সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পিতৃচোখে মেয়েরা (পর্ব-১)

  • 19 June, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 414 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
 সামাজিক মাধ্যমে সবজান্তা জনতা, তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ  মন্তব্য পেশ করে, তাঁরা কতটা মুর্খ,নীচ, কদাকার, কুরুচিসম্পন্ন বারবার প্রমাণ করে চলেছেন ! সকলের হাতে স্মার্ট ফোন, সবার অবাধ যাতায়াত ফেসবুক, ইউটিউব,ইন্সটাগ্রামে। তাই চারিদিকে দেদার মণিমুক্তা খচিত মন্তব্য দেখে ভিরমি খেয়ে অক্কা পাওয়ার অবস্থা! নুসরত,পরিমনি, মিথিলা, সুতপা, পল্লবী, বিদিশা, রেণু সকলের চরিত্র নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। মৃত্যুর পর নিস্তার পাননি- সুতপা, পল্লবী, বিদিশারা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের পিতারা এবং তাদের শ্রমিকরা ইদানিং অতি লম্ফঝম্প শুরু করেছেন। নারীর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে ইনারা তাঁদের শাণিত তরবারি নিয়ে তেড়ে আসছেন! বিগত প্রায় চার হাজার বছর ধরে পিতারা দুইটি বিষয় নিয়ে ভীষণ  তৎপর হয়ে আছেন-  ক) নারীদের চরিত্র, খ) নারীদের পোশাক। অতি সম্প্রতি ভাইরাল কাকুর ভিডিও খুব চলছে। কাকু আমাদের হেড আফিসের বড়বাবু , রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি-"সারাদিন না পড়াশোনা করে ছেলেদের পিছনে ঘুরলে ফেল তো করবেই। সারাদিন গঙ্গার ঘাট, সিনেমা এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াও ছেলেদের সঙ্গে। এছাড়া সবসময় মোবাইল টিপতে থাক। কখনও ফেসবুক, কখনও ইউটিউব লেগেই আছে। আবার ফেল করেছ বলে বিক্ষোভ দেখাতে লজ্জা করে না।" উচ্চমাধ্যমিক  পরীক্ষায় ফেল করায়, পাশের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল শিক্ষার্থীরা, সেখানেই কাকু একজন কিশোরীর চরিত্র নিয়ে প্রকাশ্যে হেনস্থা করলেন। এই কাকুর ভিডিওর নিচে, তাকে সমর্থন জানিয়ে হাজার হাজার নারী,পুরুষ মন্তব্য করেছেন।

 

সামাজিক মাধ্যমে সবজান্তা জনতা, তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ  মন্তব্য পেশ করে, তাঁরা কতটা নির্বোধ,নীচ, কদাকার, কুরুচিপসম্পন্ন বারবার প্রমাণ করে চলেছেন ! সকলের হাতে স্মার্ট ফোন, সবার অবাধ যাতায়াত ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সট্রাগ্রামে। তাই চারিদিকে দেদার মণিমুক্তা খচিত মন্তব্য দেখে ভিরমি খেয়ে অক্কা পাওয়ার অবস্থা! নুসরত,পরিমনি, মিথিলা, সুতপা, পল্লবী, বিদিশা, রেণু সকলের চরিত্র নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। মৃত্যুর পর নিস্তার পাননি- সুতপা, পল্লবী, বিদিশারা! আমাদের নারীদের মাথায় এত সুন্দর ভাবে পিতারা ভাল চরিত্রের সংজ্ঞা পেরেক ঠুকে কিংবা গজাল গেঁথে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তাঁরাও এই গোলকধাঁধা থেকে বেরোতে না পেরে যথারীতি কু- মন্তব্য ভরিয়ে তুলছেন সামাজিক মাধ্যম । এই আজব ধাঁধার দুনিয়ায় খাবি খেতে খেতে হঠাৎ আমার মত অর্ধশিক্ষিত গর্দভের মনে হয়- কী হইতেছে? কেন হইতেছে? তো সেই মনে হওয়া থেকে  বিশেষজ্ঞরা, কী বলছেন, আমরা দেখে নেব। সামাজিক মাধ্যমে আপত্তিকর মন্তব্য যাঁরা করেন, তাঁদের মন্তব্য করার পিছনে যে কারণগুলি থাকে সেগুলি হল- পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব, মনোযোগ আকর্ষণ,মেয়েদের যৌনবস্তু হিসাবে দেখা, অসচেতনতা, নারীদের প্রতি বিদ্বেষ, হতাশা, তারকাদের প্রতি ঈর্ষা ইত্যাদি।

 

আদ্যিকাল থেকে নারীদের ভাল মেয়ে-মন্দ মেয়ের ছকে ফেলা, যৌন সম্পর্ক নিয়ে রসাত্মক গল্প ফাঁদা, বহু পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক, চরিত্রহীন তকমা দিয়ে, বেশ্যাদের মত পোশাক পরছে বলে দাবিয়ে রাখার হাজার একটা ফন্দিফিকির রয়েছে। ঘরেবাইরে, আনাচেকানাচে, পেশাগত ভাবে যে কাজ করুক, তারকা হন বা সাধারণস্য সাধারণ হরিদাসী পাল, কেউ পালাতে পারেন না। সকলের চরিত্র অতি ঠুনকো। চরিত্র  হনন এক লহমায় যে কেউ করে দিতে পারেন, এই ইন্টারনেট দুনিয়ায়! কিছুদিন আগে বঙ্গ জীবন তাজ্জব হয়ে উঠেছে দক্ষিণের ছবির স্টাইলে খুন দেখে। মফস্বল শহর বহরমপুরের ঘটনা। আমার মত অতি তুচ্ছ হরিপদ কেরানীর মত মানুষ এরকম সত্যিকার হয়েছে! দেখে-শুনে-ভেবে-চমকে একাকার হয়ে, খাবি খেয়ে, এতদিন ভয় পেয়ে চুপ করে মুখ বুজে পড়েছিলাম। ২ মে সুতপা খুন হয়। বহরমপুর  গার্লস কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুতপার বাড়ি মালদহের ইংরেজ বাজারে। তিনি বহরমপুরে সূর্য সেন রোডে গোরাবাজারে একটি মেসে থাকতেন। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ দুই যুবক এসে তাঁকে মেস থেকে বাইরে আসতে বলে। সুতপা বাইরে এলেই ধারালো অস্ত্র নিয়ে সুশান্ত তাঁর উপর অতর্কিতে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তাঁরা বাধা দিতে গেলে তাঁদের উপরও বন্দুক দেখিয়ে চড়াও হয় হামলাকারী। এর পরে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় ওই দুই যুবক। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই কলেজছাত্রীকে বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করে।(তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার অনলাইন, ৩ মে,২০২২)  সুতপা মারা যাবার পর নিস্তার পাননি। তাঁর চরিত্র নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্য প্রশ্ন তোলা হয়। সমাজে যেহেতু নারী চরিত্র অতি মূল্যবান, তাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দফায় দফায় বলে গিয়েছেন- এই মেয়ের চরিত্র খারাপ, তাই তাকে খুন করেছে। অনেকজন সুশান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন।

 

আমাদের আলোচনায় অতি সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে (ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব ) কী ভাবে নারীদের অপ্রীতিকর মন্তব্য করে চরিত্র হনন করা হচ্ছে সেইদিক তুলে ধরা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমগুলির আধেয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে নারীদের চরিত্র হননের মত অপমানকর বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী

ছবি : সৌজন্য ইন্টারনেট

 

0 Comments

Post Comment