ভয়

  • 06 May, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 743 view(s)
  • লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
বাড়ির পুরুষ অভিভাবক যদি বাড়ির অন্য সদস্যদের—সে বড় কিংবা ছোট হোক—প্রতিনিয়ত তাদের উপর দমন-পীড়ন চালাতে থাকে, তাহলে সেখানে কোনও শান্তি থাকতে পারে না। ভয়ের আস্তরণে গুটিয়ে থাকে গোটা বাড়ি। ভেঙে পড়ে মানসিক স্বাস্থ্য। দুর্বিষহ হয়ে ওঠে বেঁচে থাকা। এই গল্পে ধরা পড়েছে সেই ভয়ের চিত্র।

ছোট্ট একটা ভাড়া করা ফ্ল্যাটে গাদাগাদি করে থাকে তারা। শীলা-নীলা আর তাদের মা-বাবা। রাত্রিবেলা একটি ঘরে শোয় শীলা-নীলার বাবা সোমেনবাবু, অন্য ঘরে খাটে শীলা আর নীলা, আর মাটিতে বিছানা করে তাদের মা অতসী। রাতে খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে তবে শোবার ব্যবস্থা। মেঝেতেই খাওয়াদাওয়া হয় তাদের। এঁটো তোলার পর ঘর মোছা হয়। ঘর শুকোলে তবেই বিছানা পাতা। শীতকালেও এর কোন ব্যত্যয় নেই। এঘরেই শোওয়া, খাওয়া, মেয়েদের পড়াশোনা। আত্মীয়স্বজন এলে এই ঘরেই বসা। অন্য ঘরটি বাড়ির কর্তার। তিনি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ঘর ভাগ করতে চান না। মেয়েরা বড় হয়েছে, তাই অতসী স্বামীর সঙ্গে মেয়েদের সামনে এক ঘরে আর রাত্রিবাস করতে চায় না। কর্তা চান না, তাঁর অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী বা মেয়েরা তার ঘরে ঢুকুক। তার জিনিসপত্রে হাত দিক। অবশ্য সকালে বিছানা গুছিয়ে দিতে হবে মেয়েদের। দরকার মতো হাত-পা টিপে দিতে হবে। চা-টা জলটা দিয়ে আসতে হবে...

তবে সোমেনবাবুর অনুপস্থিতিতে ঘরেও ঢোকা হয়, টিভিও দেখা হয়। স্কুল থেকে ফিরে বাবার বিছানায় একটু বিশ্রাম নেয়। উঠে আবার বিছানার চাদরটা টানটান করে দেয় মেয়েরা। সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত পরপর দুটো মেগাধারাবাহিক দেখার সুযোগ ঘটে যায় সোম থেকে শুক্র। শনি-রবিবারের ব্যাপারটা অনিশ্চিত। কর্তা যদি সন্ধেবেলা বেরোয় তাহলেই। সে ভাগ্য সব দিন হয় না।

ছোট্ট একটি টিভি, তার সামনেই সবাই ঝুঁকে বসে থাকে মা আর মেয়েরা। তবে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। ব্যাস। ওইটুকু সময়ের জন্যই। সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ সোমেনবাবু বাড়ি ফেরেন। বেলের শব্দ কানে আসামাত্র তাড়াতাড়ি টিভি বন্ধ করে হুড়মুড় করে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। প্রথমে অতসী এক ছুট্টে রান্নাঘরে চলে যায় চায়ের জল বসাতে। তারপর মেয়েরা নিজেদের ঘরে গিয়ে ঢোকে। একটু দেরি হলেই উন্মত্ত সারমেয়র মতো চিৎকার করতে শুরু করবে বাড়ির কর্তা। পড়াশোনা না করে টিভি দেখার জন্য নয়। তার ঘরে ঢোকা হয়েছে বলে, টিভিতে হাত দেওয়া হয়েছে বলে। এসবে বাড়ির অন্য সবার অনধিকার। তাই সাড়ে সাতটা বাজলেই বাড়িটাকে গ্রাস করতে থাকে ভয়।

এইরকমটাই ছিল রায়বাড়ির পরিস্থিতি মাসখানেক আগে পর্যন্ত। সারা বিশ্ব জুড়ে মহামারী তার করালগ্রাস বিস্তার করছে, এই দেশ, এই শহরও রেহাই পায়নি। সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে। জরুরি পরিষেবা ছাড়া আর সবকিছু বন্ধ। অফিস-কাছারি, স্কুল-কলেজ সবেই তালা। সরকার কড়া নির্দেশ দিয়েছে বাড়ির বাইরে বেরনো চলবে না। শুধুমাত্র সকালবেলায় বাজার-দোকানের জন্য কিছুটা সময়ের জন্য ছাড়। রায়বাবু সরকারী কর্মচারী। অতএব তিনি বাড়িতেই। সকালবেলা একবার করে থলি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। অন্যসময় বাবু রিকশ ছাড়া চলেন না, পায়ে হাঁটার অভ্যাস তার নেই বললেই চলে, কিন্তু উপায় নেই, রিকশচালকেরাও এখন ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে। অগত্যা রায়বাবু  চরণবাবুর গাড়ি চড়েই চলেন বাজারের উদ্দেশ্যে। টাটকা মাছ, সব্জি কিনে নিয়ে আসেন আর ভরা থলিটা রান্নাঘরের দরজায় নামিয়ে দেন। প্রতিদিন নতুন নতুন পদ রান্নার জন্য স্ত্রীকে ফরমাশ করেন। রান্না ভাল না হলেই হুংকারে হুংকারে বাড়ি মাথায় করেন—‘মুখে রক্ত তুলে পায়ে হেঁটে বাজার করে আনি, তাও একটা রান্না যদি মুখে দেওয়া যায়! সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে আছ, রান্নাটাও মন দিয়ে করতে পার না? কোন দিকে মন তোমার? বসে বসে শুধু গিলছ আর আমি খেটে খেটে মরছি।‘

একদিন তো মাংসে একটু বেশি ঝোল হয়ে যাওয়ায় বাটিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি। সঙ্গে গগনভেদী হুংকার। মা মিনমিন করে কিছু বলতে গেল কিন্তু রায়বাবুর চিৎকারে চাপা পড়ে গেল তার গলা। সারা ঘরে দেওয়ালে ছিটিয়ে গেল মাংসের টুকরো আর ঝোল। ভয়ে সিঁটিয়ে শীলা-নীলা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসেছিল সেদিন।

এইভাবেই বন্দি জীবনের এক একটা দিন কাটছে তাদের। রায়বাবু বাজার থেকে ফেরার পর বাকি সময়টা নিজের ঘরে শুয়ে-বসে থাকেন। খবরের কাগজ পড়েন, টিভিতে খবর শোনেন। শীলা-নীলা আর তাদের মায়ের হয়েছে মুশকিল। সারাদিন তারা ওই ঘরে ঢুকতে পারে না। একদিন দুপুরে বাবা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে দেখে নীলা চুপিচুপি বাবার ঘরে ঢুকে টিভির সাউন্ডটা একদম কমিয়ে প্রিয় সিরিয়ালটা চালিয়েছিল। কিছুক্ষণ বেশ দেখার পর খেয়াল হল বাবার নড়ে চেড়ে উঠছে। বাবা ভাল করে জেগে ওঠার আগেই শীলা-নীলা টিভি বন্ধ করে এক ছুটে ছাদে। হ্যাঁ ছাদই আপাতত তাদের নিরাপদ আশ্রয়। নীল আকাশের নীচে ছাদের একটা কোণায় চুপটি করে বসে থাকে দুই বোন।

বাবাকে দেখলেই বা তার গলার আওয়াজ শুনলেই টাবলুর হাত পা কাঁপতে থাকে। টাবলুর বয়স আট বছর। তার বাবার একটা জামা কাপড়ের দোকান আছে। দিনের বেশির ভাগ সময়টাই বাবা দোকানেই থাকে। ফেরে অনেক রাতে। সকালবেলা যখন তার মা তাকে স্কুলে নিয়ে যায় তখন তার বাবা মুখ হাঁ করে নাক ডেকে ঘুমোয়। স্কুল থেকে ফিরে এলে টাবলু আর মায়ের কত গল্প— স্কুলের গল্প, বন্ধুদের গল্প। বিকেলে কখনো পাশের বাড়ির বন্ধুর সঙ্গে একটু খেলা। কখনো আবার মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে ফুচকা আইসক্রীম খেতে যায়। সন্ধেবেলা তারা একটু টিভি দেখে, পড়াশোনা করে। রাতের খাবার খেয়ে টাবলুর শুয়ে পড়ার পর তার বাবা বাড়ি ফেরে তবে বাবার ফেরাটা ঠিক টের পেয়ে যায় সে। টাবলু বোঝে বাবা প্রতিদিন মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে। বাবা ফেরা মাত্র মায়ের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলতে শুরু করে। কীসব নোংরা নোংরা, অসভ্য অসভ্য কথা বলে। কথায় কথায় ভয় দেখায়, লাথি মারব, গলা টিপে মেরে ফেলব। মা ডুকরে কেঁদে ওঠে। একদিন নিজের বেল্ট খুলে মারতে যাচ্ছিল তার মা’কে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেয়েছিল টাবলু। ভয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিল সে। সেদিনের মতো বাবা রেহাই দিয়েছিল মাকে। কিন্তু বাড়ি ফেরা মাত্র চিৎকার করাটা ঐ লোকটার রোজকার অভ্যাস। টাবলু লোকটার ধারে কাছে ঘেঁষে না। বাবা নামের ওই লোকটা তার সঙ্গে যেটুকু কথা বলে সেটুকুও বকার ঢঙে। ছুটির দিনে লোকটা বাড়ি থাকলে টাবলু মায়ের গা ঘেঁষে থাকে সারাক্ষণ। মা রান্নাঘরে থাকলে সেখানেই বই নিয়ে বসে পড়ে সে। বাবা তার সঙ্গে কথা বলতে এলে ভয়ে তার বুক ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করে। মা মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে দিদাদাদুর কাছে যায়। টাবলু ভাবে, মা ওখানেই তো থেকে যেতে পারে তাকে নিয়ে। যে লোকটা সবসময় তার মাকে বকে, মারে, সেই লোকটার সঙ্গে মা থাকে কেন?

গত কয়েক সপ্তাহ হল টাবলুর বাবা বাড়িতেই আছে। সকালেবেলা কখনো-সখনো বাজারের থলি নিয়ে বেরোয় কিন্তু বাকি দিনটা ঘরেই থাকে। একবার চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য পুলিশের ঠ্যাঙানি খেয়েছিল তারপর থেকে পারতপক্ষে বাবা আর বাড়ির বাইরে বেরোয় না। টাবলু জানে করোনা নামের এক মহামারী থাবা বসিয়েছে পৃথিবীর ওপর এবং সেই কারণে সবাইকে বাড়িতেই থাকবে হবে কিছুদিন । তার নিজের স্কুলও বন্ধ। সারাদিন বাবার বাড়ি থাকা কারণে টাবলুর রাতের ঘুম উড়ে গেছে। সবসময় তার বুক ঢিপঢিপ করে। কেমন একটা শ্বাসকষ্ট হয়। পেটটা গুলিয়ে ওঠে। বাড়িতে বসে লোকটা দিন রাত চিৎকার আর গালমন্দ করছে মাকে। দোকান বন্ধ, অতএব বিক্রিবাটাও বন্ধ, কিন্তু সব কিছুর জন্য যেন তার মা-ই দায়ী। একদিন তার বাবা তো স্পষ্ট করে বলেই দিল, তোমাদের আমি আর পিন্ডি গেলাতে পারছি না। যাও, বাপের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে এস। বাবার চিৎকার থেকে টাবলুও রেহাই পায় না। একবার খেতে বসে বাবার জলের গ্লাসটা উলটে দিয়েছিল, লোকটার ভাতভরা পাত জলে ভেসে গেছিল। এমন হুংকার দিয়ে উঠেছিল লোকটা যে টাবলু ভয়ে ছাদে পালিয়ে গিয়ে এক কোণে চুপ করে বসেছিল। আরেকদিন বাবার ছেড়ে যাওয়া হাওয়াই চটিটা পরে টাবলু বাথরুমে গেছিল। ঠিক তারপরই বাবা এসে হাজির। চটি ভিজে দেখে তুলকালাম বাধিয়ে দিল লোকটা। এমন চিৎকার করতে শুরু করল যে ঘরে টেবিলের তলায় লুকিয়ে পড়েছিল সে। অবশ্য তার মা নিজের ঘাড়েই দোষটা নিয়েছিল বলে টাবলু সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেছিল।

সন্ধেবেলা থেকেই আজকাল তার বাবার মেজাজটা যেন আরো খিঁচড়ে থাকে। টাবলু ছোট হলেও বোঝে বাবা বাইরে গিয়ে মদ খেতে পারছে না, ঘরে মদ কিনেও আনতে পারছে না, ফলে বাবার রাগ যেন আরো বেড়ে গেছে। টাবলুর খুব রাগ হয়। দুঃখ হয়, কান্না পায়। ভাবে মাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবে সে। কিন্তু এখন যে তার পালাবার পথ নেই। তার সব রাস্তা বন্ধ। তার দাদুর বাড়ি তো সেই কোন্নগর, ট্রেনে করে যেতে হয়। আর মহামারীর কারণে ট্রেনও তো সব বন্ধ। তাহলে মাকে নিয়ে কোথায় যাবে সে? কোথায় নেবে একটু শান্তির নিশ্বাস?

ছবি : প্রতীকী

লেখক  : অধ্যাপক

0 Comments

Post Comment