- 13 December, 2020
- 0 Comment(s)
- 1045 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
যদি ধরে নিই মনঃসমীক্ষক ফ্রয়েডের কথাই ঠিক, স্বপ্নই হল মনের অচেতনে জমা-হওয়া ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ, অর্থাৎ স্বপ্নের রাজপথ ধরেই উলটো-রথের যাত্রায় চলে যাওয়া যায় মনের অন্তঃপুরে, চিনের নেওয়া সম্ভব ‘আঁতের কথা’, তাহলে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ হল এমন এক কল্পিত স্থান যা ‘ইচ্ছা হয়ে’ ছিল রোকেয়ার ‘মনের মাঝারে’। ১৮৮০ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলাদেশের ‘পায়রাবন্দ’ গ্রামের অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেওয়া রোকেয়া হলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারীবাদী লেখক। তিনি চেয়েছিলেন পুরুষতন্ত্রের শিকল ভেঙে লিঙ্গবৈষম্যহীন, শ্রেণিবৈষম্যহীন এক আদর্শ সমাজ গঠনের। দাবি করেছিলেন নারীর ‘অর্ধেক আকাশ’-এর মর্যাদা। রোকেয়া-কল্পিত সেই রাষ্ট্রই হল ‘নারীস্থান’। কেমন হবে সেই কল্পিত রাষ্ট্রের চরিত্র? ভগিনী সারা পর্দানশিন সুলতানাকে জানান, ‘নারীস্থান’ হল এমন এক আদর্শ দেশ যেখানে মহামারি বা মশা-বাহিত রোগের কোনো স্থান নেই। দুর্ঘটনা ছাড়া অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা ক্ষীণ। নেই অন্নাভাব, চারিপাশ ঝকঝকে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। স্বাভাবিকভাবেই প্লেগ বা ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দুর্লক্ষ্য।
ঠিক কোন্ সময়ে সুলতানাকে ‘নারীস্থান’-এর কথা বলছেন ভগিনী সারা? সময় শারদীয়া রাত। আকাশে পূর্ণগৌরবে পূর্ণিমাচন্দ্র। দাম্পত্যঋতুর এই সময়েই প্রথাগত দাম্পত্যছক ভেঙে বেরোচ্ছেন রোকেয়া। শোনাচ্ছেন পুরুষদের অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকার কাহিনি। রাতেই সুলতানাকে ‘সুপ্রভাত’ সম্বোধন করছেন সারা। ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’।
এই নারীস্থানের সর্বোচ্চ পদাধিকারী একজন নারী। তিনিই সেখানকার মহারানি। রোকেয়ার মতো সেই মহারানিও বুঝেছিলেন যে, শিক্ষাই হল দেশের অগ্রগতির প্রধান অবলম্বন। তাই মহারানির ইচ্ছায় সরকারি প্রচেষ্টায় স্থাপিত হল অসংখ্য বালিকা বিদ্যালয়। পল্লিগ্রামেও আছড়ে পড়ল বিদ্যাচর্চার ঢেউ। শিক্ষার বিমল জ্যোতিতে মুছে গেল অবিদ্যার অন্ধকার। বন্ধ হল বাল্যবিবাহ। দূরীভূত হল কুসংস্কারাছন্নতা। রোকেয়া অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, নারীদের উন্নতির জন্য প্রয়োজন তাঁদের স্বাধীন জীবিকা অর্জন এবং আত্মার বিকাশ। আর আত্মার বিকাশের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। কল্পিত নারীস্থানে রোকেয়া তাই মহিলাদের হাতে তুলে দিলেন বিজ্ঞানশিক্ষার পূর্ণ অধিকার। দেখিয়ে দিলেন বিজ্ঞানের ক্ষেমংকর রূপ। বিনা রক্তপাতে শুদ্ধমাত্র বুদ্ধি আর বিজ্ঞানের জোরে যুদ্ধ জয়ের কৌশল।
এই প্রসঙ্গে একটু পাদটীকা জুড়ে দিলে হয়তো অনুচিত হবে না। পিতৃতান্ত্রিক জমিদার পিতার প্রথম পক্ষের সন্তান ছিলেন রোকেয়া। বড়ো হয়েছেন কঠোর অবরোধ প্রথার মধ্যে। মেয়েদের পড়াশোনার কোনো সুযোগই ছিল না সেখানে। তাই হয়তো-বা তিনি চেয়েছিলেন তাঁর কল্পিত ‘নারীস্থান’-এ নারী-শিক্ষার সুযোগ হোক শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো সহজ, সরল, অবারিত। নিজের জীবনের অতৃপ্তিকে তো এভাবেই আমরা শিল্প-সাহিত্যের মধ্য দিয়ে পূরণ করে তৃপ্ত হতে চাই। না হলে কেন বলুন তো, যে মুকুন্দ চক্রবর্তী নিজে কোনোমতে শালুক-ডাঁটা চিবিয়ে দিনাতিপাত করেছিলেন, তিনি তাঁর সৃষ্ট চরিত্র কালকেতুর হাতে তুলে দিলেন ‘তে-আঁটিয়া তাল’।
সাল ১৯৩২। প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থ। এখান থেকে একটু আলাদা করে বেছে নেওয়া যাক ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতাটি। কবিতায় রয়েছে অত্যন্ত সাধারণ এক মেয়ের ইচ্ছার কথা। কী তার ইচ্ছা? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম হয়ে মালতী বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করুক। সেখানে জ্ঞানী, বিদ্বান মহলে জুটুক প্রচুর সমাদর। কিন্তু এতেই খুশি হতে পারলো না মালতী? কারণ পিতৃতন্ত্রের নির্দেশ মিশে গেছে তার রক্তে, মজ্জায়। তার ইচ্ছা সেখানকার বিদ্বৎমহল তাকে আবিষ্কার করুক “শুধু বিদুষী ব'লে নয়, নারী ব'লে”। নারীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিশ্ববিজয়ী জাদুকেই শেষ পর্যন্ত সে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে বিদ্যার চেয়ে। নিজের দৃষ্টিকে ‘মোহিনী’ বলে আত্মপ্রসাদও লাভ করেছে বিলক্ষণ। বোঝা যায়, যতই নরেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব তৈরি করতে চাক না কেন মালতী, নিজেকে সে কিন্তু দেখছে পুরুষের চোখ দিয়েই। ‘চোখ পালটায়ে কয়’ সমীকরণটি তখনও তার মধ্যে তৈরি হয়নি। অথচ এর ২৭ বছর আগেই ‘নারীস্থান’-এর পরিকল্পনা ছকে ফেলেছেন রোকেয়া। একজন নারীকেই তিনি করে তুলেছেন সেই অঞ্চলের রক্ষাকর্তা, শাসক। নিজেকে সেই মহারানি ব্যাপৃত রাখেন বিজ্ঞান সাধনার কাজে। উন্নততর প্রযুক্তির সাহায্যে ভারতবর্ষের চেয়ে সেই স্থান এগিয়ে রয়েছে কয়েক আলোকবর্ষ পথ। সূর্যের উত্তাপকে ব্যবহার করে তৈরি করে ফেলেছে জ্বালানি-বিহীন রান্নার পদ্ধতি। সৌরচুল্লির প্রয়োগে স্বাভাবিকভাবেই কমে গেছে দূষণ। এই তাপশক্তিকে ব্যবহার করেই ঠান্ডার দিনে ঘরবাড়ি গরম রাখার কৌশল তারা করায়ত্ত করেছে, শত্রুকে করেছে ছত্রভঙ্গ। ‘নারীস্থান’-এর নারীরা কিন্তু ‘সবলা’ হওয়ার পর কখনোই সমাজ-নির্মিত নারীত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। আর এখানেই ২৭ বছর আগেকার মালতীকে হারিয়ে এগিয়ে গেছে সিস্টার সারা ও তার মহিলা প্রতিবেশীরা। মালতীদের সমস্যাটা ঠিক কোথায় তা রোকেয়া জানতেন। সমস্যার স্বরূপ নির্ধারণে তাই তিনি বলে গেছেন : “আমাদের মন পর্য্যন্ত দাস (enslaved) হইয়া গিয়াছে”। নিরন্তর তিনি তাই চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এই মানসিক দাসত্ব থেকে নারীকে মুক্তি দেওয়ার। স্বপ্ন দেখলেন ‘নারীস্থান’-এর। পুরুষকে সেখানে বন্দি করলেন অন্তঃপুরে। নম্র আর ভীরুতাকে চিহ্নিত করলেন ‘পুরুষভাবাপন্ন’ স্বভাব হিসাবে।
