- 24 May, 2022
- 0 Comment(s)
- 1900 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
বিগত কয়েক বছর ধরে উত্তর ভারতে থাকার ফলে, প্রতিবছর এই সময়ে মহাসমারোহে করবা চৌথ উদযাপন হতে দেখি। এই বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই ব্রত পালন কীভাবে করতে হয়, বলিউড সিনেমা, হিন্দি সিরিয়ালের দৌলতে তা আমরা প্রায় অল্পবিস্তর সকলেই জানি! চন্দ্রদেবতার কাছে স্বামীর মঙ্গল কামনা করে কার্তিক মাসের পূর্ণিমার পর চতুর্থ দিন করবা চৌথ ব্রত পালন করা হয়। ব্রত পালনের দিন সূর্যোদয়ের আগে ‘সারগি’ খেতে হয়। সারগিতে থাকে বিভিন্ন ধরনের ফল, মিষ্টি, শুকনো ফল, সেমাই। রাত্রে চাঁদ দেখার পর স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায় পুজো করে নির্জলা উপবাস ভাঙ্গা হয়। সে যত রাত্রি হোক চাঁদ না দেখে উপোস ভাঙা যেহেতু দণ্ডনীয় অপরাধ, তাই ব্রতীদের চাঁদের অপেক্ষায় ঠায় বসে রই, হায় বসে রই অবস্থা হয়!
এ বছর রাত দশটায় বিকট আওয়াজ, শোরগোল, বাজির শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম চাঁদ বাবাজি দর্শন দিয়েছেন। সাধারণ থেকে অসাধারণ সকলেই স্বামীর মঙ্গল কামনায় এই ব্রত করে থাকেন। ইউটিউব থেকে ইনস্টাগ্রামে বড় বড় ইনফ্লুয়েঞ্জারা দন্তবিকশিত করে তাদের এই মহান ব্রত পালনের মাহাত্ম্য সম্পর্কে নানান মন্তব্য পেশ করেছেন, অনেকেই করোনার প্রকোপে এ বছর বিয়ে করতে পারেননি। ফলে লাল শাড়ি সিঁদুর পরে এই বছর আর করবা চৌথ উদযাপন করতে পারেননি বলে হা পিত্যেশ করেছেন! যাইহোক, কী আর করা যাবে! আগামীতে তারা এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের আরোপিত বিধিমালা অতীব আগ্রহের সঙ্গে পালন করে, তাদের লাখ লাখ অনুগামীদের পতি পরমদেব বার্তা দেবে বোঝা যাচ্ছে!
পশ্চিমবঙ্গে একাধিক ব্রত পালন করা হয়। শীলা বসাকের বাংলার ব্রতপার্বণ গ্রন্থ থেকে জানা যায়— বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ এই বাংলা। বাংলায় প্রতি মাসে ব্রত পালন করা হয়। মানুষের কামনা-বাসনা পূরণের জন্য কৃত্য সম্পাদনই ব্রত অর্থাৎ কোনও কিছুর উদ্দেশ্যে নারীসমাজ আন্তরিকভাবে যে ক্রিয়াচার পালন করে সেটিই ব্রত নামে পরিচিত। প্রাচীনকালে কৃষি সভ্যতার সময় থেকে ব্রতর উৎপত্তি হয়েছে। বেশিরভাগ ব্রত নারীরা করে থাকেন। ব্রতগুলির পরতে পরতে লিঙ্গ বৈষম্যের বিষজাল জড়িয়ে আছে। অধিকাংশ ব্রত কুমারী, সধবা, বিধবারা পালন করেন।
কুমারী ব্রত: কুমারী মেয়েরা যে ব্রত করেন, সেগুলি কুমারী ব্রত নামে পরিচিত। যেমন—পুণ্যিপুকুর, পৃথিবী, দশপুতুল, শিব ব্রত, যমপুকুর, বসুধারা, তুষ-তুষলি, সেঁজুতি, মাঘমন্ডল, সন্ধ্যামণি, হরির চরণ ইত্যাদি।
সধবা ব্রত: সধবা মেয়েরা যে ব্রতগুলি করেন সেগুলি হল— এয়োসংক্রান্তি ব্রত, জয়মঙ্গলচন্ডী, হরিষ মঙ্গলচণ্ডী, নাটাই মঙ্গলচণ্ডী, মঙ্গলসংক্রান্তি, সঙ্কট মঙ্গলচণ্ডী, অক্ষয়ঘট, মঙ্গলচন্ডী, নীলষষ্ঠী, অক্ষয়সিঁদুর, আদাহলুদ, রূপহলুদ, ষোলকলা, সাবিত্রী ব্রত, ইতু, সৌভাগ্য চতুর্থী ইত্যাদি।
বিধবা ব্রত: অম্বুবাচী, মঙ্গলচণ্ডী, হরির চরণ, অরণ্যষষ্ঠী, নাগপঞ্চমী, তালনবমী একাদশী ব্রত ইত্যাদি।
পুরুষদের মাত্র কয়েকটি ব্রত আছে— কর্মপুরুষের ব্রত, একাদশী, জন্মাষ্টমী, শিবচতুর্দশী, ইত্যাদি।
শীলা বসাক জানিয়েছেন— ‘‘নারীরা ব্রত পালন করেন বেশি। ব্রতগুলিকে নারীমনের কামনার মুকুর বলা যায়। কারণ ব্রত হল কামনার প্রতীক।’’ (তথ্যসূত্র: বাংলার ব্রতপার্বণ, পৃষ্ঠা ৫৩)
আমি সতী লীলাবতী সাত ভায়ের বোন ভাগ্যবতী
বৈশাখ মাসে পুণ্যিপুকুর ব্রত পালন করা হয়। এই ব্রতের ছড়া লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায়— সাত ভাইয়ের বোন হতেই হবে। সাত ভাই থাকলেই একমাত্র ভাগ্যবতী হওয়া যায়! পুত্র সন্তানের কামনা করা হয়। শ্বশুরকুলের মঙ্গল গান গাওয়া হয়।
ছোট্ট একটি মেয়েকে ছোট থেকেই শেখানো হয় তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য— বিয়ে, স্বামী, পুত্রসন্তান, শ্বশুরকুলের সেবা।
পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা
কে পূজেরে দুপুরবেলা?
আমি সতী লীলাবতী
সাত ভায়ের বোন ভাগ্যবতী।
হয়ে পুত্র মরবে না,
পৃথিবীতে ধরবে না।
ঢালি জল তুলসী বিল্বদলে,
স্বামী সোহাগিনী হব ফলে ফুলে।
পুণ্যিপুকুরে ঢালি জল,
শ্বশুরকুলের হউক মঙ্গল।
এই ব্রতের ফল সম্পর্কে সমাজকে জানানো হয়েছে—
এই ব্রতের ফল কি হয়, নির্ধনের ধন হয়,
সাবিত্রী সমান সতী হয়, স্বামী সোহাগিনী হয়।
পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে, মরণ হবে গঙ্গাজলে।
অর্থাৎ প্রায় সব ব্রতকথাতেই দেখা যায় সাত ভাইয়ের পরে একজন বোন থাকলে, অসুবিধে তেমন নেই। কারণ এই বোনকেই তো ভায়েদের মঙ্গল কামনা করতে হবে। নির্ধন পিতাকে ধনবান করার জন্য ব্রত করতে হবে। স্বামীকে পুত্রসন্তান দিয়ে খুশি করতে হবে। ছোটবেলা থেকে ছেলেদের কিন্তু শিক্ষা দেওয়া হয় না— সে কীভাবে একজন ভালো স্বামী, ভালো পিতা হয়ে উঠবে!
সোনার কুন্ডলে ঢালিয়া মধু, আইজ হইতে আমরা বড় মানুষের পুত্রবধূ
মাঘমন্ডল ব্রতে সূর্যের উপাসনা করা হয়। এই ব্রতে সূর্যের বিয়ের বর্ণনা করে ব্রতীরা নিজেদের বিয়ের কামনা করেন। ভালো বর চান, পিতা-ভাই-পরিজন ও সংসারের মঙ্গল কামনা করেন।
মাঘমন্ডল সোনার কুন্ডল, সোনার কুন্ডলে ঢালিয়া ঘি,
আইজ হইতে আমরা বড় মানুষের পুতের ঝি।
সোনার কুন্ডলে ঢালিয়া মধু, আইজ হইতে আমরা বড় মানুষের পুত্রবধূ।
সোনার কুন্ডলে ঢালিয়া নাড়ু, আইজ হইতে আ্মাগো শাখার আগে সোনার খাড়ু।
চন্দ্রে-সূর্যে দিয়া ফুল, ভরাইয়া উঠুক দুই কুল।
এই ব্রত প্রসঙ্গে শীলা বসাক জানিয়েছেন—‘‘তাই দেখা যায় যে পাঁচবছর বয়স থেকেই কুমারী মেয়েকে এই ব্রত পালন করানোর মধ্যে দিয়ে শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে নারী হিসেবে তার ব্যক্তিগত বা নিজস্ব কিছু চাওয়া-পাওয়া নেই। তাদের চাওয়া- পাওয়া পুরুষকেন্দ্রিক সমাজের পিতা-ভ্রাতা-পতি এবং পুত্রের মঙ্গল, আয়ু ও সম্পদবৃদ্ধির কামনার মধ্যে সার্থকতা লাভ করে।’’ (তথ্যসূত্র: প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১১৮)
আমরা আগেই বলেছি সমস্ত ব্রতে একই গীত গাওয়া হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সুপরিকল্পিতভাবে এই সকল নিয়ম-নীতি-আচার-আচরণ নারীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।
তালগাছেতে বাবুই বাসা।
সতীন মরে দেখতে খাসা।।
অগ্রহায়ণ মাসের এক থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যায় পিটুলি দিয়ে নানান ধরনের ছবি আঁকতে হয়, তারপর প্রদীপ জ্বেলে সেজুঁতি ব্রত পালন করা হয়ে থাকে। বাহান্ন ধরনের ছবি আঁকা হয় এই ব্রতে। ব্রতের আলপনার মাধ্যমে কিছু প্রতীক তুলে ধরা হয়, প্রতীক ও ছড়ার মাধ্যমে নারীজীবনের সুখ-দুঃখের চিত্র ফুটে উঠে।
এই ব্রতের ছড়াগুলিতে অসংখ্যবার সতীনের প্রসঙ্গ এসেছে—
অশ্বত্থতলায় বাস করি।
সতীন কেটে নির্মল করি।
সাত সতীনের সাত কৌটা।
তার মাঝে আমার এক অব ভরের কৌটা।।
অব ভরের কৌটা নাড়ি চাড়ি।
সাত সতীনকে পুড়িয়ে মারি।।
কুল গাছটি ঝোঁক্ড়ী।
সতীন বেটি কেঁকড়ী।।
হে হর, মাগ বর,
স্বামী হোক রাজ্যেশ্বর
সতীন হোক দাসী
পাখি পাখি পাখি
সতীনকে গঙ্গায় নিয়ে যায়
আমি খাটে বসে দেখি।।
ময়না ময়না ময়না
সতীন যেন হয় না।।
হাতা হাতা হাতা
খা সতীনের মাথা।।
বেড়ি বেড়ি বেড়ি
সতীন বেটি চেড়ী।।
উৎবেরালী উৎ যা।
স্বামী রেখে সতীন যা।।
তালগাছেতে বাবুই বাসা ।
সতীন মরে, দেখতে খাসা।।
থুথকুড়ি থুথ কুড়ি।
সতীন বেটী আঁটকুড়ী।।
আবার, এই ব্রতে একটি ছড়ায় ফার্সি ভাষা স্বামী যেন পড়তে পারেন সেই কামনা করা হয়েছে—
আর্শী আর্শী আর্শী।
আমার স্বামী পড়ুক ফার্সি।।
যাইহোক, পুরুষ মানুষ ফার্সি পড়তে পারার কামনা নিজে করতে পারেন না বোঝা যাচ্ছে! নারীদের সতীনের ভয়ে দমিয়ে রেখে, কৌশলে মগজ ধোলাই করার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই ব্রতের ছড়াগুলি।
