বিবাহিত নারী (একুশ)

  • 27 January, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 640 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
এমনকি বয়সের পার্থক্য সামান্য হলেও আসল কথা হল, একটি অল্পবয়সি মেয়ে এবং একটি অল্পবয়সি ছেলেকে সাধারণত ভিন্নভাবে বড়ো করে তোলা হয়। মেয়েটি যেখানে আবির্ভূত হয় নারীসুলভ জ্ঞান এবং নারীসুলভ মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক নারীবিশ্ব থেকে, পুরুষটি সেখানে রঞ্জিত হয় পুরুষ-নৈতিকতার দ্বারা। একে-অপরকে বোঝা প্রায়শই তাঁদের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে পড়ে এবং দ্বন্দ্ব শুরু হতে আর দেরি হয় না।

আজকের দিনে ব্যবধান কম গভীর, কারণ অল্পবয়সি মেয়েরা এখন কম কৃত্রিম সত্তা। তাঁরা এখন আরও ভালোভাবে তথ্যসমৃদ্ধ, জীবনের জন্য আরও ভালোভাবে সজ্জিত। কিন্তু এখনও প্রায়শই তাঁরা তাঁদের স্বামীদের চেয়ে অনেক ছোটো। এই বিষয়ের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। (বয়সের কারণে) এই অসম পরিপক্বতার পরিণতিগুলি প্রায়শই লিঙ্গের পার্থক্য হিসাবে গ্রহণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই বিবাহিত নারী হলেন একটি শিশু, তার কারণ এটা নয় যে তিনি নারী। প্রকৃতপক্ষে তার কারণ তিনি খুবই অল্পবয়সি। তাঁর স্বামী এবং স্বামীর বন্ধুদের গাম্ভীর্য তাঁকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। বিবাহের প্রায় এক বছর পর সোফি টলস্টয় লিখেছিলেন : 

তিনি বৃদ্ধ এবং খুবই আত্ম-নিমগ্ন। আর আমি, আমি নিজেকে আজ ভীষণ তরুণ বোধ করছি এবং আমার বন্য কিছু করার প্রবল ইচ্ছা করছিল। বিছানায় যাওয়ার পরিবর্তে আমি চাইছিলাম পিরুয়েত করতে, কিন্তু কার সঙ্গে?

বার্ধক্যের একটি পরিবেশ আমাকে ঘিরে রেখেছে। আমার চারপাশের সবই বার্ধক্যগ্রস্ত। যৌবনের প্রতিটি উচ্ছ্বাসকে আমি দমন করার চেষ্টা করেছি যেহেতু তা এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায় না এবং সেটাই যুক্তিসংগত।