বিজ্ঞান সাধারণত ছেলেরাই পড়ে, মেয়েরা মূলত আর্টস--এই চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিক চিন্তন-প্রণালীর মূলে কুঠারাঘাত করে মহারানি সারাদিন নিমগ্ন থাকেন বিজ্ঞানচর্চায়। তাঁর রাষ্ট্রের কাদম্বিনী বিজয়ী বিদ্যালয় বৃষ্টির জলকে বেলুনের সাহায্যে ধরে রেখে একদিকে দেশকে যেমন ঝড়-বৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করেছে, অন্যদিকে ইচ্ছামতো বৃষ্টির সুব্যবস্থা করে অনাবৃষ্টির করাল থাবা থেকে দেশকে বাঁচিয়েছে। আজ সেখানকার রাস্তাঘাটে কাদার চিহ্নমাত্র নেই, মেঘের মধ্যে জমে থাকা জলকে ধরে রেখে গরমের সময় কৃত্রিম উপায়ে বাড়িঘরকে বানিয়েছে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত।
খালি মেঘ-ছেঁচে জল নয়, সূর্যের উত্তাপকে ধরে রাখার কৌশলও আজ তাদের করায়ত্ত। ‘নারীস্থান’-এ রান্না হয় সৌরচুল্লিতে। শীতের সময় সূর্যকরের সাহায্যে ঘরবাড়ি গরম রাখার সুব্যবস্থা সেখানে আছে। সেই সূর্যোত্তাপকে সংহত করে প্রতিপক্ষ শত্রুর দিকে তাক করে প্রবল উত্তাপে তাদের ছত্রভঙ্গ ও দগ্ধ করে যুদ্ধজয়ের কৌশলও তাদের আয়ত্তগম্য। বিদ্যুতের সাহায্যে ‘নারীস্থান’-এ কৃষিকাজ সম্পন্ন হয়, বায়ু-শকটও চালিত হয় বিদ্যুতের দ্বারা। সেদেশে রেলপথ নেই, তাই রেল-দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও নেই। আছে পায়ের হাঁটার পথ। তা আবার কুসুম-শয্যা বিশেষ।
জেনানাপ্রথার বিপরীতে এই ‘নারীস্থান’-এ রয়েছে ‘মর্দ্দানা’ প্রথা, পুরুষরা থাকে অন্তঃপুরে আবদ্ধ। ফলে শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে অপরাধের সংখ্যা। পুরুষ তাদের কাছে বন্যজন্তুর উপমায় উপমিত। পুরুষের প্রতি রোকেয়ার এই ক্রোধ কিন্তু আকস্মিক নয়, অনবরত, ধারাবাহিক। দেখুন, ‘নরাকারে পিশাচ’ পুরুষদের প্রতি বিদ্রুপ করে কী লেখা হয়েছে ‘পদ্মরাগ’-এ : “ডাকাতী, জুয়াচুরি, পরস্বাপহরণ, পঞ্চ ‘মকার’ আদি কোন্ পাপের লাইসেন্স্ তাঁহাদের নাই?” ‘ডেলিশিয়া-হত্যা’-য় জানানো হয়েছে, পুরুষের চেয়ে কুকুরজাতি অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ। স্বাভাবিকভাবেই রোকেয়ার কাছে পুরুষের বাইরের জগতে বিচরণ নারীর জন্য নিরাপদ নয়। অন্তঃপুরে তাঁদের আটকে রাখতে পারলেই অনেক বিপদ এড়ানো সম্ভব। পরম তৃপ্তিতে সুলতানা উচ্চারণ করেন : “আমি প্রাণে বড় আরাম পাইলাম;- পৃথিবীতে অন্ততঃ এমন একটি দেশও আছে, যেখানে পুরুষজাতি অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকে”।
পুরুষেরা রোকেয়ার কাছে অশিক্ষিত, অমার্জিতরুচি। ধৈর্যহীন। চারুশিল্পে অপারগ। কায়িক শ্রম ছাড়া অন্য কোনো কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ নেই। তবে Dignity of Labour বা শ্রমের মর্যাদা রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। ‘নারীস্থান’ কর্মবিভাজনে বিশ্বাসী। নরনারী উভয়েই কাজ করেন সেখানে। নারীরা করেন মস্তিষ্কচালনা, আর পুরুষেরা শারীরিক পরিশ্রম। পুরুষ সেখানে শরীর, নারী মন। বাইরের কাজ নারীরা মাত্র ২ ঘণ্টায় সম্পন্ন করেন। কলহের কোনো সময় তাঁদের নেই। বাহুবলের অনেক ঊর্ধ্বে রয়েছে মস্তিষ্কবলের গুরুত্ব।
এই নারীস্থানের ধর্ম কী? নিজের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন ধর্মানুশাসন কেবল মানুষের মধ্যে দাসত্বের ভাবকেই দৃঢ় করেছে, কিছুতেই মানুষের উন্নতি বা উদারতার সহায় হয়ে উঠতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সব ধর্মকেই বাতিল করে দেন রোকেয়া। নিজের কল্পিত ‘নারীস্থান’-এ একমাত্র একটি ধর্মকেই স্থান দিলেন। কী সেই ধর্ম? ‘প্রেম ও সত্য’। অনিবার্যভাবেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান সেখানে নেই। শাস্তি হল অপরাধীকে দেশত্যাগে বাধ্য করানো। তবে অপরাধী অনুতপ্ত হলে, তাকে মার্জনা করা হয়। এইজন্যই তো জেলখানাকে ‘সংশোধনাগার’ বলা হয়। ‘সুলতানার স্বপ্ন’-তে ভগিনী সারা জানান, “আমরা পরস্পরকে ভালবাসিতে ধর্ম্মতঃ বাধ্য এবং প্রাণান্তেও সত্য ত্যাগ করিতে পারি না।” রোকেয়া জানতেন এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাই এখনও ‘শিক্ষিত’ ইউরোপে দেখা যায়,পুরুষ আর নারীর বেতন বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্র। সিমোন দ্য বোভোয়ারের দেশ ফ্রান্সে পুরুষ যেখানে ভোটাধিকার পায় ১৭৮৯ সালে, নারীকে সেখানে প্রবল আন্দোলনের মাধ্যমে ভোটাধিকার অর্জন করতে হয় ১৯৪৪ সালে। আজও পূর্ণ সময়ের কোনো মহিলা রাষ্ট্রপতি খুঁজে পেল না ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’র ফ্রান্স। দিনে দিনে তাই আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে রোকেয়ার শাণিত অভিমত।
রোকেয়ার এই রচনা যুগাতিক্রমী। যুগের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন তিনি। সংকীর্ণ ধর্মচেতনার ঊর্ধ্বে তিনি প্রেম ও সত্যকেই রাষ্ট্রের একমাত্র আচরণীয় ধর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। সৌরচুল্লি, বিদ্যুৎ, সূর্যকর বা মেঘের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জলের ব্যবহার বিষয়ে, অর্থাৎ অফুরান পুনর্নবীকরণযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার বিষয়ে দেশবাসীকে সচেতন করা তাঁর দূরদৃষ্টি বা Vision-কেই আমাদের চিনিয়ে দেয়। তাই আজও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক।
লেখক : অধ্যাপক
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট
0 Comments
Post Comment