ঘেরাটোপ (পর্ব- ১০)

  • 30 August, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 107 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
কফির পরিভাষা অনুযায়ী মোকা বলতে কড়া এসপ্রেসো শটস, তার উপরে ডার্ক চকোলেটের আস্তরণ। সবার উপরে দুধ আর ফেটানো ক্রিমের প্রলেপ। ঘুম তাড়ানোর জন্য তো উপযোগী বটেই, তাছাড়া ডার্ক চকোলেটের তিক্ত স্বাদ রীতিমতো নেশা তৈরি করে দেয়। আজকেও তাই মোকা নিয়েছিল সুবর্ণ। সে আজকের স্কুপটাকে নিয়ে ভাবছিল। যদিও হাতে সময় খুব কম। কাল সকালের মধ্যেই যদি বের করা না যায়, দুপুরের পরেই কিন্তু বিষয়টা আর স্কুপ থাকবে না। “উই আর গোয়িং টু পিক হিম আপ টুমরো, লেট আফটারনুন,” উর্দি পরা ভারিক্কি চেহারার মানুষটির স্পষ্ট কণ্ঠস্বর।

“চেজ করতে হবে সুবর্ণ! তোমাকে স্টোরিগুলোকে চেজ করতে হবে – যে করেই হোক …” সুবর্ণের শরীর জুড়ে অন্ধকার। সুবর্ণ আর পারছে না বোধহয়। তার চোখের সামনে কেবল অনেকগুলো আলোর বিন্দু খেলা করে বেড়ায়। রাগ হচ্ছে সুবর্ণের। সে চিৎকার করতে চায়। সবটুকু বিরক্তি, সবটুকু কষ্ট-দুর্বিষহতাকে ছাপিয়ে সে আঙুল বাড়িয়ে আকাশ খুঁজতে চায়। ক্রমশ সুবর্ণ অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে।

 

অথচ আধঘণ্টা আগেও তো উৎসাহে চনমন করে নিজের অফিসে এসে ঢুকেছিল সুবর্ণ। তিন মাসের উপর কেটে গিয়েছে। মুম্বাইতে এসে ওয়েস্টার্ন এজের অফিস। হিন্দুস্থান ক্রনিকলার্সের পরেপরেই খাস মুম্বাইয়ের ওয়েস্টার্ন এজের মতো কাগজে সুবর্ণ যে ঢুকতে পড়তে পারবে এমনটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি কোনও দিন। দক্ষিণ মুম্বাইয়ের কেম্পস কর্নারে যে ক্রসওয়ার্ডের দোকান, তারই উলটো দিকে শালিমার হোটেলের প্রাসাদোপম অস্তিত্ব, এরই মাঝে ওয়েস্টার্ন এজের অফিস। কাজেই অফিসের ফাঁকে ফাঁকে ক্রসওয়ার্ডে ঢুঁ মারাটাও সুবর্ণের দৈনন্দিন অভ্যাস। পাশেই একটি ছোট কাফে-কাম-রেস্তোরাঁ। সাধারণ কাপুচিনোর পাশাপাশি এই রেস্তোরাঁর মোকা কফিটির প্রতিও ইদানীং সুবর্ণের বেশ একটু দুর্বলতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। আজও ফিল্ড সেরে অফিসে আসার আগেই তাই ক্রসওয়ার্ডে ঢুকে পড়েছিল সুবর্ণ। চিফ এডিটর সুরেশ মানসুখানির অফিসে ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়। জানা আছে তার। অথচ এই স্টোরিটা সুরেশকে না দেখিয়ে নিলে ফাইনাল কপিতে দেওয়া যাবে না। অত্যন্ত সেনসিটিভ মেটিরিয়ল। সুবর্ণ মাঝে মাঝে ভীষণ অধৈর্য  হয়ে পড়ে। বয়সের কারণে যা একেবারেই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। ক্রাইম রিপোর্টিং তার বরাবরের পছন্দের বিষয়। তবু খাস মুম্বাই শহরে প্রথমেই একজন জুনিয়র সাংবাদিককে সাধারণত ক্রাইমের এ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয় না। এই বিষয়ে সুরেশেরও যথেষ্ট আপত্তি ছিল গোড়ায়। কিন্তু সুবর্ণের যিনি ইমিডিয়েট সিনিয়র, তিনিই সুরেশকে বলতে গেলে একরকম জোর করেই রাজি করান। সেই ক্ষমতাও তাঁর ছিল বলেই।

