মাধবী

  • 12 May, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 430 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
 “সকলের কথাই সকলে সমান ভাবে জানুক। কেউ যেন কোনও মানুষকে একাদিক্রমে অন্ধভক্তিতে দেবতার আসনে না বসায়। এই আমাদের আদর্শ এখন।” মাধবী চুপ করে গেল। হয়তো সে অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে ফেলেছে। কিন্তু আদর্শের মুখোশ পরে একদিন যারা তাকে একঘরে করে দিয়েছিল, তাদের সেই ঘটনার মূল চক্রীকে এতদিন পরে সে যখন সামনে পেয়েইছে - কিছু কথাকে তখন স্পষ্ট করে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সমীরেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। (ছোটগল্পঃ মাধবী)

এও এক যুদ্ধ। নিজেকে সাজিয়ে নিতে নিতে মাধবী ভাবছিল। এতদিন পরে এসে মাধবীকে আবারও সেই মানুষটার সামনেই গিয়ে দাঁড়াতে হবে। পুরো ব্যাপারটাকে মাধবীর কেমন যেন অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছিল। বিশেষ প্রসাধন সে কোনও কালেই করে না। ‘সুরধুনী’তে চলে আসার পর থেকে তো নয়ই। পাহাড়ের উপর এই নির্জন আশ্রমে পঁয়ত্রিশটি অনাথ শিশুকে নিয়ে মাধবীর সংসার। সপ্তাহ-দুই আগে সমীরেশের মেইলটা পেয়ে ভারী অবাকই হয়েছিল মাধবী। অবাক হওয়ার পিছনে অবশ্য আরও একটা কারণ ছিল। তার বিষয়ে যথা সময়ে বলা যাবে। কিন্তু প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই মাধবী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। মেইলের উত্তরে সমীরেশকে সে জানিয়ে দিয়েছিল অমুক তারিখ থেকে অমুক তারিখের মধ্যে যে কোনও দিন, যে কোনও সময়ে এসে সমীরেশ চাইলেই মাধবীর সঙ্গে দেখা করতে পারে। এক বা দুই রাত্তিরের জন্য সমীরেশ ‘সুরধুনী’র আতিথেয়তা গ্রহণ করলে পরে যারপরনাই ভালো লাগবে তার। আজ সেই তারিখের প্রথম দিন।

 

শর্ত অবশ্য মাধবীরও ছিল। সমীরেশ যেমনটা বলেছিল সংবাদমাধ্যম, মিডিয়া অথবা টিভির লোকেদের মধ্যে কেউই যেন কোনওভাবে খবর না পায় তার এই সফরের বিষয়ে, তেমনই মাধবীও বলেছিল কোনওরকমের অপ্রয়োজনীয়, বাড়তি নিরাপত্তা ছাড়াই যেন সমীরেশ ‘সুরধুনী’তে আসে। মানালি থেকে গাড়ির রাস্তা ধরে এলে কুড়ি মিনিটও লাগে না। চারপাশে ঘন পাইন বন। এখানে অন্তত কারও নিরাপত্তার অভাব ঘটবে না। সে যতই সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অথবা রাশভারী রাজনীতিবিদ যাই হোক না কেন। সমীরেশ সম্মতি জানিয়ে উত্তর দিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগেই মিনতি এসে মাধবীর হাতে চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে গেছে। তার উপরে পরিষ্কার জ্বলজ্বলে অক্ষরে সমীরেশের নাম। মাধবী চিরকুটটাকে ভাঁজ করে তার কাজের টেবলের নীচে, ডানপাশে ড্রয়ারটার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। এই ঘরে আসবাব বলতে কেবল একটা টেবল, দুটো কাঠের চেয়ার আর একটা তক্তপোশ। একটা আলমারি রয়েছে কাপড়চোপড়ের জন্য, তারই উপরে একফালি কাঁচ লাগানো আয়নার প্রয়োজনে। নিজের জন্য বিলাসিতা বলতে মাধবী রেখেছে কেবল ওইটুকুই। আশ্রমের অফিস ঘর একতলায়। দোতলায় দুটি ঘরের মধ্যে একটিতে মাধবী আর অন্যটিতে মিনতি আর নমিতা থাকে। ওরাই এই আশ্রমের ডেপুটি ইনচার্জ বলা চলে। মাধবীর কড়া নজরদারিতে আর প্রশিক্ষণে থাকতে থাকতে দুজনেই বেশ পোক্ত হয়ে উঠেছে। এই আশ্রমের আশেপাশে লোকবসতি যে একেবারেই নেই তা নয়। সামান্য দূরের কনভেন্ট স্কুল থেকে দুজন করে শিক্ষক প্রতি সপ্তাহে তিনদিন করে এসে ছাত্রদের পড়িয়ে যান। ক্লাস সিক্স অবধি ছাত্রদের এখানে পড়ার ব্যবস্থা আছে। তারপর এদেরকে দেরাদুন অথবা মুসৌরীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কনভেন্টের মাদার সুপিরিয়রই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্রায় দশ বছরের প্রচেষ্টায় তিলে তিলে এই ‘সুরধুনী’র স্বপ্নকে মাধবী সাকার করে তুলেছে। নমিতা আর মিনতি দুজনেই বাংলার মেয়ে। রাজ্য ছেড়ে শেষবারের মতো চলে আসার সময় মাধবী এই দুজনকেই কেবল সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল।

 

এবারে উঠতে হয়। প্রায় পনেরো মিনিট হয়ে গেল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সমীরেশ স্যান্যালকে সে নীচে অফিস ঘরের বাইরেটায় বসিয়ে রেখে দিয়েছে। মুখ টিপে মাধবী একটু হাসল। তারপর ত্বরিত গতিতে সিঁড়ি ভেঙে নামতে শুরু করল। এখনও তার যৌবনের সেই ক্ষিপ্রতা মাঝে মাঝেই জেগে ওঠে হঠাৎ।

 

মাঝে মাঝে বোধকরি সমস্তকিছুকেই কল্পনা বলে মনে হয়। নয়তো আজকের দিনেও সমীরেশ স্যান্যালের মতো একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, একজন মাত্র নিরাপত্তারক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে, কোনওরকম পারিষদবর্গের ভিড় ছাড়াই প্রায় জঙ্গলে ঘেরা এই পাহাড়ের উপর, ‘সুরধুনী’ আশ্রমের মতো একটি জায়গাতে রাত্রিবাস করতেও রাজি হয়ে গেলেন? ... হাসতে হাসতে এই প্রশ্নটাই সমীরেশকে ছুঁড়ে দেয় মাধবী। সমীরেশ মনে মনে মাথা নীচু করে।

 

বারংবার, বারংবার এই মেয়েটার কাছেই ... কেবলই, কেবলই তাকে হেরে যেতে হয়েছে। তবুও তার মনের মধ্যেকার যে অনুভূতি, যে অপরাধবোধ (?) এতদিন, এতকাল ধরে তাকে দগ্ধ করে এসেছে – আজ কি তারই প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছে সে? সমীরেশ কিভাবে কথা শুরু করবে ভেবে পায় না। মাধবীই কাজটা সহজ করে দেয়।

 

-“উন্নতি হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। দলটা সঠিক সময়েই বদলিয়ে নিয়েছিলে!” মাধবীর ঠোঁটের কোণে হাসি চিকচিক করে। সমীরেশ আবারও খেই হারায়। কিন্তু দর্পটা ঠিকই ফুটে বেরোয় তার।

-“সবসময় আদর্শ আঁকড়ে পড়ে থাকলে চলে না। এটা তুমিও জানতে। তাছাড়া আমিও তোমাকে বলেছিলাম আমার সঙ্গে আসতে।”

-“গোটা যৌবন বয়সটা ইন্টারন্যাশনাল আউড়ে আর যাই হোক ধ্বজা-ওড়ানো ফাসিস্তদের দলে গিয়ে ভিড়তে পারতাম না। রাজনীতির বিষয়টাকে আমি যে কোনও দিনও কেরিয়র অপশন হিসেবে দেখতে পারিনি”, মাধবী জবাব দেয়।

-“কেন পারোনি! লুক এ্যাট মি নাও। জীবনে তোমার সুখের প্রয়োজন পড়ে না? সুখী হতে চাওনি তুমি কখনও?”

