পূর্ণ হোক অর্ধ আকাশ

  • 14 October, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 816 view(s)
  • লিখেছেন : ​​​​​​​নার্গিস পারভিন
স্বাধীনতার পর থেকে রোজই মনে হয়েছে আসছে আসছে, এই এল বলে, অথচ যা আজও এল না! এদিকে আমাদের আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখাও ফুরলো না! এখন মনে প্রশ্ন জাগে নারী স্বাধীনতা তাহলে কি সত্যিই তেমনই এক অলৌকিক বস্তু? অবশ্যই না। নারীর স্বাধীনতা তেমন কোনো অলৌকিক বিষয় নয় বরং আমাদের ওই আচ্ছে দিনের মতোই যা একান্ত কাম্য এবং যা সত্যিই আসা সম্ভব, তবুও আসছে না। এখন প্রশ্ন, এই নারী স্বাধীনতা তাহলে কি? নারী স্বাধীনতার বিপরীতেই কি রয়েছে পুরুষের পরাধীনতা?

নারী স্বাধীনতা নারীর মনে বুনে দেওয়া এমনই এক অলৌকিক স্বপ্নের মত, যা আমরা চিরদিনই মনে পোষণ করে যাব, অথচ স্বপ্নপূরণ আর কখনোই হবে না। অনেকটা সেই আমাদের দেশে আচ্ছে দিন আসার মত; স্বাধীনতার পর থেকে রোজই মনে হয়েছে আসছে আসছে, এই এল বলে, অথচ যা আজও এল না! এদিকে আমাদের আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখাও ফুরলো না! এখন মনে প্রশ্ন জাগে এই নারী স্বাধীনতা তাহলে কি সত্যিই  তেমনই এক অলৌকিক বস্তু? অবশ্যই না। নারীর স্বাধীনতা তেমন কোনো অলৌকিক বিষয় নয় বরং আমাদের ওই আচ্ছে দিনের মতোই যা একান্ত কাম্য এবং যা সত্যিই আসা সম্ভব, তবুও আসছে না। এখন প্রশ্ন, এই নারী স্বাধীনতা তাহলে কি? নারী স্বাধীনতার বিপরীতেই কি রয়েছে পুরুষের  পরাধীনতা? না, একদমই তা নয়। নারীর স্বাধীনতা বলতে, নারীর সমান অধিকারের কথাই বলব। তবে এই সমানাধিকার শব্দটার মধ্যে থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই একটা তুলনার ইঙ্গিত উঠে আসে। নারী পুরুষের তুলনায় কম অধিকার বা কম স্বাধীনতা ভোগ করেন। নারীকে পুরুষের সমান স্বাধীনতা অর্জন এবং ভোগ করতে হবে। সেই হল নারীর সমানাধিকারের বিষয়।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং সমমর্যাদাপূর্ণ সহাবস্থান একমাত্র নারীরই কাম্য হওয়া উচিত নয়, এটি সমাজের  সমস্ত মানুষেরই কাম্য হওয়া উচিত। আমরা সকলেই জানি দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা হিসেবে নারীর পিছিয়ে থাকার অর্থ হল দেশের অবনতি। মানব সমাজের অবনতি। তাই কেবলমাত্র নারীর প্রয়োজনে নয়, সমাজের কল্যাণে, দেশের কল্যাণে নারী-পুরুষ ভেদে একত্রিতভাবে সমস্ত  মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে নারীর সমানাধিকার অর্জনে।

এ প্রসঙ্গে অবশ্যই মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা কাউকে পাইয়ে দেওয়া যায় না, তাকে অর্জন করতে হয়। নারী যদি সত্যিই স্বাধীনতা ভোগ করতে চান তবে নারীকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মনে পড়ছে, ফরাসী বিপ্লবের পর ফ্রান্স থেকে যখন রাজতন্ত্র উঠে গেল, তখন ফ্রান্সে শুধুমাত্র পুরুষদের  জন্যই বরাদ্দ হল মৌলিক অধিকারগুলো। সেই সময় ওই দেশের এক নারী অলিম্পি ডে গউজেস, দাবি করলেন নারীও পুরুষের সঙ্গে সমান তুল্য, তাই পুরুষদের মতই ফ্রান্সের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা নারীদেরও প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁর এই সমানাধিকারের প্রশ্নে পুরুষ নেতারা (জ্যাকোবিন দলের নেতারা) তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নারীর চাওয়ার পথ ধরেই আজকের পৃথিবীতে নারী অনেকটা অধিকার অর্জন করেছেন। অর্থাৎ যার যেটা প্রাপ্য সেটা পাওয়ার জন্য নিজের মনে সেই ইচ্ছা জাগাতে হবে, তার প্রকাশ ঘটাতে হবে এবং সেটা অর্জনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। তবেই তার প্রাপ্তি ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস।

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে, কিছু আন্দোলন, বিজ্ঞানের উন্নতি, আইন প্রণয়ন কিংবা সময়ের সাথে সাথে নারীর সমানাধিকারের বিষয়টা কিছুটা এগিয়ে, অনেকটা থেমে আছে। মুষ্টিমেয় কিছু নারী এদেশেও হয়ত বিচ্ছিন্নভাবে নারী স্বাধীনতার আলোয় আলোকিত হয়েছেন, কিন্ত তিক্ত সত্য যে, সার্বিক ভাবে নারী যে অন্ধকারে ছিল আজও সেই অন্ধকারে। আজও নারী সমাজের চোখে যৌনতার বিষয় মাত্র। আজও নারীর জন্য পরিবারের সর্বশ্রেষ্ঠ কামনা হল একটা সুযোগ্য পাত্র। আজকের নারী শিক্ষা গ্রহণ করছে, হয়ত অর্থ উপার্জনও করছে কিন্তু সে সবই নির্ধারিত হচ্ছে সেই নারীর নিজের ইচ্ছায় নয়, বিবাহের বাজারে চাহিদার নিরিখে। তাই বিবাহের পরই নির্ধারিত হয় নারী চাকরি করবে, না ছেড়ে দেবে। আজও বিবাহই নারীর জীবনযাপনের প্রথম শর্ত। তাই নারী পণ্য। নারীকে এই সমাজ ঢেকে রাখতে চায়, নিভৃতে ভোগ করতে চায়। তাই নারী যৌবনে যৌনকর্মী হয়ে কোঠাবাড়ির মালকিন হয়ে যেতে পারেন আর বৃদ্ধে পথের ভিখারী। আজও নারী ধর্ষিতা, অত্যাচারে অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত। এ সমাজ নারীকে ভোগ্য হিসাবে দেখে বলেই মনে করে রাতের অন্ধকারে নারীর একলা চলাফেরা বিপদের কারণ। সেই চর্যাপদের কবির ভাষায়, "অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী"। সময় বয়ে গেছে, ভাবনা আজও একই রয়ে গেছে। তাই বধু হত্যা, নারী পাচার কিংবা ধর্ষণ দেখেও আমরা স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন করতে পারি।  