 

স্পষ্ট উচ্চারণে তিনি সুরেশকে বলেছিলেন, “মেয়ে বলে কি মনুষ্যেতর কোনও জীব সুরেশ? এই ট্যাবুগুলো থেকে আমরা তাহলে কবে বেরুতে পারব? এই আমাদের এমপাওয়ারমেন্ট?” সুরেশ আর কথা বাড়াননি। যদিও মুম্বাই অপরাধনগরীতে প্রথমেই নাশকতামূলক অপরাধের ঘটনায় একজন জুনিয়রকে ঠেলে দেওয়া চলে না। তাই প্রথমে আর্থিক দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলোতেই সুবর্ণকে পাঠানো হতে থাকে। গত তিনমাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাইলাইন পেয়েছে সুবর্ণ। কিন্তু আজকের যে স্কুপ সেটা ফ্রন্ট পেজে গেলেও সে আশ্চর্য হবে না। ক্রসওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে বই দেখতে দেখতে সে উৎকণ্ঠার সঙ্গে একেকবার হাতের স্মার্টওয়াচটার দিকে তাকায়। বিকেল ছটা পনেরো। আবারও সে বইয়ের তাকগুলোর দিকে নজর করতে থাকে। ফিকশন, নন-ফিকশন, হিস্টোরিক্যাল। পরপর কয়েকটি বই সে হাতে তুলে নেয়। গত পরশুই স্যালারির দিন ছিল। তার মন উশখুশ করে ওঠে। উৎসাহে ফুটতে ফুটতে তার তর সইছে না একেবারেই। কফি খাওয়া যাক। দুটো বই সে পছন্দ করে কিনে পাশের রেস্তোরাঁয় গিয়ে কফির অর্ডার দেয়।

 

“চেজ করতে হবে সুবর্ণ! তোমাকে স্টোরিগুলোকে চেজ করতে হবে – যে করেই হোক …”

 

কফির পরিভাষা অনুযায়ী মোকা বলতে কড়া এসপ্রেসো শটস, তার উপরে ডার্ক চকোলেটের আস্তরণ। সবার উপরে দুধ আর ফেটানো ক্রিমের প্রলেপ। ঘুম তাড়ানোর জন্য তো উপযোগী বটেই, তাছাড়া ডার্ক চকোলেটের তিক্ত স্বাদ রীতিমতো নেশা তৈরি করে দেয়। আজকেও তাই মোকা নিয়েছিল সুবর্ণ। সে আজকের স্কুপটাকে নিয়ে ভাবছিল। যদিও হাতে সময় খুব কম। কাল সকালের মধ্যেই যদি বের করা না যায়, দুপুরের পরেই কিন্তু বিষয়টা আর স্কুপ থাকবে না। “উই আর গোয়িং টু পিক হিম আপ টুমরো, লেট আফটারনুন,” উর্দি পরা ভারিক্কি চেহারার মানুষটির কণ্ঠস্বর সুবর্ণের কানে এসে ধাক্কা মারে, “সো উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট, মেক ইট ফাস্ট।” এই ক’মাসেরই ভিতর যে কতকিছু শিখতে পারল সুবর্ণ। অথচ এই কেসটাকে নিয়ে সে কাজ করতে শুরু করেছিল মাত্র হপ্তা-দুই।

 

