- 19 July, 2022
- 0 Comment(s)
- 598 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
বিভাসকে খবরটা জানানোর জন্য ভিতরটা আঁকুপাঁকু করছে মল্লিকার। কদিন থেকে বলব বলব করেও বলতে পারছেনা সে। কোথা থেকে একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরছে। অথচ এবার না বললেই নয়। আজ বিভাস ফিরলে কথাটা বলেই ফেলবে মনে মনে ঠিক করে ফেলে মল্লিকা। খবরটা শোনার পর বিভাসের মুখের ভাবটা কেমন হবে? কী বলে উঠবে প্রথমে? ভাবতে গিয়ে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে ওঠে মল্লিকা।
বিভাসের আসার সময় হয়ে এল। একটা গানের কলি সুরেলা করে তোলে মল্লিকাকে। ঘরের চারপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে। চৌকিতে পাতা চাদরটা ফের একবার টানটান করে পাতে। আলনায় ভাঁজ করা জামা কাপড়গুলো নেড়েচেড়ে ঠিকঠাক করে। গুছিয়ে পরা শাড়িটার কুঁচিগুলো ভাঁজেভাঁজে মেলাবাবার চেষ্টা করে। বিভাস বেরিয়ে যাবার পর কিছুই প্রায় কাজ থাকেনা তার হাতে। সারাদিনের একঘেঁয়ে অবসরের পর এই ব্যস্ততাটুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে মল্লিকা। তাকের টুকিটাকি জিনিসের ভিতর থেকে ছোট্টো একটা আয়না হাতে তুলে নিয়ে মুখটা পরিষ্কার করে পরম যত্নে একটা টিপ পরে মল্লিকা। তারপর এক দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর এক আয়নায় তখন প্রতিবিম্বিত হতে থাকে অন্য এক ছবি।
ভিড় বাসের ভিতর কলেজ ফেরত মল্লিকা। বহুক্ষণ ধরে একজন মাঝবয়সি লোকের আপত্তিজনক স্পর্শ সহ্য করে চলেছে সে। ঘেন্নায় শরীর রিরি করছে। কিন্ত প্রতিবাদের সাহস নেই। ভিড়ের কারণে সরে দাঁড়ানোর উপায়ও নেই। এমত অবস্থায় একগোছা বই হাতে হকারবেশী তরুণ বিভাস ভিড় ঠেলে মল্লিকার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। ভিড়টা এলোমেলো হয়ে যায়। মাঝবয়সি লোকটিও ছিটকে যায় আগের অবস্থান থেকে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে মল্লিকার। বই দেখার বাহানায় বিভাসকে কিছুটা সময় আটকে রাখে। শেষে অপ্রয়োজনীয় দুটো বই কিনে ফেলে সে। বই দেওয়ানেওয়া, দাম দেওয়ার ফাঁকে বেশ কবার চোখাচোখি হয় দুজনার। নিমেষের মধ্যে একটা ভাললাগা এসে জড়িয়ে যায়। চোখের সেই ভাষা পড়ে নিতে অবশ্য অনেকগুলো দুপুর অনেকগুলো বিকেল লেগেছিল তাদের দুজনের। একসময় বুঝতে পারে তারা একে অন্যকে ছাড়া বাঁচতে পারবেনা।
কিছুদিন যেতে মল্লিকার মা কিছু একটা আঁচ করে ফেলে। তার বিয়ের ঠিক হয়। ছেলে সরকারি অফিসের কেরানি। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ের পাত্র হিসেবে যথেষ্ট ভাল। বিভাসের কথাটা বাড়িতে বলতে তার কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বিভাসের বাড়িতেও এত তাড়াতাড়ি বিয়ে প্রশ্রয় পায়না কোনমতে। এরপর একটা পথই খোলা থাকে তাদের কাছে।
ঘড়ির দিকে তাকায় মল্লিকা। সাতটা বাজে। সাড়ে সাতটার বাস চলে যাবার পর লোকজন বিশেষ থাকেনা মফস্বল শহরের বাস স্টপটিতে। সেখনেই বিভাসের ছোট্ট দোকান। দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় আটটা বেজে যায়। প্রতিদিনের মত রাস্তার দিকের জানালাটা খুলে দাঁড়ায় মল্লিকা। এখানে দাঁড়ানোটা এই কটা মাসের অভ্যাসে কেমন একটা নেশার মত হয়ে গেছে। অচেনা মানুষজনের ভিড়ে হঠাৎ করে বিভাসকে আবিষ্কার করা, এটা যেন একটা খেলা মল্লিকার কাছে। একটা অন্য রকম অনুভূতি, একটা খুশির ঝিলিক। এই রোমাঞ্চটুকুর জন্য বিভাসের প্রতীক্ষায় থাকা প্রতিটি মুহুর্ত বড় সাধের মল্লিকার কাছে।
সামনের রাস্তায় রমাকে দেখতে পায় মল্লিকা। পরনে হলুদ রঙের পাটভাঙ্গা তাঁতের শাড়ী। লাল ব্লাউজ। ফর্সা ঘাড়ে লুটিয়ে আছে একটা আলগা খোঁপা। এমনিতেই সে সুন্দরী। হলুদ শাড়িত আরও মোহময়ী লাগছে তাকে।
— কিগো! বরের পথ চাওয়া হচ্ছে? মল্লিকার চোখে চোখ পড়তে কৌতুকের স্বরে বলে রমা। বলবার মত কিছু না পেয়ে লাজুক হাসে মল্লিকা।
— রোজ রোজ দেরি করছে বুঝি? কষে ধমক দিতে পারনা?