নানা ভাবে ভাবতে থাকি মেয়েটার কোথায় ভুল ছিল। কী কী সাবধানতা অবলম্বন করলে আমার মেয়েরও সেই বিপদ হবে না! এভাবেই নারীকে আমরা মনে মনে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিই। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা সেই অন্ধকারেই নিমজ্জিত। নারী-পুরুষের এই সমানাধিকার আজও যে সোনার পাথরবাটি হয়েই রয়ে গেছে, তার মূল কারণ আমাদের চিন্তার অভাব, আমাদের সচেতনতার অভাব, আমাদের যথাযথ প্রচেষ্টার অভাব। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বা স্বনির্ভরতা নারীর সমানাধিকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। আমাদের মানতেই  হবে, শক্তিই স্বাধীনতা অর্জনের এবং ভোগের মূল উৎস। সেই শক্তিই আজ অর্থের আঙ্গিকে বিদ্যমান। তাই অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নারীর সমানাধিকারের মূল চাবিকাঠি। তবে অবশ্যই বলব শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নারীর সমানাধিকার অর্জনের একমাত্র শর্ত নয়। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পাশাপাশি প্রয়োজন সদ্ভাবনা, সচেতনতা এবং উপযুক্ত প্রচেষ্টা। ব্যক্তিগত ভাবে এমন অনেক নারীকে জানি যারা পেশায় শিক্ষক অধ্যাপক বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ জীবিকার সঙ্গে যুক্ত, সংসারে একটা মোটা অংকের অর্থ তিনি উপার্জনও করেন, অথচ সেই নারীর কোনো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই। এই সচেতনতার ক্ষেত্রে নারী এখনও অনেকটা পিছিয়ে। নারীর অধিকার অর্জনের বিষয়টিও তাই দেশ, কাল ও ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। প্রকৃতির নিয়মই সেটা যতটুকু আকাঙ্ক্ষা করব আমরা হয়ত ততটুকুই অর্জন করব। ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বেশ কিছু দেশেই নারীর সচেতনতার অনেকটা উত্তরণ প্রয়োজন বলেই আমার বিশ্বাস।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ রোকেয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেই হয়। তাঁর গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধগুলোতে বারবার তিনি নারীকে শিক্ষিত, সচেতন এবং উপার্জনশীল হতে বলেছেন। তাঁর "অবরোধবাসিনী"তে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে নারী অলংকার নামক সোনার বেড়িতে আবদ্ধ। বিস্ময়কর যে, একশ বছর পরেও রোকেয়া প্রাসঙ্গিক। আজকের নারীকে তাই  আরো অনেকটা  সচেতন হতে হবে। যে পুরুষ পরিচালিত সমাজ নিজের স্বার্থে নারীকে একদিন তার স্বাধীন বিচরণ ক্ষেত্র থেকে ঠেলে অন্দরমহলে পাঠিয়ে দিয়েছিল সেই অন্দরমহল থেকে, নারীকেই বেরিয়ে আসতে হবে।

বর্তমান সময়ে, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সারা পৃথিবী যখন মুঠোর মধ্যে, ঠিক তেমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে পুরুষ পরিচালিত সমাজকে একদিকে যেমন বদলাতে হবে তার ভাবনাচিন্তা, অন্যদিকে নারীকেও শিখতে হবে যুক্তির আলোকে নিজেকে বিচার করতে। নারীকে নিজের মূল্য প্রথমে নিজেকেই দিতে হবে। নারী নিজে, নিজের আত্মমর্যাদাটুকু অনুভব করতে পারলে তবেই পরিবার, সমাজ, দেশ নারীকে সেই মর্যাদা দিতে শিখবে। তার অধিকারের জায়গাটুকু ছেড়ে দেবে। দেশ বলতে বোঝায় দেশের মানুষ। সেই মানুষ প্রথমে পরিবারবদ্ধ। আর পরিবার গড়ে তোলে সমাজ; সেই সমাজ, যে সমাজ একটা ভাবনা, ধ্যান-ধারণাকে মান্যতা দেয়, প্রচলন ঘটায়। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অঙ্গুলি হেলনেই, গড়ে ওঠে দেশের আইনকানুন। তাই নারীর সমানাধিকার অর্জনের কাজটাও সদর্থক অর্থেই শুরু হতে হবে পরিবার থেকে। এই জায়গায় নারী ব্যক্তিগতভাবে করতে পারেন অনেক কিছুই। সংসারের গণ্ডির মধ্যে নারীকে ভেঙে ফেলতে হবে কাজের সীমানা। কেবল নারী নয়, পুরুষকেও মনে সেই সদ্ভাবনা পোষণ করতেই হবে। আগেই বলেছি নারীর সমানাধিকার নারীর একার বিষয় নয়, কেবল নারীর কল্যাণের জন্যও নয়, এ হল দেশের দশের সার্বিক কল্যাণে। তাই নারী-পুরুষ মিলেমিশে উদ্যোগী হতে হবে। নারীকে বুঝতে হবে অর্থ উপার্জন করাটাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয়, অর্থনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং দায়িত্ব নেওয়ার জন্যও নারীকে এগিয়ে আসতে হবে। আমি কিছু জানিনা বুঝিনা, যা জানে সব উনি, তাই আমি অর্থনৈতিক ব্যাপারে নাক গলায় না— এভাবে ভাবলে চলবে না। হোক ভুল, তবু নারীকে সঙ্কোচ কাটিয়ে এগিয়ে আসতেই হবে। পুরুষের কি ভুল হয় না? ব্যবসায় অর্থলগ্নি করে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন না? তখন কি সেই পুরুষের সমগ্র পরিবারকে দুর্ভোগে পড়তে হয় না? হয় তো। তবে কেন নারী ভয়ে পিছিয়ে থাকবে? কাজে নেমে ভুল করতে করতে (উপহাস শুনতে শুনতে, যদিও তার প্রাপ্য নয়) একদিন নারী শিখবেই। মনে রাখতেই হবে নারীকে স্বাধীনতা অর্জন বা ভোগ করতে গেলে দায়িত্ব পালনের কৃতিত্বও দেখাতে হবে। কেবল বাসের সিট সংরক্ষিত আছে কিনা ওইটুকুতেই নারীকে সন্তুষ্ট হলে চলবে না, নারীকে বাস চালানোর দায়িত্ব নিতে পারতে হবে। বাসের সিট সংরক্ষিত হোক, নারী-পুরুষ ভেদে অসহায় দুর্বল অক্ষমদের জন্য। নারীকে সংরক্ষিত আসনে বসানো আসলে নারীকে অক্ষম দুর্বল অসহায় ভাবা। এই ভাবনা থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে নারীকে নিজেকে। সেই সঙ্গে সমাজকে দেশকেও। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয়, নারীকে দুর্বল অসহায় কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবার পিছনে রয়েছে বহু যুগ ধরে প্রচলিত সামাজিক প্রথা; নারীর বাধ্যতামূলক বিবাহ। বিশেষত  বিদ্যা-বুদ্ধিতে, অর্থে, নারীর তুলনায় ক্ষমতাশীল কোনো পুরুষের সঙ্গে নারীর বিবাহ। আজও চলে আসছে সেই অহেতুক প্রথা। পুরুষ পরিচালিত সমাজের এই ভন্ডামিকে চিনে নিতে হবে প্রতিটা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকেই। সেই আদিম প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে নারীকে। নারী নিজে পেশায় ডাক্তার হলে তার জীবন সঙ্গীকে হতেই হবে তার থেকে কোন বড় ডাক্তার, এই ভাবনার বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে নারীকেও। তবেই নারী নিজেকে চিনবেন। তবেই এই সমাজ, দেশ পরিচালনায় নারী সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন। আক্ষরিক অর্থেই মনের সীমাবদ্ধ ভাবনা থেকে নিজেদের মুক্ত করে, পুরুষকেও তাদের তাসের আড্ডা থেকে উঠে এসে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যৌথভাবে পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে হবে সব শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকেই, তবেই হয়তো একদিন সোনার পাথরবাটি আর সোনার পাথরবাটি থাকবে না হয়ে উঠবে সেই বাটি যা পাথরের মতোই জমাট-জোটবদ্ধ, আবার সোনার মতই গৌরবোজ্জ্বল!

পুনঃপ্রকাশ

লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার

ছবি সৌজন্য ইন্টারনেট

0 Comments

Post Comment