ন্যূনতম শিক্ষা কোনোক্রমে অর্জন করেই পৈতৃক ব্যবসার হাল ধরতে উদ্যোগী হয়েছে। ঘোষেদের ছোট কর্তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলেদের ব্যবসায়িক বুদ্ধির জোরে দিন দিন ওদের অবস্থা আরও ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করলো। ওদের এই সমৃদ্ধি দেখে পাড়ার অনেকেরই গায়ে জ্বালা ধরে গেল। ছোটো ছেলের বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও তার আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। বড় ছেলের বউ বছরের বেশিরভাগ সময়ই নানা প্রকার অসুখে পড়ে। সে তার পাঁচ বছরের ছেলেটিকে নিয়ে বারো মাসে তেরো বার বাপের বাড়িতে গিয়ে অনেকদিন কাটিয়ে আসে। সকলেই বোঝে বড়বউয়ের গৃহকর্মে তেমন কোন রুচি নেই। তাই হেঁশেল ঠেলবার ভয়ে সে বাপের বাড়ি পলায়ন করে। ঘোষেদের দুই মেয়ের যেন শ্বশুরবাড়িতে মন টিকতেই চায় না। কারণে অকারণে তারা বাপের বাড়িতে এসে মাসের পর মাস থেকে যায়। ঘোষ গিন্নি মেজো ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনে তাকে সংসারের সমস্ত কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়ে গৃহস্থের সকল ক্রিয়াকর্ম থেকে নিজে অবসর নিলেন। ঘোষেদের বাড়িতে এর আগে ঠিকে কাজের জন্য এক পরিচারিকা ছিল। সেই ঝি এর দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বভাবের জন্য মনে মনে অসন্তুষ্ট হয়েও তাকে তোষামোদ করে রেখে দিতে ঘোষ গিন্নি বাধ্য হতেন। এরপর ঘরে মেজবউ এসে যাওয়াতে সেই ঝিকে আর ধরে বেঁধে কাজে বহাল রাখার প্রয়োজন হয়নি। এ পাড়াতে আমাদের বাড়িসহ আরও অনেক বাড়িতেই কাজের মেয়েটি কাজ করে আর ঘোষেদের কথা উঠলেই সে সবাইকে একই কথা বলে, ‘দেখই না মেজবউ কতদিন এদের জুলুম সহ্য করে। সেও একদিন পালাবে শেষে বাপের বাড়ি। তারপর আবার আমাকেই কাজ করার জন্য হাতে পায়ে ধরে নিয়ে যেতে আসবে। তা আমি আর ওমুখো হই কখনও’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেই থেকে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা থেকে শুরু করে ননদদের বিচিত্র সব আবদার পূরণ, চৌদ্দ গুষ্টির রান্নাবান্না, ঘর গেরস্থালির কাজকর্মের সমস্ত দায়িত্বভার এসে পড়লো একা মেজবউয়ের ওপর। দোতলা বাড়িতে সর্বক্ষণ ওপর-নিচ করতে করতে তার দম বেরিয়ে যেত। এক দণ্ড বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগও তার শাশুড়ি তাকে দিত না। ঘোষেদের মেজবউ আমার পূর্বপরিচিত। সে আমার সঙ্গে একই কলেজে পড়তো। আমার শ্বশুরবাড়ির ঠিক পাশের বাড়িটাই ঘোষেদের। বিয়ের পর ওদের মেজবউ ছাদে ভিজে কাপড় মিলতে উঠতো আর আমার সঙ্গে প্রায়ই তার দেখা হয়ে যেত। তারপর ছাদে দাঁড়িয়ে দু’জনে অনেকক্ষণ সংসারের সুখ-দুঃখের অনেক গল্প করতাম। মনে হত ঘোষেদের মেজবউ আমার সঙ্গে কথা বলে প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে পারতো, তাই একবার আমাকে পেলে সে সহজে ছাড়তে চাইতো না। আমার সঙ্গে গল্প করে ছাদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া তার শাশুড়ি একদম পছন্দ করতেন না। তাই একদিন এই নিয়ে বাড়িতে একপ্রস্থ ঝামেলা হওয়ার পর থেকে ঘোষেদের মেজবউ আর আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইতো না।