মুম্বাই-সাতারা হাইওয়ের উপর পরিত্যক্ত একটা গাড়িকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ভিতরে ছিল গুলিবিদ্ধ ড্রাইভারের লাশ, আর ডিকিতে পাওয়া গিয়েছিল নগদ এক কোটি টাকার নোট। দুটো কালো স্যুটকেসে ভাগাভাগি করে ঠাসা। টাকাটা যে খুনীরা ওভাবে ফেলে দিয়ে গিয়েছে, সেই থেকেই বোঝা গিয়েছিল কেবল টাকার জন্য এই ঘটনা নয়। কোনও একটি বিশেষ গ্যাং অন্য কোনও গোষ্ঠীকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্য থেকেই এই কাজ করেছে। তবুও যেখানে উদ্ধার হওয়ার টাকার পরিমাণ কোটির অঙ্কে বলতে হয়, বড় ধরণের কাউকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যেই যে এমন পরিকল্পনা সাজানো পুলিশ এমনকি সাংবাদিকেরাও তা বুঝতে পারে। তদন্ত শুরু হয় দুপক্ষেই। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত তথ্য থেকে বিরাট কিছু জানা না গেলেও ব্যাপারটা যে জমি সংক্রান্ত কোনও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত অনেকেই তা আন্দাজ করতে পারে। সুবর্ণও নিজস্ব পদ্ধতিতে এই স্টোরিটাকে চেজ করতে থাকে। শুরু হয় মুম্বাই জুড়ে বিবিধ সোর্স-ইনফর্মারদের সঙ্গে কথা চালাচালি। তথ্য মিলছিল না তেমন। দিনদুয়েক আগেই প্রথম লিড পায় সুবর্ণ। আন্ধেরি ওয়েস্ট এলাকায় মগরা নালার ধার বরাবর এক ঘুপচি চায়ের দোকানে এক স্থানীয় ইনফর্মার তাকে প্রথম দেয় খবরটা। গুরুত্ব দেখে সুবর্ণ বুঝতে পারে সরকারি কোনও সূত্রের তরফে বিষয়টা যাচাই করে নিতে না পারলে এই খবর ছাপা অসম্ভব। তখনই সুবর্ণ ক্রাইম ব্রাঞ্চের দ্বারস্থ হয়।

 

মুম্বাই ক্রাইম ব্রাঞ্চ, জয় ভবানী মার্গ, ভাসি নাকা, চেম্বুর। মহারাষ্ট্র ৪০০০৭৪। ডিসিপি সমর্থ তাওড়ে অবাক হয়ে বাঙালি সুবর্ণের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চেনা মুখ, কিন্তু অতটাও চেনা নয়। ক্রাইম ব্রাঞ্চের প্রেস কনফারেন্সগুলোয় গত এক-দু’মাস যাবৎ নতুন এই মুখটিকে তিনি দেখেছিলেন বটে, কিন্তু দুঁদে অন্য সমস্ত সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মীদের ভিড়ে আলাদা করে সেভাবে নজর করেননি। এই মেয়েটিই কিভাবে ঠিক ইন্দ্রায়নী রিভার ব্রিজের গাড়ির ব্যাপারটাকে সোর্স লাগিয়ে বের করে ফেলেছে। তবুও বিস্ময় লুকিয়ে রাখেন তাওড়ে। ঘটনার গুরুত্ব বুঝেই অফিসার মৃত্যুঞ্জয় শেলভাঙ্কর সরাসরি সুবর্ণকে ডিসিপি স্যরের চেম্বারে এনে হাজির করেছে। ডিসিপি তাওড়ে সোজাসুজি সুবর্ণের দিকে তাকান।

 

-“টেল মি ম্যাডাম আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?” তিনি জিজ্ঞেস করেন।

-“ক্যান ইউ কনফার্ম মাই লিড?” সুবর্ণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “আপনারা কি সত্যিই এই ব্যক্তিকে সন্দেহ করছেন?”

