- 26 December, 2022
- 0 Comment(s)
- 612 view(s)
- লিখেছেন : নন্দিনী ধর
বছরে অন্তত একবার, আমি লিঙ্গ ও মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রিক একটি ক্লাস পড়াই আমার কর্মস্থলে -- উত্তর ভারতের একটি অধুনাপ্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে । আমার ছাত্রী ও ছাত্ররা মূলত: উত্তর ভারতীয় --- পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লি ঘিরে যে স্থানিক বলয়টি, সেখানেই তাঁদের বেড়ে ওঠা। আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে তাঁরা ভারতের ০.১ শতাংশ। মূলত: হিন্দু, বিপুলভাবে উচ্চবর্ণীয়। কারণ, আমি যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, সেখানে জাতপাতভিত্তিক কোনো সংরক্ষণ নেই। বহিরঙ্গ থেকে বিচার করলে, আমার ছাত্রীরা, সমাজের অগ্রণী অংশ। তাঁরা ইংরেজিতে বিপুল পরিমাণে স্বচ্ছন্দ। বরঞ্চ, মাতৃভাষা, তা পাঞ্জাবিই হোক, হরিয়ানভীই হোক অথবা হিন্দি, তাতে তাঁদের জ্ঞান সীমিত। তাঁদের প্রায় সবারই আছে একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা , তাঁদের শারীরিভাষায় জড়তার চিহ্নমাত্র নেই। এককথায় বলতে গেলে, আমার কর্মক্ষেত্র প্রায় করণ জোহরের ছবির কলেজ।
এহেন কলেজের শ্রেণীকক্ষে ঠিক কেমন হতে পারে লিঙ্গ ও মানবীবিদ্যাচর্চার বাতাবরণ? ঐতিহাসিকভাবে, শ্রেণীকক্ষে মানবীবিদ্যাচর্চা নিয়ে রয়েছে বহু বিতর্ক। একদিকে যেমন নারী ও লিঙ্গ আন্দোলনের বহু কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন নারীবাদের এই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়ে, তেমনি একথাও অনস্বীকার্য যে মানবীবিদ্যাচর্চা শ্রেণীকক্ষে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থান পেয়েছে কয়েক শতকের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা পৃথিবীব্যাপী বহুধাবিভক্ত নারী আন্দোলনের ফলে। বহু সময়েই এইজাতীয় বিভাগগুলি গড়ে তুলতে গিয়ে নারীবাদী শিক্ষক/ অধ্যাপক, তথা নারী আন্দোলনের কর্মীদের বহুস্তরীয় লড়াই গড়ে তুলতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানের ভেতরেও। যদিও, খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই, শ্রেণীকক্ষে বা পাঠক্রমে লিঙ্গ, বিষয়টি বড়োই জটিল। বহুশিলাকেন্দ্রিক।
উদাহরণস্বরূপ, নয়ের দশকে স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রী আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব পড়েছি প্রায় সম্পূর্ণভাবে নারীবাদী চিন্তক ও নারী অভিজ্ঞতা বিবর্জিত পাঠক্রমের মধ্য দিয়ে। দু-একজন নারী নৃতাত্ত্বিকের কথা ছিটকে পাঠক্রমে এলেও, তাঁদের নারীসত্তা ও লিঙ্গভাবনা কোনোটাই স্থান পেতো না আলোচনায়। কিন্তু, মজার ব্যাপার হলো এই যে, এই বর্জনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েনি বাংলা তথা এদেশের ছাত্রীসমাজ। যেমন, কিন্তু সীমিত আকারে হলেও ঘটেছিলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠক্রমের মার্ক্সবাদের বর্জনের ফলে।