ঘোষেদের মেজবউয়ের নাম কৃষ্ণপ্রিয়া। কৃষ্ণপ্রিয়ার জন্ম যে বছর হয়েছিল সেই বছর ওর জন্মের দিন জন্মাষ্টমী পড়েছিল। তার বাবার অনেক আশা এবং মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে পরিবারের প্রথম সন্তান যখন জন্মাষ্টমীর মত শুভ দিনে পৃথিবীতে আসছে তখন নিঃসন্দেহে সে গোপালই হবে। কিন্তু বাবা-মা উভয়ের পুত্র প্রাপ্তির সকল আশাকে বিফল করে দিয়ে কৃষ্ণপ্রিয়া তার কালো রূপ নিয়ে কন্যাসন্তান হয়ে ভবে অবতীর্ণ হয়। বাবা নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে তাই মেয়ের নামের মধ্যে ‘কৃষ্ণ’ নাম রেখেই দিলেন। এর কয়েকবছর পর কৃষ্ণপ্রিয়ার ভাই জন্মগ্রহণ করে। বাবা-মায়ের পুত্রসন্তানের অভাব মেটার পরেও কৃষ্ণপ্রিয়ার প্রতি তাদের স্নেহ কোন অংশে বৃদ্ধি পেল না। যখন ঘোষেদের মত বড় ও সচ্ছল সম্ভ্রান্ত পরিবারে মেয়ের বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল তখন কন্যাদায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরে কৃষ্ণপ্রিয়ার বাবা ও মায়ের আনন্দের সীমা রইল না। ঘোষেদের মেজবউ কালো হলেও রূপবতী। তার বড় জা গাত্রবর্ণ নিয়ে তাকে অপমান করে আনন্দ পাওয়ার সুযোগ পেলে কখনই ছাড়ে না। মেজবউ নিজের রঙয়ের অভাব শ্বশুরবাড়িতে এসে সেবা দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিল। তার এই সেবাধর্মের কারণে বাড়ির সকলের অভ্যাস খারাপ হয়ে গেল। অবশেষে এমন পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ালো যে, মেজবউ ব্যতীত সংসার অচল। মেজবউয়ের যদি কখনও জ্বর কিংবা শরীর অসুস্থ হত সেই অসুস্থতা নিয়েই সারা বাড়ির কাজ তাকে একা হাতে সারতে হত এবং পান থেকে চুন খসলেই শাশুড়ি ও ননদদের অপমান পড়ে থেকে থেকে সহ্য করতে হত। সকলেই জানতো বিনম্রতার প্রতিমূর্তি তাদের মেজবউয়ের কোথাও পালানোর উপায় নেই। তবে ধীরে ধীরে মেজবউয়ের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়তে থাকলো। খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম, অতিরিক্ত পরিশ্রম, ভালো চিকিৎসা ও যত্নের অভাবে সে প্রায়ই দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলো। শরীরের সঙ্গে বোধ করি তার মনটিও ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