 

ডিসিপি তীক্ষ্ণ চোখে সুবর্ণকে মেপে নিতে থাকেন। অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। তবুও এথিক্স, কনভেনশন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সঠিক ভাবে মেনে চললে কোনও পক্ষেরই অসুবিধা হবার কথা নয়। তবু এই মেয়ে কি প্রথা মেনে চলতে অভ্যস্ত? নাকি তরুণ তুর্কি হিসেবে হঠাৎই কোনও হঠকারী রিপোর্ট বাজারে ছেড়ে দিয়ে নিজের কেরিয়র গোছাতে চায়? সুবর্ণ পালটা তাকিয়ে থাকে। সমর্থ তাওড়ে বলেন, “সরকারি ভাবে এই বিষয়ে আমি যে আপনাকে কিছু বলতে পারি না, এটা আপনি নিশ্চয়ই জানেন?” সুবর্ণ মৃদু হাসে। সত্যি হাসে কিনা সঠিক বোঝাও যায় না তেমন। “সরকারি ভাবে আমি আপনার বিবৃতি চাইতে আসিনি। আপনার কেরিয়রে এতদিন ধরে সাংবাদিক হ্যাণ্ডল করে আপনিও নিশ্চয়ই সেটা বোঝেন?” সুবর্ণ স্ট্রেট ব্যাটে খেলতে চায়। প্রসন্ন হন সমর্থ। মেয়েটির গ্রুমিং রয়েছে। তিনি ইশারায় মৃত্যুঞ্জয়কে বাইরে যেতে বলেন। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে সে বাইরে চলে যায়। সমর্থ তাওড়ে বলেন, “কনফার্ম করছি। ক্রাইম ব্রাঞ্চ সূত্রে এই বিষয়ে জানা গিয়েছে, আপনি এভাবে লিখতে পারেন।” সুবর্ণের মুখে এইবার চওড়া হাসি ছড়ায়। সমর্থ বুঝতে পারেন মেয়েটি তিলে তিলে নিজে গড়ে তুলতে চায়। “থ্যাঙ্কিউ স্যর,” সুবর্ণ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, “আমি তাহলে স্টোরিটা রান করছি।” ডিসিপি সমর্থ হাত তোলেন, “দাঁড়ান, ম্যাডাম। আরও একটা বিষয় তো আপনার জানা প্রয়োজন বোধহয়।” সুবর্ণ থমকে তাকায়। ডিসিপি হাত তুলে ঘড়ি দেখেন, “দিস টাইম টুমরো, দ্য এ্যাকিউজড উইল বি বিহাইণ্ড দ্য বারস। আমরা দিল্লি থেকেও এই ব্যাপারে ভার্বাল অর্ডার আনিয়ে নিয়েছি। সেন্টার থেকেও এই কেসটার বিষয়ে একটা প্রেসার রয়েছে। কাজেই, উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট, মেক ইট ফাস্ট।”

 

প্রায় ছুটতে ছুটতে ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসেছিল সুবর্ণ। “মেক ইট ফাস্ট!” আজ রাতের মধ্যেই স্টোরিটা রান করাতে হবে। কোনওমতে পরিচিত এক রেস্তোরাঁয় ঢুকে ল্যাপটপ খুলতে খুলতেই ইমিডিয়েট সিনিয়রকে ফোন করে সুবর্ণ। “ম্যাডাম, ইন্দ্রায়নী রিভার ব্রিজের কেসটায় আমার লিডটাই কারেক্ট। মুম্বাই পুলিশ এ্যাকশন নিতে চলেছে। ওরা মেঘনাথ শিণ্ডেকে এ্যারেস্ট করবে বলে কনফার্ম করেছে।” “হোয়াট!” সিনিয়র ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করেন, “আর ইউ সিওর? কে কনফার্ম করেছে এটা? আর ইউ প্রিটি সিওর এ্যাবাউট দিস সুবর্ণ?” তাঁর গলায় স্পষ্ট অবিশ্বাস। “ডিসিপ তাওড়ে হ্যাজ কনফার্মড দিস ম্যাডাম!” সুবর্ণের গলায় আত্মবিশ্বাস, “এ্যাণ্ড দে আর গোয়িং টু মেক দ্য এ্যারেস্ট টুমরো।” এক নিঃশ্বাসে সে পুরো খবরটা উগরে দেয়। ওপাশে সুবর্ণের সিনিয়র বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। “মেক দ্য স্টোরি সুবর্ণ, এইট হাণ্ড্রেড ওয়ার্ডস। আমি সুরেশের সঙ্গে কথা বলছি। রান ইট থ্রু হিম ফার্স্ট, দেন উই প্রোসিড।” আবারও ওপাশের কণ্ঠ নীরব হয়ে যায় কিছুক্ষণ। একটু পরেই আবার যেন কিছুটা বিধ্বস্ত গলায় শোনা যায়, “আজকেই খবরটা আসতে হল,” ম্যাডামকে হঠাৎ ক্লান্ত শোনায় খুব। সুবর্ণ উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন ম্যাডাম? হোয়াট এ্যাবাউট টুডে?” “নাথিং,” গলা আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে, “সুরেশের মে বি একটু দেরী হতে পারে আজ। তুমি কপিটা তৈরি করে আমায় পাঠাও। দেন, অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করো। এ্যাজ সুন এ্যাজ সুরেশ কামস, ওকে দেখিয়ে নিয়ে উই রান ইট।” ফোন কেটে যায়।

 

ক্রসওয়ার্ডের পাশের রেস্তোরাঁয় বসে আবারও ঘড়ির দিকে তাকায় সুবর্ণ। সিনিয়র স্টোরিটা ‘ওকে’ করে দিয়েছেন অনেকক্ষণ। তার কাপের কফিও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজতে যায়। সুবর্ণ টেবল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। একটু আগেই সুরেশ মানসুখানির নীলরঙা টয়োটা আর্বান ক্রুজার অফিসের গেট পেরিয়ে ভিতরে গিয়ে ঢুকেছে। সুবর্ণ কফির দাম মিটিয়ে দেয়।

 

“চেজ করতে হবে সুবর্ণ! তোমাকে স্টোরিগুলোকে চেজ করতে হবে – যে করেই হোক …”

 

চেজ শব্দটা শুনলেই আজও কুঁকড়ে যায় সুবর্ণ সেন। তার সেই বদ্ধ কুঠুরিটাকে মনে পড়ে। অন্ধকার সেই রাত।

 

চেম্বারে ঢুকতেই সেদিন সে হালকা মদের গন্ধ পেয়েছিল। অথচ সুরেশের চরিত্রের এই দিকটার বিষয়ে কিছু জানা ছিল না তার। সুবর্ণের সিনিয়র অবশ্য জানতেন সবটুকুই। তাঁর জানার কারণও ছিল অনেক। কিন্তু সেই খবর সুবর্ণ অবধি কোনও দিন পৌঁছনোর আগেই সবকিছু ভেঙে পড়েছিল। স্টোরিটা নিজের ল্যাপটপে পড়তে পড়তে সুরেশ হাত নেড়ে সুবর্ণকে চেয়ার ছেড়ে উঠে টেবলের ওপাশে ওনার দিকে চলে আসতে বলেছিলেন। “ভালো স্টোরি হয়েছে সুবর্ণ,” একটা মৃদু উচ্ছাসপূর্ণ গলার স্বর। সুরেশের হাত সুবর্ণের কাঁধে মৃদু চাপড় দেয়, “বাস্টিং দ্য নেক্সাস অব দ্যাট ব্লাডি আর্বান ডেভেলপমেন্ট মিনিস্টার,” সুরেশের গলায় হালকা জিঘাংসার সুর, “লোকটা আজ নয়তো কাল ফাঁসতোই। এখন আপাতত ছেলেকে তুলছে, বাপকে তুলতেও ক্রাইম ব্রাঞ্চের দেরী হবে না। কি বলো হ্যাঁ? ” আবারও সুরেশের হাত সুবর্ণের পিঠ ছুঁয়ে যায় হঠাৎ। সুবর্ণ একটু নড়ে ওঠে বোধহয়। “ওহ সরি সরি,” সুরেশের গলা কি একটু জড়িয়ে যায়? তবু সে আবারও ল্যাপটপের উপরে ঝুঁকে পড়ে। নাঃ, স্পষ্ট ইঙ্গিত এবার, সুরেশের হাত সুবর্ণের পায়ের উপর। টান পড়ছে। কোলে বসানোর চেষ্টা? “স্যর হোয়াট ইউ আর ডুয়িং স্যর,” বলতে বলতেই সুবর্ণ আবিষ্কার করে লোকটা প্রায় তার গায়ের উপরে উঠে পড়তে শুরু করেছে। সুবর্ণের গায়ে অতটাও জোর নেই যে সেই কঠিন মুষ্ঠিকে সে ছাড়িয়ে নেয়।

 

আদতে সুবর্ণ খেই হারিয়ে ফেলেছিল সেদিন। তার বোধ-বুদ্ধি-চিন্তা সবকিছু এক মুহূর্ততেই চৈতন্য হারিয়ে ফেলেছিল। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার বিষয়ে সে নানান আর্টিকল পড়ে থাকলেও বা কোনও কোনও ম্যাণ্ডেটরি ট্রেনিংয়ের সময় সেই বিষয়ে শুনে থাকলেও, সেটা যে কোনও দিন পাওয়ারপয়েন্টের স্ক্রিন ফুঁড়ে বেরিয়ে কখনও তারই সঙ্গে বাস্তব হয়ে দাঁড়াবে, সুবর্ণেরা তা বুঝে উঠতে পারে না। কেবল যারা এই পরিস্থিতির শিকার হয়, তারাই জানে সেই নোংরা অনুভূতি কেমন। সুবর্ণ চিৎকার করার আগেই লোকটা তাকে নিয়ে এতদূর – ভাবতে চায় না সুবর্ণ। সেই নোংরা ঘিনঘিনে দুটো হাত, সুবর্ণ আব্রু হারিয়ে চিৎকার করার আগেই চেম্বারের দরজাটা ঠেলে খুলে গিয়েছিল। “সুরেশ!” দরজা ঠেলে যিনি ঢুকে এসেছিলেন তাঁকে দেখে আবারও মাথা নীচু করে ফেলেছিল সুবর্ণ। নিজের প্রতি তার যে তখন ঠিক কি মনে হয়েছিল, সে ভেবে উঠতে পারেনি। সে চিৎকার করে উঠতে পারেনি। সে হাঁটু গেড়ে মাটির উপরে বসে পড়েছিল প্রথমটায়। তারপর কোনওমতে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হাতব্যাগটাকে তুলে নিয়ে একছুটে বেরিয়ে এসেছিল সেই চেম্বার থেকে। মাথা হেঁট করে ডেস্কে পৌঁছিয়ে ল্যাপটপটাকে সোজা শাটডাউন করে সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সমস্ত ঘটনাটা ঘটতে সময় লেগেছিল দশ মিনিটেরও কম। সেই দিন রাতেই কলকাতা থেকে ফোন এসেছিল তার। “বাড়ি আয় মা, তাড়াতাড়ি! তোর বাবা আর …” ফোনের ওপাশে উথলিয়ে ওঠা কান্নার স্বর। পরপর দুটো আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে কলকাতা ফিরে এসেছিল সুবর্ণ সেন।

 

মুম্বাই এয়ারপোর্টে গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে ঢোকার সময় কেবল সে লক্ষ্য করেছিল পিছনে আরও একটা চেনা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে।

 

-“সুবর্ণ প্লিজ, একটু দাঁড়িয়ে যাও!”

 

তার মাথা দপদপ করছিল। তবু সে মুখ ফিরিয়ে মাথা নীচু করে সুস্মিতাশ্রীর সামনে দাঁড়াল।

 

সুস্মিতাশ্রী পন্নিরসেলভম। তিনি কেবল সুবর্ণের সিনিয়রই নন। তাঁর আরও এক পরিচয় তিনি সুরেশ মানসুখানির স্ত্রী, এবং ওয়েস্টার্ন এজের তিনি অন্যতম পার্টনারও বটে। সুবর্ণ হঠাৎ মাথা তুলে তাকায়। তার দু’চোখে একই সঙ্গে লজ্জা এবং ক্ষোভ! “আমি কোনও,” কিন্তু সে কিছু বলার আগেই সুস্মিতাশ্রী তাকে থামিয়ে দেন, “আমি জানি সুবর্ণ। তোমার কোনও দোষ নেই এতে। আমার স্বামীকে আমি অনেক দিন ধরেই নতুন ভাবে চিনছিলাম। কিন্তু সে যে এত বড় জানোয়ার হয়ে গিয়েছে আমি বুঝে উঠতে পারিনি।” সুস্মিতাশ্রী হাত বাড়িয়ে সুবর্ণের হাত ধরতে গিয়েও যেন ধরতে পারেন না। তিনি নিজেকে গণ্ডির ভিতরে রাখেন। “আমি, খুব ক্লান্ত। বিশ্বাস করুন ম্যাডাম,” কোনও মতে এই কথা’কটি বলে সুবর্ণ। “আমি জানি, আই নো ইট। তোমার রেজিগনেশন ওরা এ্যাকসেপ্ট করে নেবে। বাট হোয়াই আর ইউ নট ফাইটিং ব্যাক?” সুস্মিতাশ্রী জিজ্ঞেস করেন, “তোমার দিকেই তো সব আইন এখন।” সুবর্ণ হাত তুলে সুস্মিতাকে থামিয়ে দেয়, “আমার আর সেই শক্তি নেই ম্যাডাম। আই নিড টু গো এ্যাণ্ড সি মাই ফাদার। ফর ওয়ান লাস্ট টাইম। আই রিয়ালি ডোন্ট কেয়ার এ্যাবাউট এনিথিং এলস রাইট নাও।” “কিন্তু তারপর?” সুস্মিতাশ্রী যেন চান সুবর্ণ একটা ব্যবস্থা নিক। সুস্মিতাশ্রী জানেন এইটুকু ব্যবস্থা যদি সুবর্ণ নেয় অন্তত, তাহলে তাঁর পক্ষেও এই জানোয়ারটার হাত থেকে ডিভোর্স চাওয়াটা আইনি পথে সহজ হয়ে যাবে। সুস্মিতাশ্রী তাই নিজেরই স্বার্থে সুবর্ণের কাছে ভিক্ষাপ্রার্থী আজ। সুবর্ণ কি তা বুঝতে পারে? নাকি এত জটিল মারপ্যাঁচে সে যেতে চায় না আর?

 

সুবর্ণ শেষবারের মতো ঘাড় নাড়ে। প্রত্যেকের লড়াই আদতে প্রত্যেকেরই একার। কেউ তার হয়ে সেই লড়াই লড়ে দিতে পারে না। সুস্মিতাশ্রী বুঝতে পারেন মেয়েটার এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে অনেক দিন। এভাবেই বারবার লম্পটেরা জিতে যেতে থাকে। তিনি নিজেও যে শিরদাঁড়া সোজা করে উঠতে পারলেন না এতদিনেও! সুবর্ণ সিআইএসএফের ঘেরাটোপ পেরিয়ে বিমানবন্দরে ঢুকে গিয়েছে।

 

সুস্মিতাশ্রী নিজের গাড়িতে উঠে যান। ড্রাইভারকে বলেন, “আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। অফিস যাব না আর।” এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে শহরে ঢুকতে না ঢুকতেই তাঁর গা গুলিয়ে ওঠে হঠাৎ। তিনি কোনওমতে সামনের ফ্ল্যাপ থেকে কাগজের সিকব্যাগটা বের করে এনে হড়হড় করে বমি করতে থাকেন।

(চলবে)

আগের পর্বের ঠিকানা – https://nariswattwo.com/welcome/singlepost/the-siege-serialised-novelette-series-nine

লেখক : বিজ্ঞানী, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক।  

ছবি : সংগৃহীত। 

0 Comments

Post Comment