তাই, একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে বিষয়গুলিকে ধরে কেন্দ্রীভূত হয় এই মেয়েদের পিতৃতন্রের আলোচনা, তা কোনোভাবেই একধরনের অতীব উচ্চবিত্ত, হিন্দু, উচ্চবর্ণীয় যাপন ও পরিমণ্ডল ছেড়ে বেরোয় না। ফলত:, যে ছাত্রীরা রাস্তায় মহিলা ড্রাইভারদের ওপর সার্বিক কটাক্ষ বা মহিলাদের জন্য সুরক্ষিত পথঘাট ও সর্বজনীন ক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি নিয়ে সরব হয়, তারাই ক্লাসের সবাই মিলে শাহীনবাগে শিক্ষামূলক ভ্রমণে যাওয়ার কথা উঠলে বলে -- "ঐসব অঞ্চলে" যাওয়ার অনুমতি মিলবে না তাদের পরিবারের কাছ থেকে। অথবা, যে ছাত্রীরা পোশাকের স্বাধীনতা বিষয়ে হয়ে ওঠে অতীব পীড়িত, হিজাব-বিতর্ক নিয়ে ক্লাসে কথা তুললে, দেখা যায়, তারা সার্বিকভাবে নীরব।
এক্ষেত্রে, আরেকটি উদাহরণ বিশদে আলোচনা করলে, বোধহয় বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট হবে। যেমন ধরুন, প্রায় প্রতিটি ক্লাসেই আমি ধার্য করেছি একটি ছোট্ট সমীক্ষামূলক কার্যবিধি বা প্রজেক্ট। সেখানে, প্রথমত: ছাত্রছাত্রীদের করতে হয় একটি বিশদ সাক্ষাৎকার। একজন গৃহশ্রমিকের। তারপর, সেই সাক্ষাৎকারের ওপর দাঁড়িয়ে লিখতে হয় একটি বিশ্লেষণাত্মক লেখা। কার্যবিধিটি ছাত্রছাত্রীদের ধার্য করার দিনই বলে দেওয়া হয় যে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে কাজ করেন যে গৃহশ্রমিক মহিলারা, তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া চলবে না। নৈর্ব্যক্তিক ও নীতিগত কারণে।
অবশ্য, লেখাগুলি জমা পড়ার পর যা দেখা যায়, তা হলো, বারণ থাকা সত্ত্বেও, ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজ নিজ গৃহে নিযুক্ত গৃহশ্রমিকদেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। কারণ হিসেবে তারা বলেন যে অন্য কোনো গৃহশ্রমিককে তাঁরা চেনেন না, এবং কিভাবে সেইসব অচেনা গৃহশ্রমিকদের পরিচয় করে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে, তাও তাঁদের অজানা। এই স্বীকারোক্তির মধ্যেই আছে আমাদের সবার শ্রেণীবিভক্ত যাপনের সমাজতত্ত্ব। শ্রেণীর স্থানিক দূরত্বের সমাজতত্ত্ব। আমাদের শ্রেণীবিভক্ত জীবন তো আসলে আমাদের শেখায় শ্রেণীবিশেষে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে বসবাস করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, স্পষ্টতই মানবীবিদ্যাচর্চার শ্রেণীকক্ষ, তার নারীবাদী তত্ত্বের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মধ্য দিয়ে, ছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করতে পারে না, সেই বিভক্ত সামাজিক ক্ষেত্র অতিক্রম করার প্রাথমিক পদক্ষেপটুকুও ওঠাতে। প্রশ্ন করলে, আবারও তারা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বলেন, "ঐসব অঞ্চল", যেখানে গৃহশ্রমিকরা থাকেন, সেখানে তাঁদের যাওয়া বারণ। এবং, এই যে পরিবার থেকে ঘোষণা করা নিদান, তার পেছনে যে গভীর পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ, তার বিরূদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে তারা অনুপ্রাণিত হয় না। এবং, এখানেই মানববিদ্যাচর্চার হাত ধরে গড়ে তোলা যে "নারীবাদী" শ্রেণীকক্ষ, তার ব্যর্থতা। প্রকারান্তরে, সামাজিক আন্দোলনের যে ক্ষেত্রগুলি -- তা সে নারী আন্দোলনই হোক, বা অন্যকিছু -- সেখানে কিন্তু ভাঙে এই সামাজিক বিভাজনগুলি। হয়তো বহু দ্বন্দ্ব সহই ভাঙে, ভাঙে বহু ভুলভ্রান্তিসহই। কিন্তু, ভাঙে। কিছুটা হলেও ভাঙে। যেমন, ভাঙে আরও অনেক কিছুই। তবে, সেই আলোচনার জায়গা এই লেখাটি নয়।
অবশ্য, এই গল্পের আরেকটি দিক আছে। ঠিক কিরকম গদ্য লেখে ছাত্রীরা সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার পর? স্বাভাবিকভাবেই, প্রত্যাশামতো শেষে থাকে পিতৃতন্ত্রের রোজনামচা -- বিশেষত:, একজন গৃহশ্রমিকের জীবনকে কেন্দ্র করে যেভাবে চালিত হয় পিতৃতন্ত্র। সেখানে থাকে গৃহহিংসার গল্প, থাকে গ্রামীণ সামন্ততান্ত্রিক পিতৃতন্ত্রের কাহিনী, থাকে সেসবকে অতিক্রম করে শহরে স্থান পাওয়ার গল্পও। যা থাকে না, তা হলো, গৃহশ্রমিকটির কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনার কাহিনী। যে কর্মক্ষত্রটি আসলে আবার ছাত্রীটিরই পরিবার ও পারিবারিক গার্হস্থ্যতা।
অর্থাৎ, ছাত্রীটি সেখানে মালিকপক্ষ। খুব স্বাভিকভাবেই, মালিকপক্ষের এক প্রতিভূর কাছে, তাঁর কর্মক্ষেত্রের বঞ্চনা --- তা সে অর্থনৈতিকই হোক, কিংবা যৌন হেনস্থা কেন্দ্রিক, কিংবা সার্বিকভাবে মনুষ্যত্বের জন্য সম্মানহানিকর -- সে বিষয়ে মুখ খুলবেন না গৃহশ্রমিকটি। কাজেই, সমীক্ষা- পরবর্তী সময়ে, পিতৃতন্ত্রের অর্থ দাঁড়ায়, শুধুই সেই ধারার বঞ্চনাই, যা গৃহশ্রমিকটি মুখোমুখি হন, তাঁর পরিবার, তাঁর মূল সম্প্রদায়ের হাতে। প্রশ্নচিহ্নের বাইরে থেকে যায় আমার ছাত্রীদের পরিবার, তাদের সমাজ। অর্থাৎ, শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। ধনীক সমাজ।
উপরন্তু, বহু ক্ষেত্রেই যে রচনাটি তাঁরা লিখে আনেন, তাতে থাকে তাঁদের পরিবারের প্রতি গৃহশ্রমিকটির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। এবং, এর মধ্যেও কোনো অসততা নেই। সত্যিই, গৃহশ্রমিকটি হয়তো বলেছেন এই কথাগুলি। বলেছেন ঠিক একই কারণে, যে কারণে তিনি বলেন নি তাঁর কর্মক্ষেত্রে -- তাঁর মালিক-মালকিনের বাড়িতে -- তাঁর বঞ্চনার কথা। এই যে একজন প্রান্তিক, শ্রমজীবী মহিলার কৃতজ্ঞতার আবৃত্তি, এও হতে পারতো পিতৃতন্ত্র ও শ্রেণিব্যবস্থার পরস্পরাশ্লেষী বয়ানের জটিল বিশ্লেষণ। কিন্তু, আমার ছাত্রীদের হাতে তা হয়ে ওঠে না। বরং, এই প্রান্তিক মহিলাটির কৃতজ্ঞতার পারফরম্যান্স, তার জন্য হয়ে ওঠে পারিবারিক আত্মশ্লাঘার ক্ষেত্র। যে আত্মশ্লাঘার চরিত্র আবার শ্রেণীগতও বটে। মানে, গল্পটা কিরকম? প্রায় প্রত্যেকটি রচনাতেই উঠে আসে একটি আধিপত্যকারী বয়ান। সেই বয়ানটি অনেকটা এইরকম -- গৃহশ্রমিকদের পরিবার ও নিজ নিজ সম্প্রদায়ে আছে প্রাচীর পরিমাণে পিতৃতান্ত্রিক শাসন। পিতৃতন্ত্রে জর্জরিত গরিব মেয়েটি তাই শহরে আসে, কোনো এক বাবুর বাড়িতে কাজ নেয় ও বর্তে যায়। এই বয়ানটির মধ্য দিয়ে শ্রেণীকক্ষে গড়ে ওঠে আরেক ধরনের যৌথতা -- শ্রেণী যৌথতা। কাজেই, নারীবাদী যৌথতা যখন ভেঙে যায় -- যে ভাঙ্গন বা অসম্পূর্ণতার কথা আগেই লিখেছি -- সেখানে তার বদলে গড়ে ওঠে আরেক ধরনের যৌথতা। লিঙ্গ ও শ্রেণী মিলেমিশে যায় এক জটিল সমীকরণে।
এই শ্রেণী যৌথতা, আমার অভিজ্ঞতায়, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পাঠক্রম ভাঙতে পারে না। আবারো বলি, আন্দোলনের ক্ষেত্রে পারে। আবারো বলছি, বহু দ্বন্দ্ব, অসম্পূর্ণতা সহই পারে। এবং, তার সাথে, শ্রেণীকক্ষটির প্রকৃতি যদি হয় বেসরকারিকরণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, তা হলে এই বিকল্প যৌথতা গোড়ার কাজটি হয়ে ওঠে আরও কঠিন। কারণ -- আমার ছাত্রছাত্রীরা সেই শ্রেণীকক্ষে হাজির ভোক্তা হিসেবে -- তাঁদের ভোক্তাসত্তা পরিপুষ্ট হয় তাঁদের শ্রেণীসত্তার ওপর দাঁড়িয়ে।
আমাদের সাবেকি যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেখানে শ্রেণীকক্ষে কার্যকরী হতো শিক্ষকশিক্ষিকাদের একধরনের কর্তৃত্ব। সেই কর্তৃত্বের মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্য ছিল, গুরুবাদ ছিল। জেক সমস্যায়িত করার বিশেষ রাজনৈতিক প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু, বেসরকারিকৃত যে শ্রেণীকক্ষ, সেখানে শিক্ষক বা শিক্ষিকা পর্যবসিত হন একজন পরিষেবা প্রদানকারীতে। ভোগবাদের ভিত্তিগত কথাই যেহেতু "the consumer is always right," (ভোক্তাই সর্বক্ষেত্রে সঠিক), এই বেসরকারিকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে শ্রেণীকক্ষ, সেখানে তাই ছাত্রছাত্রীদের দিকে আরেকটু বেশি শিক্ষকসুলভ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার জায়গা থাকে না। যেমন, আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের রচনাগুলি বাতিল করতে পারি না। তাঁদের বলতে পারি না যে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। কারণ, বেসরকারি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দস্তুর ঠিক তা নয়। কাজেই, সেক্ষেত্রে, আরও অনেক কিছুর মতোই, লিঙ্গ ও মানবীবিদ্যাচর্চা পর্যবসিত হয় একটি পুঁজি-নির্ভর, ব্যবসায়িক পণ্যে। তার সাথে লড়াকু নারীবাদ, নারী আন্দোলন বা লিঙ্গ রাজনীতি, কোনোটারই কোনো বিশেষ সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে, আরেকটু বৃহত্তর অর্থে ভাবলে, প্রশ্ন তুলতে হয় ভারতবর্ষে প্রাতিষ্ঠানিক নারীবাদ চর্চা নিয়েও, যার একটি বড়ো জায়গা কেন্দ্রীভূত হয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানববিদ্যাচর্চা কেন্দ্র ও বিভাগগুলিতে। মানে, যে রাষ্ট্র সোনি সোরির ধর্ষককে পুরস্কৃত করে , অথবা কুনান পোশপোড়া বা থাঞ্জাম মনোরমার ধর্ষণ ঘটায়, যে পুঁজি মহিলা শ্রমিকদের সমবেতন বা সংগঠিত হওয়ার অধিকার কেড়ে নেয়, তারাই যখন নারীবাদচর্চা কেন্দ্র খোলে, কিভাবে আমরা দেখবো আজ সেই দ্বন্দ্বটিকে ? আজ এই ভিত্তিগত কথাটি না ভাবলে রাজনৈতিকভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য এ দেশের নারী আন্দোলন।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১২ এপ্রিল ২০২২
0 Comments
Post Comment