সাবিত্রী ব্রত
সধবা নারীরা এই ব্রত করেন। ব্রতের আগের দিন নিরামিষ খেতে হয় ব্রতীকে। ব্রতের দিন উপবাস থাকতে হয়। এই ব্রত পালন করে সধবা নারীরা স্বামীর মঙ্গল, পুত্র সন্তান এবং আজীবন সধবা থাকার কামনা প্রকাশ করেন। পুত্র লাভের আশায় অনেক ব্রত পালন করা হয়। কিন্তু কন্যা কামনা করে কোনও ব্রত পালন করা হয় না। সাবিত্রী ব্রতের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শীলা বসাক জানিয়েছেন— ‘‘আবার এই ব্রতাচারটিতে আর্থ-সামাজিক স্তরে নারীর অবমূল্যায়নের চিত্রটি লক্ষ্য করা যায়। নারীকে পুরুষের দাসী বলেও দেখানোর প্রবণতা এই ব্রতচারটির মধ্যে লক্ষণীয়।’’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১১৬) এই ব্রতে স্বামীর পা ধুইয়ে আঁচল দিয়ে পা মুছিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। সতী সাবিত্রী হয়ে উঠতে গেলে স্বামীর দাসীগিরি করতে হবে, এমনই শিক্ষা এই ব্রতে রয়েছে।
জামাইষষ্ঠী
জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী পালন করা হয়। শ্বশুরালয়ে মেয়ে যেন সুখে-শান্তিতে থাকে সেই উদ্দেশ্যে মূলত জামাইকে বরণ করা হয়। দেবী ষষ্ঠীর কাছে কন্যার জন্য পুত্রসন্তানের কামনা করা হয়। এছাড়া গবেষকগণ মনে করেন আঠারো-উনিশ শতকে কয়েকটি সমস্যা দেখা গিয়েছিল— বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ। বাল্যবিধবার সমস্যা তখন ব্যপক আকারে প্রসারিত হয়েছিল। সেই কারণে কন্যার মায়েরা জামাতার দীর্ঘ জীবনের কামনায় জামাইষষ্ঠী ব্রত করতেন। বর্তমানে সেই জামাই তোষামোদ প্রতি বছর ধুমধাম করে উদযাপন করা হয়। অপরদিকে, বেশিরভাগ বৌমাদের জন্য রয়েছে কেবল একরাশ লাঞ্ছনা-গঞ্জনা।
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যমের দুয়ারে পড়ুক কাঁটা
ভাইয়ের মঙ্গল ও দীর্ঘ জীবনের কামনায় কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ব্রত পালন করা হয়। কয়েকদিন পরে এবছর ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। চারিদিকে সাজসাজ রব পড়ে গেছে। ইউটিউব ছেয়ে গেছে ভাই দুজ মেকআপ লুকে। ইনস্টাগ্রামে ফেস্টিভাল লুকের ভিডিও নিয়ে দুবেলা ইনফ্লুয়েঞ্জাররা হাজির হচ্ছেন। এত কিছুর ভিড়ে আমাদের সময় কোথায় বলুন তো সাম্যের ভাবনা নিয়ে চিন্তিত হবার?
এই সমস্ত উদযাপনে হরিষে বিষাদ লুকিয়ে আছে, আহা, তাহা যদি আমরা একটু বুঝতুম! তাই হতাশায়, বিষাদে, শ্রান্তিতে, খোকার মত রেগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে বলতে ইচ্ছা করছে—
দিনগুলোকে করলে মাটি মিথ্যে পাজি পঞ্জিকাতে-
মুখ ধোব না ভাত খাব না ঘুম যাব না আজকে রাতে। (সুকুমার রায়)
পুনঃপ্রকাশ
ছবি: প্রতীকী
লেখক: প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment