- 10 December, 2020
- 0 Comment(s)
- 782 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
বিয়ে করার পর বিবাহিত মহিলারা পৃথিবী থেকে উপহার হিসাবে পান কিছু আইনি অধিকার যা তাঁকে পুরুষের খামখেয়ালি ইচ্ছার থেকে রক্ষা করে। কিন্তু মহিলারা বিয়ের পর একেবারে স্বামী-মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন। অর্থনৈতিকভাবে পুরুষেরাই হলেন সম্প্রদায়ের প্রধান ব্যক্তি এবং এই ধারণাকে সমাজের চোখে পুরুষেরাই মূর্ত করে তোলেন। বিয়ের পর একজন মহিলা পুরুষের পদবি গ্রহণ করেন, তাঁর ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন, তাঁর সামাজিক অবস্থান এবং চারপাশের সঙ্গে নিজেকে একীভূত করেন, নিজেকে স্বামীর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেন। এইভাবে একজন মহিলা হয়ে ওঠেন পুরুষের ‘অর্ধেক’।
কাজের ডাকে স্বামীকে যেখানে যেতে হয়, স্ত্রীকেও সেখানে চলে যেতে হয়। প্রকৃতপ্রস্তাবে ছেলেদের কাজের জায়গাই ঠিক করে দেয় তাঁদের বিবাহিত জীবনের ঠিকানা। কম-বেশি নির্মমতার সঙ্গেই একজন মহিলা নিজের অতীত জীবনের সঙ্গে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁর স্বামীর জগতের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে দেন। স্বামীকে তিনি তারপর নিজের সবটুকু দেন : কুমারীত্ব ও কঠোর সতীত্ব। কুমারী মেয়ের আইনি অধিকারের একটি অংশ এরপর তিনি হারিয়ে ফেলেন। রোমান আইনও স্বামীর হাতে স্ত্রীকে তুলে দিয়েছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে Bonald ঘোষণা করেছিলেন, একজন শিশুর কাছে তার মা যেরকম, একজন স্ত্রীর কাছে তাঁর স্বামীও তদনুরূপ। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের আইনও মহিলাদের কাছ থেকে স্বামীর প্রতি আনুগত্য বা বশ্যতাই দাবি করে এসেছে। আইন এবং প্রথা পুরুষের ওপর বেশ বড়ো রকমের কর্তৃত্বই প্রদান করতো আর এই কর্তৃত্ব মিশিয়ে দেওয়া হত পুরুষের অবস্থান, এমনকি তাঁদের বিবাহিত সমাজের মধ্যেও।
আজকের দিনেও বিবাহ এইরকম ঐতিহ্যের একটি বড়ো অংশ ধরে রেখেছে। শুরুতেই বলতে হয়, বিবাহ বিষয়টি একজন যুবক ছেলের চেয়ে একজন যুবতী মেয়ের ওপর আরও কঠোর বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের বাইরে সমাজে আরও নানান গুরুত্বপূর্ণ স্তর আছে যার সম্পর্কে কোনো ধারণাই তাঁকে দেওয়া হয় না। কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিবাহিত মহিলারা হলেন সমাজের চোখে ব্রাত্য। বাবা, ভাই বা দেবর-ভাসুরের ভৃত্য হয়েই তাঁকে দিন কাটাতে হয়। শহরে চলে যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। বিবাহ তাঁকে একটি পুরুষের দাস করে তুলে তাঁকে উপপত্নীতে পরিণত করে।
কিছু বুর্জোয়া পরিবারে মেয়েদের এখনও উপার্জনে অক্ষম করে রাখা হয়। বাপের বাড়িতে তিনি কেবল পরজীবীর মতো চিন্তাহীন অলসভাবে জীবন-যাপন করেন অথবা কোনো অচেনা বাড়িতে একটু নীচু কাজ করতে রাজি থাকেন। এমনকি যে-সব ক্ষেত্রে তাঁরা একটু বেশি মুক্ত, বেশি স্বাধীন, সেখানেও ছেলেরা যে অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করেন, তা মেয়েদের বাধ্য করে চাকরির থেকে বিয়ে করাকে অগ্রাধিকার দিতে। মেয়েরা তখন এমন এক স্বামীর সন্ধানে থাকেন, যাঁর অবস্থা তাঁর নিজের চেয়ে ভালো অথবা আশা করেন স্বামী তাঁর চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে পারবেন এবং এত দূর এগিয়ে যাবেন যে স্ত্রী তাঁকে ধরতে পারবেন না। এখনও পর্যন্ত এটাই মেনে নেওয়া হয়েছে যে, মেয়েদের দিক থেকে ভালোবাসা হল পুরুষের প্রতি এক ধরনের সেবা। পুরুষেরা এই আনন্দ গ্রহণ করেন এবং এর প্রতিদান দিতে বাধ্য থাকেন।
মহিলাদের শরীর হল একটি ক্রয়যোগ্য পণ্য। এই শরীর হল মহিলাদের কাছে এমন এক মূলধন যা তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে পারেন। কিছুক্ষেত্রে তাঁরা তাঁদের স্বামীকে পণ এনে দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেন গৃহস্থালীর কিছু নির্দিষ্ট কাজে, বাড়িঘরের যত্ন নিতে, সন্তানের প্রতিপালন করতে। সব ক্ষেত্রেই তাঁর অধিকারের মধ্যে পড়ে অন্যের হাতে নিজের ভরণপোষণের ভার ছেড়ে দেওয়া এবং ঐতিহ্যবাহী নৈতিকতা মহিলাদের এই কাজেই উৎসাহ দেয়। বিয়ে করার এই সুবিধাগুলোর জন্য স্বাভাবিকভাবেই মহিলারা বিয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন যেহেতু মহিলাদের কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজের প্রশংসা পায় না এবং তাঁদের কম বেতন দেওয়া হয়। বিয়েই তাই তাঁদের কাছে অন্য অনেক কিছুর থেকে অনেক বেশি সুবিধাজনক ক্যারিয়ার। রীতিনীতি বা আচার-প্রথাই কুমারী মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা লাভের পথকে কঠিন করে তুলেছে। প্রায় আজকের দিন পর্যন্ত ফ্রান্সে বিবাহিত মহিলাদের ব্যভিচারিতাকে অপরাধ হিসাবে দেখা হয়েছে, যেখানে এমন কোনো নিয়ম নেই যা কোনো মহিলার স্বাধীন ভালোবাসাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। তবে যদি তিনি কোনো প্রেমিক রাখতে চান, তাহলে তাঁকে আগে বিবাহিত হতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক।
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট।
0 Comments
Post Comment