বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতাঃ

  • 22 April, 2024
  • 1 Comment(s)
  • 909 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
নারীর কষ্টকে আমরা ‘যাপন’ করি না, ‘রোমন্থন’ করি – উত্তেজিত হই, দু-চার কলম সাহিত্য লিখতে চেষ্টা করি, কিন্তু সংগ্রামের অন্তিম ফলটিকে অনেক সময়েই উদ্‌যাপন করি না। তাই বোধহয় নারী বৈজ্ঞানিক বলতে মারি কুরি অথবা অধুনা ভ্যাকসিন গবেষণার কারণে পরিচিত নাম সারা গিলবার্ট অবধিই আমাদের দৌড়। আমাদের এই সম্মিলিত অজ্ঞতা নিরসনের জন্য এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে নারীস্বত্ব.কম -এর আঙিনায় আমার কলমে ফুটে উঠবে বিজ্ঞানচর্চায় বিভিন্ন নারীর অবদানের কথা। (পর্ব ১)

“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি ... ?” সত্যিই তো তাই। অকূল পারাবারের সাঁতারু হয়ে আমরা কেবল ভেসে বেড়াতে চেষ্টা করেছি। মধ্যে মধ্যে একেকটা নুড়িপাথর, একেকটা মণিমুক্তো-সোনাদানার বিচিত্র সংবাদ। এখানে আকাশ নীল – সবখানেই ...

 

‘আকাশ’ আমার সবচেয়ে প্রিয় শব্দগুলির মধ্যে একটি। অর্ধেক আকাশ। এই শব্দবন্ধটির প্রতি আমার ঘোরতর আপত্তি রয়েছে। আকাশ অর্থে উদারতা, উন্মুক্তের প্রতীক। সেই আকাশকে কখনও খণ্ডন করা চলে না – আনন্দকে খণ্ডন করা চলে না – উদারতাকে খণ্ডন করা চলে না – স্বাধীনতাকে খণ্ডন করা চলে না। যা কিছু খণ্ডিত, তাই-ই অসম্পূর্ণ। নারীর পরিচয়ে ‘অর্ধেক আকাশ’ বলাটাকে তাই আমি অন্যায় বলে মনে করি। স্বাধীনতা যেমন সকলের, আকাশও তাই।

 

আমরা যখন কাউকে আশীর্বাদ করি, আমরা বলি “বিজয়ী হও।” কিন্তু মেয়েদের কথা, সাব-অলটার্নদের কথা, দলিত আদিবাসীদের কথা বলতে গেলেই আমরা কেমন যেন একটা দুঃখবাদী ভাবমূর্তি নিয়ে চলতে পছন্দ করি। দুম করে ‘সাব-অলটার্ন’ বলে ফেললাম, প্রান্তিক বললেও চলত – কিন্তু “সহজ কথা যায় না বলা সহজে”, আর বললেও বিখ্যাত না হলে পরে কারোর সহজ কথায় আজকাল আর কেউ পাত্তা দিতে চায় না। কাজেই, দু-চারকথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে হয়। একইরকম ভাবে, “বাঙালির অতি প্রিয় শব্দ, এই স্ট্রাগল ...” ‘আগন্তুক’-এর এই কালজয়ী সংলাপকে মনে রেখেই বলতে চাই, আমরা প্রান্তিকদের - (সে নারী, পুরুষ, দলিত, আদিবাসী যাই হোক না কেন) তাঁদের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে একেক সময়ে কেবল তাঁদের দুঃখ-কষ্ট-অপমান-যাতনার বারোমাস্যা নিয়েই আটকে থাকি। অথচ তাঁদের কষ্টকে আমরা ‘যাপন’ করি না, ‘রোমন্থন’ করি – উত্তেজিত হই, দু-চার কলম সাহিত্য লিখতে চেষ্টা করি। সংগ্রামের অন্তিম ফলটিকে অনেক সময়েই উদ্‌যাপন করি না। তাই বোধহয় নারী বৈজ্ঞানিক বলতে মারি কুরি অথবা অধুনা ভ্যাকসিন গবেষণার কারণে পরিচিত নাম সারা গিলবার্ট অবধিই আমাদের দৌড়। নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে আমাদের জ্ঞান সীমিত। ‘বিজয়িনী’দের কথা কি কেবল তাঁদের ‘স্ট্রাগল’-এই সীমাবদ্ধ থাকবে ?