নিজের দিক থেকে স্বামী তাঁর স্ত্রীর মধ্যে একটি ‘শিশু’-কে দেখেন। স্বামীর কাছে স্ত্রী তাঁর প্রত্যাশিত সঙ্গী নন এবং স্বামী এই বিষয়টি স্ত্রীকে উপলব্ধি করান। স্ত্রী অপমানিত হন। প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাপের বাড়ি থেকে বেরোনোর পর স্ত্রী একজন গাইড বা পথ-প্রদর্শক খুঁজতে পছন্দ করেন, যদিও তিনিও চান তাঁকে একজন ‘সাবালিকা’ হিসাবে দেখা হোক। তিনি মনেপ্রাণে ইচ্ছা করেন শিশু থাকতে, তিনি চান নারী হয়ে উঠতে। বয়সে বড়ো স্বামী কিছুতেই স্ত্রীর সঙ্গে তেমনভাবে আচার-ব্যবহার করতে পারেন না যা স্ত্রীকে সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট করে।
এমনকি বয়সের পার্থক্য সামান্য হলেও আসল কথা হল, একটি অল্পবয়সি মেয়ে এবং একটি অল্পবয়সি ছেলেকে সাধারণত ভিন্নভাবে বড়ো করে তোলা হয়। মেয়েটি যেখানে আবির্ভূত হয় নারীসুলভ জ্ঞান এবং নারীসুলভ মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক নারীবিশ্ব থেকে, পুরুষটি সেখানে রঞ্জিত হয় পুরুষ-নৈতিকতার দ্বারা। একে-অপরকে বোঝা প্রায়শই তাঁদের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে পড়ে এবং দ্বন্দ্ব শুরু হতে আর দেরি হয় না।
বিবাহ যেহেতু সাধারণত স্ত্রীকে স্বামীর অধীনস্থ করে, তাই সর্বোপরি স্ত্রীর কাছেই দাম্পত্য সম্পর্কের সমস্যাগুলি সমস্ত তীক্ষ্ণতা এবং তীব্রতা নিয়ে উত্থাপিত হয়। বিবাহের কূটাভাষ হল : একইসঙ্গে বিবাহের রয়েছে ইরোটিক এবং সামাজিক কাজ। যুবতী স্ত্রীর কাছে স্বামী যে-ছবিটি উপস্থাপন করেন, সেখানেই এই দ্বৈধ প্রতিফলিত হয়। স্বামী হলেন একজন অর্ধ-দেবতা, যিনি পুরুষসুলভ প্রতিপত্তির দ্বারা সমৃদ্ধ এবং পিতার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য পূর্ব-নির্দিষ্ট : রক্ষক, জোগানদাতা, শিক্ষক, পথ-প্রদর্শক। তাঁর ছায়াতেই বিকশিত হওয়া উচিত স্ত্রীর জীবন। তিনি মূল্যবোধের ধারক, সত্যের গ্যারান্টার, দম্পতির নৈতিক ন্যায্যতা। কিন্তু তিনি একজন পুরুষ যার সঙ্গে এমন একটি অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে হবে যা প্রায়শই লজ্জাজনক, উদ্ভট, ঘৃণ্য বা বিপর্যস্তকর, যে-কোনো ক্ষেত্রেই আকস্মিক। নারীকে তিনি আমন্ত্রণ জানান পাশবিকতায় গা এলিয়ে দিতে, যদিও অন্যদিকে তিনি স্ত্রীকে দৃঢ়ভাবে পরিচালিত করেন আদর্শের দিকে।
ফেরার পথে এক সন্ধ্যায় প্যারিসে তাঁরা থামলেন। মিউজিক হলের অনুষ্ঠান দেখে হতবাক হয়ে ব্যার্নার স্পষ্টতই সেই মিউজিক হল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন : “বিদেশিরা এটা দেখে কী ভাববেন! কী লজ্জা! এটা দেখে আমাদের কী বিচার করবেন তাঁরা ...” তের‍্যাস বিস্মিত হয়েছিলেন যে এই শালীন মানুষটিই সেই ব্যক্তি এক ঘণ্টার মধ্যে অন্ধকারে যাঁর অধ্যবসায়ী উদ্ভাবনের কাছে নিজেকে অবশ্যই সমর্পণ করতে হবে। 

মেন্টর এবং পশু-প্রকৃতির ব্যক্তির মধ্যে অনেক সংকর রূপ সম্ভব। কখনও কখনও পুরুষটি একইসঙ্গে হয়ে ওঠেন পিতা এবং প্রেমিক। যৌন কাজ হয়ে ওঠে একটি পবিত্র বেলেল্লাপনা। স্ত্রী এমন একজন প্রেমিকা যিনি স্বামীর বাহুতে সম্পূর্ণ সমর্পণের মাধ্যমে-কেনা একটি নিশ্চিত মুক্তি খুঁজে পান। বিবাহিত জীবনের মধ্যে এই প্রেম-আবেগ খুবই বিরল। কখনও কখনও বিবাহিত মহিলা তাঁর স্বামীকে প্ল্যাটোনিকভাবে ভালবাসবেন, কিন্তু নিজেকে তিনি একজন অতি-সম্মানিত পুরুষের হাতে ছেড়ে দিতে অস্বীকার করবেন। এরকম এক মহিলার কেস রিপোর্ট করেছেন স্টেকেল : “শ্রীমতী ডি এস একজন মহান শিল্পীর বিধবা স্ত্রী যাঁর বয়স এখন চল্লিশ। স্বামীকে ভালোবাসলেও স্বামীর সঙ্গে তিনি সম্পূর্ণ কামোত্তেজনাহীন ছিলেন”। বিপরীতে, স্বামীর সঙ্গে তিনি একটি আনন্দ জানতে পারেন যা তাঁকে একটি সাধারণ অসম্মানের শিকার করে তোলে এবং যা তাঁর শ্রদ্ধা এবং সম্মানকে হত্যা করে। অন্যদিকে, একটি ইরোটিক ব্যর্থতা চিরকালের জন্য স্বামীকে পাশবিক পদে নামিয়ে দেয়। বিপরীতভাবে, আমরা দেখেছি যে কীভাবে অবজ্ঞা, বিদ্বেষ, হিংসা বিবাহিত নারীদের উৎসর্গ করে কামোত্তেজনাহীনতায়। প্রায়শই যা ঘটে তা হল, যৌন অভিজ্ঞতার পরে স্বামী থেকে যান তাঁর সম্মানিত উচ্চপদে আর তাঁর পাশবিক দুর্বলতাগুলিকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। মনে হয়, অন্য অনেক ঘটনার মধ্যে এই ঘটনাও ঘটেছিল আদ্যাল উগো-র সঙ্গে। অথবা, সম্মান ছাড়াই তিনি একজন চমৎকার সঙ্গী। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের একটি রূপকে কে. ম্যানসফিল্ড বর্ণনা করেছেন তাঁর ছোটোগল্প ‘প্রিলিউড’-এ :

তিনি সত্যিই তাঁকে ভালোবাসতেন। তিনি তাঁকে যত্নে আগলে রাখতেন, তাঁর প্রশংসা করতেন এবং অত্যন্ত সম্মান করতেন। ওহ! এই পৃথিবীর সবার চেয়ে বেশি। গভীরভাবে তিনি তাঁকে চিনতেন। তিনি ছিলেন অকপট, শ্রদ্ধেয় এবং সমস্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সরল, এক্কেবারে বুদ্ধিমান, অল্পেতে খুশি, সামান্যতেই বিরক্ত ... যদি তিনি তাঁর দিকে ঝাঁপিয়ে না-পড়তেন, এত জোরে জোরে চিৎকার না-করতেন, আগ্রহী এবং প্রেমময় চোখে তাঁর দিকে না-চেয়ে থাকতেন। তিনি ছিলেন তাঁর জন্য ভীষণ শক্তিশালী। শৈশব থেকেই তিনি এমন জিনিসগুলি ঘৃণা করতেন যা তার দিকে ছুটে আসে। এমনও কিছু সময় ছিল যখন তিনি ভীতিকর, সত্যিই ভীতিকর হয়ে উঠতেন। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনি তখন চিৎকার করার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন : “তুমি আমাকে মেরে ফেলতে যাচ্ছ!” এরপর তাঁর প্রবল ইচ্ছা হত কঠোর কথা, ঘৃণ্য কথা বলতে ... হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটা সত্যি ছিল; স্টানলির প্রতি তাঁর সকল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং মুগ্ধতা সত্ত্বেও স্টানলিকে তিনি ঘৃণা করতেন। আগে কখনোই স্পষ্টভাবে তাঁর এই অনুভূতি হয়নি। স্টানলির প্রতি তাঁর সমস্ত অনুভূতিই ছিল স্পষ্ট, নির্দিষ্ট এবং একটির মতো অন্য অনুভূতিও ছিল সত্য। আর এই অন্যরকম অনুভূতি--এই ঘৃণা ছিল বাকি সব কিছুর মতোই খুব অকৃত্রিম।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

 

0 Comments

Post Comment