তারপর একদিন শুনলাম ঘোষেদের মেজবউ নাকি সন্তানসম্ভবা। এই পরিস্থিতিতে মেজবউয়ের যত্ন নিতে হবে শুনে ননদেরা তাদের শ্বশুরবাড়ি এবং বড় জা নিজের বাপের বাড়িতে চলে গেল। মেজবউয়ের যতটা সেবা এ অবস্থায় পাওয়া স্বাভাবিক ছিল তা সে বলতে গেলে কিছুই পেল না। তার স্বামীটিও বাড়ির অন্যান্য পুরুষদের সঙ্গে ব্যবসার কাজে সারাদিন বাইরে থাকে। বউয়ের যত্ন নেওয়ার কথা তার মনেও পড়ে না। ডাক্তার মেজবউয়ের স্বাস্থ্যের জন্য হাজার রকম বিধিনিষেধ আরোপ করলেও মেজবউয়ের তা অধিকাংশই সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে মেনে চলা সম্ভব হয়নি। তবে মেজবউ দিবারাত্র ঈশ্বরের কাছে নিজের সন্তানের মঙ্গল কামনায় নিয়মিত প্রার্থনা করতো। সে বলতো, ‘ঠাকুর আমার যা হয় হোক কিন্তু আমার সন্তানকে তুমি সুস্থ রেখো।’ অবশেষে একদিন মেজবউয়ের প্রসব যন্ত্রণা উঠলে তাকে বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। নাতির মুখ দেখার জন্যে শাশুড়ির উৎসাহের অন্ত ছিল না। তিনি নাকি পূর্বদিন রাত্রেই ঘুমের মধ্যে গোপালের আগমনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু মেজবউ তার সেই ইচ্ছাটিও পূরণ হতে দিল না। সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে মেজবউ এক মৃত সন্তান প্রসব করলো। ডাক্তার জানালেন গর্ভস্থ সন্তান অনেক আগেই মারা গেছে। মৃত সন্তান এতকাল জঠরের মধ্যে থেকে যাওয়াই পীড়ার একমাত্র কারণ। ঘোষ পরিবারের মাথার ওপর এই প্রথম এত বড় বজ্রপাত হল। মেজবউয়ের দুর্বল স্বাস্থ্যের কথা কেউ একবারও চিন্তা করলো না। শাশুড়ি ও ননদেরা সকলেই তাকে ‘অলক্ষ্মী’, ‘অপয়া’, ‘ডাইনি’ ইত্যাদি নানা অভিধায় ভূষিত করে নিজের সন্তানকে নিজেই খেয়ে ফেলার গুরুতর অপরাধে তাকে পরিত্যাগ করার ভয় দেখাতে লাগলো। সবাই মেজবউয়ের অপরাধের গুরুত্ব বিচার ও তার শাস্তি বিধান করতে তৎপর হল কিন্তু এক সন্তানহারা মায়ের অপার বেদনার প্রতি কেউ সামান্য সহানুভূতিটুকুও দেখালো না। নিজের কালো রূপের জন্য মেজবউ সংসারে এমনিতেই নিজেকে সবসময় গুটিয়ে নিয়ে সংকুচিত হয়ে থাকতো, এই ঘটনার পর সকলের চক্ষুশূল হয়ে উঠে সে যেন একেবারে বিন্দুর মত মিলিয়ে যেতে থাকলো।

তারপর একদিন হঠাৎ শুনলাম ঘোষেদের মেজবউকে ভূতে ধরেছে। সে নাকি এখন আর কারো কথা শোনেনা, কাউকে তোয়াজ করে না, সকলের খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে না, ননদদের ফাইফরমাশ খাটে না, শাশুড়ির সঙ্গে সে কেবল ঝগড়া করে। মেজবউ যেন ভুলে গেছে সে কালো, ভুলে গেছে যে ঘোষেদের কুলপ্রদীপকে সে বাঁচাতে পারেনি। দিনের পর দিন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে মেজবউ। কারো কোন অনুমতি ছাড়াই যখন যা ইচ্ছা হয় সে তাই করে। বড় জা বা ননদেরা কোন কথা শোনাতে এলে সে মারমুখী হয়ে তেড়ে যায়। বাড়ির কর্তার কানে মেজবউয়ের নামে অনেক অভিযোগই ওঠে। মেজবউকে তার স্বামী বা শ্বশুর এ সম্বন্ধে কোন কৈফিয়ত চাইতে এলে সে কোন প্রতিবাদ না করে বরং পরিবারে নিজের গুরুত্ব ও অবস্থান তাদেরকে ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। মেজবউয়ের মুখে এখন আর কোন মিষ্টি কথা নেই, তার মুখ থেকে সব হাসি মুছে গিয়েছে, চোখে-মুখে কেবলই একটা উগ্রতার ছাপ। দিনের বেশিরভাগ সময় নিজেকে সে একাকী ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখতে ভালোবাসে। মেজবউয়ের খিদেও যেন অনেক বেড়ে গেছে। শাশুড়ির অনুমতি ছাড়াই যখন যেটা ইচ্ছা হয় ফ্রিজ থেকে বের করে খেয়ে ফেলে। কারো নিন্দার ধার ধারে না। লোকমুখে এও শোনা যায় ঘোষেদের মেজবউয়ের সন্তান মারা যাওয়ার প্রায় একমাস পর থেকে প্রতিদিন গভীর রাত্রে ঘোষেদের বাড়ির ছাদে কাকে যেন ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।

একদিন মধ্যরাত্রে আমার ঘুম কি কারণে যেন ভেঙে গিয়েছিল। রাত তখন আড়াইটে বাজে। হেমন্তের শেষ রাত। উত্তুরে ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎই ঘোষেদের ছাদটা একবার দেখার জন্য কৌতূহল হল। যারা গল্প রটিয়েছিল তারা এমন নিশুতি রাতের কথাই বলেছিল। তারা বলেছিল, বংশের উত্তরপুরুষ মারা গেছে সেই শোকে ঘোষেদের কোন এক অতি দূর অতীতের পূর্বপুরুষের অতৃপ্ত আত্মা ওপর থেকে নেমে এসে বিক্ষুব্ধ পদচারণ করে বেড়ায় ঘোষেদের এই পুরাতন পৈতৃক ভিটের ছাদজুড়ে। ঘোষেরা নিজেরাও ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে সারা রাত। তাদের দেখলে মনে হয় এই গল্প তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছে। তাই তারা রাত ন’টার মধ্যে তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে যে যার ঘরের ভিতর ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম না এলে সারা রাত ছাদের ওপর ধুপধাপ প্রেতের পদধ্বনি শোনে। যদি কখনো কারোর উঠবার প্রয়োজন হয় তবে সে তাদের কুলগুরুর দেওয়া রক্ষাকবজ মুঠোয় বন্দি করে ঘরের বাইরে পা ফেলে। ঘোষেরা যে বাড়িকে ভূত মুক্ত করার কোন প্রয়াস করেনি তা নয়। এলাকার সবচেয়ে জাগ্রত কালীবাড়ি থেকে মন্ত্রসিদ্ধ তান্ত্রিককে ধরে এনে অনেক টাকা খরচ করে গোটা বাড়ি স্বস্ত্যয়ন করিয়েছিল। বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো ও যজ্ঞ করে ব্রাহ্মণদের অনেক দান-ধ্যান করেছিল। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয়নি। উপরন্তু ভূতের উপদ্রব আরও বেড়ে গেল। মেজবউয়ের আচরণও তখন থেকেই বদলে যেতে থাকলো। তাই সকলের দৃঢ় বিশ্বাস হল যে মেজবউকে ভূতে পেয়েছে। অনেক রাতে দু’একজন প্রতিবেশী ঘোষেদের ছাদের ওপর মেজবউকে ঘুরে বেড়াতে স্বচক্ষে দেখেছে। আমি গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে নিয়ে ছাদে উঠে গেলাম। ধুপ করে একটা শব্দ কানে আসতেই চোখ পড়লো ঘোষেদের ন্যাড়া ছাদের ওপর। দেখলাম কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের দশমীর চাঁদের আলো এসে পড়েছে ছাদের একদিকে। ছাদের অন্যদিকে অন্ধকারের মধ্যে যেন কিছু নড়েচড়ে উঠলো। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝলাম একটা নারীর ছায়ামূর্তি পাশের নারকেল গাছ থেকে সদ্য ছাদের ওপর ঝুপ করে পড়া একটা ঝুনো নারকেল হাতে তুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে গলা তুলে ডাকলাম, ‘কৃষ্ণপ্রিয়া’। মেজবউ যেন একবার চমকে উঠলো। তার হাত থেকে নারকেলটা নিচে পড়ে গেল। তারপর আমাকে দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে সে এগিয়ে এসে চাঁদের আলোয় দাঁড়ালো। আকাশপ্রদীপের শিখার মতই সে যেন স্নিগ্ধ অথচ নিজের ক্ষুদ্র দীপ্তিতে উদ্ভাসিত করছে রাতের ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ। মেজবউ বলল, ‘এই নামে তো বহুকাল আমাকে কেউ ডাকেনি। ‘মেজবউ’এর প্রতাপে নামখানি অনেকদিন আগে শুকতারার মত মিলিয়ে গিয়েছিল।’ আমি বললাম, ‘তুমি রোজ এত রাতে ছাদে এসে কী কর?’

মনে হল সামান্য হেসে মেজবউ বলল, ‘সুখ খুঁজি।’ আমি বললাম, ‘পেত্নীর কি সুখের কোন প্রয়োজন আছে?’ সে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল, ‘আছে। এতকাল আমার অতৃপ্ত আত্মা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। এখন আমাকে ভূতে ধরতেই সে আত্মা যাতনার থেকে মুক্তি পেলো। 

লেখক : শিক্ষার্থী, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

 
0 Comments

Post Comment