সুলতানার স্বপ্ন

  • 23 May, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 700 view(s)
  • লিখেছেন : ‌চন্দন আঢ্য
স্বপ্নিল গল্পের প্রতি টানের কারণে কখনোই রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ পড়তে যাবেন না। এই বই পাঠককে মুহুর্মুহু চাবুক মেরে সৎ ও সচেতন রাখার বই। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ আমাদেরকে নিয়ে এমন এক রম্যস্থানে দেয় স্বপ্ন-উড়ান— যেখানে না-আছে মহামারি বা মশাবাহিত রোগ, না-আছে অকালমৃত্যু বা দুর্ঘটনার প্রকোপ।

সময় শারদীয়া রাত। আকাশে গোল থালার মতো ঝকঝকে পূর্ণচন্দ্র। চাঁদের চন্দ্রিমায় উজ্জ্বল রাতের পৃথিবী। এতই উজ্জ্বল যে রাতেই সুলতানাকে ‘সুপ্রভাত’ সম্বোধন করছেন সারা। ‘অন্ধকারের হৃদয় হতে উৎসারিত আলো’। কে এই রোমান্টিক রাতে আমাদের প্রথাগত দাম্পত্যছক ভেঙে বেরোতে উৎসাহিত করছেন? কে শেখাচ্ছেন নারী-শিক্ষায়ন ও ক্ষমতায়ন ছাড়া কিছুতেই দূর করা যাবে না কুসংস্কারাচ্ছন্নতাকে? অবিদ্যার অন্ধকারকে? অসুখ-বিসুখকে? শেখাচ্ছেন রোকেয়া। আজ থেকে প্রায় ১০৪ বছর আগের পৃথিবীতে। নারীদের নিয়তি ছিল তখন মোটের উপর ‘রাঁধার’পরে খাওয়া আর খাওয়ার ’পরে রাঁধা’। কোথায় শেখাচ্ছেন? তা হলে দেরি না করে এই মুহূর্তে সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করুন ‘সুলতানার স্বপ্ন’।

স্বপ্নিল গল্পের প্রতি টানের কারণে কখনোই এই বই পড়তে যাবেন না। এই বই পাঠককে মুহুর্মুহু চাবুক মেরে সৎ ও সচেতন রাখার বই। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ আমাদেরকে নিয়ে এমন এক রম্যস্থানে দেয় স্বপ্ন-উড়ান--যেখানে না-আছে মহামারি বা মশাবাহিত রোগ, না-আছে অকালমৃত্যু বা দুর্ঘটনার প্রকোপ। এইসব সাধারণ স্বাস্থ্যবিধির কথা সে-যুগের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হলেও আজকের ইন্টারনেটের যুগে বেশ একঘেয়ে, বড়ো সেকেলে। তাহলে ২০২০-তে দাঁড়িয়েও কেন পড়বো এই বই? সেই কথাতেই এবার সরাসরি আসি।

আজকের পৃথিবীতে দিনদিন প্রাসঙ্গিকতর হয়ে উঠছে ‘সুলতানার স্বপ্ন’। সারা পৃথিবীর মানবসভ্যতা আজ নিজেকে মন্থন করে যত্রতত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে অসহিষ্ণুতার বিষবাষ্প। প্রায় সবাই সবাইকে আড়চোখে দেখে। আবিল হয়ে যাচ্ছে আমাদের দৃষ্টি, আমাদের বুদ্ধি। নাগিণিরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর সংহতির কথা এখন সত্যিই পরিহাসের মতো শোনায়। কে মুক্তি দেবে এইসময় আমাদের? রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কোন্‌ আজন্ম-বন্ধু দেবেন আশ্রয়? তিনিই তো আমাদের শোনালেন শান্তির সেই ললিত বাণী ‘অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো’। এই একই কথা কিন্তু আমাদের শুনিয়েছেন রোকেয়াও। অবশ্যই একটু কম উচ্চকিতভাবে। শোনাচ্ছেন এই বইতেই। চিনিয়ে দিচ্ছেন সমস্যা-মুক্তির পথ। তাই তো তিনি তাঁর এই বইয়ের কল্পিত ‘নারীস্থান’-এর ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিলেন ‘প্রেম ও সত্য’-কে। কাউকে পর করলেন না। মৃত্যুদণ্ডের বিধান পুরোপুরি নস্যাৎ করে ছাড়লেন। ভালোবাসলেন মানুষকে। অপরাধীকেও। দিলেন তাঁদের সংশোধনের সুযোগও। তাই অপরাধের জন্য বিধান থাকলো শাস্তির। অপরাধী যদি অনুতপ্ত হন, তাহলে পুরোনো সামাজিক বৃত্তে নতুন করে তাঁর প্রবেশের কোনো বাধা থাকলো না। রোগীর বদলে রোগের চিকিৎসার গুরুত্ব আমাদের হাতে ধরে শেখালেন রোকেয়া।

রোকেয়া জানতেন, সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষার। এবং অতি অবশ্যই বৈজ্ঞানিক শিক্ষার। বিজ্ঞানই পারে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে। ‘নারীস্থান’-এর নারীরাও তাই রীতিমত বিজ্ঞান-শক্তিতে বলীয়ান। ঋতু অনুযায়ী তাঁরা ঘরবাড়ির উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই কাজে  আসে গতি। ৮ ঘণ্টার কাজ সম্পন্ন হয় মাত্র ২ ঘণ্টায়। রাস্তাঘাট হয়েছে পরিষ্কার। শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে অপরাধ। সৌরচুল্লির ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে অপুনর্নবীকরণযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডারকে অক্ষুণ্ণ রাখার। এত প্রগতিশীল ভাবনার একত্র সমাবেশ ১৯০৫ সালে সত্যিই আশাতীত। এরকম উদাহরণ আরও অনেক আছে বইতে। উৎসাহী দরদি পাঠকেরা অবশ্যই সন্ধান পাবেন সেইসব মণি-মুক্তোর। রোকেয়ার এই বিস্ময়কর সৃজনীশক্তি অবশ্যই দাবি করে আমাদের শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রমের। 

‘নারীস্থান’ ঠিক কী, তা আর এই লেখায় খোলসা করলাম না। এইটুকু অতৃপ্তি থাক। চাইছি, আপনারা এই অস্বস্তিটুকু কাটানোর জন্য পড়েই ফেলুন ‘সুলতানার স্বপ্ন’। জেনে নিন ‘মর্দ্দানাপ্রথা’ কী? আর পড়তে পড়তে মনের মধ্যে গেঁথে নিন এই সত্য--বাহুবলের তুলনায় মস্তিষ্কবল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। দেখবেন, নিজের অজান্তেই হয়তো-বা কখন করে ফেলছেন ভবিষ্যৎ-পৃথিবী থেকে দুর্বলের উপর সবলের লাঞ্ছনার নিষ্ঠুর ইতিবৃত্তকে মুছে ফেলার মুষ্ঠিবদ্ধ অঙ্গিকার।

রোকেয়ার ‌‘‘Sultana’s Dream‌’‌’ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন  মাদ্রাজের ‘Indian Ladies Magazin‌e’-‌এ প্রকাশিত হয়েছিল। পরে রোকেয়া নিজেই বাংলায় অনুবাদ করেছেন।

প্রকাশক: চরাচর, ডি–৪৮, ক্যালকাটা গ্রিনস কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স, ১০৫০/২ সার্ভে পার্ক, কলকাতা–৭০০ ০৭৫, ফোন: 9433109853 দাম: ৭০ টাকা

লেখক বাংলার অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী

 

0 Comments

Post Comment