দুধে-আলতা রঙ : পটল চেরা চোখ -শিমের মতো নাক

  • 09 August, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 523 view(s)
  • লিখেছেন : সেখ আসাদ আলি
যদি সত্যিকার কেউ ‘র‍্যাশনাল’ হয়; কেউ যদি ‘যুক্তি’কে গুরুত্ব দেয়- তাহলে যুক্তির আধার যে ‘মানুষ’ সেই ‘মানুষকেন্দ্রিক পৃথিবীর’ নান্দনিকতায় মানুষ ‘সুন্দর’ হয়ে ওঠে- উঠতে থাকে ক্রমশ। পোশাকে, আচারে, বাক্যে, সৃষ্টিশীলতায় সে নিজেকে প্রকাশ করে এবং নিজ চেষ্টায় সুন্দর হয়ে উঠতে থাকে। ফলে প্রকাশ ভিন্ন দৃশ্যত সুন্দর অসম্ভব। আর কেউ যদি বলে সম্ভব তাহলে জানতে হবে তাতে ধাপ্পাবাজি আছে; যে ধাপ্পাবাজির কাছে বারবার এই ‘মানুষ’ নামক জীবের একটি অবলা দল অন্যের দ্বারা দলিত হয়েছে বারবার।

গল্পকার বা ঔপন্যাসিক হওয়ার জ্বালা অনেক। বেশিরভাগ সময়েই নিজের পছন্দ
মতো শব্দ লেখা যায় না; শত ইচ্ছা থাকলেও না। হয়তো কোনো কথা লিখতে মন
চাইছে না; তবুও গল্পের খাতিরে তা লিখতে হচ্ছে- এইটা যে কি, তা বলে বোঝানো খুব
মুশকিল। এটা অনেকটা জাপানি সৈন্যদের পানিশমেন্ট নেওয়ার যে ঐতিহ্যিক প্রথা-
‘হারিকিরি’ নামে পরিচিত আত্মহত্যা- তার সঙ্গে তুলনীয়! কি রকম সেই আত্মহত্যা
তা একটু বলি।


এখন একটি উপন্যাস লিখছি যা হয়তো খুব শিগগিরি প্রকাশ পাবে। সেই উপন্যাসের
এক পাত্রের এমন নারী পছন্দ- যার চোখ হবে ‘পটল চেরা’, নাক হবে ‘শিমের মতন’,
গায়ের রঙ হবে ‘ধবধবে সাদা’...। আরও অনেক চাহিদা আছে ছোকড়ার। বড় হবে বলে
সেই বর্ণনা এখানে বেশি দিচ্ছি না। আসলে এই রকম শারীরিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কোনও
মহিলার ছবিই সে মনে মনে এঁকে রেখেছে- যাকে খুঁজে পেলে সে বিয়ে করতে পারবে!
বিশ্বাস করুন এটা লিখতে একদম মন চাইছিল না; কিন্তু ওই ছোকড়ার যেহেতু পছন্দ
তা না লিখে উপায়ও নেয়; অগত্যা আমি আর কি করি! তার মনের হদিশ দেওয়ার
দায়িত্ব নিয়ে যে বসে আছি।


বিশ্বাস করুন এই ‘পটল’ নামক নিরীহ গোছের একটা সব্জির মধ্যে এমন কোনও
বিশেষত্ব আমি এখন আপাতত খুঁজে পেলাম না যার জন্য তাকে কারোর চোখের সঙ্গে
তুলনা করতে হবে। মেয়ের চোখ, ছেলের চোখ- যাই হোক না কেন; তাকে পটলের সঙ্গে
চোখের তুলনা করতে হবে! দৃশ্যত কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা আপাতত। বিশ্বাস
করুন যতবারই ভাবছি ততবারই পটলের দোরমা, মাছের ডিম দিয়ে পটল ভাজা, আলু
পটলের তরকারি মনে পড়ছে! আরও যে কতো কি- তা বলতে গেলে এই লেখা শেষ করাই
দায়। শেষে রন্ধন শিল্প নিয়ে প্রবন্ধ হয়ে যাবে।


শিমের কথা ভাবলেই কেমন যেন মনে হচ্ছে! আর কতো কি যে মনে পড়ছে! কাঠ শিম,
শিম ভাজা, কিডনি বীজ... আরও কতো কি! আচ্ছা বলুন তো, নাক কি কখনও শিমের
মতো পাতলা হলে ভালো লাগবে? মনে হয় না। শিমের এদিক থেকে ওদিকে দেখলে
পোকা দেখা যাবে না? নাকের ভিতরে পোকা? ছিঃ। আচ্ছা এও বলুন তো, এসবের সঙ্গে সুন্দরের কোনও সম্পর্ক দূর দূর তক আছে? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।
এরপর থেকে ভাবছি শিম খেলে শিকনিও মনে পড়বে। ছিঃ। আর কথা বাড়িয়ে কাজ নেই।


এখন ভাবছি তাহলে এইসব কথাগুলো এলো কোত্থেকে? সুন্দরের কথা যখন এলো
তখন কালিদাসের কথা মনে আসছে। কালিদাস নাকের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন
‘তিল ফুলের মতো’! বিশ্বাস করুন তিল ফুলের সঙ্গেও নাকের কোনও মিল পাচ্ছি না আমি। যদিও দুটোই তেল নামক পদার্থকে মনে করায়- তিল থেকে তেল হয়, আর
নাক থেকও তেল বেরোয়। এটা মনে করেও গা ঘিনঘিন করছে যে! আবার এটাও মনে
পড়ছে, আগেকার লোকে বর্ষা পড়লে তিলের তেলের লুচি খেত। ভাবুন তো, নাকের
তেলের লুচি কেমন হবে! ছ্যাঃ।


তাহলে কথাটা এলো কি ভাবে! অবাক কাণ্ড! যাক এবারে একটা সূত্র পাচ্ছি মনে
হচ্ছে। মনে করার চেষ্টা করুন- আম বাঙালি যা কিছুই খায়, সবই বলে, ‘খুব মিষ্টি
হয়েছে’; টিকি গরম ঝাল মাছের ঝোল খেলেও বলে ‘মিষ্টি হয়েছে’! আমার আব্বা
যেমন ফ্যাসফ্যেসে পানসে ‘ফুটি’ নামক ফল খেলেও বলে, ‘চিনির মতো মিষ্টি’।
আমার ছেলে অবশ্য বলে, ‘ফুটি তো ভেজিটেবল; ওটা আবার ফল নাকি- বাজে খেতে।
ছিঃ।’ আসলে আমি তো ইতিহাসের ছাত্র, সেজন্য বুঝি বাঙালি দীর্ঘদিন চিনি বা
মিছরির স্বাদ পায়নি; স্বাদ পেয়েছে অনেক পরে- চিনি চিন থেকে আর মিছরি/মিস্রি
মিশর থেকে আমদানি হবার ফলে। এমনিতেই খুব দামী ছিল- যার জন্য কদর এত।
যেমন দেখেন না যা কিছু পছন্দ হয় সবই, ‘সোনা আমার’, ‘সাতরাজার ধন হিরে-
মানিক আমার’! আবার যা লেটে আসে তার কদর আকাশ ছোঁয়া; যা থেকে আকাশ
কুসুম কল্পনা হতে বাধা কি!


আসলে পটল আর শিম ব্যাপারটাও এই রকম ব্যাপার। পটল খেতে বাঙালি খুব
বেশিদিন শেখেনি। ফলে খুব আদরের আর কদরের। সেইজন্য আদরের বৌমা এবং
কন্যার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে তার চোখ কেমন তা বোঝাতে হাতের কাছের আদরের
পটলের কথাই মনে পড়েছে গৃহিণীদের! আর এ-তো জানা যে গৃহিণী যা বলে তা গৃহস্থ
মানতে বাধ্য; কিচেন পলিটিক্স বলে একটা ব্যাপার আছে না? (এই ‘কিচেন
পলিটিক্স’ ব্যাপারটাকে খারাপ ভাবে নেবেন না প্লিজ। আমি সদর্থক অর্থেই
লিখলাম।) কাজেই গৃহস্থও আগুপিছু না ভেবে ‘পটলের মতন চোখওলা মেয়ে’ খুঁজতে
লেগেছে- ঘটককেও দায়িত্ব দিয়েছে খুঁজতে। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ধীরে ধীরে
সেসব মেয়েলি ব্যাপার ছেল- ছোকরাকেও গ্রাস করেছে। বেচারা ছোকরা জানে না যে,
ব্যাপারটা ‘মেয়েলি’; যদি জানতো যে এটার এরকম ব্যাপার তাহলে ঋতুপর্ণ ঘোষ
হবার ভয়ে আগে-ভাগেই সটকে পড়ত ঠিক।

 

