- 27 November, 2022
- 0 Comment(s)
- 234 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
মাঝারি গড়নের তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়সের মেয়েমানুষটিকে যে কয়দিন দেখেছি, প্রতিদিনই দেখেছি লাল রঙের একটি ম্যাক্সি পরিহিত। পিঠে মেঘমেদুর দীঘল চুলের সমাহার। সূর্যাস্তের কয়েক মুহূর্ত আগে দেহকে সরল রেখার মতো সোজা করে দাঁড়ায় দোতালার বারান্দা। রোদোজ্জ্বল মুখখানি উঁচিয়ে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন মাথার মধ্যখানের সিঁথির রেখাটাও স্পষ্ট দেখা যায়। সায়ংকালের লাল রং মুখের উপরে পড়ে। আশ্চর্য এক স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। এতোটা নিঃশব্দে আর মগ্নচিত্তে সূর্যাস্ত উপভোগ করে যে, মনে হয় কয়েক হাজার বছর ধরে মেয়েমানুষটি সূর্যাস্তের অপেক্ষা করে আসছে এভাবেই, এখানেই। আমি যুবক, হতেই পারে এই দৃশ্য দেখার লোভ; কিন্তু কোন ভদ্রলোকের স্ত্রীর দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকাটাও তো চূড়ান্ত অভদ্রতা সামাজিক অপরাধ। মেয়েমানুষটিই বা কিভাবে নেবে কে জানে।
আমার কাজের মেয়ে রাকিবের মা বড্ড বেশি কথা বলে। তাই ওর কথায় কান দেই না। এ কথায় সে কথায় হঠাৎ একদিন বলে, মানুষটা কী পাষণ্ড গো! অমন চান্দের মতো সুন্দর বৌডারে পিডায় হররোজ। ভেবেছি, ওর বস্তির কারো কথা বলছে হয়তো। খেয়াল করে দেখেছি, সপ্তাহে একবার, কোন
সপ্তাহে দু-বার তিনবার একই কথা বলে, মানুষটা কী পাষণ্ড গো! বৌডারে খালি পিডায়। এই পর্যন্তই বলে। আমার দিক থেকে কোন সাড়া পায় না বলেই আর এগোয় না। এদিন আমি ওর কথার প্রত্যুত্তরে বললাম, এই যুগেও মানুষ বউ পেটায়?
সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির বাসায় কাজ নিয়েছে এবং এ কয়দিন ধরে তার কথাই বলছে। রাকিবের মার মুখে যাবতীয় বৃত্তান্ত শুনে যা বুঝেছি, তা রীতিমতো আতঙ্কের ব্যাপার।
সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির স্বামী একটি প্রাইভেট ব্যাংকের দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিজীবী। ওদের পাঁচ-ছয় বছরের একটি পুত্রসন্তান। বদরাগী স্বামী নানা ছুতোনাতায় স্ত্রীর শরীরে হাত তোলে। খুব মারাত্মকভাবে মেরে জখম করে। এরমধ্যে একবার হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছিল। কেন এভাবে পড়ে মার খায়? এই প্রশ্নের উত্তরে রাকিবের মা’র সরল যুক্তি, মাইয়া মানুষ। একবার সাদী হয়্যা গেলে কী করার থাকে? এরমধ্যে এক ছেলের মা। এই সরল যুক্তির বিপরীতে আমি কোন যুক্তি দাঁড় করাতে পারি না।
নারীকে শোষণের প্রধান দু-টি অস্ত্র-উর্বরতা ও অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা—দু-টিই পুরুষটির হস্তগত। এভাবে নির্যাতন করা তার অধিকারের মধ্যে পড়ে, আর মুখবুঁজে মার খেয়ে যাওয়াটাও মেয়েমানুষটির কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেন যারা, তারা ঘোর আপত্তি করবেন নির্ঘাত। পুরুষতন্ত্র, নারীবাদ এই সব নিয়ে গবেষণা করার প্রবৃত্তি আমার নেই। মাঠের বাস্তব বলে একটা কথা আছে।
এরপর সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটিকে দেখার লোভ আরও বেড়ে গেল। সেদিন ছুটির দিন না হলেও কাজ অসামাপ্ত রেখে বিকেলেই বাসায় ফিরে আসি এবং সূর্যাস্তের পূর্বে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। প্রায় সূর্যাস্ত হতে চলছে কিন্তু তার উপস্থিতি না ঘটায় আমি হতাশ এবং সেইসঙ্গে ভীষণ উদ্বিগ্ন। রাত নেমে এলে আমার কেবলি মনে হয়, মেয়েমানুষটি নিশ্চয় স্বামীর হাতে মার খেয়ে কলে-পড়া ইঁদুরের মতো থ্যাঁতলানো মাথাগুঁজে পড়ে আছে বিছানায় অথবা হাসপাতালের বিছানায়। তাই আজ তার প্রিয় সূর্যাস্ত দেখার রুটিন কাজে বেরোয়নি।
আশ্চর্য এক স্বপ্ন রাতভর তাড়া করে ফেরে—আমি শৈশবকালে ফিরে গেছি, এমন একটি বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি, যে বাড়িটির চারদিকে চারটে ঘর, ঘরগুলো ছনের ছাউনির, পাটকাঠির বেড়া মাটি দিয়ে লেপা। উত্তরের ঘরটি থেকে একজন মেয়েমানুষকে পেটানোর শব্দ শুনতে পাই, কানে আসে মেয়েমানুষটির আকুতিমিনতির শব্দাবলি, একটি শিশুকণ্ঠের ভয়ার্ত চিৎকারও শুনতে পাই। ঘুম ভেঙে গেলে স্বপ্নটি অসমাপ্ত রয়ে গেল। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটিকে নিয়ে বেশি ভাবার ফল এই ধরনের স্বপ্ন। বিষয়টিকে এতোটা সিরিয়াসভাবে নেয়া ঠিক হচ্ছে না। মন থেকে মুছে ফেলে স্বাভাবিক হতে হবে। এভাবে কতো মেয়েমানুষই প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে পাষণ্ড স্বামীর হাতে দেহ-মনে মার খায়, আমি একা তার বিরুদ্ধে যাই কেন?
বয়স তিরিশ পেরিয়ে গেলেও সংসার করার কথা ভাবি না। সংসারের সাথে আমার তেমন কোন বন্ধন নেই। ইচ্ছে করেই কঠিন ব্যস্ততার এক চাকরির মধ্যে ডুবে আছি। স্ত্রী, সন্তান, সংসার এসবের মোহ আমার কাছে ঘুঘুর ফাঁদ। জেনেশুনেই এই ফাঁদে পা দিচ্ছি না। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটি এই
ফাঁদে পড়ে গেছে। এখন এভাবেই জীবন চলবে।
একদিন বিরতি দিয়ে রাকিবের মার উপস্থিত যেদিন, সেদিন ছুটির দিন। ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। গেটের চাবি ফেলে দরজা খুলে দিয়ে ফের বিছানায় শুয়ে পড়ি। রাকিবের মা ঘরে ঢুকেই গজগজ করতে লাগল রাগে, ক্রোধে। একজন মানুষকে খুন করা তার জরুরি প্রয়োজন, কিন্তু সামর্থ্য
আর শক্তিতে কুলোচ্ছে না বলে এখন মেনে নিচ্ছে অসহ্য ক্রোধ আর ঘৃণা নিয়ে। আমি বুঝতে পারি, ওর সমস্ত ক্রোধই সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির স্বামীর ওপরে। লোকটা আজ আবার বউ পিটিয়েছে কি না? এই প্রশ্নের উত্তরে গাঢ় শ্বাস ফেলে ছোট্ট করে জবাব দেয় রাকিবের মা, হুম। লোকটা পাগল কি না? আমার কথার প্রত্যুত্তরে ক্ষেপে ওঠে রাকিবের মা, পাগল! পাগল!! শেয়ানা পাগল। কিন্তু কী নিয়ে ওদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, তুমি জানো কিছু? এভাবে মার খেতে হবে কেন? এ বিষয়ে কিছুই জানে না রাকিবের মা এবং মেয়েমানুষটিও মুখ ফুটে কিছু বলে না।
ছুটির দিনটি যে ছন্দে কাটে, কেন জানি এই দিনটা সেভাবে কাটেনি। দুপুরের খাবারের পর ঘুম আসেনি। বিকেল হতে না হতে এক প্যাকেট সিগারেট শেষ। ভীষণ অস্থির আর অবর্ণিত একটি ব্যথা অনুভব করছি বুকের ভেতরে। মনে পড়ে, ছেলেবেলায় এই ধরনের ব্যথা প্রায়ই অনুভব করতাম। ধীরে ধীরে এই ব্যথাটা হারিয়ে যায়। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির কথা অতিরিক্ত ভাবছি বলে কি না এই ব্যথার উজান। কিন্তু এখানে আমি কী করতে পারি? ধরে নিলাম, তার জন্যে আমার মধ্যে একটা গভীর সহানুভূতি জন্ম নিয়েছে। আমি তাকে এই নরক-পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করতে চাই। তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে পারি। এজন্য প্রথমে তার সাথে আলাপ করা প্রয়োজন। কিন্তু আমি তার কে? সে এই বিষয়টি নিয়ে আমার সাথে শেয়ার করতে আসবেই বা কেন? তারপর ধরা যাক, আমি মেয়েমানুষটির স্বামীর কাছে জানতে চাই, কেন সে এমন নির্দয়ভাবে তার স্ত্রীকে পেটায়? এই পেটানোর পেছেনে তার কী যুক্তি আছে? কিন্তু সে মানুষটির স্বভাবের,
তার ক্ষমতার দৌরাত্ম্য এসব কিছু আমার জানা নেই। আর তার স্ত্রীকে সে পেটাবে, আমি বলার কে? সামাজিক দায় অথবা মানবিকতা অথবা নারীর অধিকার ইত্যাদি যে কোনো একটি প্রসঙ্গ টেনে তার মুখোমুখি দাঁড়ানো যায় বটে, কিন্তু তার পরিণাম কী হতে পারে তা ভেবেও আমি বিচলিত। এই ভাবনাগুলো যতোক্ষণ ধরে ভাবছি, বুকের অবর্ণিত ব্যথাটা কিছুটা কমে এসেছিল। এখন ধীরে ধীরে সেই ব্যথাটা উজানে। এই ব্যথাটাকে আমি চিরতরে ভুলে যেতে চাই বলে আমি আমার শৈশবকে মনে করি না। কেন আমি মেয়েমানুষটির কথা এতো ভাবছি, ভাবনার সাথে সাথে বুকের ব্যথাটা উজিয়ে ওঠে কেন, এই দু-য়ের সাথে আন্তঃযোগটাই বা কোথায়, এসব ভাবনার
অবসান হওয়া দরকার।
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে কেবল, আমি এরমধ্যেই অন্তত পাঁচবার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির মুখে অস্তগামী সূর্যের লাল আলো পড়ে যে স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়, সেই দৃশ্য আজ কী রূপে ধরা দেয় তাই দেখার ইচ্ছা থেকে উৎকণ্ঠিত। উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মেয়েমানুষটি বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। পরনে সেই লালরঙের ম্যাক্সি, মাথার এলোমেলো চুলগুলো পিঠের উপরে ছেড়ে দিয়েছে, নীলাভ রঙের একটি ওড়না ইউ-আকৃতি হয়ে বুকের উপরে পড়ে আছে আলগোছে। অত্যন্ত শান্ত ও ধীর পায়ে সে যখন ঘর থেকে বারান্দায় আসে, তখনি আমার চোখে চোখ পড়ে। আমার উৎকণ্ঠা মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে যায়।
ধীরে ধীরে সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে আসে। মেয়েমানুষটি তার স্বভাবসুলভ ভঙিমায় সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে কিছু একটা অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। সম্ভবত; আমার অতিরিক্ত তাকানোর ফলাফল হিসেবে এমন একটি অভিব্যক্তি প্রকাশ করে যে, আমার তাকে কিছু বলার আছে কি না? কিছু বলার তো অবশ্যই আছে। কেন এভাবে মার খাচ্ছেন? আম, বড়ুই, লিচু ইত্যাদি লোভনীয় কিছু চুরি করে পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়ার পরে গাছের মালিক দেখে ফেললে বালক যেমন ব্রিবত হয় এবং পালানোর জন্য পথ খোঁজে, আমার বাস্তব পরিস্থিতি তাই দাঁড়াল।
নারীজন্মের এ কী ট্রাজেডি! এর থেকে মুক্তি কি কোনদিনই পাবে না ওরা? সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির কথা ভেবে মধ্যরাত পার হয়ে গেল। রাতের শেষ প্রহরে ঘুমাচ্ছন্ন হতেই সেই দুঃস্বপ্নটা ভর করে চোখে। আজকের দুঃস্বপ্নটা আরও ভয়ঙ্কর, মেয়েমানুষটিকে দেখিনি, ছায়া দেখেছি শুধু, সেই ছায়াটিকে গরু পেটানোর লাঠি নিয়ে তাড়া করছে আর একটি পুরুষ ছায়া। উঠোনের ঠিকমধ্যে যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে আছি আমি, তার পাশ দিয়ে মেয়েমানুষটি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাড়ির উঠোনের মধ্যেই ঘূর্ণিপাক খায়। শেষপর্যন্ত আর নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। উঠোনে বেঁধে রাখা ছাগলের দড়ির সাথে পা আটকে পড়ে গেল। সামনে এসে দাঁড়াল পুরুষ ছায়াটি। এই দৃশ্যগুলি কেন দেখছি আর দেখার পরে পরেই বুকের অবর্ণিত ব্যথাটা এমন মারাত্মকভাবে উজানে ঠেলে ওঠে কেন, তার আমি কিছুই বলতে পারি না। এই বিষয়টাকে আর বেশিদূর এগোতে দেয়া ঠিক হবে না। সকালে মার খেয়ে বিকেলেই যে মানুষটি এমন ঠোঁট টেনে মৃদু হাসি উপহার দিতে পারে, সে নিশ্চয় স্বামীর হাতে মার খাওয়াটাকে খুব বেশি আমলে নেয় না। তার নিজের কোন একটা দুর্বল দিক আছে নিশ্চয়। তা না হলে এ যুগের কোন শিক্ষিত মেয়ে এভাবে মার খায় নাকি? অবশ্য আমার এসব ভাবনা নিতান্তই গা-বাঁচানোর জন্যেও হতে পারে।
এদিন রাকিবের মা আসতে দেরি করে। আমার বেরিয়ে যাবার তাড়াহুড়া দেখে ও নিজে থেকেই বলে, দেরি হয়্যা গেল। ঐ আপা আজ বিছানাগত। কালকের মারেই আজকে শরীলে আগুনের লাহান জ্বর আইছে। জ্বরে শরীর পুইড়া যাইবো যেন। আমার বেরিয়ে যাবার তাড়াহুড়ায় মারাত্মক ছেদ পড়ে। সম্পূর্ণ অবচেতন মনে হঠাৎ বলে ফেলি, আমার কিছু করার আছে। আমি এভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারি না। কিন্তু কী করার আছে, তাই ভাবতে পারছি না। বুকের অবর্ণিত ব্যথা সমস্ত বুকে ছড়িয়ে পড়লে আমার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয় না। রাকিবের মা কখন কাজ শেষ করেছে এবং সদর দরজা খোলা রেখে বেরিয়ে গেছে, টের পাইনি। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসি, আজ আর কোথাও বের হচ্ছি না। প্যান্ট-শার্ট খুলে লুঙি পরে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে বুকের অবর্ণিত ব্যথাটাকে চেপে ধরার জন্য বালিশ বুকের নিচে দিয়ে ডানাভাঙা পাখির মতো দুই হাত দু-দিকে ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকি। এই ব্যথাটা আমার মৃত্যুর কারণ হতে যাচ্ছে কি না, তাই ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কয়েকবার চেকআপ করার পরেও ব্যথার কোন প্রকার কারণ নির্দেশিত না হওয়ায় আমি ভীত-সন্ত্রস্ত। স্বামীর পাশবিক নির্যাতনে মেয়েমানুষটির শরীরে আগুনজ্বর, এই সংবাদটির সাথে আমার বুকের অবর্ণিত ব্যথাটির মিতালি হয়ে গেল কিভাবে এবং এর পেছনে কী রহস্য আছে আমি তার অনুসন্ধান করতে শুরু করি। জীবনের কোন একটি পর্বে এই ধরনের কোন ঘটনা দ্বারা আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম কি না, এই ধরনের অনুসন্ধানে আমি তেমন কিছু উদ্ধার করতে পারি না। বুকের ব্যথা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলে লক্ষ করি, আমার শরীরের ঘামে বিছানা ভিজে জবজব। এমন দুর্বল হয়ে পড়েছি যে, যেন মুগুর দিয়ে পিটিয়ে শরীরের হাড়-মাংস সব গুড়া করে ফেলেছে।
টানা দু-দিন রাকিবের মার অনুপস্থিতি আর আমার বুকের ব্যথার বাড়াবাড়িতে এখন সবকিছুই লণ্ডভণ্ড। ইচ্ছার বিরুদ্ধে একঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকি বারান্দায়। আমি লক্ষ করেছি, বারান্দায় এসে দাঁড়ালে আমার বুকের ব্যথা কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটি এখন কেমন আছে, জানার জন্য ভীষণ উদগ্রীব। রাতের খাবারের জন্য বাসা থেকে বেরোবার সময় একবার ভেবেছি, ওই ফ্লাটের কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় কি না, মেয়েমানুষটি এখন কেমন আছে? কিন্তু এটা একান্ত ঘরোয়া একটি ব্যাপার এবং মেয়েমানুষটি যে স্বামীর হাতে মার খেয়ে জ্বরে আক্রান্ত এ কথা কেউ নাও জানতে পারে। তখন ভারী বেকায়দায় পড়তে হবে।
তিনটি রোগাপাতলা রুটি আর ঠাণ্ডা সবজির তরকারি রাতের খাবার। একটি রুটি খেতে পারি, বাকি দু-টি রুটিই ফ্রিজে রেখে শুয়ে পড়তে গিয়ে দেখি, বিছানার চাদরটি এখনো ভেজা। চাদর পাল্টে নতুন একটি চাদর বিছিয়ে লাইট নিভিয়ে জিরো পাওয়ারের হলুদ বাল্ব জ্বালিয়ে শুতে যাচ্ছি এবং মাথা বালিশের উপরে রেখেছি মাত্র, ঠিক তখনি মনে হলো, নারীকণ্ঠের কেউ একজন ডাকছে আমাকে। রাত প্রায় এগারোটা, এতো রাতে রাকিবের মা আসবে কি? কে ডাকতে পারে? হন্তদন্ত হয়ে উঠে লাইট জ্বালিয়ে বুঝতে পারি, এ আমার নিতান্তই অবচেতন মনের ভুল। এই ধরনের ভুল ছেলেবেলা খুব ঘটত। সবসময়ই মনে হতো আমার পেছনে কেউ হাঁটছে, পেছন থেকে কেউ একজন ডাকছে। রাত হলেই মনে হতো, নারীকণ্ঠের কেউ মমতাজড়ানো কণ্ঠে আমাকে ডাকে, তখন আমার ঘুম ভেঙে যেত এবং আতঙ্কে কেঁদে উঠতাম দেখে নানি বুকের মধ্যে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে বলতেন, ভয় পাস ক্যানো? তোর মা তোরে ডাকে? তোর মা কবরে থাইকা তোরে ডাকে। তুই ভয় পাস না। আমার এই ভয় তাড়ানোর জন্যে ইউনুস কবিরাজের মাদুলি কোমরে বেঁধে দিয়েছিলেন। সেই মাদুলির দাগ এখনও আছে। বুকের অবর্ণিত ব্যথাটার মতো এই পিছুডাকটাও বড়ো হয়ে যাবার পরে হারিয়ে যায়। এতো বছর পরে কি আমি সেই ডাক শুনছি? নাকি পাশের ফ্লাটের মেয়েমানুষটাকে তার স্বামী এখন পেটাচ্ছে। অসহায় হয়ে আমাকে ডাকছে সাহায্যের জন্যে। রাতের শব্দ জোরে হয়। ঐ ফ্লাট থেকে মেয়েমানুষটির ডাক শোনারই কথা। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি, ঐ ফ্লাটের দো-তালায় মানুষের কোন সাড়া শব্দ নেই। বিছানায় শোবার পরে মনে হলো, আমার মা কেমন ছিল? মার স্মৃতি বলতে, অত্যন্ত ক্ষীণকায় অস্পষ্ট একটি ছায়াছবি ছাড়া কিছুই মনে পড়ে না। মার কোন ছবিও ছিল না। নানিদের বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড়ের পারিবারিক কবরস্থানে মার যে কবরটি, সেখানে ছেলেবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের ছবি আঁকতাম। নানি বলতেন, একটি ছবিও নাকি মার
মতো হয়নি। নানির বর্ণনামতে, মা শ্যামলা ছিলেন। বেশি লম্বা ছিলেন না। দেহের গঠন ছিল কলাগাছের মতো টানা। বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৬ বছর বয়সে। রোগ-শোকের বালাই ছিল না। শুধু সেই জ্বরের ধকলটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মনে মনে সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তার জন্যে এতো বছর পরে জন্মদাত্রীর কথা ভাবছি। এবং আকস্মিক এই সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলি যে, কাল-পরশু গ্রামে যাব এবং নানিদের পারিবারিক কবরস্থানে গিয়ে মায়ের কবর জিয়ারত করব।
কবর জিয়ারতের সিদ্ধান্ত নেবার সাথে কী মিল জানি না; নানির জংধরা ছোট্ট ট্রাংকটির কথা মনে পড়ল। নিতান্ত অবহেলায় আলমারির এককোণে ফেলে রেখেছি। খোলে দেখার প্রবৃত্তি না হবার একটিই কারণ। নানির সম্পদ ছিল দুটো স্বর্ণের বালা আর মোটা একটা চেইন, যা তার একমাত্র
কন্যা অর্থাৎ আমার মাকে দিয়েছিল। মা’র মৃত্যুর পরে বালাজোড়া ও চেইন এই ট্রাংকে রেখে চাবি কোথায় হারিয়ে ফেলেছে, বহু খোঁজাখুঁজির পরেও দাদি নিজেই পায়নি। নানির দিব্যি ছিল এবং এই দিব্যি মা নানিকে দিয়ে গিয়েছিল; যত কঠিন বিপদই হোক, এই বালাজোড়া ও চেইন যেন হাতছাড়া না করি এবং আমার স্ত্রীকে বাসররাতে হাতে-গলায় পরিয়ে বরণ করি। কী মনে করে ট্রাংকটি খোলার ইচ্ছে আজ। আলমারির ভেতর থেকে ট্রাংকটি বের করে জংধরা তালা মোচড় দিতেই খুলে গেল আলগোছে। কাপড়ের একটি পুঁটলি আর একটি হলুদ খাম ছাড়া আর কিছুই নেই। কাপড়ের পুঁটলিতে কী আছে জানা বিধায় হলুদ খামটিই খুলি প্রথম। হাসপাতালের রিপোর্ট। ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে লেখা DEATH CERTIFICATE মার ডেথ সার্টিফিকেট। প্যাঁচানো ঘুরানো হাতের লেখা রিপোর্টের পাঠোদ্ধার বলতে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি শব্দ ধরতে পারিনি। এরমধ্যে injured শব্দটি একাধিকবার লেখা। মা হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন, এ কথা আমি জানি। মা-র ডেথ সার্টিফিকেটে injured কথাটি লেখা কেন? মা’র কী অসুখ হয়েছিল এবং কিভাবে মারা গিয়েছিল ইত্যাদি কিছু জিজ্ঞেস করলে নানি বরাবরই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেত অথবা ঘুরিয়ে ফেলত অন্য প্রসঙ্গ দিয়ে। আমার প্রচণ্ড জেদের কাছে হার মেনে একদিন শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট্ট করে বলেছিল -মরণ-জ্বর!
বাবার বাড়ি থেকে নানার বাড়ি প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরে হওয়ায়; দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার করায় এবং পরপর পাঁচ সন্তানের জনক হওয়ায় বাবার কাছে আমার অস্তিত্ব প্রায় ছিল না। নানি ও মা’র ছোট দুই ভাই অর্থাৎ আমার দুই মামার ভালোবাসা বাবা-মা’র অভাব পূরণ করেছিল। আমার কাছেও বাবা ছিল নামসর্বস্ব মৃত মানুষের অস্তিত্বের মতো। মাত্র দু’বার মুখোমুখি দেখা হয়েছে, স্রেফ দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে দেখা হবার অনুভূতি তৈরি হয়েছে। গত বছর বাবার মৃত্যুর দু’দিন পরে ছোট মামা ফোন করেছিল। মার মৃত্যুবার্ষিকীতে ছোট্ট করে মিলাদের আয়োজন করেছে, আমি যেন অবশ্যই যাই। ফোন রাখার মুহূর্তে ভুলে যাওয়া কথা হঠাৎ মনে পড়ার মতো মনে করে মামা নির্বিকার কণ্ঠে বাবার মৃত্যুর সংবাদটি দিয়ে মোবাইল কেটে দিয়েছিল। অনাত্মীয় মৃত্যুর মতো স্রেফ একটু আফসোস জেগে ওঠা ছাড়া পিতৃবিয়োগের কষ্ট অনুভব করিনি।
ঠিক কত রাতে চোখে ঘুম এসেছে মনে নেই। কিংবা আদৌ আমি ঘুমিয়েছি কিনা সে কথাও ভাবছি। রাতভর ঐ দুঃস্বপ্নটার মধ্যে ডুবে ছিলাম। সুবিন্যাস্ত ভয়ার্ত দৃশ্যের যে দুঃস্বপ্নটা দু-দিন ধরে ধারাবাহিক নাটকের মতো চলছে আজ তার তৃতীয়পর্ব এবং শেষপর্ব বোধহয়। যথারীতি আমার শৈশব চোখ আর আতঙ্কিত মন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি উঠোনে। যথারীতি দরজা-জানালা বন্ধ একটি ঘর, ঘরের ভেতরে একজন মেয়েমানুষের আর্তচিৎকার। পুরুষ কণ্ঠে শুয়োরের গোঙানির শব্দ। ঘরের ভেতরে যেন দৌড়ের প্রতিযোগিতা চলছে। হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে গেলে মেয়েমানুষটি তার ছায়ার আগেই লাফিয়ে পড়ে উঠোনে। পুরুষটির পরনের লুঙি খুলে গেল। পালানোর জন্য যথেষ্ট সময় পেল মেয়েমানুষটি। কোমর থ্যাতলানো কুকুরের মতো হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে শরীর টেনে টেনে উঠোনের চৌহদ্দিও অতিক্রম করতে পারেনি। পুরুষটি লুঙি পরার কাজটি সম্পূর্ণ করে ধীরে। কয়েক মুহূর্ত
লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের নিশ্বাস স্বাভাবিক করে নেয়। অন্ধকারে হাতড়ে ম্যাচবাক্স ও বিড়ির প্যাকেট খোঁজায় ব্যয় করে কিছুটা সময়। তার কোন তাড়াহুড়া নেই, কারণ, সে জানে, পালানোর মতো জীবনীশক্তি অবশিষ্ট নেই মেয়েমানুষটির শরীরে। একটি বিড়ি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ধোঁয়া সেবনে ৫ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়। মোবাইলের ব্যাটারি চার্জ দেবার মতো নিজেকে রিচার্জ করে নেয়। কোরবানির গরু জবাই করার ছোরাটি খুঁজে পেতে তার অসুবিধা হয় না। কারণ, পূর্ব পরিকল্পনামাফিক ছোরাটিকে বিছানার নিচে লুকিয়ে রেখেছিল।
এখন রাতের চূড়ান্ত নিস্তব্ধতার কাল। ভরাপূর্ণিমা। পরিপূর্ণ চাঁদটি মাথার উপরে যেন স্থির হয়ে থেমে গেছে। উঠোনের একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে ডুমুর গাছের ছায়াচ্ছন্ন একটি জায়গায় মেয়েমানুষটি হাত-পা ছেড়ে দিয়ে আকাশের চাঁদটির দিকে মুখ করে শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। দু-চোখে দুটি অশ্রুধারা। ছোরা হাতে পুরুষটির বের হয়ে যাবার ছায়াদৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুম ভেঙে গেলে আমার বুকের অবর্ণিত ব্যথাটি এমন ভয়ানকভাবে লাফিয়ে ওঠে যে, বুকের ভেতরে যেন ধারালো একটি চাকু
প্রবেশ করিয়ে মোচড়ানো হচ্ছে। বুকের উপরে চিলথাবা দিয়ে বালিশ কামড়ে ধরলে ব্যথাটা সহনীয় হয় বটে, কিন্তু শরীরজুড়ে মুগুর-পেটানো ব্যথা। হাত-পা অবশ, নিথর। নির্ঘুম মানুষের মতো চোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ভীষণ ক্লান্তি শরীরে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। তন্দ্রাচ্ছন্ন কিছুক্ষণ
থাকার পরেই রাকিবের মার কলিংবেল বেজে ওঠে।
দুদিনের ছুটি নিয়ে টানা ছয়দিন অনুপস্থিত রাকিবের মা। কোন একটা অজুহাত দাঁড় করবে নিশ্চয়। ছেলে, মেয়ে, স্বামী অথবা নিজের অর্থাৎ কারো না কারো অসুস্থতা অথবা এমন এক সমস্যা বা সংকটের কথা এতো নিখুঁতভাবে গুছিয়ে বলবে যে, অনুপস্থিতির জন্য কিছু বলার চেয়ে আরো দু-দিন ছুটি মঞ্জুর করা প্রয়োজন পড়বে। ওর সাথে পারা কঠিন। দরজা খুলে তন্দ্রালু চোখে ওর দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠি এবং পেছনে সরে যাই। ওর শরীর থেকে মেডিসিনের উৎকট গন্ধ মুহূর্তের মধ্যে এমন ব্যাপক ও বিশ্রীভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, মনে হলো, আস্তো একটা হাসপাতাল আমার
সামনে। এ কী রাকিবের মা! তোমার শরীরে এমন বিশ্রী ওষুধের গন্ধ কেন? তোমার শরীরে মরা মানুষের গন্ধও পাচ্ছি। হাসপাতাল থেকে এসেছো নাকি? মরা টেনেছো নাকি? তোমার চোখ-মুখ ফোলা, মনে হয় দু-তিন দিন ধরে ঘুমাওনি?
রাকিবের মা দপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। দীর্ঘ ও কঠিন শ্রমে এতেটাই ক্লান্ত যে, এখনি শরীর ছেড়ে দেবে। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবতী, বুদ্ধিমতী ও স্বাস্থ্যবতী রাকিবের মা যথেষ্ট সংগ্রামী। এই শহরে একা সংগ্রাম করে একটি পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছে। পরাস্ত মানুষের মতো যেভাবে হাত- পা ছেড়ে দিয়েছে তাতে বড় ধরনে একটা কিছু ঘটতে পারে ভেবে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভয় পেলাম এই ভেবেও যে, ওর পরিবারের কারো বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটল কি না?
আমি যা ভাবিনি অথবা ভাবতে পারিনি, এমন দুঃসংবাদ জানিয়ে রাকিবের মা বলে, এই খবর দেবার জন্যই এসেছে। হাসপাতাল থেকে এসেছে এবং হাসপাতালে ফিরে যাবে এখনি। হঠাৎ গোঙিয়ে উঠে আঁচল দিয়ে মুখ ডেকে নিজেকে সংযত করে বলে, এই ধাক্কায় মনে হয় আপা আর বাঁচবো না স্যার! একবার গিয়া দেইখা আসেন। আপা প্রতিদিনই আপনার খোঁজ-খবর লইতেন। গেলেই পইলা জিগাইতেন, আপনি কি আনছেন বাজার থেকে, আমি রাঁধছি, ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না? এসব আপনারে কইতে বারণ করছিলেন আপা। ওয়ার্ড ও বেড নাম্বার জানিয়ে রাকিবের মা আর দাঁড়ায়নি। ছুটে বেরিয়ে গেল।
রাকিবের মা বলেছিল বটে, কিন্তু আজকেই মারা যেতে পারে এতোটা সিরিয়াস ভাবিনি। অফিসের রুটিন ডিউটিগুলো শেষ করে সূর্যাস্তের ঠিক আগের মুহূর্তে যখন রিক্সা নিয়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি, তখন মনে হলো, এই সময় মেয়েমানুষটির সূর্যাস্ত দেখার কথা ছিল। এখন তার জীবনসূর্য
অস্তগামী। আমি হাসপাতালের গেটে পা রেখেই দেখি, রাকিবের মা বেরিয়ে আসছে একটি স্ট্রেচার ঠেলতে ঠেলতে। সাদা কাপড়ের নিচে সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির প্রাণহীন শরীর। তার প্রিয় সূর্যাস্তের সময় এখন। আমাকে দেখেই রাকিবের মা কেঁদে ওঠে, ভাইজান, আপা আর নাই! আপা মারা গ্যাছে!
স্ট্রেচারকে ঘিরে আর কোন মানুষ নেই। রাকিবের মা একা স্ট্রেচার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে বিস্মিতই হলাম। অন্তত পাষণ্ড স্বামীটার তো থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তুমি একা কেন রাকিবের মা? আর কেউ নেই? তার স্বামী কোথায়?
রাস্তার উপড়ে দাঁড় করানো সাদা রঙের একটি মাইক্রো দেখিয়ে রাকিবের মা বলে, এই মাইক্রো ঠিক করে ওর উপরে দায়িত্ব দিয়ে গেছে লাশ মেয়েমানুষটির বাড়ি পৌঁছে দিতে। বাড়ির ঠিকানা জানে কিনা প্রত্যুত্তরে রাকিবের মা বলে, মাইক্রোর ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে গেছে। রাকিবের মা আমার বাধা মানেনি। লাশের মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিল যেন আমি দেখতে পারি।
অস্তগামী সূর্যের লাল আলো পড়েছে লাশের মুখে। চোখ দুটি বন্ধ করা হয়নি। এখনো সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে আছে।
0 Comments
Post Comment