- 21 December, 2020
- 0 Comment(s)
- 779 view(s)
- লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
চলে গেলেন ঐতিহাসিক শ্রীমতী উত্তরা চক্রবর্তী। কোভিডের আক্রমণ সফলভাবে যুঝে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেও ২৯শে নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। আমরা গভীর শোকে আচ্ছন্ন হলাম। দেহের নশ্বরতা জীবনের এক অবিসংবাদিত সত্য। একে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি? তবে দেহ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও মানুষ থেকে যায় কাছের মানুষদের স্মৃতিতে, তার কাজের মধ্যে। জীবনের বালুকাতটে দাগ রেখে গেছেন উত্তরাদি। মৃত্যু সেই দাগ মুছে দিতে পারে না।
শ্রীমতী উত্তরা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪৪ সালের ২৩শে ডিসেম্বর কলকাতায়। পড়াশুনো কলকাতার St. John’s Diocesan স্কুলে। পরে ইতিহাস নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা যথাক্রমে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মজীবন শুরু কলকাতার পাঠভবন স্কুলে। ইতিহাসের অধ্যাপিকা হিসেবে ১৯৬৯ সালে দার্জিলিঙের লোরেটো কলেজে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ওই কলেজে পড়ানোর পর তিনি West Bengal Education Service এ যোগদান করেন। প্রথমে মৌলানা আজাদ কলেজ, তারপর চন্দননগর সরকারি কলেজ এবং শেষে বেথুন কলেজে অধ্যাপনা করেন তিনি। কিছুদিন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের সঙ্গেও আংশিক শিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। বেথুন কলেজ থেকে ২০০৪ সালে অবসর গ্রহণ করার পর ২০০৫ সালে উনি অতিথি অধ্যাপক হিসেবে প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হবার পরেও তিনি ইতিহাস বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে অধ্যাপনা করেছেন। ২০১৩র পর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আর যুক্ত না থাকলেও বিভিন্ন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রিত অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে পঠন-পাঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। মধ্যযুগীয় ইউরোপ ও ভারতের ইতিহাস তিনি ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রাঞ্জল করে তুলতেন। উনিশ শতকের বাংলার রেনেশাস তাঁর বক্তৃতায় জীবন্ত হয়ে উঠত। ছাত্রছাত্রী মহলে তিনি ছিলেন অসামান্য জনপ্রিয়।
তবে শুধু ক্লাসরুমনির্ভর অধ্যাপনা নয়, উত্তরাদি ছিলেন ইতিহাসের একনিষ্ঠ গবেষক, প্রকৃত অর্থে ইতিহাসপ্রেমী। অতীত-অন্বেষণের অদম্য তাগিদ থেকে তিনি নিয়োজিত হয়েছিলেন অভূতপূর্ব সব কর্মকাণ্ডে। ১৯৯৭-১৯৯৮ নাগাদ বেথুন কলেজের প্রাঙ্গনে প্রত্নসামগ্রীর সন্ধান পেয়ে যে খননকার্য সংঘটিত হয় তার পেছনে উত্তরাদির ছিল মুখ্য উদ্যোগ। উত্তরাদির অসামান্য একটি কাজ হল বেথুন কলেজে অবহেলায় পড়ে থাকা ধুলোমাখা নথিপত্র সংগ্রহ করে archive বা লেখ্যাগার নির্মাণ। এবং ওই লেখ্যাগার নির্মাণের সময় থেকেই উত্তরাদির নারীবাদী মনন মানবী-ইতিহাসচর্চায় নিবেদিত হয়েছিল। সরকারি মহাফেজখানার দলিল, পুলিশ বিভাগের নথি, স্মৃতিকথা, আত্নজীবনী, চিঠিপত্র প্রভৃতি উপাদানের ভিত্তিতে তিনি ঔপনিবেশিক বাংলায় মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস লিখেছেন। শিক্ষার বলে বলীয়ান হয়ে তাদের চেতনার জেগে ওঠা, পিতৃতন্ত্রের গড়ে দেওয়া ছাঁচ ভেঙে, জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান, তাদের সৃজনশীল সত্তার বিকাশ, তাদের মন, মনন, দেহের ওপর পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের করালগ্রাস থেকে মুক্তির লড়াইয়ের আখ্যান লিখেছেন তিনি একের পর এক প্রবন্ধে ও গ্রন্থে।। বিশেষত মুসলিম নারীর শিক্ষা, সৃজন ও পথচলা বিষয়ে তার গবেষণা মানবী ইতিহাসচর্চায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কলকাতা শহরের ইতিহাসেও তাঁর আগ্রহ ছিল। বহু ছাত্রছাত্রীর গবেষণা তত্ত্বাবধান করেছেন। অসংখ্য মনোজ্ঞ প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। তিনি। Indian History Congress, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, Society for Understanding Indian History and Culture প্রভৃতি ইতিহাসচর্চায় নিবেদিত সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত থেকেছেন। তাঁর লেখা The Rattling Chains, Bina Das : A Woman in Revolution ২০১৭ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল ওফ উইমেন’স স্টাডিজ থেকে প্রকাশিত । তাঁর দাদামশাই শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের প্রজ্ঞা ও কৃতিত্বকে তুলে ধরেছেন পথচারী ঐতিহাসিক : যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত গ্রন্থে। ২০১৮ সালে কলকাতার সম্পর্ক পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত হয়েছে ওই গ্রন্থটি। তিনি যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন Education of Women and the Politics of Gender (কলকাতাঃ বেথুন কলেজ, ২০০৪); In the Footsteps of Chandramukhi : 125 Years of Bethune College । এই দুই গ্রন্থই বেথুন কলেজ থেকে ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে। শেষ গ্রন্থটি সম্প্রতি পুনঃমুদ্রিত হয়েছে। এছাড়া তার সম্পাদিত গ্রন্থের তালিকায় আছে Time Past and Time Present : Two Hundred Years of the Asiatic Society। কলকাতার Asiatic Society থেকে প্রকাশিত হইয়েছে এই গ্রন্থটি।
উত্তরাদি ছিলেন নির্ভীক, স্পষ্টবাদী। প্রখর ছিল তাঁর ন্যায়-অন্যায় বোধ। কোনো সেমিনারে বক্তার বক্তব্যে ফাঁকি বা গোঁজামিল থাকলে তা ঠিক ধরে ফেলতেন। তাঁর নিজের গবেষণায় কোন ফাঁক ছিল না বলেই অন্যের মধ্যেও ফাঁকি বরদাস্ত করতেন না। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে দ্বিধা করতেন না তার ভুলগুলো, ফাঁকফোকরগুলো। আবার গুণের কদর করতেও কোনো কুণ্ঠা ছিল না তাঁর। তাঁর মতো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে খুব কম বিদ্বৎজনকেই দেখেছি। গবেষণায় উৎসুক ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাঁর বাড়ির দ্বার অবারিত। তাদের দিকে এগিয়ে দিতেন অকৃপণ সাহায্যের হাত। আমার পরিচিত এক গবেষক একটি গোটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি তাঁকে একনাগাড়ে বসে পড়ে শুনিয়েছিল। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তিনি শুনেছেন এবং নিজের মতামত জানিয়েছেন। উত্তরাদি এমনই ছিলেন।
সম্প্রতি আমারা কয়েকজন মিলে মানবীইতিহাসচর্চার উদ্দেশ্যে Women’s History Conclave নামের একটি মঞ্চ গড়েছি। আপাতত মঞ্চটি অন্তর্জালেই সীমাবদ্ধ। যখন আমরা এই মঞ্চটি চালু করার ভাবনাচিন্তা করছি তখন থেকেই উত্তরাদির উৎসাহের অন্ত নেই। পরামর্শদাতা হিসেবে, প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য হিসেবে সানন্দে সাগ্রহে সামিল হয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে । এই মঞ্চের উদ্বোধনী আলোচনাচক্রে বক্তা ছিলেন অধ্যাপিকা শমিতা সেন। উত্তরাদি আগাগোড়া উপস্থিত ছিলেন এবং যথারীতি তীক্ষ্ণ কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব চলেছিল আমাদের। ওঁর সেদিনকার উজ্জ্বল হাসিমুখ মোবাইলের ক্যামেরায় তোলা আছে।
প্রসঙ্গত জানাই, ক্লাসরুমে উত্তরাদিকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে ১৯৮৮-১৯৯১ সাল পর্যন্ত অধ্যাপক সুভাষরঞ্জন চক্রবর্তীর ছাত্রী ছিলাম। স্যার ক্লাসে শুধু অসাধারণ পড়াতেন তাই নয়, তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে ছাত্র-ছাত্রী-দরদী। এমএ পাশ করার দুই বছরের মধ্যে দার্জিলিং সরকারি কলেজের নিয়োগপত্র হাতে পেলাম। শুনেছিলাম সুভাষবাবু ওখানে পড়িয়েছেন। নিউ জলপাইগুড়ির ট্রেনে ওঠার আগে ওনার কাছে গেলাম পরামর্শ নিতে। জয়েন করার পর একটা বিশ্রি সমস্যায় পড়েছিলাম আমি, পাহাড় থেকে ছুটে এলাম স্যারের কাছে। পরে অবশ্য সমস্যার একরকম সমাধান হয়েছে, আমি এক সহকর্মীকে বিয়ে করে থিতু হয়েছি। ১৯৯৮ সালে দার্জিলিং কলেজের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্যারকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালো কলেজ কর্তৃপক্ষ। স্যার এলেন দার্জিলিং, সঙ্গে উত্তরাদি। আমার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজনে ওঁদের নিমন্ত্রণ জানালাম। তখন সদ্য রান্না করতে শিখেছি। প্রবল উৎসাহে রেঁধেছি বিরিয়ানি। সেই প্রথম উত্তরাদিকে কাছ থেকে দেখা। তারপর বিভিন্ন সভায়, আলোচনাচক্রে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। ২০১৪ সালে আমি লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। Women’s Studies Centre আয়োজিত একটি সেমিনারের ওঁকে আমন্ত্রণ জানালাম বক্তৃতা দিতে। এর পর একটি মানবীবিদ্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি প্রবন্ধ সঙ্কলন (The Other Universe, An Anthology of Women’s Studies, 2014) সম্পাদনা করতে উদ্যোগী হলাম। উত্তরাদির কাছে লেখা চাইলাম। উনি দিলেন। প্রবন্ধের নাম ‘Women’s Education and Empowerment: from Pre-colonial to Colonial Times’। এই সংকলনটি বেরোনর পর বাংলায় আরেকটি সংকলনের কাজ শুরু করলাম (নহি সামান্যা নারীঃ ইতিহাসে, সমাজে ও চিন্তায়) । এবারও উত্তরাদি আমাদের ফেরালেন না। এই সংকলনে ওঁর প্রবন্ধের নাম ‘মুসলিম নারী উচ্চশিক্ষা ও বেথুন কলেজ’। ২০১৮র ২২শে মার্চ উত্তরাদি আর স্যারকে আমন্ত্রণ জানালাম আমার বিশ্ববিদ্যলয়ে একটি সেমিনারে। বিষয় Women in Revolution. উত্তরাদির বক্তৃতার শিরোনাম ; ১৯৩০ একুশ বছরঃ বিপ্লবে নারী’। ২০১৯ সালে অধ্যাপিকা জেরাল্ডিন ফর্বসের ভারতে আসার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ডঃ ভাস্বতী চট্টোপাধ্যায় ও আমি একটি সম্মাননা গ্রন্থ সম্পাদনার কাজ শুরু করলাম। অসুস্থতা সত্ত্বেও উত্তরাদি আমাদের হাতে তুলে দিলেন এক অনবদ্য প্রবন্ধ, Minerva’s Daughters। ১৯৩০ এর দশকের এক ঝাঁক তরুণীর গল্প। ওদের মনে উচ্চাশা চোখে স্বপ্ন, রাবীন্দ্রিক রোমাটিকতায় বুঁদ তারা। বইটির কাজ এখনো চলছে। দুঃখের বিষয় বইটা প্রকাশিত হবার আগেই উত্তরাদি চলে গেলেন।
উত্তরাদির সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল উনি চলে যাওয়ার দিন দশেক আগে। উনি তখন হাসপাতালে। সেরে উঠেছেন অনেকটাই। রোকেয়া হোসেনের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন উপলক্ষে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম ওঁকে। সানন্দে সম্মতি দিয়েছিলেন উনি। উনি আমার কয়েকটা লেখা পড়তে চেয়েছিলেন। আমি চেয়েছিলাম ওঁর একটা বই। কথা ছিল উনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে ওঁর বাড়ি গিয়ে দেওয়া-নেওয়ার পালা সারব। রোকেয়া সম্বন্ধে ওনার বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য আমাদের আর হল না। ওনাকে দেওয়া হল না অনেক কিছু। না পাওয়ার তালিকাটা আরো অনেক বড়। বড় আক্ষেপ রয়ে গেল আমাদের মনে। এই না পাওয়ার যন্ত্রণাকে বুকে চেপে রেখেই ওঁর দেখানো পথে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। পেরোতে হবে আরো অনেক মাইল।
0 Comments
Post Comment