সোসিও-লিঙ্গুইস্টিকস বলে একটা বিষয় আছে- যা থেকে আমরা জানতে পারি,
গড়পড়তা বাঙালি মেয়েরা যেহেতু বাইরে খুব একটা বেরোত না, ফলে তারা খুব বেশি
কিছু চোখে দেখার সুযোগ পেতো না। ফলে যা কিছু তারা বর্ণনা করতো তার তুলনা
হিসেবে হাতের কাছের যেসব আটপৌরে জিনিস থাকত তার সঙ্গেই তুলনা করত।
যেমন ‘মেয়েটা লঙ্কার মতো ঝাঁজালো’, ‘মেয়েটার দুধে-আলতা রঙ’, ‘কি মদুময়
কতা’/ ‘কতার ধার বঁটির মতন’...। সুকুমার সেনে এসবের সমর্থন মেলে! যাইহোক,
এভাবেই হয়তো শিমের মতন নাক এসেছে। আসলে তখনকার দিনে খুব কম বয়সে
মেয়েদের বিয়ে হত- চার, পাঁচ, কি ছয় বড়জোর! নয় বছর পেরিয়ে গেলে আর বিয়ে
হওয়া মুশকিলের ব্যাপার! ফলে সেই ছোট্ট মেয়ের কান-নাক ফুঁড়তে হত শ্বশুর
বাড়িতে। নাকের পেটি পাতলা হলে নাক ফোঁড়া সহজ হয়- সেই পাতলা যদি কাঙ্ক্ষিত
শিমের মতো হয় তাহলে তো খুব ভালো। বিজ্ঞাপনের ঢঙে প্রতিবেশীকে বলা হল,
‘আমার বউয়ের নাক যেন শিমের মতন’; অর্থাৎ খুব কম বয়েস- মোটে চার বছর।
আর নাকের পেটি মোটা মানে মেয়ের বয়েস নয়ের অধিক; শিমের মতো নয়। নয় বছরের
ধাড়ি মেয়ে একটা! ছ্যাঃ।


এখন ভাবছি, তখন নাহয় পার্মানেন্ট নাক ফোঁড়ার ব্যাপার ছিল বলে শিমের মতো
নাক লাগত; এখনও লাগবে কি জন্য? নাক-ছাবি লাগাবে তো চিমটি আঁটা। আর বিয়েও
তো করো অন্ততপক্ষে মেয়ে চাকরি পেলে। তাহলে এখন আবার শিমের মতো নাক
নিয়ে করবে কি! হিসেব করে বিয়ে করতে পারছো আর এদিকে হিসেব নেই- ওই বয়সের
মেয়ের নাক শিমের মতন পাতলা হবে কি করে!


এবারে আসি ‘গোরো ধবধবে সাদা রঙে’। এই কথাটিও এসেছে হেঁসেলবন্দী গৃহিণীদের
হেঁসেল থেকে। এমিনিতেই স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা থেকে আসা নর্ডিক কূলের লোকদের
‘গৌড় কান্তির’ ধারনা তো ছিলই। আরও ছিল ‘কৃষ্ণত্বচ’দের অবমাননার আনুষঙ্গ।
ঋষি বঙ্কিম তাঁর ‘লিখিত সিরিয়ালগুলিকে’ হেঁশেলে হেঁশেলে ঢুকিয়ে দিলেন; যার ফলে
যতসব গৌড়কান্ত, হেমকান্ত, উন্নত-নাসা, প্রশস্তললাট নায়কদের প্রাদুর্ভাব
হল। হেঁসেলবন্দী মহিলারা বাইরেটা দেখল বঙ্কিমের বঙ্গদর্শনের লিখিত সিরিয়ালে!
কর্তারা এমনিতেই সোনা দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছিল; সোনা তো ছিলই জান-পসন্দ। এর
সঙ্গে হেঁসেলের দুধ আর আলতাকে মিশিয়ে তার ফেমিনাইন রূপ গড়তে কতক্ষণ?
গড়ে নিল মনগড়া তাড়াহুড়োয়। সেইসব জিনিস এখনও চলছে তো চলছেই! ফলে কোনও
বিচারের তোয়াক্কা না করেই ছোকরার দল বলছে, ‘এমন নারী আমার পছন্দ যার
চোখ হবে ‘পটল চেরা’, নাক হবে ‘শিমের মতন’, গায়ের রঙ হবে ‘ধবধবে সাদা’...
এদিকে আমরা যারা কথাসাহিত্য লিখছি, তারা বাধ্য হয়েই শিল্পের খাতিরে, কখনও শিল্পের দোহায় দিয়ে, কখনও-বা সমাজবাস্তবতার চিত্র আঁকতে গিয়ে সেসব লিখতে
বাধ্য হচ্ছি- শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও।

 

তবে চেষ্টা যে করি না তা নয়; এই যেমন আমার ক’মাস আগে প্রকাশিত উপন্যাস ‘দোজখ-যন্ত্রণা’ নামক উপন্যাসে (প্রকাশক গাঙচিল) এক বউয়ের শারীরিক বর্ননায় লিখেছিলাম, ‘এদিকে আবার গুলামের বউ কৃষ্ণকায়; মসৃণ এবোনি কাঠের পদ্মিনী ভাস্কর্য! চওড়া কপালে এবং গালে দিনের বেলাতেই চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ে।’ আসলে এই বর্ননায় আমি ‘দুধ-আলতা মেশানো সোনা রঙের’ যে প্রভাবশালী নারী প্রতিমার সামাজিক আকাঙ্ক্ষা আছে তাকে ভাঙতে চেয়েছিলাম। আমি দেখেছি আফ্রিকান এবোনি কাঠের অদ্ভুত সব শিল্পিত ভাস্কর্য; তেল চকচকে! সত্যিই দিনের বেলায় চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ে। দেখলে অভিভূত হই! আর আমরা তো সব ওখান থেকেই এসেছি। তাই ওইটাই আমার কাছে বেসিক রঙ। ছবি আঁকার সময় যেমন একটা বেসিক কালার থাকে- ঠিক তেমনি ভাবে আমার কাছে মানুষের বেসিক কমপ্লেকশন্ হল কৃষ্ণবর্ণ; কিন্তু খুবই শিল্পিত সেই রঙ- যার সম্ভাবনা অনেক!
যেন সদানন্দময়ী মাতৃরূপী কালিকা আমার! আমি লিখতে চেয়েছিলাম ‘গুলামের বউ
আমাদের আটপৌরে বঙ্গীয় শ্যামা মা’র মতো’; কিন্তু এতে দেবীত্ব আরোপিত
হচ্ছিল, যা হলে মানবী রূপটা চাপা পড়ে যেত। অগত্যা সেই সম্ভাবনা রূপ পায়নি। আর
দ্বিতীয়ত, বাঙালিদের মধ্যে একটা চালু বাক্য আছে, ‘অমুকের বউ যেন মা কালী!’
অর্থাৎ খুব কালো- হাঁড়ির পোঁদের মতো গায়ের রঙ। ফলে এটা লিখতে বেধেছে
আমার। আর শারীরিক গঠনের বর্ণনায় আমি সরাসরি হস্তিনী, শঙ্খিনী, পদ্মিনীর
শাস্ত্রীয় ছককে বেছে নিয়েছি। যে যা বুঝে বুঝুক গে। জানি এতে একটা পুরুষ পুরুষ
ব্যাপার আছে; তবুও উপায় নেয়! পুরুষের দৃষ্টিতে নারী দেহের বর্ণনা এটা। তবুও
আমি ‘পদ্মিনী’ বলে ছেঁড়ে দিয়েছি। এছাড়া উপায় কি? বিকল্প পথ ছিল একমাত্র
পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা- যা আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুব রুচিহীন মনে করি।


বিশ্বাস করুন, এমনিতেই আমার কাউকে ‘দেখতে সুন্দর’ বলতে রুচিতে লাগে খুব।
এটা হয়তো শিল্পীদের থাকার কথা না; কিন্তু আমার আছে। সব সময় মনে হয়
কাউকে সুন্দর বললে কাউকে অসুন্দর ধরতে হয়। যদিও মেয়েদের মধ্যেই শুনি,
‘অমুক খুব সুন্দর দেখতে’! এর ফলে হয় কি- ঈশ্বরের আধিপত্যকে মেনে নিয়ে কেউ
কেউ খুব অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে বসে, সে সুন্দর নয়; কারণ তার নাক
চ্যাপ্টা, রঙ কালো, ঠোঁট মোটা, পা চওড়া...। এটা ন্যাচারালিস্টদের ধাপ্পাবাজি। ওরা
বলতে চায়, প্রকৃতি যা করেছে তার ওপরেই নির্ভর করবে সুন্দর অসুন্দর! এটা
ধাপ্পাবাজি। আসলে মানুষকে হতোদ্যম করার জন্য এসব ধারণার সৃষ্টি। ফলে তার লালন পালন তারাই করে। সেজন্য রেনেসাঁকালীন বতিচেল্লির ভেনাস প্রকৃতির
মধ্যেই আরোপিত। উদোম গায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মাইকেল এঞ্জেলোর পুরুষ মহিলা
যত তারাও সব একই। এগুলির মধ্যে একটা ঈশ্বর ঈশ্বর ব্যাপার আছে। বলতে
চায়ছে ঈশ্বর যেমনটি তৈরি করেছে তাই সুন্দর- সেই জন্যই আদুর গায়ে; বস্ত্রহীন।
জন্মগত সৌন্দর্যে এতোটাই আস্থা যে তাকে বস্ত্র দিয়েও ঢাকা অন্যায়! আমার
জানা একটি লোকের কথা মনে পড়ছে- তার লেপ তৈরি করা ধুনুরিওলার ওপর এতোটাই
আস্থা যে ধুনিরির তৈরি লেপে কোনও মতেই কভার লাগাতে দিত না; স্ত্রী তা করতে
গেলে কভার ছিঁড়ে পুকুরে ফেলে দিয়ে আসত! বলতো ‘এইটেই সোন্দর; আবার জামা
ক্যানে?’ ব্যাপারটা ঠিক এই রকম ধুনুরি-ঈশ্বর যেভাবে মানুষকে গড়েছে তাতে
সুন্দর হলে হল নাহলে নয়! কভার দেওয়া যাবে না। কিন্তু যদি সত্যিকার কেউ
‘র‍্যাশনাল’ হয়; কেউ যদি ‘যুক্তি’কে গুরুত্ব দেয়- তাহলে যুক্তির আধার যে ‘মানুষ’
সেই ‘মানুষকেন্দ্রিক পৃথিবীর’ নান্দনিকতায় মানুষ ‘সুন্দর’ হয়ে ওঠে- উঠতে থাকে
ক্রমশ। পোশাকে, আচারে, বাক্যে, সৃষ্টিশীলতায় সে নিজেকে প্রকাশ করে এবং নিজ
চেষ্টায় সুন্দর হয়ে উঠতে থাকে। ফলে প্রকাশ ভিন্ন দৃশ্যত সুন্দর অসম্ভব। আর
কেউ যদি বলে সম্ভব তাহলে জানতে হবে তাতে ধাপ্পাবাজি আছে; যে ধাপ্পাবাজির
কাছে বারবার এই ‘মানুষ’ নামক জীবের একটি অবলা দল অন্যের দ্বারা দলিত
হয়েছে বারবার।


আসলে দলনের প্রথম ধাপ হল ওইসব ন্যাচারালিস্ট ‘সুন্দরের’ ধারণাগুলো।
সাহিত্যে শিল্পে তারা বারবার তুলে ধরেছে, ‘সাদা লোকটি দেবদ্যূতের মতো কোথা
থেকে নিমেষে এলো এবং সকলকে মুক্ত করল!’ ‘ছেলেটা এতো সাদা যেন সাক্ষাৎ
রাজপুত্র!’ এই যে অপার বিস্ময় তাকে প্রথমে নিজেদের গালগল্পে এবং সাহিত্যে
মনমতো গড়েপিটে নিয়েছে প্রথমে। পরে তাকে কাজে লাগিয়ে সেই প্রথম সুদূর
কিরঘিজ স্তেপ থেকে আগত ‘আর্য’ নামক দলটি মোহিত করেছে দ্রাবিড় আর
অষ্ট্রিকদের যে, তারা ‘রাজপুত্র’! রোদে-জলে জ্বলেপুড়ে এরা যখন একটু তামাটে
হয়েছে তখন তাদের থেকে আর একটু সাদা ফারস্-এর সাইরাস দখল করেছে এদেশ।
এরপর ম্যাসিডনীয় সিকান্দার করেছে বাজিমাত। এরপর একে একে একটু অন্য সাদা-
তুর্কি আর উজবেক। খুব বেশি লোক নিয়ে কেউ আসেনি কিন্তু! তবুও অপার বিস্ময়ে
দাঁড়িয়ে ঠায় থেকে পথ ছেড়ে দিয়েছে সকলে। শেষে ক্লাইভের দল মোট কয়জন মিলে
মুর্শিদাবাদ দখল করেছে। লক্ষ লোক বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পথ ছেড়ে দিয়েছে; ভেবেছে 
দেবদ্যূত এলো বোধ হয়! আর সাদা স্কার্ট পরিহিত রমণী যত উর্বশী মেনকা অথবা
হুর এসেছে রাজরানি হয়ে! সেই যুগ এখনও চলছে। আমার উপন্যাসের ছোকরাকে শুধুদোষ দিই কি করে বলুন তো? আর এই সত্যতাকে অস্বীকার করার  কৌশল
রপ্ত করতে কি যে খাটুনি তা আর কি বলি...

লেখক : অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment