- 19 August, 2020
- 0 Comment(s)
- 1074 view(s)
- লিখেছেন : রোশন কুমার
‘‘ঘরের কাজও কাজ’’ অথবা ‘‘সংসারের জন্য মহিলাদের নিঃস্বার্থ পরিশ্রম’’ ইত্যাদি শিরোনামে অনেক লেখা হয়েছে। এই নিয়ে সম্পাদকীয় থেকে গবেষণাপত্র হয়েছে লক্ষ লক্ষ। তাই বলেই কি সেই আলোচনা বা গবেষণার পজিটিভ প্রতিফলন দেখা গেছে মহিলাদের জীবনে? বোধ হয় না! যতই নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং সমান সুযোগ পাওয়ার কথা আলোচনা/গবেষণা হোক না কেন, সিংহভাগ মহিলারা যে এখনও বাস্তব জীবনে যথেষ্ট অসমান জীবনই কাটাচ্ছেন তা আরো একবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই করোনা অতিমারী।
গত মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে করোনা ভাইরাস মারাত্মক ভাবে সংক্রমিত হতে শুরু করলে প্রথমে পুরোপুরি ও ক’মাস পর থেকে শুরু হয় হালকা লকডাউন। প্রথম দিকে বন্ধ হয়ে যায় অত্যাবশ্যকীয় ছাড়া বেশ কিছু অফিস/কাজের জায়গা। তবে কিছু দিনের মধ্যেই আসে ‘‘work from home’’ মানে বাড়ি থেকেই কাজ। যদিও এই ব্যাপারটা করোনা পরিস্থিতিতে প্রথম না। এর আগেও work from home ছিল, তবে এত বহুলভাবে ঘর থেকে কাজ করার প্রয়োজন ছিল না।
যে বিষয়টা আলোচনা করব সেটা শুরু করার আগে প্রেক্ষাপট স্বরূপ দুচার কথা বলি। ওই যে আগে যেটা বলছিলাম ‘‘ঘরের বা সংসারের কাজ’’, মানে সেইসব টিপিকাল কাজগুলোর কথা বলছি যেগুলো এখনও পৃথিবীর অধিকাংশ স্থান জুড়েই সহজাত ভাবে মহিলাদের ঘাড়েই ফেলে দেওয়া হয়। আর মহিলারাও এই ধরনের কাজগুলোকে নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে ধরে নেন। ঘর মোছা, রান্না করা, বাসন মাজা, জামা কাপড় কাচা, শিশু বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকলে তার দেখভাল করা— এইসবগুলো একতরফা মেয়েদের কাজ বলেই ধরে নেওয়া হয়।
‘‘আমাদের বাড়িতে এরকম নয়, অধিকাংশ বাড়িতেই আমরা এখন নারী পুরুষ সমান সমান কাজ ভাগ করে নিচ্ছি সংসারের’’—এই বলে আমার কথাকে খণ্ডন করবেন জানি। তবুও বলছি, জোর গলায় বলছি, অধিকাংশ বাড়িতে মোটেও এরকম হয়না। কারণ মহিলারাও তো নিজেদের যথেষ্ট গড়ে নিয়েছেন এই বৈষম্যের মধ্যে।
লক ডাউন শুরু হওয়ার পর প্রথম প্রথম ফেসবুক বা আরো সব সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট নজর পড়ছিল ‘‘সবকিছু বন্ধ থাকলেও রান্না ঘর বা সংসার বন্ধ নেই, মেয়েদের কাজ করেই যেতে হচ্ছে’’। এ তো গেল আগেই যা বলছিলাম তার কথা , এবার তাহলে একটু ভেবে দেখা যাক যে যেসব মহিলা চাকুরিজীবী এবং পরিবারের সঙ্গে থাকেন, তাদের সমস্যাটা আরো কতটা গভীর হয়ে উঠছে।
সাধারণ সময়েও মহিলা পুরুষ একই খাটুনির কাজ করে, দুজনে একই সময়ে বাড়ি ফিরলেও, মহিলার রয়ে যায় গৃহের আরো হাজারো কাজ। যেগুলো নাকি একতরফা মেয়েদের। যুক্তি হিসেবে তার পেশাটা হয়ে যায় তখন সেকেন্ডারি একটা ব্যাপার। ঠিক করে কান পাতলেই এই কথা আমরা অনেক শিক্ষিত পুরুষের মুখেও শুনি, ‘‘চাকরিটা তো ইচ্ছেতে করছে, তাই বলে সংসারের কাজ করবে না?’’ অথবা কোনো এক মহিলা, কোনো এক কর্মজীবী মহিলাকে উপদেশ দেন, ‘‘বাচ্চার দিকে আরেকটু নজর দিন, বাইরে চাকরি করলে সন্তান তো বিগড়ে যাবে।’’
লকডাউনে বাড়ি থেকে কাজের ব্যাপারটা বেশি করে শুরু হল। এদিকে গৃহ পরিচারিকারাও তাঁদের নিজের বাড়িতে বন্দি। আর এই পরিস্থিতিতে কীভাবে মেয়েরা ঘরে বসে অফিস করছেন তার নমুনা সোশ্যাল মিডিয়ায় রসিকতা করে প্রকাশও পেল। এক মহিলা অনলাইনে অফিসের বসের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁর বাড়িতে তখন রান্নাঘরে প্রেশার কুকারে সিটি পড়ছে। কয়েকটা সিটি পড়ার পর শাশুড়ি চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘বৌমা কটা সিটি পড়ল?’’ বৌমা তো সিটি গোনেননি। তিনি যে অফিসের ডিউটিতে। ঠিক করে উত্তর দিতেও পারছেন না। বস তখন ঘরের সেই বৌমা, যিনি তাঁর অফিসের কর্মী তাঁকে বললেন, ‘‘আমি চারটে সিটি পড়তে শুনেছি।’’ এটা হাসিচ্ছলে মেয়েদের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’- এর কিছুটা বাস্তব চিত্র। বাড়ি সামলে নাকানি-চোবানি খেয়ে যেসব মেয়েদের অফিস বেরোতে হয়, তাঁরা বাড়িতে বসে নির্বিঘ্নে অফিস করার সুযোগ যে পাবেন না, এই রসিকতা সেইদিকের ইঙ্গিত।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠী, পেশায় শিক্ষক, সে বলে “আমার বাবা-মা, আমি সব কাজ সমান ভাগ করে নিয়ে করছি। আমার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তবে আমাকে পেশাগত ক্ষেত্রে খুবই কম সময় দিতে হচ্ছে বলে বাকি সব ঠিক করতে পারছি।’’ ও আরো জানায় যে, ওর ক্ষেত্রে যখন কাজ করতে বাইরে যেতে হতো তখন সবটা কাজই ওর মাকে করতে হতো। যেটা এখন ও সারাদিনে ভাগাভাগি করে নিতে পারছে। তবে সেই সঙ্গে ও এটাও বলে যে ওর “বিবাহিত সহকর্মীদের ক্ষেত্রে ব্যাপার তো তখনও মুস্কিল, ছিল এখনও আছে।’’
আরেক বান্ধবী, একটি বহুজাতিক সংস্থায় তথ্য প্রযুক্তির কাজ করে, সে জানায় যে, পারিবারিক কারণে এই লকডাউনের মধ্যে ওর মা (যিনি আগে ঘরের সব কাজ করতেন) অন্য জায়গায় থাকে তাই বাবা এখন অনেক কাজ করছেন। তার বাবা মনে করেন, তাঁর নোবেল পাওয়া উচিত। এইসব মজার ছলেও বোঝা যাচ্ছে যে শুধু মাত্র নিজেরটুকুই করে নেওয়ার অভ্যেসটা পুরুষের সাধারণভাবে এত কম যে, সবারটা করার ক্ষেত্রে তাদের কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। অথচ এই সবারটা তো ঘরেই থাকুন আর চাকুরীরত হন মহিলারা করতে বাধ্য হন। ঘরের বহু কাজ সামলে তাঁদের চাকরিতে যেতে হয়।
একজন রেলকর্মী জানান, যতদিন ঘর থেকে অফিসের কাজ করতে হয়েছে তখন যতই অফিসের কাজ বেশি থাকুক, ঘরে থেকেও ঘরের কাজে একটু বেশি নজর না দেওয়াটা দৃষ্টিকটু লেগেছে। তাঁর মতে, যখন অফিসে গিয়ে কাজ করতেন তখন ঘরের কাজ সামলে যেতেন। এতে নির্দ্বিধায় কিছু বেশি খাটনি হত। কিন্তু ঘরে থেকে অফিস করার ক্ষেত্রে, অফিসের থেকে ঘরের কাজ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। পরিবারের দাবি যে সেই রকমই।
আগেও যেটা বলেছি, সেটাই শেষে বলছি— কী কারণে মহিলাদের এই কাজগুলো করতে হয় তা নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। তবে তাতে কোনো বিশেষ অবস্থার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। যেটা এই অতিমারির পরিস্থিতিতে বাড়ি থেকে কাজের চল হয়েছে তাতে মহিলারা আরো একটা খারাপ প্যাঁচে পড়ে গেছেন। বাইরে কাজ করতে গেলে সেই সময়টা কর্মক্ষেত্রের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু মহিলা ঘরে থাকবেন অথচ পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেবেন না, অফিসের কাজে বেশি মনোযোগ দেবেন এটা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলাদের তাই পেশাগত কাজ কম সময়ে মিটিয়ে, ঘরের কাজের জন্য বেশি করে সময় দিতে হচ্ছে। এইসব থেকে এখন একটাই ভাবনার বিষয় থেকে যায়, এই বাড়ি থেকে কাজ (পেশাদারী কাজ) ভবিষ্যতে কতটা মহিলাদের সুবিধা দেবে? তাঁরা পারবেন তো কর্মক্ষেত্রে নিজের দক্ষতা প্রমাণের লড়াইয়ে এগিয়ে যেতে?
ছবি: প্রতীকী
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
0 Comments
Post Comment