-“আমাকে দেখে কি অসুখী বলে মনে হচ্ছে?” মাধবী জিজ্ঞেস করে।

-“সেটা তো তোমার বাবার জমিজমা-সম্পত্তি ইত্যাদি ছিল বলে আজ তুমি এইরকম একটা জায়গাতে উঠে এসে আশ্রম খুলে বসতে পেরেছ”, সমীরেশ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই মাধবী তাকে থামিয়ে দেয়।

-“টাকার কথা তুলে অপমান কোরো না সমীর। সে অধিকার তোমার নেই। টাকার জোর তোমারও কিছু কম ছিল না। এখনও নেই। বরং তোমারই কি কখনও মুরোদ হতো আমার মতো নিজের আপন ক্যাপিটালিস্ট বাবার জন্মদিনে, ঘরভর্তি মুঠো মুঠো পুঁজিপতিদের সামনে গান গাইব বলে ইন্টারন্যাশনাল গাওয়ার? তারপরেই কিন্তু আমার বাবা আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি উইল থেকে অবধি বঞ্চিত করবেন বলে শাসিয়েছিলেন। যদিও শেষ অবধি তা করেননি বলেই আজ”, মাধবী হেসে তাকায়। সমীরেশ মাধবীকে তার কথার মাঝখানেই থামিয়ে দেয়, “ভুলে যেও না মাধবী, সেই সময়ে আমিই কিন্তু তোমাকে সাহায্য করেছিলাম।”

-“ভুলিনি কিছুই। তোমার আগুনের উদ্ভাসেই সেদিন বোকামো করে ঘর ছেড়েছিলাম। ভাবিনি তুমিও অত সহজে সবকিছু ভুলে যাবে।”

-“ক্ষমতার লোভ, ভুল হয়েছিল আমার”, সমীরেশ মাথা নীচু করে।

-“ওকে ভুল বোলো না সমীর। আমাকে ভালোবাসবে বলেও, কোনওদিনও যে বাসনি সে কথায় নাহয় এতদিন পরে আর নাই বা গেলাম। কিন্তু মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে কল্যাণীর জীবনেও কোন উপকারটাই বা করেছিলে? অথচ পার্টির ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি ইলেকশনের সময় প্রিয়াংশুর সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে কেচ্ছাবৃত্তি করতেও পিছপা হওনি। আশ্চর্য এও যে, সদস্যেরা সেসব বিশ্বাসও করেছিল। ভোটটাও ঠিক সেইভাবেই হয়েছিল। এও এক আশ্চর্য কম্যুনিজম বটে! পুরুষতন্ত্রের একাধিপত্য সেখানেও! এতটুকুও হাত পড়লেই হলো। সবকজনে মিলে, একেবারে একত্রেই সব হট্টগোল পাকিয়ে বসবে। আমাদের এই প্রতিষ্ঠানে তাই আমরা কোথাও কোনও মহাপুরুষের ছবি টাঙাতে দিইনি”, মাধবী অল্প থামে, “তাঁদের বিষয়ে আমরা ছাত্রদেরকে পড়াই ঠিকই, কিন্তু তাঁদেরকে গুরু-মার্কা আসনে সজোরে চাপিয়ে দিইনি। সকলের কথাই সকলে সমান ভাবে জানুক। কেউ যেন কোনও মানুষকে একাদিক্রমে অন্ধভক্তিতে দেবতার আসনে না বসায়। অন্ধভক্তিতে কারোকে যেন সত্যি সত্যিই অন্ধ হয়ে যেতে না হয়। এই আমাদের আদর্শ এখন।” মাধবী চুপ করে গেল। হয়তো সে অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে ফেলেছে। কিন্তু এই কথাগুলো বলাও বোধ করি প্রয়োজন ছিল কোথাও। আদর্শের মুখোশ পরে একদিন যারা তাকে একঘরে করে দিয়েছিল, তাদের সেই ঘটনার মূল চক্রীকে এতদিন পরে সে যখন সামনে পেয়েইছে - কিছু কথাকে তখন স্পষ্ট করে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সমীরেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।

