- 08 March, 2022
- 0 Comment(s)
- 450 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
আসুন খোলাখুলি কথা বলি। সবসময় প্রবন্ধাকারে বলতে ইচ্ছে করে না। লেখক আর অধ্যাপক এক ব্যক্তি নন। ক্লাসের প্ল্যাটফর্মের উপরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়ার মনোবৃত্তি লেখককে পেয়ে বসলে পরে, তিনি আর লেখক থাকেন না। প্রচারক হয়ে দাঁড়ান। অবিশ্যি অধ্যাপনার পদ্ধতিও কেবল যে মোনোলগেই সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়। যে কোনও বিষয়, যার মাধ্যমে কি না অন্তরের সমৃদ্ধি ঘটার সুযোগ থাকে – সেগুলি দ্বিমুখী হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সে অধ্যাপনাই হোক, কিংবা সাহিত্য। যদিও শেষ অবধি এখানে একনাগাড়ে আমিই বলে চলব। আপনারা পড়বেন। আপনাদের মতামত, মুখভঙ্গি, জাগ্রত বোধ অথবা সমালোচনা, আমার কাছ অবধি পৌঁছানোর সম্ভাবনা কম। তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে, উপলক্ষ্য যেমনটাই হোক না কেন – প্রবন্ধের চেয়ে মুক্তগদ্যের আলোচনায় স্পর্শসুখ আসে বেশি। মানুষই মানুষের দিকে হাত বাড়ায়।
শ্রমজীবী নারী দিবস, ৮ই মার্চ। কথা দিয়েছিলাম কিছু একটা লিখতে চেষ্টা করব। যদিও একথা বলা উচিত, নারীবাদের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে যাওয়াটা আমার ক্ষেত্রে বাতুলতা। বিগত কিছু মাস যাবৎ নারী বৈজ্ঞানিকদের বিষয়ে বেশ কিছু আলোচনা-মূলক প্রবন্ধ লিখেছি বটে, কিন্তু সে হলো ডকুমেন্টেশন মাত্র। সেসব ঐতিহাসিকদের কাজ। আক্ষরিক অর্থে নারী-আন্দোলনের কর্মী বলতে যা বোঝায় আমি তা নই। তবে নিয়মিত লিখি কেন ? লিখি এই কারণে যে, আমি মনে করি প্রত্যেক সার্থক আন্দোলনের একটি সার্বিক আপিল থাকা প্রয়োজন; এবং সর্বাত্মক আন্দোলন সেটিই, যেখানে লিঙ্গ-বর্ণ-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ একত্রে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। একত্রে প্রতিবাদ করে। সেই সূত্রে নারী আন্দোলনের দায় কেবলমাত্র নারীদেরই নয়, তার দায় পুরুষদের উপরেও বর্তানো উচিত।
আজ নারীদিবসের প্রাকমুহূর্তে দাঁড়িয়ে টুকরো টুকরো যে ভাবনাগুলো মনকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে, ভাবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেগুলিকে নিয়েই দু’এক কলম লিখতে চাইব। শ্রমজীবী নারীদের প্রতি সেই হবে আমার সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্যজ্ঞাপন।
সময়টা বইমেলার। আমার খুব আনন্দ হয়েছে সেদিন, যেদিন কি না প্রথমবারের জন্য এবারের বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে ক্রেতা নয়, বরং হয়তো বা কর্মী (?) হিসেবে টেবলের ওইপারে বসার সুযোগ পেলাম। অনেক মানুষের সংগ্রাম মিশে থাকে এই প্যাভিলিয়নের সঙ্গে। অনেক পুরুষ, অনেক নারীর সংগ্রাম। এই সংগ্রামকে লিঙ্গের বিভাজনে ফেলতে নেই। কিন্তু মফস্বলের যে কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি রোজ সকালের টিউশনি সেরেই পিঠে একটা আধমণি ব্যাগ ঝুলিয়ে, প্রেসের খিটখিটে মালিককে নতুন সংখ্যাগুলি তাড়াতাড়ি ছেপে দেওয়ার তাগাদা দিতে দিতে, দুপুর আড়াইটের লোকাল ধরে কলকাতার বইমেলায় ছুটে আসে, তাদের পত্রিকার ‘বিশেষ রোকেয়া সংখ্যা’কে পাঠকের হাতে পৌঁছে দেবে বলে, অথবা সারাটা দিন যাবৎ অফিসে কলম পিষতে পিষতে নিঃশেষে ফুরিয়ে যেতে যেতেও সন্ধ্যে ফুরনোর আগেই মেলার ময়দানে এসে হাজির হয় ধর্মের ভিত্তিতে বেআইনি নাগরিক পঞ্জিকরণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য – আমি চোখ চেয়ে দেখি, এরাই রোকেয়ার ভবিষ্যৎ। এরাই উলস্টনক্র্যাফটের উত্তরসূরী।
এরা পরিসরকে আদায় করে নেয়। পরিসর পাওয়ার অপেক্ষা করে না। যে পরিসরের কথা উলফ লিখেছিলেন, তাঁর ‘এ রুম অব ওয়ানস ওন’১ সংকলনে।
এই বইমেলাতেই আমার রোকেয়ার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটল। আমার এবারের নারীদিবস বোধ করি এই কারণেও উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। ‘সুলতানার স্বপ্ন’২ পড়তে পড়তে অবাক বিস্ময়ে ভাবতে চেষ্টা করেছি, ইংরেজিতে এই রচনা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের বছরে, ১৯০৫ সালের ভারতবর্ষে, আজ থেকে একশো সতেরো বছর আগেকার এক সময়ে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কেবল নারীস্বাধীনতাই নয়, বিজ্ঞানচেতনা ও পরিবেশভাবনার কি আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটেছে রোকেয়ার এই লেখাটিতে। যুগের আগে আবির্ভূত হওয়া, বোধ করি একেই বলা হয়ে থাকে। রোকেয়ারই অন্য উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’ এখনও পড়তে শুরু করিনি, তারই ভূমিকাতে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ উত্তরা চক্রবর্তীর আলোচনার একটি পংক্তিকে এখানে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না, “ভার্জিনিয়া উলফের প্রবন্ধ সংকলন ‘এ রুম অব ওয়ানস ওন’ (১৯২৯)এর অনেক আগেই রোকেয়া নবনূরে ‘গৃহ’ (১৯০২) প্রবন্ধে লিখেছিলেন ‘আমাদিগের গৃহ নাই’ – নারীর পরিসরহীনতার কথা সোচ্চারে বলেছিলেন।’ ‘গৃহ’ অথবা ‘রুম’ শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও কালের পরিহাসে কি আশ্চর্য এক মেলবন্ধন। নারী অথবা পুরুষ, প্রত্যেক চিন্তাশীল জীবমাত্রের কাছেই আকাঙ্ক্ষার বস্তু হলো এক নিজস্ব চিন্তার পরিসর, এক নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তির সুযোগ, এক স্বাধীনতা। নারীদিবসের আন্দোলন তাই পরিসর খুঁজে নেওয়ার প্রয়োজনে। ন্যায্য পরিসরকে দাবি করার প্রয়োজনে। পরিসরকে, সম-অধিকারকে ভোগ করার প্রয়োজনে। এব্যতীত নারীদিবসের আর কোনও প্রধানতর উদ্দেশ্য হয় না।
পারস্পরিক সম্মান ও পরিসরের স্বীকৃতি ... আমরা পুরুষেরা যখন এত কাল, এত শতাব্দী ধরে নির্লজ্জ সাম্রাজ্যবাদীদেরই মতো ক্রমাগত নারীর পরিসরে আগ্রাসন চালিয়েছি, আজ তাদের পালটা অধিকারের দাবিকে আমাদের মান্যতা দিতেই হবে। প্রশ্নটা জোরের নয়, প্রশ্নটা নীতির ও স্বাভাবিক অধিকারের।
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে, সমকালীন নারীর কোন দুটি রূপকে সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ছে জানেন ? যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের একাধিক শহর থেকে পরের পর হৃদয়বিদারক একেকটি ঘটনার কথা যখন সামনে আসছে, তখন দেখছি কোথাও বা শহরের ভূঅভ্যন্তরস্থ বাঙ্কারে বর্ষীয়সী মহিলারা কর্তৃত্ব হাতে তুলে নিয়ে অল্পবয়সী অথবা বৃদ্ধদেরকে উদ্ধার করে আনছেন, তাদেরকে রক্ষা করছেন। আবার কোথাও বা প্রেয়সীরা সেখানেও প্রেমিকের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাতে তুলে নিচ্ছেন কালাশনিকভের মারণাস্ত্র। প্রত্যেক নারী যে বুদ্ধিরূপেণ, শক্তিরূপেণ অথবা মাতৃরূপেণ – এই তিনভাবেই বিরাজিত হতে পারেন; আমরাই কেবল সেই সত্যকে বিস্মৃত হই।
ম্যাক্সিম গোর্কির বিখ্যাত উপন্যাসের৩ শেষ কিছুটা অংশকে এই সময়ে অনুবাদ করতে চাইব,
“... তাঁর গলায় এবং পিঠে ধাক্কা দেওয়া হতে লাগল। কাঁধে, মাথায় বাড়ি পড়তে লাগল। সমস্ত কিছুই যেন হঠাৎ চোখের উপরে ঘুরতে শুরু করেছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, চিৎকার, শিসের শব্দ, উল্লাস আর হুঙ্কারে অন্ধকার একটা ঘূর্ণির ভিতরেই যেন বা তলিয়ে যাওয়ার মতো একটা অনুভূতি হচ্ছিল। ঘন ও বধির করে দেওয়ার মতো একটা কিছু যেন তাঁর কানের ভিতরে ঢুকে আসতে চাইছিল। গলাটাকে চেপে ধরছিল। তাঁর পায়ের তলাকার মাটিটুকুও কেঁপে কেঁপে উঠছিল, সরে যাচ্ছিল। তাঁর পা’দুটো ভাঁজ হয়ে এল, শরীর কেঁপে উঠল যন্ত্রণায়, সমস্ত দেহটা ভারী হয়ে আসতে লাগল, দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করল। কিন্তু তাঁর চোখের দ্যুতিটুকু তখনও নেভেনি। চারপাশে তাকিয়ে যারা মাদামকে মারছিল, তারা দেখল পার্শ্ববর্তী আরও অনেকেরই চোখে যেন বা সেই দ্যুতিটাকে দেখা যাচ্ছে, উজ্জ্বল অপলক সেই আগুন – যে আগুনকে তিনি এতকাল ধরে চেনেন।
তাঁকে একটা দরজার ভিতরে কোথাও ঠেলে দেওয়া হলো। তিনি শেষ একঝটকাতে সশস্ত্র সৈনিকদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার হাতলটা ধরে দাঁড়ালেন,
‘তোমরা সত্যকে কোনওদিন রক্তস্রোতের সমুদ্রে ডুবিয়ে ফেলতে পারবে না ... তোমরা -’
এবারে তাঁর হাতের উপরে আঘাত নেমে এল।
‘তোমরা কেবলই নিজেদের উপরে আরও আরও ঘৃণার পর্বতকে নামিয়ে আনছ। বোকা তোমরা – সেই পাহাড়ের ভার তোমরা সইতে পারবে না -’
কেউ তাঁর গলাটা এইবারে পেঁচিয়ে ধরল। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। গলাটা কেমন ঘড়ঘড় করছে।
‘দুর্ভাগ্য তোমাদের, আমার দুঃখ হয় তোমাদের জন্য ...’ মাদাম কথাটা শেষ করতে পারেন না।”
এর মধ্যে দিয়েই তো আমরা প্রত্যেক মৃত্যুঞ্জয়ী নারীযোদ্ধাকে, সহনাগরিক প্রত্যেক নারীকে কুর্নিশ জানাই। ৮ই মার্চ কেবল একটা তারিখ নয়, এই তারিখ নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করার দিন। একের পাশাপাশি অন্যের পরিসর সম্পর্কে সচেতন হবার দিন। অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। এই তারিখটা তাই যে কোনওদিনই হতে পারত। অথবা আমাদেরও তাই প্রত্যেক দিনেই নারী দিবসের উদযাপন।
সূত্রঃ
১। ‘এ রুম অব ওয়ানস ওন’, ভার্জিনিয়া উলফ, হোগর্যাথ প্রেস, ইংল্যাণ্ড, সেপ্টেম্বর, ১৯২৯
২। ‘সুলতানার স্বপ্ন’, রোকেয়া, প্রথম ‘চরাচর’ প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০১৮
৩। ‘দ্য মাদার’, ম্যাক্সিম গোর্কি, প্রথম ইংরেজি সংস্করণ - ডি এ্যাপলটন এ্যাণ্ড কোম্পানি, ১৯০৬
0 Comments
Post Comment