- 11 July, 2024
- 0 Comment(s)
- 128 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
বীণাদি বলল, ‘পুতুলতন্ত্রের কথা কখনো শুনেছিস?’ সুরভি বলল, ‘হ্যাঁ, আমার ঠাকুরদার কাছে একবার শুনেছিলাম। ঠাকুরদার এক বন্ধু সিদ্ধ তান্ত্রিক ছিলেন। মাঝেসাঝে তন্ত্র বিষয়ে তাদের মধ্যে নানারকম আলোচনা হত। সেই কারণে ঠাকুরদা এই বিষয়টা কিছুটা জানতেন।’ আমি বীণাদিকে বললাম, ‘পুতুলতন্ত্র আবার কী গো?’ বীণাদি কিছু বলার আগেই সুরভি আগ বাড়িয়ে আমাকে বলল, ‘পুতুলতন্ত্র কী জানিস না? আরে, তান্ত্রিকরা ঐ যে একটা পুতুল তৈরি করে তার সাহায্যে কারুর ক্ষতি করে।’ আমাকে বোকার মত তাকিয়ে থাকতে দেখে সুরভি এবার বিষয়টা নিয়ে গুছিয়ে বলতে শুরু করলো, ‘শোন তবে, পুতুলতন্ত্র হল এক বিশেষ প্রকারের কালোজাদুবিদ্যা। তান্ত্রিকরা অনেক সময় কারোর ক্ষতিসাধন করার জন্য একটা পুতুল নিজের হাতে তৈরি করে। যে সে পুতুল নয়, মন্ত্রশক্তির প্রয়োগে বিশেষ উপকরণ দিয়ে তা তৈরি করা হয়। এরপর যার অনিষ্ট করতে ইচ্ছুক তার প্রাণ ঐ পুতুলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর নানা ভাবে পুতুলটার ওপর অত্যাচার করার মধ্য দিয়ে সেই ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়। এর বেশি আমাকে ঠাকুরদা আর কিছু বলেননি।’
আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ গম্ভীর। তবে বৃষ্টিটা ঝেঁপে নামল ঠিক সন্ধ্যেবেলা। বীণাদির কাছে টিউশন পড়ে বাড়ি ফেরার ঠিক দশ মিনিট আগে থেকে শুরু হল মুষলধারায় বৃষ্টি, তার সঙ্গে অনবরত বজ্রপাত। আমি আর সুরভি বীণাদির ঘরে বিছানায় বসে বসে দক্ষিণের খোলা জানালাটা দিয়ে দেখলাম বীণাদির বাড়ির ঠিক পিছনের সেই খোলা মাঠের মত জায়গাটা নিকষ কালো আঁধারে ডুবে গেছে। মাঠ পেরিয়ে যে সবুজ ঝোপঝাড়ের জঙ্গল ছিল তা মিশকালো অন্ধকারের সীমারেখার মত মনে হচ্ছে। সেই ঝোপের মধ্যে মাঝেমাঝে মাথা উঁচিয়ে থাকা নারকেল আর সুপুরি গাছগুলো ঝড়ের দাপটে বিশাল ব্রম্ভদৈত্যের মত এপাশে ওপাশে ক্রমাগত মাথা ঝাঁকিয়ে চলেছে। তার মধ্যে পড়ে চলছে মেঘভাঙা বৃষ্টি। ঝড়ের ঝাপটায় বৃষ্টির ঝাঁট ঘরের মধ্যে প্রবেশ করায় বীণাদি তড়িঘড়ি জানলার কাঠের পাল্লাগুলো টেনে বন্ধ করে দিল। কিন্তু জানালা বন্ধ থাকলেও আমরা ঘরের মধ্যে থেকে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ভালোই শুনতে পাচ্ছিলাম। জানালা বন্ধ করে এসে বীণাদি বলল, ‘যা অবস্থা দেখছি এত সহজে এ ঝড় থামবে বলে মনে হয় না। তাহলে অগত্যা আর কি, আমার বাড়িতে কিছুক্ষণ থেকে যাও তোমরা।’ বীণাদিকে সুরভি তখন অনুরোধ করলো, ‘দিদি এমন পরিবেশে একটা ভূতের গল্প হলে মন্দ হয় না।’ বীণাদি প্রায়ই সুযোগ পেলে আমাদের নানা রকম গল্প শুনিয়ে থাকে। বীণাদির গল্প বলার অসাধারণ দক্ষতার কথা স্বীকার করতেই হবে। সুরভির কথা শোনামাত্র বীণাদি খেপে গিয়ে বলল, ‘শোন ঐসব ভূত-ফূত বলে আসলে কিছু হয় না। আমি বানিয়ে বানিয়ে বাজে গল্প শোনাতে পারবো না। আমি তোদেরকে যে গল্পটা বলবো তা একেবারে বাস্তব।’
এরপরেই বীণাদির মুখে পুতুলতন্ত্রের কথা শুনে আমি আর সুরভি দুজনেই গল্প শোনার আগ্রহে নড়েচড়ে বসলাম। ঠিক এমন সময় ঘরের লাইটটা দুবার কেঁপে উঠেই কারেন্ট চলে গেল। ঘরের ভিতরকার ঘুটঘুটে অন্ধকারে বীণাদিকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। বীণাদির কন্ঠস্বর অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভেসে এল, ‘এই হয়েছে এক সমস্যা।’ অনুমান করলাম বীণাদি হয়তো মোমবাতি আনতে অন্য ঘরে গেল। হঠাৎই কড়কড় শব্দে একটা ভয়ানক বজ্রপাত হল। আমি কানে হাত দিয়ে দরজার বাইরে চেয়ে দেখলাম একটা ক্ষীণ আলো দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। বীণাদি একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে এনে ঘরের মাঝখানে কাঠের টেবিলটাকে টেনে নিয়ে তার ওপর রাখলো। তিনটে কাঠের চেয়ার টেনে নিয়ে এসে বীণাদি ও আমরা দুজন কাঠের টেবিলটাকে ঘিরে বসলাম। আমাদের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বীণাদি বলতে শুরু করলো, ‘ছোটবেলায় মা আমাকে একটা আশ্চর্য পুতুল উপহার দিয়েছিলেন। সেটা ছিল কাপড়ের তৈরি একটা মেয়ের পুতুল। পুতুলটার বয়স কম নয়, মাও সেটাকে নিয়ে তাঁর বাল্যবস্থায় অনেক খেলেছেন। পুতুলের চোখদুটোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে ক্ষণিকের জন্য যেন প্রাণবন্ত বলে মনে হত।’ মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় বীণাদির মুখের ওপর আলো আঁধারির খেলা চলতে লাগলো। বীণাদি সামান্য হেসে বলল, ‘পুতুলটার ওপর ছোটবেলায় কম অত্যাচার করিনি। কখনো তার শণের মত লম্বা চুল ধরে টানাটানি করেছি, কখনো বা সেটাকে নিয়ে লোফালুফি করেছি। কখনো বা আদরের চোটে তার হাত পা মুড়ে দিয়েছি। ছোটবেলায় পুতুল নিয়ে ঘাঁটার আমার শখ ছিল তাই সেটাকে নিয়ে টানাটানি, ছেঁড়াছেঁড়ি সবসময় চলতেই থাকতো। পুতুলটার হয়তো এই অত্যাচার সহ্য হত না। তাই কখনো কখনো বিছানার ওপর একাকী বসে থাকা পুতুলটাকে দূর থেকে দেখলে মনে হত তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভে তার চোখ মুখ যেন বিকৃত হয়ে একটা হিংস্র ভাব ফুটে উঠেছে। তাই কখনো কখনো ওটাকে ধরতে আমার ভয় করতো। অবশ্য পুতুলেরও যে মন থাকতে পারে, না দেখলে আমি তা কোনোদিন বিশ্বাস করতাম না।’ একটু থেমে বীণাদি আবার বলতে শুরু করলো, ‘আমার বাবা একটা ছোট প্রাইভেট ব্যাংকে কাজ করতেন। সেই ব্যাংকটা হঠাৎই একদিন দেনার দায়ে বন্ধ হয়ে গেল। আচমকা এভাবে কাজটা চলে যাওয়ার পর বাবা একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। তখন চারদিকে অন্ধকার ছাড়া বাবা আর কোন আশা দেখতে পেতেন না। ফলত এই যন্ত্রণা ও হতাশা থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য তিনি ড্রাগস নিতে শুরু করলেন। বাবার এভাবে সারাদিন চুপচাপ বসে থাকাকে কেন্দ্র করে মায়ের সঙ্গে তাঁর খিটিমিটি লেগেই থাকতো। মা বাবাকে অনেকবার চাকরির সন্ধান করার জন্য অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু বাবা যেন ঠিক করেই রেখেছিলেন যে মা যা যা তাঁকে করতে বলবেন তিনি ঠিক তার উল্টোটাই করবেন। বাবাকে অনেকবার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করার সময় বলতে শুনেছিলাম, ‘নিজে ঘরের বাইরে বেরোও না তো চাকরির ক্রাইসিস আর কী বুঝবে?’ এরপর কাজের সন্ধান করা দুরস্থ বাবা ক্রমশ বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দিলেন। আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ধীরে ধীরে ভীষণ খারাপ হতে শুরু করলো। মায়ের সঙ্গে বাবার মনোমালিন্যও তখন সর্বোচ্চ মাত্রা ধারণ করলো। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে আমার বাবার চাকরিটা যখন চলে যায় তখন আমার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। মা আমাকে রাতে তাড়াতাড়ি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু কোনো কোনোদিন ঘুম ভেঙে গিয়ে বাবা ও মায়ের বচসার টুকরো টুকরো কথা কানে আসতো। বাবাকে মা বলতেন এখনও পর্যন্ত কোনো কাজ না জুটিয়ে হাতের ওপর হাত রেখে চুপচাপ বসে আছ? একবারও ভেবে দেখেছ সংসারটা কিভাবে চলবে? ঘরে বুড়ো অসুস্থ বাবা আছেন। নিজের বাচ্চা মেয়েটার কথা অন্তত ভাবো। কি খাওয়াবে ওদেরকে দুদিন পর? মেয়েটার স্কুলের দুমাসের টিউশন ফি বাকি। এবার ওকে হয়তো স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে। বাবার ওষুধের খরচাই বা জোগাড় করবে কোথা থেকে? আর আমার কথা নয় বাদই দিলাম।’ বাবা বলতেন, ‘ঘরে বসে খালি ঘ্যানঘ্যান করতে শিখেছ। চাকরি কি ছেলের হাতের মোয়া যে চাইলেই পাওয়া যায়? বসে বসে আমার অন্ন ধ্বংস করা ছাড়া আর কাজ কি তোমার?’ মা বলতেন, ‘তোমার সংসারের জন্য আমি কি না করেছি, দিনের পর দিন নিজে না খেয়ে তোমাদের জন্য খাবার বাঁচিয়ে রেখেছি, তার প্রতিদান এই? এই রকম পরিস্থিতিতে সংসারটাকে কিভাবে চালাচ্ছি তুমি আর কী বুঝবে? চাকরি তো আমিও করতে পারতাম, কিন্তু কেন আর কাদের কথা ভেবে করি না তা বোঝার মত বুদ্ধি আছে তোমার? আমি বাড়িতে না থাকলে তোমাদের কাজকর্ম সব কে করে দেবে?’ বাবা বলতেন, ‘বিপদে যখন পড়েছ তখন বাপের কাছ থেকে দুটো টাকা চেয়ে আনতে পারছো না? বুড়োর অত সম্পত্তি সব কি তোমার ভাইগুলোই ভোগ করবে?’ বাপের বাড়ি তুলে কথা বলেই বাবা মাকে বেশ ভালো মত জব্দ করতেন। মা তখন আর কোনো তর্ক না করে একেবারে চুপ করে যেতেন। তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারি মা কতটা অসহায় ছিলেন। নিজের বাবাকে বিপদের কথা লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারতেন না আর শ্বশুরবাড়িতেও তাঁর যন্ত্রণাটা ভাগ করে নেওয়ার মত কেউ ছিল না। মায়ের থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে বাবা আরও রেগে যেতেন এবং তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করলো এবার অন্যভাবে। রাতের বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো তখন বাবা মায়ের চুলের মুঠি ধরে ঠিক সেইভাবে টানতেন যেভাবে আমি পুতুলটার চুল ধরে টানাটানি করতাম। আমার মা যেন তখন বাবার কাছে খেলার পুতুল হয়ে যেতেন। বাবা যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে তাঁর হাত পিছনের দিকে বাঁকিয়ে মুড়ে দিতেন। বাবা মাকে পুতুলের মত মাটিতে আছাড় মেরে ফেলে দিতেন। তারপর তাঁর মুখে পেটে নির্বিচারে লাথি মারতেন। মা কেবল অসহায় ভাবে নীরবে চোখের জল ফেলতেন। তিনি লজ্জায় চরম অপমানের সেই আর্তনাদকে বুকের মধ্যে চেপে রাখতেন। বাবার সমস্ত কুকীর্তির জবাব মায়ের মনের মধ্যে আগ্নেয়গিরির লাভার মত যেন জমা হত। বাবার কাছে মার খাওয়ার সময় মায়ের মুখটাকেও আমার সেই কাপড়ের মেয়ে পুতুলটার মত তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভে বিকৃত হয়ে যেতে দেখেছি। ঠিক সেই হিংস্র ভাব ক্ষণিকের জন্য মায়ের মুখেও ফুটে উঠতো। কিন্তু পরক্ষণেই যখন মা জানতে পারতেন যে আমার ঘুম ভেঙে গেছে তখন এমন ভান করতেন যেন সব কিছু স্বাভাবিক আছে। এভাবে কিছুদিন চলার পর হঠাৎ একদিন সকাল থেকে মাকে আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। মা সব কিছু ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেলেন, আর কোনোদিনও ফিরে এলেন না।’ এই পর্যন্ত বলে বীণাদি থামলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেই পুতুলটা এখনো তোমার কাছে আছে?’ বীণাদি বললো, ‘সে হারিয়ে ফেলেছি কবেই। মায়ের ওপর বাবার সেই অত্যাচার দেখে ভয় পেয়ে আমি পুতুলটাকে একটা গুপ্ত স্থানে রেখে এসেছিলাম, যাতে সেখান থেকে পুতুলটাকে বের করে নিয়ে আর কেউ কখনো খেলতে না পারে। ছোটবেলায় কোথায় যে সেটাকে রেখে এসেছিলাম তা পরে নিজেও ভুলে গেছি। তবে এটা ভালো মনে আছে যে পুতুলটা হারিয়ে যাওয়ার পরদিন আমি মাকেও হারিয়ে ফেলি।’ বীণাদির গলাটা ধরে এসেছিল। একটু কেশে গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে বীণাদি বললো, ‘বাবা মারা যাওয়ার দুবছর পর বীরভূমের একটা জেলা হাসপাতাল থেকে চিঠি পেয়েছিলাম, তার সঙ্গে একটা মানি অর্ডারও ছিল। সেই চিঠি থেকে জানতে পেরেছিলাম যে, আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মা বীরভূমে তাঁর এক দূরসম্পর্কের মাসির বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। সেখানে থেকেই মা ঐ হাসপাতালে আয়ার কাজ করতেন। দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে মানুষের সেবা করার পর মা দেহ রাখেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল আমি তাঁর একমাত্র সন্তান তাঁর মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া যেন বিধিসম্মত ভাবে পূর্ণ করি এবং সেটা করার জন্য মা তাঁর সারাজীবনের উপার্জন থেকে কিছুটা অর্থ আমাকে পাঠাতে বলে গিয়েছিলেন। বাকি টাকা তিনি হাসপাতালে জনসেবার্থে দান করেছেন।’ গল্পটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট ফিরে এল। দেখলাম বীণাদির চোখের কোণটা চিকচিক করছে। বীণাদি আমাদের সামনে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে উঠে বন্ধ জানালার দিকে এগিয়ে গেল। জানলা খুলে এদিকে ওদিকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে এসে বীণাদি বললো, ‘ঝড় বৃষ্টি একদম থেমে গেছে। তোরা এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যা, রাত তো অনেক হল।’
0 Comments
Post Comment