 

-“সরি, তোমার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই আশ্রমে ডিনারের সময় পার  করে এসেছ। খাবে কিছু? নীচের তলায় আরেকটা ঘর আছে। সেখানেই একটা তক্তপোশের ব্যবস্থা হয়েছে। তোমার সিকিউরিটির ব্যাপারটা”, মাধবী থেমে যায়।

-“আমরা ডিনার খেয়েই এসেছি, আর কনস্টেবল বাহাদুরকেও গাড়িতেই থাকতে বলে দিয়েছি”, জবাব দেয় সমীরেশ।

-“ভালোই করেছ। ওদিকে আমাদের ছাত্রদের ডরমিটরি। উপরতলায় সেই জায়গাতেই হলঘর করা রয়েছে। সেখানেই খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা, সবকিছু। আমাদের আয়োজন সামান্য।”

-“এভাবে আমার আসার কারণটা তুমি জিজ্ঞেস করবে না?” এতক্ষণে সমীরেশের গলাটা যেন একটু খাদে নামল। আত্মবিশ্বাসের অভাব?

-“জিজ্ঞেসের কি আছে, তুমি কল্যাণীর খোঁজে এসেছ। সে এখানে নেই।” স্পষ্ট গলায় মাধবীর উত্তর আসে।

-“তুমি বুঝতে পেরেছ আমি কল্যাণীর খোঁজে এসেছি?” সমীরেশ অবাক হয়ে গেছে।

-“লজ্জা করে না তোমার সমীরেশ? দাঙ্গা লাগানোর পর সেই রাত্তিরে যখন গ্রাম ছেড়ে সকলের সঙ্গে মিশে গিয়ে তোমরা পালালে, একবারের জন্যও মনে পড়ল না পার্টি অফিসে তখনও আমি, প্রিয়াংশু আর কল্যাণী আটকে রয়ে গিয়েছি! আমাদের কথা নাহয় নাই বা ভাবলে। কল্যাণীর কথাও তোমার একটিবারের জন্যও মনে পড়ল না?” মাধবীর গলাটা কেঁপে যায়, “অবশ্য পরে জেনেছিলাম, যে দাঙ্গার চক্রান্তকে রুখতে আমরা ওখানে অফিস খুলেছিলাম, ক্যাম্প করেছিলাম, তুমি – সেই তুমিই, তখনকার কমরেড সমীরেশ স্যান্যাল – সেই তুমিই তলে তলে ফাসিস্তদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই আগুনের পরিকল্পনা সাজিয়েছিলে। ধিক তোমাদের মতো কম্যুনিস্টদের। প্রিয়াংশু সেদিনই পাইপগানের গুলিতে মরেছিল; আর কল্যাণীর খবর আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গিয়ে চুপ করে মাধবী।

-“দশ বছর অপেক্ষা করেছি আমি মাধবী”, সমীরেশের গলাটা যেন একটু ভাঙা ভাঙা শোনায়।

-“কেন অপেক্ষা করেছ? এতদিন ধরেই বা কেন অপেক্ষা করতে হলো তোমায়?”

-“তোমার খবর পাইনি বহুদিন। মাস ছয়েক আগে খোঁজ পেলাম তুমি এখানে এসে উঠেছ।”

-“খোঁজ না পাওয়ারই কথা। পার্টির সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গের মাটিটাকেও যে ছেড়ে চলে এসেছিলাম। তবুও বলব তোমার খোঁজাখুঁজিতেও খামতি থেকে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্য সমীরেশ স্যান্যালের পক্ষে এই ভারতবর্ষের বুকে একটা মেয়েকে খুঁজে বের করা, যে কি না আবার এককালে তারই পূর্বতন পার্টিতে তারই অন্যতম সতীর্থ ছিল, তার পক্ষে এ কাজ বোধ করি এতটাও শক্ত ছিল না।”

 

সমীরেশ মাথাটাকে এপাশ ওপাশ করে। দৃশ্যতই সে অস্বস্তিতে পড়েছে।

 

-“আসলে তোমার কেরিয়রটাকে পরিপূর্ণরূপে গুছিয়ে নেওয়ার একটা প্রয়োজন ছিল বোধহয়। তারই জন্য তোমার আরও কিছুটা সময় দরকার ছিল। প্রায় দশবছর”, মাধবী স্বগতোক্তি করে, “দশ বছর!”

 

-“আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব মাধবী। সামনের ইলেকশনে আর আমি দাঁড়াব না”, সমীরেশ বলে ওঠে হঠাৎ।

-“সেসব তো জানতে চাইনি”, মাধবী জবাব দেয়।

-“এখানেও সেই একই দলাদলির ভিতরে আমি ফেঁসে গিয়েছি মাধবী। বিস্তর গোলমাল, এইখানেও।”

-“দলাদলির অন্ধকারেই তো রাজনীতির পরিসরটাকে তোমরা একেবারে পাঁকের চেয়েও নোংরা করে তুলেছ। এ বিষয়ে তো আমার আর নতুন করে কিছুই বলার নেই।” মাধবী অনড় হয়ে বসে থাকে।

-“আমি কালই চলে যাব মাধবী। কাল সকালেই চলে যাব। তুমি লক্ষ্মীটি আমাকে বলে দাও, কল্যাণীর কোনও খবর – যে কোনও খবর। সে বেঁচে আছে আমি নিশ্চিত জানি”, গলাটা আবারও কেঁপে যায় সমীরেশের, “আমি তার সাথেই”, মাধবী তাকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দেয়, “কল্যাণী আর বেঁচে নেই সমীর। সে মারা গেছে। কেবল এইটুকুই আমি বলতে পারি।” সমীরেশ স্থির হয়ে যায়।

 

-“আই ডোন্ট বিলিভ ইট”, টেবলের সজোরে হাত চাপড়িয়ে ওঠে সমীরেশ, “আই ডোন্ট বিলিভ ইট, মাধবী – প্লিজ, সত্যিটা বলো আমায়”, সমীরেশের গলায় আকুতি। মাধবী তার মন স্থির করে নিয়েছে।

-“এর বেশি আর কিছুই জানাব না তোমায়। এইটুকু শাস্তি তোমার প্রাপ্য”, মাধবীর গলাটা ক্রমশ বাইরের জোরালো কনকনে বাতাসের চেয়েও ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। সমীরেশ তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চড় মারবে নাকি? সেটুকু ক্ষমতা সমীরেশের আছে। পুরুষের ভিতরকার পৌরুষ জেগে ওঠে হঠাৎ!

 

-“বড়দি আসব ?” ঘরের পরিবেশটা হঠাৎই যেন শান্ত হয়ে যায়। সমীরেশ মুখ তুলে দেখে দরজার কাছে বছর দশেকের একটি ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে। “আয়”, মাধবী বলে ওঠে, “এত রাত্তিরে কি হলো আবার? ঘুম আসছে না?”

-“নরবুর মনে হয় অল্প জ্বর এসেছে। কাশছেও দেখলাম। তাই ওষুধ নিতে এসেছি”, ছেলেটি জবাব দেয়।

-“সেকি, দাঁড়া এখনই যাচ্ছি আমি”, মাধবী চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। সমীরেশকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমাকে এখনই যেতে হবে একটু। আমাদের কথাও বোধকরি ফুরিয়ে এসেছে। কাজেই”, হাতজোড় করার একটা ভঙ্গি করতে গিয়েও যেন করে না সে, “ডরমিটরির পাশেই একটা ঘরে আপনারও থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। যেতে যেতে আপনাকেও সেইটে দেখিয়ে দিই বরং। আসুন”, সে দৃঢ় পদক্ষেপে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

 

সমীরেশ স্যান্যাল আবারও হেরে গিয়েছে।

 

নিরাপত্তারক্ষী-সহ সমীরেশ স্যান্যালকে নিয়ে কুয়াশা-মাখা ভোরে পাকদণ্ডী বেয়ে বিদেশী গাড়িটা যখন মানালির দিকে নেমে গেল তখন সকাল ছটা বাজে। মাধবীর অনুরোধ সত্ত্বেও, এক কাপ চা অবধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সমীরেশ স্যান্যাল ‘সুরধুনী’তে মুখে তুলতে রাজি হয়নি। আরেকটু বেলা হতেই ভালো করে চোখমুখ ধুয়ে এসে, নিজে চা খেয়ে মাধবী কম্পিউটারটা খুলে বসল। উপরে ছাত্রদের সকালের প্রার্থনা শুরু হয়ে গেছে। আজ ওরা গাইছে রবীন্দ্রনাথের গান। তাই বলে রোজদিনই যে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয় তা নয়। বিভিন্ন ভাষার, এমনকি আঞ্চলিক দু’একটি ভাষাকে নিয়েও মোট পনেরোটি গান প্রার্থনাসঙ্গীত হিসেবে বেছে রাখা হয়েছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একেকদিন একেকটি করে গান গাওয়া হয়ে থাকে। যাতে করে কি না ছাত্রদের মানসিক বিস্তার ঘটে। নিজের মেইলবক্সটাকে খুলে বসেছে মাধবী। ড্রাফট ফোল্ডারে থাকা মেইলগুলোকে ডিলিট করতে হবে। কি শুভক্ষণেই না সমীরেশকে লেখা সেই মেইলটাকে তার সরকারি এ্যাড্রেসে পাঠাতে যাওয়ার আগেই মাধবীর ইনবক্সে সমীরেশের মেইল ঢুকেছিল। যে কথা মাধবী সমীরেশকে জানাতে চেয়েছিল, তার সঙ্গে দেখা করার পর মাধবী বুঝেছে সে খবর আর তাকে না জানানোই ভালো। ব্যক্তি সমীরেশের মানসিকতায় বিন্দুমাত্র বদল তো আসেইনি, উলটে নিজের সমস্ত জীবনটাকেই সে তিলে তিলে বিকিয়ে দিয়েছে আরও, আরোই আশ্চর্য এক জুয়োখেলার মজলিশে। সে মেইলটাকে ড্রাফট থেকে ট্র্যাশে পাঠাল। তারপর ট্র্যাশ ফোল্ডার থেকেও ডিলিট করে দিল।

 

-“বড়দি আসব?” আবারও দরজার কাছে কাল রাত্রের সেই ছেলেটা এসে দাঁড়িয়েছে, “ক্লাস টু আর থ্রিয়ের অঙ্ক ক্লাস আজকে হবে না। রেগেনজা ম্যাম আসতে পারবেন না। ওনার ঠাণ্ডা লেগেছে। মিনতি ম্যাম বললেন আপনাকে জানাতে”, ছেলেটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মাধবীর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করে।

-“আচ্ছা তুই যা, আমি দেখছি”, মাধবী জবাব দেয়। ছেলেটা ঘাড় নেড়ে ছুটে চলে গেল। মাধবী উঠে দাঁড়ায়।

 

‘সুরধুনী’র আবাসিকদের মধ্যে এই একটিই বাঙালী ছেলে রয়েছে। বাংলার সঙ্গে এই শেষ টান থেকে গিয়েছে মাধবীর। ওর নাম অভ্রজিৎ। দাঙ্গা থেকে প্রাণে বাঁচলেও, শেষমেশ চাইল্ডবার্থের সময় মাধবীরই কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিল কল্যাণী। চোখ বোজার আগে বলে গিয়েছিল, “ওর নাম রাখিস অভ্রজিৎ। ছেলে হলে আমার আর সমীরের ওই নামটাই পছন্দ ছিল। রাখিস লক্ষ্মীটি আমার! রাখবি তো?” প্রবল যন্ত্রণায় সে তখন চোখে অন্ধকার দেখছিল। মাধবীরও চোখে তখন অন্ধকার। সেই দিনই সমীর কলকাতার এক অনুষ্ঠানে রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজের আনুগত্য পরিবর্তনের কথা সরকারি ভাবে সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দেয়।

 

অভ্রজিৎ ডরমিটরিতে ফিরে গিয়েছে ...

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment