- 11 January, 2021
- 0 Comment(s)
- 733 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
যুদ্ধ মানুষকে মানবতার পথ দেখায়। জানি-না এই কথাতে সকলে একমত হবেন কি না, কিন্তু ইতিহাসে এমনটাই ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেপরেই বৈজ্ঞানিক জগৎ থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক জগৎ অবধি প্রতিভার স্ফুরণ দেখা গেছে। নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছে, পৃথিবী পেয়েছে কলাবৃত্তিরও নতুন ধারা, নতুনতর সমস্ত উপকরণ। আসলে, মানুষ যখনই একেবারে কোনো ধ্বংসের সামনেটায় এসে দাঁড়ায়, মানবতার বা মানবসভ্যতার চরমতম লাঞ্ছনাকে নিজদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করে, তখনই যেন তার মধ্যে এক-একটা আলোর উন্মেষ ঘটতে শুরু করে। অন্ধকারের বিপ্রতীপে আলোর সেই উষ্ণতাটিকে তখন সহজবোধ্য বলে মনে হয়। সমস্ত প্রাচীনত্বকে, সমস্ত অন্ধকারকে ছাপিয়ে মানুষের সাহস আর প্রতিভার সার্থক মেলবন্ধন ঘটে। যেমনটা ধরা যাক না কেন, ১৮৫৩ সাল থেকে ১৮৫৬ সাল অবধি চলতে থাকা ক্রিমিয়ার যুদ্ধকে। ইতিহাসে সেই যুদ্ধের গুরুত্ব ঐতিহাসিকেরা বিচার করবেন। কিন্তু মানবতার ইতিহাসেও যে এই যুদ্ধের খবর শীর্ষস্থান অধিকার করে বসে আছে। কারণ এই যুদ্ধের মাধ্যমেই পৃথিবী চিনেছিল ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে। সেবাব্রতী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, জন্ম ১৮২০, মৃত্যু ১৯১০। সেবাব্রতের জগতে এক নতুন আলোর দিশারী।
কিন্তু এই নারীদের জগতে যে, আলোর উন্মেষটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বড্ড বেশি রকমের ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ অথবা (ইচ্ছাকৃত ভাবে) ‘আবছাটে’ হয়ে প্রকাশ পায়। নারীদেরকে ইতিহাস মনে রাখে না। ইতিহাসের একটু গভীরে গেলেই নারীদের উপস্থিতিটাকে ক্রমশ লক্ষণীয় ভাবে কমে আসতে দেখা যায়। অতল ইতিহাসের গভীরে সেই এক-একজন মহীয়সীর যতটুকুও-বা সংবাদ পাওয়া যায়, তাতে তথ্যের ভার ক্রমশই লঘু থেকে লঘুতর হতে থাকে। ক্রমশ কেবল তুচ্ছ দুটি-একটি বিস্রস্ত প্রশস্তিবাক্য ছাড়া আর কোনো কিছুরই হদিস মেলে না। কাজেই, রুফাইদা আল-আসলামিয়াকে ইতিহাস ঘেঁটে যখন তুলে আনতে চেষ্টা করেছি, মনে হয়েছে যেন এই প্রতিমা অসম্পূর্ণ। হয়তো-বা আরও গবেষণা, আরও খোঁজের উচিত ছিল। হয়তো-বা আরও অনেক কিছুই ক্রমশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হবে, আমরা জানতে পারবো। এক-একটা নতুন সংবাদের পরত। এক-একটা নতুন ইতিহাস রচনার অপেক্ষা। যেখানে মানুষের ইতিহাস, লিখবে মানুষ। সম্পূর্ণ অর্থে তারা বুঝবে সম্পূর্ণটাকেই।
হিজরি সন বলতে বোঝায়, ধর্মগুরু মহম্মদ যে সময়ে মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়ে তাঁর অনুগামীদেরকে নিয়ে মদিনার উদ্দেশে গমন করেন। ঘটনাটি ঘটেছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই। সেই থেকেই হিজরি সনের গণনা শুরু। গুরু মহম্মদ মদিনা পৌছোলে প্রথম যে শিষ্যেরা সেখানে তাঁর অনুগামী হন, তাঁদের মধ্যেই বিশেষ একটি উপজাতির কন্যা ছিলেন এই রুফাইদা। তর্কাতীত ভাবে যিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন প্রথম ইসলামীয় নার্স এবং একই সঙ্গে বিচক্ষণ শল্যবিদ। যদিও, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁকে পুরুষ নেতৃত্বের অধীনে কাজ করতে হত, তবু তা সত্ত্বেও রুফাইদার নিজস্ব কৃতিত্বকে অস্বীকার করা চলে না।
রুফাইদার পরিবারের সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সম্পর্ক ছিল। তাঁর পিতা সাদ আল-আসলামি নিজে চিকিৎসক ছিলেন, এবং তাঁর হাত ধরেই চিকিৎসা ও সেবায় হাতেখড়ি হয় রুফাইদার। ক্রমশ নিয়মিতরূপে চিকিৎসা করতে করতে তিনি রোগের চিকিৎসা, সেবা এমনকি শল্যবিদ্যাতেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ইসলামীয় রীতি অনুসারে প্রাক্-ইসলাম বা এমনকি ইসলাম প্রবর্তনের সময়েও চিকিৎসা বা সেবার ক্ষেত্রে সরাসরি নারীদের অংশগ্রহণের অনেকটাই উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকি যেখানে সমসাময়িক ক্রিশ্চানেরা অসুখকে পাপী মানুষের উপরে ঈশ্বরীয় শাস্তি বলেই দেখতে চেয়েছে, বিপরীতে স্বাস্থ্য এবং দৈনন্দিন পরিচ্ছন্নতার উপরে ইসলামের গুরুত্ব দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই সব কিছুর মধ্যে রুফাইদার অস্তিত্বকে তাই ততটাও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় না। যদিও, চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ সেই সময়ে প্রায় সম্পূর্ণটাই পুরুষ কর্তৃত্বের অধীনে ছিল। তবুও, তাঁদের সেই অংশগ্রহণ কখনও তাই বলে মিথ্যা হয়ে যায় না। তাঁরা ছিলেন, এবং থাকবেন। রুফাইদার মধ্যে দিয়েই তাঁরা আজও অস্তিত্ববহন করে চলেছেন।
যেহেতু গুরু মহম্মদের জীবনের একটা বড় অংশই কেটেছে যুদ্ধক্ষেত্রে, মদিনা থেকে আবার ইসলামকে গ্রহণ করা সমস্ত উপজাতিবর্গকে এককাট্টা করে মক্কাকে পুনর্দখলের প্রচেষ্টায়, তাই যুদ্ধ ব্যাপারটা সেই সময়ে তাঁর অনুগামীদের কাছে খুব নিয়মিত একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক এই সময়েই রুফাইদার গুরুত্ব সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। মহম্মদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর চিকিৎসাদক্ষতা এমনকি, তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার বিশেষ ক্ষমতার কথাও মহম্মদের কর্ণগোচর হয়। সেইসময়ে মদিনার হাসপাতালগুলিতে পুরুষদের রোগের চিকিৎসা পুরুষেরা এবং নারীদের চিকিৎসা মূলত নারীরাই করতেন বলে উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। রুফাইদার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হয়ে, তাঁকে এবং তাঁর অধীনস্থ একটি নার্স বা সেবাকর্মী বাহিনীকে মহম্মদ সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার অনুমতি দেন। খন্দক, খাইবার সহ অজস্র যুদ্ধের ময়দানে রুফাইদার নেতৃত্বে এই গোষ্ঠী তাদের পেশাগত দক্ষতার পরিচয় দেয়। খাইবারের যুদ্ধে তাদের পরিষেবার গুরুত্বকে অনুধাবন করে গুরু মহম্মদ সেই যুদ্ধের মাধ্যমে আহৃত ধনের একাংশকে পুরস্কারস্বরূপ রুফাইদা ও তার গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেন। খন্দকের যুদ্ধে মহম্মদের অন্যতম শিষ্য ও পার্শ্বচর সাদ ইবন মুয়াধ গুরুতর ভাবে আহত হলে, মহম্মদ তাকে রুফাইদার কাছে নিয়ে যেতে বলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে শিবির অঞ্চলে দ্রুত স্থানান্তরযোগ্য চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন এবং সেগুলিকে চালানোর বিষয়ে রুফাইদার নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার কথা একাধিক উৎসে উল্লিখিত হয়েছে। সংকটের সময়ে আপৎকালীন চিকিৎসা পরিষেবা, যুদ্ধক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি ইত্যাদি বিষয়েও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়। শান্তির সময়েও, অনাথ আশ্রমসহ অন্যান্য সামাজিক কাজে রুফাইদা নিজেকে সংযুক্ত রেখেছিলেন।
ইতিহাসের মরুবালুরাশিকে ভেদ করে রুফাইদার আরও অনেক ইতিহাসকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। একাধিক গবেষণা-প্রবন্ধ, গবেষণা-গ্রন্থের পাতায় তাঁর অবদান আজ নিবন্ধিত হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব বাহরেনের অধীনস্থ রয়্যাল কলেজ অব নার্সিং, রুফাইদা আল-আসলামিয়ার নামে নার্সিংয়ের একটি বিশেষ পুরস্কার চালু করেছে। যদিও কেবল একটি পুরস্কারের ফলকের মাধ্যমে সেই মানুষটির কৃতিত্বকে কখনই সীমাবদ্ধ করতে চাইছি না, তবুও আনন্দের খবর এটাই যে আজ এতদিন পরেও রুফাইদাকে মনে পড়েছে সকলের। নারীর ইতিহাসের উপরে যে দিগবিস্তৃত কুয়াশার আচ্ছাদন, তাকে সম্পূর্ণ ভাবে অপসারিত করতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে বলেই রুফাইদাকে অথবা রুফাইদার মতো আরও অজস্র মানুষকে আজ আমরা আবিষ্কার করতে পারছি। সেবায়, শল্যচিকিৎসায়, স্বাস্থ্য-পরিকল্পনায় – ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল তো ছিলেনই, আজ একই সঙ্গে রুফাইদাও কি এই বিষয়গুলিতে বিজ্ঞান-প্রগতির অন্যতম নায়িকা নন ? ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলেরও সহস্রাব্দ আগে জন্ম যাঁর ...
সূত্রঃ
১) কে. রোসার-মিলার ও অন্যান্য, ‘হিস্টোরিকাল কালচারাল অ্যান্ড কনটেম্পোরারি ইনফ্লুয়েন্সেস অন দ্য স্টেটাস অব উইমেন ইন নার্সিং ইন সৌদি আরবিয়া’, দ্য অনলাইন জার্নাল অব ইস্যুস ইন নার্সিং, খণ্ড ১১, সংখ্যা ৩, জুলাই, ২০০৬
২) জোনাথান লিয়ন্স, ‘আর্লি ইসলামিক মেডিসিন’
৩) এন. এল-সানাবেরি, ‘উইমেন এন্ড নার্সিং প্রফেশন ইন সৌদি আরবিয়া’, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, পাকিস্তান
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক।
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট।
0 Comments
Post Comment