— কোথাও যাচ্ছ রমাদি? কথা ঘোরায় মল্লিকা। নয়তো কি! সেজেগুজে হাওয়া খেতে বেরিয়েছি? পরক্ষণেই মল্লিকা বলে— একদিন আমাদের বাড়ি এসো না?
— যাব একদিন। আঁচল উড়িয়ে হাঁটা দেয় রমা।
রমাসেন। বিভাসের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় ছেলে টোটোনকে নিয়ে একাই থাকে। একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ায়। রমাদি না থাকলে কি হত ভাবতে ভয় করে মল্লিকার। সেই দুর্দিনে বন্ধুর মত, অভিভাবকের মত তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল এই রমাদি। মল্লিকার ঘর সংসার, বিভাসের দোকান সমস্তই তার সহায়তায়। পুরোনো কথা তুলে যখনতখন ঠাট্টা করতে ছাড়েনা রমাদি— “পালাবেই যখন ঠিক করলে তখন বাড়ি থেকে কিছু হাতাতে পারলেনা? নাকি তোমাদের উঠল বাই তো দরগা যাই! হাত আর পা সম্বল করে ট্রেনে উঠে বসলে? দুটির সেই ঝোড়োকাকের মত চেহারা মনে পড়লে আজো আমার হাসি পায়।” টাকাপয়সার কথা ভাবার মত অবকাশ তখন ছিলনা। বিচ্ছেদের ভয়টাই সেদিন তাদের ঘরছাড়া করেছিল। সেকথা রমাদিকে বোঝানোর চেষ্টা করেনা মল্লিকা বা বিভাস। শুধু দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ।
সামনের রাস্তায় লোক চলাচল কমে এসেছে। বিভাসের ফেরার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। এত দেরি তো করেনা বিভাস? কাকে ডাকবে? পাড়ার কারো সঙ্গে তেমনভাবে পরিচয় হয়নি। আনচান করে ওঠে মল্লিকা। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে সে। বিভাসের দোকান সে চেনে। হয়তো হিসাবের খাতা নিয়ে বসেছে। কটা বেজেছে খেয়ালই নেই! নাকি ঘুমিয়ে পড়ল? পরিশ্রম তো কম হয়না? মল্লিকা অনেক বার শুনেছে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিভাস বিড়বিড় করছে— “চানাচুর পাঁচ প্যাকেট, চা পাতা, বিস্কুট, সাবান কুড়ি পিস--।” বিভাসের ঘুমন্ত মুখখানা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দৃষ্টি নরম হয়ে আসে মল্লিকার।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে বিভাসের দোকানের কাছাকাছি এসে পড়ে মল্লিকা। এতখানি পথ উজিয়ে একাএকা এখানে আসা কি উচিত হল? ঘোর কাটতে বেশ ভয় ভয় করে। আশেপাশের সব দোকান বন্ধ। প্রায় অন্ধকার জায়গাটায় কেমন একটা বুনো গন্ধ। বিভাসের দোকানের দিকে এগিয়ে যায় সে। ভিতরে আলো জ্বলছে। দরজার ফাঁকে তার মৃদু আভাস। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পরম নির্ভরতায় ভেজানো দরজায় হাত রাখে মল্লিকা। একটু ঠেলতেই ভেজানো দরজা হাট করে খুলে যায়। হতবম্বের মত সেদিকে তাকিয়ে থাকে সে। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বিভাস! আর তাকে পাকে পাকে জড়িয়ে আছে একটা হলুদ শাড়ি! ভালো করে দেখার চেষ্টা করে মল্লিকা। সমস্ত কিছু ঝাপসা ঠেকে। একটা হলুদ আঁচল ছাড়া কিছুই ঠাওর হয়না আর। পায়ের তলার মাটিটা কেঁপে ওঠে। মাথাটা ঘুরতে থাকে। ভীষণ বমি পায়। দু হাতে মুখ চেপে ছুটতে শুরু করে মল্লিকা। একটা হলুদ আঁচল তাকে তাড়া করতে থাকে। সামনে আগাছার জঙ্গল। সে ঢুকে পড়ে গভীরে। আগাছা জড়িয়ে যায় শরীরে। বসে পড়ে মল্লিকা। হড় হড় করে বমি করে ফেলে।
কতক্ষণ এলোমেলো হেঁটেছে খেয়াল নেই। একটা ট্রাক আসছে। হেড লাইটের আলোটা ক্রমশ তীব্র হতে শুরু করেছে। মনস্থির করে ফেলে সে। না! কোন পিছুটান নাই তার! ওই তো এসে পড়ল? শরীরটা টানটান করে ছুটন্ত দানবটার দিকে পায়ে পায়ে এগোতে থাকে মল্লিকা। হঠাৎই সব যেন উলোটপালট হয়ে যায়। শরীরের ভিতর আর একটা প্রাণের অস্তিত্ব প্রবল ভাবে টের পায় মল্লিকা। আমুল কেঁপে ওঠে সে। তার পা দুটি ভারি হয়ে মাটিতে গেঁথে যায়। চতুর্দিকের নীরবতা ছিন্ন করে মল্লিকার গা ঘেঁষে ট্রাকটা বেরিয়ে যায়। ধাতস্ত হতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। তারপর পরম মমতায় তলপেটে হাত রাখে মল্লিকা। গা থেকে শুকনো কুটো খুঁটে খুঁটে তুলে ফেলতে থাকে। শুধু চোর কাঁটাগুলো বিঁধেই থাকে এখানে সেখানে। একরাশ অবসাদ নিয়ে চেনা রাস্তায় উঠে আসে মল্লিকা।
পুনঃপ্রকাশ
লেখক : ছোটগল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment