- 20 August, 2020
- 0 Comment(s)
- 1025 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
দুলালি! ও দুলালি? কানের মাথা খেয়েছিস? ডেকে ডেকে গলা যে শুকিয়ে গেল? খ্যান খ্যান করে ওঠে আসমা।
কি বলচো বল? চৌকাঠে এসে দাঁড়ায় দুলালি।
তোর মা ভাত চাপিয়েচে?
না।
না? এতমুড়ি বেলা হল এখনও ভাত চাপায় নাইকো? কি করচে লবাবের বেটি? দুটো মুড়ি দে তাইলে চুষি ত্যাতোক্ষণ?
মা! দাদী মুড়ি চাইছে?
কোটোয় আছে দে। আমেনা বলে।
কোটোয় মুড়ি নাইকো? কাল দাদী খেয়ে লিয়েছে?
ভাল।
কুতায় গেলি লো? দুটি মুড়ি দিতে কতক্ষণ লাগে? দুলালি! ওলো ও দুলালি? বিরামহীন ডেকে চলে আসমা খাতুন।
চিল্লাও ক্যানে? ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রাগতস্বরে বলে আমেনা।
চিল্লাচ্চি কি সাদে? কাল হনে প্যাটে দানা নাইকো? খালি প্যাট মোচোড় মারচে! আর যে পারিনাকো? এই দ্যাক! পেটের ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিয়ে তুবড়ে যাওয়া পেটখানা দেখিয়ে বলে আসমা খাতুন।
কি করবো বল? লকডাউনের জন্য তোমার ছেলে ক্যারালায় আটকে রয়েচে। ওখানে তারও কাজ নাই। এখানে আমারো কাজ নাই। হাতে যা ছিল তা দিয়ে এই কটা দিন চলল। এবার কি করে চলবে আল্লা জানে। কথাগুলো শাশুড়িকে নয়, নিজেকেই যেন শোনায় আমেনা।
লোগ্ডাউনি? সিটো আবার কি? কুনো পরব লিকিনি? ভ্রু কুঁচকে শুধোয় আসমা খাতুন।
পরবই বটে? শাশুড়ির কথায় হাসি পায় আমেনার।
পরব লয়কো দাদী? লোকডাউনিতে সব্বারি কাজ চলে যায়। তাই চাল কেনা হয় না। আর ভাত রাঁদাও হয় না। বিজ্ঞের মত লকডাউনের অর্থ দাদীকে বোঝায় সাত বছরের দুলালি।
অমন লোগ্ডাউনির মুয়ে ঝ্যাঁটা মারো? বুকে সাত মন মাটি চাপিয়ে কবরে সাঁদ করিয়ে দাও। চাল কিনা হবে না, ভাত রাঁদা হবে না, তবে কি খাবো লো? লোগ্ডাউনি চুষে খাবো? মর মর! ত্যাকে কালে খাক। সাপে খাক।
চুপ! সারাদিন খালি বকর বকর? ধমকের সুরে বলে আমেনা।
ছেলের বৌয়ের কাছে ধমক খেয়ে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে আসমা খাতুন। তারপর আবার গলা চড়িয়ে দুলালিকে ডাকাডাকি করতে থাকে। যতক্ষণ না ভাত খাবে ততক্ষণ ডাকাডাকি থামবে না। আমেনা ভাত চাপায়। দুলালি এসে মায়ের কাছ ঘেঁষে বসে। মাকে সে এভাবে পায়না বড় একটা।
ভোরের আলো ফুটি ফুটি করার আগেই আমেনা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। তার ঘর থেকে স্টেশন পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের রাস্তা। তারপর ট্রেনে চেপে হাসনাবাদ। সেখানে একটা চিংড়ির ভেড়িতে মাছ ছাড়ানোর কাজ করে আমেনা। সারাদিন চিংড়িমাছের ধড় থেকে মাথা, লেজ আলাদা করতে হয় তাদের। তারপর সেই মাছ বাক্সবন্দী হয়ে চালান হয়ে যায়। প্রথম প্রথম একাজ করতে বড় কষ্ট হত আমেনার। হাতে ব্যথা করত। নোনাপানিতে ভিজে হাত এমনিতেই নরম হয়ে যায়। তার ওপর চিংড়ির দাঁড়ার খোঁচা। এখন সব সয়ে গেছে। তবে ইদানিং একটা ব্যাপার নিয়ে আমেনা চিন্তায় আছে। শফিক বলে ছেলেটি বড় জ্বালাতন করছে। আমেনার আশেপাশে ঘুর ঘুর করে। মাল দেওয়া নেওয়ার অছিলায় হাত চেপে ধরে, গায়ে গা ঠেকায়। কাজ চলে যাবার ভয়ে আমেনা সব বুঝেও কিছু বলতে পারছে না। ম্যানেজারের সাথে শফিকের খুব দহরম মহরম। কাজটা চলে গেলে না খেয়ে মরতে হবে। একদিন বেকায়দায় একটা চিংড়ির খোঁচায় আমেনার আঙ্গুল রক্তারক্তি। হঠাৎ শফিক এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ‘দেখি দেখি’ করে আমেনার আঙ্গুলটা সোজা মুখে পুরে চুষতে শুরু করে দেয়। অপ্রস্তুত আমেনা শফিককে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সেদিন নিজেকে সামলে নিয়েছিল। শফিকের ব্যাপারটা বাদ দিলে কাজটায় রোজগারপাতি ভালোই। লকডাউনের জন্য সব বন্ধ। আবার কবে কাজে যেতে পারবে কে জানে?
রাত কত হবে কে জানে? খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমেনার। কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করে আমেনা—কোথা থেকে আসছে শব্দটা? চৌকির তলা থেকে? মেয়েটা ফাঁক দিয়ে পড়ে যায়নি তো? নাহ! বিছানা হাতড়ে ঘুমন্ত মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হয় আমেনা। ইঁদুর হবে হয়তো, হাঁড়ি হাতড়াচ্ছে। ইঁদুরের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে হাসি পায় আমেনার। হঠাৎ হুড়মুড় করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে অন্য ভাবনা এসে পড়ে। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে চৌকির তলায় উঁকি মেরে আমেনা হতবাক। তার শাশুড়ি চৌকির তলায় আড়েকাটে আটকে গিয়ে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করছে।
মরতে উখেনে ঢুকেছ ক্যানে?
আমাকে আগে বার কর তাবাদে বলব। কোঁকাতে কোঁকাতে বলে আসমা খাতুন।
অনেক কসরত করে শাশুড়িকে চৌকির তলা থেকে বার করে আমেনা। জিজ্ঞেস করলে সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘খুব ভোক লেগেইলো, নিদ আসছেলোনাকো। ভাবনু, চৌকির নামোয় হাড়িগুনোয় দেকি, যেদি মুড়ি-মুড়কি কিচু পাই, তাই-----!’
ভাবনার বলিহারি যাই। কি ভেবেছ? তোমাকে খেতে না দিয়ে চৌকির নামোয় সব লুকিয়ে রেখেছি? তাই রাত দুপুরে সেখেনে ঢুকে বসে আছ? আর কত জ্বালাবে? ওই দুধের বাছাকে কম দিয়ে তোমার পেট ভরাই, তবু তোমার খাই খাই ঘোচে না?
ম্যালা বকিস নাকো! দিনে ক বার খেতে দিস? ভাত চেয়ে চেয়ে গলা শুকিয়ে গেলেও ভাত চড়াস না। আবার কতা বলচে? গজ গজ করতে থাকে আসমা খাতুন।
আমেনা জানে তার শাশুড়ির বকবকানি আর থামবে না। সে চোখ বুজে চুপ করে শুয়ে থাকে। হাতে যা টাকা-পয়সা ছিল সব শেষ। রেশনে মাঝে-মধ্যে চাল, গম দেয়। কিন্তু তা দিয়ে আর কদিন চলে? দোকানে ধারে জিনিস দিতে চায় না। এখন কি ফ্যাসাদেই না পড়েছে আমেনা। রাত পোহালেই আবার একটা দিনের শুরু, আবার খাবার চিন্তা। রাত না পোহালেই বুঝি ভাল। কিন্তু নিয়ম মাফিক রাত শেষ হয়ে ভোর হয়। মসজিদে ফজরের আজান শুরু হল। আমেনার বাড়ির কাছেই মসজিদ। আজান হলেই গম গম করে ওঠে। ইদানিং লকডাউনের কারণে চার- পাঁচ জনের বেশি মুসুল্লি হয় না। কী ভেবে মসজিদের গেটের কোনায় নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকল আমেনা। নামাজ শেষ করে মুসুল্লিরা বেরিয়ে গেল। মকবুল সাহেব অনেক দোয়া-দরুদ পড়ে শেষে বেরোবেন। মকবুল সাহেব নিঃসন্তান, কিছুদিন হল স্ত্রীও গত হয়েছেন। এখন বেশিরভাগ সময় তিনি মসজিদেই কাটান। কিছুদিন আগে আমেনাকে রান্নার কাজের জন্য ডেকেছিলেন। আমেনা রাজি হয়নি। মকবুল সাহেব কেমন ভাবে যেন তাকায় আমেনার দিকে, ভাল ঠেকেনা আমেনার।
কী ব্যাপার? তুমি এখেনে? মসজিদ থেকে বেরিয়ে আমেনাকে দেখে অবাক হয় মকবুল সাহেব।
হ্যাঁ, ওই একটু পানিপড়া --, মেয়েটার জন্য ---! পেটের ব্যাতায় --, তোতলাতে থাকে আমেনা।
পানিপড়া নিতে গেলে তো আমার বাড়িতে যেতে হবে। দোয়া-দরুদের বই-পত্তর সব তো বাড়িতে। রহম তো ক্যারালায় আটক পড়েচে। তা তোমার চলছে কীভাবে?
ওই কুনোমতে ---।
তোমাকে যে কাজের কথাটা বলেছিলাম সেটা আর একবার ভেবে দেখতে পার।
এখন কে রাঁদচে? মিনমিন করে বলে আমেনা।
কে আর রাঁধবে? নিজেই হাত পুড়িয়ে---। তুমি যদি রাজি থাক তা হলে হাতে চাঁদ পাই। টাকাপয়সা যখন যা দরকার পাবে, অসুবিদে হবে না।
ভেবে দেকি!
আর কত ভাববে আমেনাবিবি? তোমার টাকার দরকার। আমার যত্ন-আত্তির দরকার। দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেল।
মকবুল সাহেবের অনেক দিনের লোভ আমেনার ওপর। আমেনা পাত্তা দেয়নি। আজ শিকার নিজে এসে ধরা দিয়েছে। শ্বাপদের মত দু চোখ চক চক করে ওঠে মকবুল সাহেবের। আমেনা মাটির দিকে তাকিয়েও সেই দৃষ্টির আঁচ পায়। গনগনে সেই দৃষ্টির আওতার মধ্যে আমেনা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। সরে পালায় না। আগের মত খরখরিয়ে উঠতেও পারে না।
এস তাহলে, আমি এগোই।
কিছুসময় একভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর, মকবুল সাহেবের সাথে খানিকটা দুরত্ব রেখে আমেনা হাঁটতে শুরু করে।
ছবি: প্রতীকী
লেখক: ছোটগল্পকার
0 Comments
Post Comment