- 11 June, 2025
- 0 Comment(s)
- 123 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মিলির বাড়ি ফিরতে দেরী হচ্ছিল। শুভর অপেক্ষা করতে ভালো লাগছিল না। ঘরে বসে তার থেকে থেকে ঘুম পাচ্ছিল। পাশের দেরাজ থেকে একটা বই নামিয়ে সে পড়তে চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। কাজ হল না। গলা তুলে শুভ মা’কে চা করতে বলে। ভিতর থেকে কোনও জবাব আসে না। মিলি বাড়ি ফিরল। শুভ মিলিকে দেখে। দিনে দিনে মিলি কেমন গ্রেসফুল হয়ে উঠছে। শুভর হঠাৎ ছোটবেলা মনে পড়ে। মতিন আঙ্কল ওদের বাড়িতে থাকত তখন। মতিন আঙ্কল ওদের মায়ের মাসতুতো বোন স্বর্ণালী আন্টির হাজব্যাণ্ড। ওরা কেউই এখন আর এদেশে থাকে না। মতিন আঙ্কল স্টেটসে চলে গেছে। স্বর্ণালী আন্টির সঙ্গে মতিন আঙ্কলের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে অনেকদিন। মিলি ঘরে ঢুকতে শুভ মিলির দিকে তাকায়।
-“এত দেরী হলো যে?”
-“কই দেরী?” মিলি কবজি ঘুরিয়ে সময় দেখে, “ও বাবা, সাতটা বেজে গেছে বুঝি?”
-“গেছেই তো,” শুভ জবাব দেয়, “এতক্ষণ বসে বসে এই একটু আগে মা’কে চা করতে বলেছি।”
-“যাক!” মিলি কাঁধের ব্যাগটা পাশের মোড়াটার উপর নামিয়ে রেখে কোনওমতে আদরের দুলুনি-চেয়ারটার উপর শরীর ছেড়ে দেয়, “বড্ড খাটনি গেছে সারাদিন।” মিলি দোল খাচ্ছে। শুভর শরীরে অস্বস্তি হয় হঠাৎ।
এমন অস্বস্তি কি শুভর আগেও হতো? অন্তত জুলাই, ২০২৪এর আগেও? প্রশ্নটা তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। শুভর আরও অস্বস্তি হয়। মিলি দোল খাচ্ছে। এর আগে তো কখনও মিলির দোল খাওয়াটা শুভর কাছে এমন অস্বস্তিজনক বলে মনে হয়নি। তাহলে হঠাৎ আজই কেন মনে হচ্ছে এসব? শুভর মাথায় পোকা বিনবিন করতে থাকে।
সেদিনের সেই রাত জুড়ে হট্টগোল। পাড়ায় মিলিটারি এসে নামল। আলম আঙ্কলদের বাড়ির সামনেটায়। লতিফদের গ্যারাজের পিছনে লুকিয়ে বসেছিল শুভরা কয়েকজন। মিলিটারি ভ্যানের ঘরঘর আওয়াজ। কমবয়সী কর্নেলের গলায় সেই বাছাবাছা খিস্তি-সহযোগে পাড়ার সকলের উদ্দেশ্যে হুমকি ছুঁড়ে দেওয়া। লতিফদের গ্যারাজের পিছনেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল সেসব। গুলির শব্দ। মামুন আর প্রতীকের হাতে হাত রেখে শুভ কেঁপে উঠেছিল। আবারও গুলির শব্দ। পরে জানা গিয়েছিল নেহাতই ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার। পাড়ার লোককে ভয় দেখাতেই মিলিটারিরা কায়দা শানাচ্ছিল তখন। কিন্তু রমেনের বুকে গুলিটা সত্যিই লেগেছিল। গুলি লেগেছিল ফারুখের বুকেও। পরদিন কলেজে যেতেই সত্যিটা শুভর কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ছাত্রাবাস থেকে মিছিলের ডাক আসতে শুভ তাই আর এতটুকুও দেরী করেনি। অনেকগুলো মিছিল এসে শহরের কেন্দ্রে মিলেছিল। আওয়াজের দাপটে শ্লোগানের শব্দগুলো আর কারোর খেয়ালে ছিল না। বেলা গড়াতেই ঢাকা থেকে খবর এসেছিল আপা’র খেলা শেষ। অত্যাচারী সরকারের পতন হয়েছে। রাত আরও বাড়তে খবর এসেছিল ইয়ুনুস আসছেন। শুভ আর মিলি অনেক রাত অবধি ঘরের জানালা বন্ধ করে মোবাইলের আলোয় জেগে বসেছিল। মিলি সেদিনের মিছিলে যায়নি। আগের দিন অনেক রাত্তিরে শুভ বাড়ি ফিরেছিল যখন, মিলির ঘরে গিয়ে শুভ দেখেছিল মিলি জানালার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেয় বসে আছে। মিলি মলাট দেওয়া একটা বই পড়ছিল। হাত থেকে বইটা নিয়ে শুভ পাতা উলটিয়ে লেখক আর গল্পের নাম দেখেছিল। ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। অন্ধকারে একটু হেসে শুভ মিলিকে বইটা ফিরিয়ে দিয়েছিল। বাইরে ভোর হয়ে আসছিল তখন। জুলাই স্বাধীনতার বাংলাদেশ।
-“একটা দেশ এই নিয়ে আর কতবার স্বাধীন হতে পারে মশাই? আপনারাই বলুন!” টিভি থেকে লাল পাঞ্জাবী পরা, কাঁচাপাকা চুল মানুষটার চোখা চোখা বক্তব্য ভেসে আসতে থাকে। চড়াৎ করে শুভ টিভিটা বন্ধ করে দেয়। “উফফ, এরা যে কেন এখনও ইণ্ডিয়ার মাউথপিসগুলোকে ফুটেজ দেয়!” মিলি চায়ে চুমুক দেয়। “এইজন্যই আমি এখন আর টিভিতে নিউজ দেখি না। মারামারি আর অন্যকে খিস্তানো ছাড়া কিছুই নেই!” “চুপ কর! নিজের মুখের ভাষাটাও তো তেমনই বানিয়েছিস!” হঠাৎ মিলির উপরেই যেন রেগে যায় শুভ। মুখে একটা তেতো স্বাদ উঠে আসে। মিলি অবাক হয়ে তাকায়। “আজকাল আমার ভাষা নিয়েও প্রবলেম হচ্ছে তোর?” মিলি জিজ্ঞেস করে। শুভর দিকে না তাকিয়েই। শুভর রাগটা তখন মস্তিষ্কের আরও উপরে চড়ে বসতে চায়। তার করোটিতে দ্রিমিদ্রিমি মাদল বাজতে শুরু করে। এক চড়ে ভিজে বেড়ালের মতো সামনে বসে থাকা মিলিটাকে তার শায়েস্তা করে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু শুভ এসব কিছুই করে না। সে মাথা নামিয়ে চায়ে চুমুক দেয়।
খানিক নীরবতা। শুভর চা শেষ হয়ে এসেছে। মিলি ধীরেসুস্থে খায়। শুভই প্রথম কথা বলে। সামনে টিভি চলছে, তবে তাতে কোনও শব্দ নেই। শুভ বলে, “ব্লগে তোর লেখাটা পড়ছিলাম।” মিলি চায়ের কাপ থেকে চোখ তুলে তাকায়। “তাই?” শুভ ঘাড় নাড়ে। কী বলবে যেন বিষয়গুলোকে মনে মনে সাজিয়ে নেয়। তেমন সাজাতে পারে না। তার মাথার পোকাটা এখনও জ্বালাচ্ছে খুব।
“নিজেকে পতিতা বলে মনে হচ্ছিল। আমাকে ওরা বাধ্য করেছিল বিশেষ পৃষ্ঠপোষকদের সাথে একই টেবলে গিয়ে বসতে। তাদের মনোরঞ্জনে শামিল হতে,” শুভ যেন কেটে কেটে মিলির লেখা শব্দগুলো মোবাইল থেকে উচ্চারণ করে। মিলি শুনেও শোনে না। টেবলের সামনে আকাশিরঙ দেওয়ালটায় নোনা ধরে দাগ হয়ে আছে। মিলি একদৃষ্টে সেদিকে তাকায়। “এইসময় ব্লগে লেখার মতো আর কোনও বিষয় পেলি না তুই?” শুভ জিজ্ঞেস করে। মিলির চা শেষ হয়ে এসেছে। “কেন বল তো?” শুভর প্রতি মিলির পালটা প্রশ্ন ছুটে যায়, “আমার যেটা ভালো মনে হয়েছে আমি লিখেছি। এই ধরণের মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স – বিউটি উইথ এ পারপজ, এমন বিষয়গুলোকে নিয়ে আমি অনেকদিন ধরেই ভেবেছি। ভেবেছিলাম। তাই, এই যে প্রতিযোগীদের একজন অন্তত এটা নিয়ে মুখ খুলেছেন, সরাসরি বক্তব্য রেখেছেন, আই থট আই শ্যুড রাইট ইট। ব্যস,” মিলি কাঁধ ঝাঁকায়।
“কিন্তু তারপর?” শুভর কথা এখনও শেষ হয়নি, “তারপর ইউ কমপেয়ারড দিস উইথ আওয়ার কালচার! তুই বলেছিস একদিকে পুরুষ বিচারকদের সামনে মহিলারা স্যুইমস্যুট পরে ঘুরে বেড়াবে, তাদের এন্টারটেইন করবে – এটা যেমন এক ধরণের বিকৃতি, অন্যদিকে, শরিয়া মেনে কোনও কোনও দেশে মেয়েদের আজীবন বোরখার তাঁবুতে বন্ধ হয়ে থাকতে হবে, এও সেই একই ধরণের বিকৃত অভ্যাস, ঐতিহ্য,” “হ্যাঁ লিখেছি,” মিলি এই অভিযোগেও এতটুকু অবাক হয় না, “লিখেছিই তো, এ্যাণ্ড আই ডোন্ট থিঙ্ক আই হ্যাভ সেইড এনিথিং রং।” শুভ উত্তেজনায় চেয়ার থেকে উঠে পড়ে প্রায়, “এ্যাণ্ড ডোন্ট ইউ থিঙ্ক ইউ আর গোয়িং টু ফার? রাইট এ্যাট দিস মোমেন্ট? দেশটা নতুন করে গড়ে উঠছে। এখন এই পাওয়ার স্ট্রাগলের সময় শরিয়া-ইত্যাদি নিয়ে ক্রিটিসিজম করাটা কি খুব দরকার ছিল?” শুভর গলায় স্পষ্ট অধৈর্যের ছাপ। মিলি অবাক হয় এবার।
রাত যত বাড়ে, অন্ধকার বারান্দায় মিলি আর শুভ মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। পাড়ায় লোডশেডিং। সন্ধ্যের আলোচনার তিক্ততাটুকু এখনও যেন কালিমাখা হ্যারিকেন আলোর চারপাশে ভিড় করে আসা দেওয়ালি পোকাগুলোর মতো গিজগিজ করে। উড়ে উড়ে গায়ে পড়তে চায়। মিলি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে।
-“রাজুর সামনে গত সপ্তাহের ঘটনাটাও কি তাহলে তোর সঠিক বলে মনে হয়?” হঠাৎ মিলি শুভকে জিজ্ঞেস করে, “আমি কিন্তু ওটা নিয়েও লিখব হয়তো। খুব শিগগিরই।” শুভ সরাসরি এর কোনও জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।
-“আমার হাতে কিছু নেই মিলি,” শুভ থেমে থেমে বলে, “একটা বিরাট আন্দোলন গড়ে ওঠে যখন, তাতে বিচ্যুতি আসাটা স্বাভাবিক। আমাদের তার মধ্যে থেকেই পথ খুঁজে নিতে হবে,” শুভর কথা শেষ হয় না।
-“পথ খোঁজার মতো কী চেষ্টা করেছিস তুই?” মিলির প্রশ্ন ভেসে আসে, “জুলাইয়ের পর আর কয়দিন মিছিলে গেছিস? কয়দিন পাড়ার ভিতরে দলবল জুটিয়ে অন্তত এই নিয়ে কোনও আলোচনা করেছিস? আমি নাহয় জুলাইতেও মিছিলে যাইনি। তারপরেও নয়। কিন্তু,” মিলির আওয়াজ থেমে যায়।
-“কিন্তু কী? বল? শুনছি,”
দুজনে যেন দুজনের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। দুজনের মধ্যে একটা দেওয়াল তৈরি হয়।
মিলির মুখের উপর একটা চটির ঝাপটা পড়ে। পিছন থেকে পিঠে লাথি খেয়ে হঠাৎ সে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কেউ তার ওড়না ধরে টানছে। নোংরা দাড়িওলা কুচকুচে একটা বীভৎস মুখ, তা থেকে বিশ্রী মশলার গন্ধ বের হয়। মিলির ওড়নাটা সালোয়ারের উপর থেকে খসে পড়েছে। কুৎসিত একটা স্পর্শ। রাজু ভাস্কর্যের সামনে গনগনে পিচ রাস্তাটার উপর মিলি মুখ থুবড়ে পড়েছে। “মাইরা শ্যাষ কইরা দে,” অশ্লীল এক-একটা গালাগাল তার কানে উথাল সাগরের তীব্রতায় আছড়ে পড়তে থাকে। স্বপ্ন ভেঙে মিলি ধড়মড় করে উঠে বসে বিছানার উপর। হাঁটুমুড়ে তার উপরে থুতনি রেখে মিলি অপেক্ষা করে। এই দেশ তার পরিচিত নয়। উচ্ছৃঙ্খলতার নজির গণআন্দোলনের ইতিহাসে অনেক। তবু, মেধার নামে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল – শেষমেশ এই কি পরিসমাপ্তি তার? কোথায় ভুল হয়েছিল? কার ভুল হয়েছিল? কাদের ভুল হয়েছিল? কিসে ভুল হয়েছিল? ওপাশের গলিতে আবারও একটা চিৎকার শোনা যায়। মদ খেয়ে আবারও ভাঙা গলায় চিৎকার করছে কেউ। চিৎকার মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। বাইরের স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় ঘরের নোনাধরা দেওয়ালের উপর জানালার গরাদগুলোর ছায়া পড়ে। শুভ কি বারান্দায়? কি বিশ্রী ভঙ্গিতেই না সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাস্তার আলোটা তিরতির করে কাঁপে। মিলি চোখ ফিরিয়ে নেয়।
নাহ। শুভর গলায় অনুশোচনা নেই। সকালে তার ঘরে চা দিতে এসে মিলি দেখে খুব মন দিয়ে মোবাইলে মাথা ঝুঁকিয়ে সে কী যেন দেখছে। “আরেকটা আওয়ামীর দালাল খতম,” মুখ তুলে মিলিকে দেখে চাপা উচ্ছাসের গলায় শুভ বলে ওঠে, “এবারে রঙপুর। শালায় বহুৎ লোকের জমি দখলে রেখেছিল! জনতা একেবারে খাল্লাস করে দিয়েছে।” ল’এর উপর অযাচিত জোর পড়ে। মিলি চা’টা খাটের পাশে টেবলের উপর নামিয়ে রাখে। টুং করে অল্প আওয়াজ হয়। “এটা লিঞ্চিং। জাস্টিস নয়।” শুভ মোবাইলটা নামিয়ে এবারে সোজাসুজি মিলির দিকে তাকায়।
-“কী বলতে চাইছিস তুই বল তো?” শুভর গলায় অন্য স্বর।
-“বলতে চাইছি যে এমন মব জাস্টিসের জন্যই কি তোরা জুলাই করেছিলি?”
শুভ খাট থেকে নেমে এসে মিলির মুখোমুখি হয়। “মিলি, ইটস এ মাস আপসার্জ। এতদিন যখন লিগের নামে ঘুরিয়ে জামাতিদেরই তোল্লাই দেওয়া হচ্ছিল, কই তখন তো কারোকে কিছু বলতে শুনিনি,” শুভর গলায় ঝাঁঝের আভাস পাওয়া যায়, “আজ একটা এত বড় আন্দোলন হল। ইট টেকস টাইম ফর দ্য ওয়াটার টু সেটল! আর হোয়াট ইজ দিস?” শুভ হঠাৎ অদ্ভুৎ এক প্রশ্ন করে ফেলে। “তোর ওড়না কোথায়? এবার থেকে সকালে চা দিতে আসার সময় ওড়নাটা গায়ে দিয়ে আসবি মিলি। মনে রাখবি তুই বড় হয়েছিস অনেক!” এরপর,
ঘটনার তীব্রতায় শুভর ডানপায়ের পাতার উপর অনেকটা গরম চা ছিটকিয়ে পড়ে। মেঝেতে পড়ে থাকা ভাঙা চিনেমাটির টুকরো অঢেল। মিলি ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
[***]
মতিন দেশে ফিরবে। স্টেটস থেকে নিজের কান্ট্রিতে ফিরতে ভালো লাগছে তার। নিউইয়র্ক জেএফকে থেকে আর আধঘণ্টায় ফ্লাইট। লাউঞ্জে বসে মতিন ড্রট বিয়রে চুমুক দেয়। শরাবকে ওরা কী যেন বলে আবার, ‘হারাম!’ মনে মনে মোল্লাদের নিয়ে হাসে মতিন। ইলিয়াস ভালো বলেছিলেন, কাঠমোল্লা তো নয়। শালারা উডেন মোল্লা। হারামের চেয়েও খারাপ। এদিকে ভালো ড্রট বিয়রের স্বাদ এখন আবার কতদিনে মিলবে কে বলতে পারে, নিজের অদৃষ্টকে মনে মনে হালকা গালাগাল দেয় মতিন। তবু এখানে হোম কান্ট্রির ডেভেলপমেন্টের প্রশ্ন জড়িয়ে। মতিনের পকেটেও তো … না না না! সুদ নেওয়া তো ইসলামে হারাম। মতিন জানে। কিন্তু সুদ নেবে তো তার ব্যাঙ্ক। সে তো ব্যাঙ্কের বেতনভুক কর্মচারী মাত্র। বিজনেস আনার জন্য পাওয়া কমিশনকে তো আর সুদ বলা চলে না। বিয়র নামিয়ে মতিন হাতের টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচায়।
একটু আগে খাওয়া সাবওয়ে স্যাণ্ডউইচের নরম মাংসের কুচিগুলো এখনও তার দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে কোথাও আটকে, গেঁথে রয়েছে। লাউঞ্জের ওপাশে গেরুয়াধারী, ফোঁটাকাটা আরেকজন। দেখলেই বোঝা চায় হরেকৃষ্ণ-পাবলিক। এদিকে ইয়াটে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, অথচ মুখে কৃষ্ণনাম। ত্যাগের নামে ভাঁওতাবাজি কেবল। ক্যালিফোর্ণিয়ায় এমন এক হরেকৃষ্ণের সঙ্গে মতিনের ভাবসাব হয়েছিল একসময়। শহরের কোথায় বেস্ট পর্ক পাওয়া যায়, কাদের রিবস ভালো আর কাদের লিন পর্কে ছিবড়ে হয় সবথেকে কম – সেই বিষয়ে অগাধ জ্ঞানের ভাণ্ডার।
মতিন মনে মনে হাসে। ড্রট বিয়রে নেশা হয় না। কেবল মনটা একটু ফুরফুরে লাগে। মতিন নতুন করে আর বিয়ে করেনি। মোবাইলে এখনও সে স্বর্ণালীর কমবয়সের ছবিগুলো রেখে দিয়েছে। এইসব ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিজে শরীরের খিদে মেটানোটা কোনও বড় ব্যাপার নয়। বরং নেশা খুব চড়লে কোনওদিন, অনেক রাত্তিরে মতিন স্বর্ণালীর পুরনো ছবিগুলো ফোনে বের করে দেখে। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ। স্বর্ণালী মতিনকে শাসিয়েছিল ২০০১’এর পর নতুন সরকারের আমলে বিল্ডিং ডেভেলপমেন্ট ফাণ্ডকে সামনে রেখে ইন্টারন্যাশনাল এইডের টাকা নিয়ে মতিন যে দুনম্বরিটা করেছিল সেটা ওর দিদি-জামাইবাবুর কাছে ফাঁস করে দেবে। মতিন ভয়ে ভয়ে তখন মিনিস্টারকে গিয়ে ওর আশঙ্কার কথাটা বলেছিল কেবল। রেসপন্সে মিনিস্টার যে ওর বউয়ের দিদির হাজব্যাণ্ডকে একেবারে জানে মেরে দেবে, মতিন ভাবতে পারেনি। স্বর্ণালী কিছু আঁচ করেছিল বোধহয়।
ওর দিদির ছেলেমেয়েদুটোর জন্য মতিনের জেনুইন কষ্ট হয়। কিন্তু কোনও উপায় নেই। স্কুলফেরত স্বর্ণালীকেও একদিন একা পেয়ে গুণ্ডারা শাসিয়েছিল। চড়-চাপটা কিছু মেরেওছিল বোধহয়। তাতেও মতিনের কিছু করার ছিল না। এরপর সাহস করে ওর দিদিকেও স্বর্ণালী আর আলাদা করে কিছু বলে উঠতে পারেনি। বলার উপায়ও ছিল না। মতিন শুনেছে হাজব্যাণ্ডের সেই বিশ্রী দুর্ঘটনার পর স্বর্ণালীর দিদি নিজেও অসুস্থ, অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিল। প্রায় বেড-রিডন অবস্থায় পড়েছিল অনেকদিন। খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করত না। কারো সঙ্গে কথাও বলত না। সব কাজ করানোর জন্য মাসের হিসেবে নাকি আয়া রাখতে হয়েছিল। তারপর আস্তে আস্তে নাকি অনেকটা সেরেও উঠেছিল। কিন্তু আগের জোশ আর ফেরেনি। এতদিনে সেই ছেলেমেয়েদুটোও অনেক বড় হয়ে গেল বোধহয়। মতিন চোখ কুঁচকে ভাবতে চেষ্টা করে। আচ্ছা, এতদিনে সেই দিদিও কি জীবিত, আদৌ? হয়তো সেই একই বাড়িতে তারা রয়েছে। একই মহল্লায়। তার জিভে-টাকরায় টকটক শব্দ হয়। ফ্লাইট কল করেছে। বোর্ডিং শুরু হতে আর পাঁচ মিনিট। বিয়রের তলানিটুকু এক চুমুকে শেষ করে স্টেটসে সেটল করা মতিনুদ্দিন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।
[***]
-“বলি অরে! তরা নাশতা কইরবি না আজ? খাবার-দাবার তো সব ব্যাকটি শেতল হয়্যা পড়ে!” ঘরের ভিতর থেকে কেউ ডাকছে। ধরা গলায়, কাটা কাটা শব্দে আঠালো ডাক। তাতে মায়ের গন্ধ লেগে থাকে।
-“যাই আম্মু!” বারান্দা থেকে মিলি সাড়া দেয়। তার গলায় এখন রোদ। মিলির শরীর বেশীক্ষণ ড্যাম্প থাকে না। ত্যাঁদড় ইউক্যালিপটাসের মতোই তার দেহ সরু, সোজা, নির্লজ্জ হয়ে ওঠে। শুভ বাইরে গিয়েছিল। ঝড়ে বাঁশপাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে সে ঘরে ঢুকে আসে হঠাৎ। “মামুনকে ওরা মেরে দিয়েছে, মামুনকে মেরে দিয়েছে,” ধপ করে জমির উপর বসে পড়ে শুভ। তার কথা জড়িয়ে যায়। “মামুন নাকি লীগের দালাল! চপারে ওর শরীরটা একেবারে -” শুভ কথা শেষ করতে পারে না। ওর কথা জড়িয়ে যায়।
-“হ্যাঁ রে! কি কইছস, অরে পোলাডা আমার! তুই এডা কি কইছস – কান্দস কেনে তুই?” সেই আঠালো মা-মা গলাটা শুভর পাশে এসে দাঁড়ায়। জমিতে বসে পড়ে। শুভর পিঠ জুড়ে সেই মা-মা গলাটা হাত বোলায়। শুভ কাঁপছে। মিলি দোতলায় উঠে যায়। নিজের ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর ছাদের উপর। সে পাখির মতো সবদিক দেখছে। তার চোখ পাড়ার শেষ মাথায়। বড় রাস্তার কাছে কোথাও আগুন জ্বলছে। গাছের মাথা ছাড়িয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়ার স্তর উঠতে থাকে। ওখানেই কোথাও মামুনের লাশ পড়ে রয়েছে।
মিলির পায়ের নীচে এখন সিমেন্টের ফাটা জমি।
তার মাথার উপরে ফকফকে আকাশ।
সেই আকাশের কোথাও এতটুকুও মেঘের আরাম নেই।
এত বছর পর, আবারও “একটা উড়াল দেবার জন্য মিলি পা ঝাপটায়”
[ঋণস্বীকারঃ ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস]
0 Comments
Post Comment