 

অনেক কথা বলে ফেললাম। এখন মনে হচ্ছে, আমি ইতিহাসবিদও নই – সেই অর্থে বিজ্ঞানীও নই। আমি কেবল সাদামাটা একজন প্রযুক্তি-গবেষক। এই যে সুদূরের যাত্রাপথ – যার সূচনা হয়তো সেই উপনিষদের সময়ে, অথবা প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ায় – কিংবা হয়তো মধ্যযুগের ইতালিতে, অথবা আমাদের বাংলাদেশের কোনো অগোছাল পল্লিগৃহের নিভৃতছায়ের অবকাশে, তার কতটুকুকে আমি লিপিবদ্ধ করতে পারব ? আর যদি পারিও-বা, সে লেখায় ইতিহাস, আবিষ্কার, সাহিত্য, বিজ্ঞান সমস্ত কিছুকে মেলাবার প্রক্রিয়াতে, শেষমেশ সমস্তটাকেই পিণ্ড পাকিয়ে তুলব না তো ? আরও একটা প্রশ্ন আসতে পারে, প্রযুক্তি-গবেষক হয়েও নিজেকে ‘বিজ্ঞানী’ বলে জাহির করছি না কেন, একি কেবলই আমার বদান্যতা ? এই প্রশ্নেরও একটা ফয়সালা হওয়া প্রয়োজন। কারণ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির মধ্যে যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে সেটিকে ভালো ভাবে হৃদয়ঙ্গম করা দরকার। এই ২০২০-তে দাঁড়িয়ে তো বটেই। ‘বিজ্ঞান’ অর্থে বিশেষ জ্ঞান, বা বিশেষ রূপে অধীত ও অর্জিত জ্ঞান – যার প্রয়োগ আমরা দেখি প্রযুক্তিতে। এই অর্থে, বিজ্ঞানই হল প্রথম বা মৌলিক – যার থেকে আসবে প্রযুক্তি। এ কথাকে কেন স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলাম ? কারণ, আজকাল প্রযুক্তির রমরমাতে প্রাকৃতিক বা মৌলিক বিজ্ঞানচর্চায় রীতিমতো সমস্যা দেখা দিয়েছে। ন্যাচারাল সায়েন্স বা বেসিক সায়েন্সের গবেষণায় আজকাল সরকারি বা বেসরকারি অর্থ জোগাড় করাটাই এখন ক্রমশ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। কারণ ন্যাচারাল সায়েন্স বা বেসিক সায়েন্স আমাদেরকে ‘ফিনিশড প্রোডাক্ট’ দেয় না, দিতে পারে না। প্রযুক্তির জাঁতাকলে এখন ফিনিশড প্রোডাক্টের যে সর্বগ্রাসী একনায়কতন্ত্র দিকে দিগন্তে রাজত্ব বসিয়েছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবটিকে আমরা টের পেতে পেরেছি অতিমারীর ভ্যাকসিন গবেষণায়। ৫জি প্রযুক্তির একটি মোবাইল ফোন বানাতে যত সংখ্যক সংস্থা উদ্যোগী হয়ে আর্থিক সাহায্যের ঝুলি নিয়ে ‘রিসার্চার’দের আনবেন, জটিল কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবের জীবনরহস্য বোঝবার গবেষণায় – সেই সংখ্যার শতাংশের একাংশের কাছেও বিজ্ঞানীরা পৌঁছতে পারবেন না। কারণ, অণুজীবেরা ‘ফিনিশড প্রোডাক্ট’ নয়।

 

মেয়েদের বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে কথা হচ্ছিল বোধহয়। মেয়েদের বিজ্ঞানচর্চার বিষয়েও আমরা হয়তো অনেকটা একইরকমে উদাসীন। আমরা মেয়ে বলতেই কেবল লালিত্য বুঝি, শিল্প বুঝি, সৌন্দর্য বুঝি। আজকের প্রজন্মের কজন ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভার বিষয়ে অবগত ? কজন জানি আমরা, যে কবি বায়রনের কন্যা কাউন্টেস লাভলেস আধুনিক কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের বিষয়ে অত্যন্ত মৌলিক এবং মূলগত একাধিক ধারণার উদ্ভাবক ?

 

যুগে যুগে নারীকে অবদমিত করা হয়েছে। এ কেবল কথার কথা নয়। খুব শিগগিরিই এই রচনামালার আগামী কোনো একটি কিস্তিতে একেবারে ইতিহাস তুলে ধরে সেই দমনের প্রত্যক্ষ উদাহরণ প্রমাণসহ আপনাদের সকলের কাছে পেশ করব। কিন্তু, নারীর ইতিহাস তো কেবল সেই দমনেই শেষ হয়ে যায়নি। নারীর ইতিহাস উজ্জ্বল হয়ে আছে তার উৎকর্ষে। কেবল রূপে নয়, লালিত্যে নয়, মায়াতে নয়, সুন্দরে নয় – তার অঙ্কবুদ্ধিতে, তার  বিজ্ঞানচর্চাতে, তার ব্যবহারিক উদ্‌যাপনে। কোপারনিকাস বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। পণ্ডিত অ্যারিস্টটল, খ্যাতিমান টলেমির বক্তব্যকে খণ্ডন করে তিনি তাঁর বক্তব্যকে তুলে ধরেছিলেন। ইতালীয় দার্শনিক ও গণিতবিদ জ্যর্দানো ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, কোপারনিকাসের মতকে প্রচার করবার অপরাধে। এতদসত্ত্বেও, সূর্যের গতিপথকে বিভ্রান্ত করা যায়নি। সূর্য-সত্যই শেষমেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্রুনোর আত্মদান, সেই সত্যকে আলোকিত করে। আগুনের যন্ত্রণার অন্ধকারকে ছাপিয়ে, সেই সত্যের বিচ্ছুরণ। নারীর ইতিহাসও তেমন।

 

যুগ যুগ ধরে দমন, পীড়ন, অবনমনকে উপেক্ষা করে সত্যের জয়তিলক। সে তিলক দেরিতে এসেছে, সে তিলক তাচ্ছিল্যের মোড়কে এসেছে – তবু সে সত্য। তাঁদের সে সৃষ্টি সত্য। মানুষের উচিত কেবল সত্যকে সন্ধান করা। অন্ধকারে, শীতে, বর্ষাতে – সত্যের অন্বেষণ।

 

ইউনেস্কোর রিপোর্ট অনুযায়ী আজ সারা পৃথিবীর মোট গবেষক সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মহিলা। বলিভিয়ার মতো দেশে মহিলা গবেষকের সংখ্যা ১০০জনে ৬৩জন, যেখানে আধুনিক ফ্রান্সেও সংখ্যাটা ২৬%। সুইডেনে স্নাতকস্তরে মহিলা ছাত্রের সংখ্যা প্রায় ৬০%, মহিলা পিএইচডি গবেষকের সংখ্যা ৪৯%। ওই দেশে পিএইচডির পরেও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এমন মহিলার সংখ্যা মোট গবেষকসংখ্যার ৩৬%। ভারত সরকারের অধীনস্থ সিএসআইআর-এর গবেষণাগারগুলিতে মহিলা গবেষকদের সংখ্যা এখন প্রায় ১৬%। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের গবেষণাগারগুলিতে কর্মরত মহিলা গবেষকের সংখ্যা প্রায় ২০%। আজ এদেশের বায়োটেকনোলজি এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের একাধিক গবেষণা সংস্থায় মোট গবেষক সংখ্যার অন্তত ৩০%ই মহিলা। কাজেই, পথ দুরূহ হলেও – সে পথের একাকিত্ব ঘুচেছে। নারী আজ আর একাকিনী নয়। অবলা নয়। নিপীড়িতা নয়। তাঁর উপলব্ধির ইতিহাস আছে, আবিষ্কারের ইতিহাস আছে, প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আছে।

 

একটি একটি করে সেই অজানার ইতিহাসকে খুঁজে বের করি চলুন। কালোত্তীর্ণ সেই ইতিহাসকে খুঁজে পেতে গিয়ে পিছিয়ে যাই কয়েকশো বছর, অথবা কয়েক হাজার। যাজ্ঞবল্ক্য কেমন করে গার্গীকে নিরস্ত করতে চেয়েছিলেন, কী করেই বা নিজের নারীত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অ্যাগনোদিস ? রুফাইদা-আল-আসলামিয়ারই বা অবদান কোথায় ? একেকটা করে দুয়ার খুলে যাচ্ছে। একেকটা করে অন্ধকার। ফরাসিতে উভ্‌রির অর্থে খোলা, দেকুভ্‌রির অর্থে আবিষ্কার (ডিসকভারির তর্জমা অনুসারে), তেমনই এক ফরাসিনি ভদ্রমহিলা এমিলি দ্যু শাঁতেলিয়র সঙ্গেই বা নিউটনের কী সম্পর্ক ? আশ্চর্য মায়াবী রাত, একেকটি জোনাকির মতো আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অর্ধাংশকে ছাপিয়ে আজ, সমস্ত আকাশটুকুতেই দীপাবলি উদ্‌যাপিত। নারীত্বের, বিজ্ঞানের, সব কিছুর।

 

সূত্রঃ ‘ভারতীয় মহিলা গবেষক’ – একটি রিপোর্ট, রোহিণী গোডবোলে এবং রামকৃষ্ণ রামস্বামী, ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক প্রকাশিত

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৭ অক্টোবর ২০২০ 

 

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক

ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট

1 Comments

Kaushiki Som

19 October, 2020

Osadharon lekha

Post Comment