ক্রিমিনাল

  • 07 September, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 235 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
বর্তমান ছকে বাঁধা অভ্যস্থ জীবনটার তলায় সুরলতার যে রোমাঞ্চে ভরপুর অতীত জীবনের কাহিনিটা এতকাল তার বন্ধুদের কাছে অপ্রকাশিত ছিল, সেই গল্পই হয়ে উঠেছে আজকের আড্ডার মূল আলোচ্য বিষয়। কোন এক জাদুবলে চাপা স্বভাবের মেয়ে সুরলতার মনটা আজ নিজেকে মেলে ধরতে চাইছে বন্ধুদের সামনে।

‘তবে জানিস এদের চাইতেও ঢের বেশি ভয়ংকর ক্রিমিনাল আমার নিজের চোখে দেখা।’

কথাটা বলে সুরলতা থামল। রাত সাড়ে বারোটা। ওদের নৈশ আড্ডা তখন বেশ জমে উঠেছে। নিজেদের বাইক দুটোকে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে ল্যাম্প পোষ্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কনস্টেবল সুরলতা বোস। তার সামনে রাতের আঁধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও দুজন, ইন্দিরা ও জয়তী। এরা সুরলতার সহকর্মী ও ভাল বন্ধুও বটে। ষ্ট্রিট ল্যাম্পের ঘোলাটে সাদা আলোর মায়ায় তিন বন্ধুর মুখের ওপর চলছে একটা আলো-আঁধারির খেলা। ইন্দিরা ও জয়তীর চোখে নাইট ডিউটির ক্লান্তি ও ঘুম মিলে মিশে হানা দিয়েছে। যত রাত বাড়বে ক্লান্তির কাছে ততই পরাভূত হতে হবে ওদের। বর্তমান ছকে বাঁধা অভ্যস্থ জীবনটার তলায় সুরলতার যে রোমাঞ্চে ভরপুর অতীত জীবনের কাহিনিটা এতকাল তার বন্ধুদের কাছে অপ্রকাশিত ছিল, সেই গল্পই হয়ে উঠেছে আজকের আড্ডার মূল আলোচ্য বিষয়। কোন এক জাদুবলে চাপা স্বভাবের মেয়ে সুরলতার মনটা আজ নিজেকে মেলে ধরতে চাইছে বন্ধুদের সামনে। ইন্দিরা বরাবরই গল্পরসিক আর সুরলতার জীবনের এমন একটা জমজমাট গল্প শোনার জন্য সে আরও লালায়িত হয়ে উঠে বলে, ‘থামলি কেন? ভালোই তো বলছিলিস গল্পটা। আগাগোড়া খুলে বল। মাঝখান থেকে কিছু বুঝতে পারব না।’

সুরলতার ঠোঁটের কোণে সামান্য একটা হাসির ঝিলিক খেলে গেল। এরপর গলাটাকে যথা সম্ভব গম্ভীর করে সে বলে চলল, ‘সব গল্প সত্যি নয়। তবে ঘটনাটা গল্পের মত শোনালেও এটা বাস্তব। চার-পাঁচ বছর আগের কথা। তখনকার গিন্নি-বান্নি সুরলতাকে দেখলে, এই কনস্টেবলকে চিনতেই পারতিস না। আমার বাপের বাড়ি ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল। বাবা যা পেনশন পেতেন তাতে আমাদের ভালোই দিন চলে যেত। আমাদের বলতে আমি, মা, বাবা ও দাদু। দাদু মনেপ্রাণে চাইতেন আমি যেন বড় হয়ে পুলিশের চাকরিতে যোগ দিই। তবে দাদু গত হওয়ার পর তাঁর ইচ্ছাটার কথা সকলেরই মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। তখন আমি মাস্টার্সে পড়ছি, সেকেন্ড ইয়ারে। পাশাপাশি সরকারি চাকরির চেষ্টাও চালাচ্ছি, এমন সময় বাবা আমার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করলেন। দেখতে আমাকে মন্দ ছিল না, তাই খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের পাকা কথাও সারা হয়ে গেল। যৌথ পরিবার, পাত্রও দেখতে শুনতে ভালো, মোটা মাইনের চাকরি করে। সবদিক বিচার করে বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। চেনা চারপাশটা একটা মায়াবি স্বপ্নের মত সরে গেল দ্রুত। সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা পরিবারে পা রাখলাম। বিয়ের পর মানুষের জীবন বদলে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না। তবে শ্বশুরবাড়িতে আসার কিছুদিন পরেই আমার মনে হল এখানে কিছু একটা গোলমাল আছে। ওদের এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে যা শুনেছিলাম তা বেশ অবাক করার মত। আমার স্বামী অনিরুদ্ধর প্রথম স্ত্রী কোনো অজানা কারণে হঠাৎই মারা যান। বুঝতেই পারছিস অল্প বয়সে বউ মারা গেলে যা হয়। অনিরুদ্ধর মাথার ঠিক ছিল না। তাই তার আবার বিয়ে দেওয়া হয়। এই এত বড় সত্যিটা এরা সকলে আমার বাবার থেকে লুকিয়ে বিয়েটা দেয়। ঠিক সেইদিন থেকেই এদের ওপর একটা সন্দেহ আমার মনের মধ্যে গেঁথে যায়। পরিবারের একজন সদস্য আচমকা মারা গেল, তার কারণ কেউ জানে না এবং কখনও জানারও চেষ্টা করেনি। এও কি সম্ভব? প্রতিবেশীর কাছে আমি এও শুনেছিলাম যে গত পক্ষের স্ত্রীর সাথে এই পরিবারের কারোরই সম্পর্ক তেমন ভাল ছিল না। রোজই খিটির মিটির, ঝগড়া অশান্তি লেগেই থাকত। তা বলে তার মৃত্যুতে এমন নির্বিকার চিত্তে থাকা ওদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হল তা আমি জানিনা।’

সুরলতা নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য থামতেই বোঝা গেল চারপাশটা ঠিক কতখানি নিস্তব্ধ। জনমানবশূন্য রাস্তার এ মোড় থেকে ও মোড় পরিষ্কার দেখা যায়। মাঝেমধ্যে দু একটা গাড়ি একটানা হর্ণ বাজিয়ে নিদ্রিত রজনীর অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা ভেদ করে ওদের মুখের সামনে দিয়ে বেড়িয়ে যায়। তারপর আবার চাদরের মত ঘিরে ধরে ঘনীভূত এক নিস্পন্দতা। ঝিরঝিরে হাওয়ায় ফুটপাথের ধার ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাতা একটু তিরতির করে নড়ে ওঠা ছাড়া সব কিছু নিশ্চল। সুরলতার ঠোঁট আবার ফাঁক হল মন্ত্রমুগ্ধের মত, ‘আমার শ্বশুর শাশুড়ি, ননদ দেওর, স্বামী সকলকেই অত্যন্ত ভাল বলে আমার মনে হয়ে ছিল। অন্ততপক্ষে তাদের কাছ থেকে অস্বস্তিজনক কোনো ব্যবহার আমি পাইনি। ভালই খাপ খেয়ে গিয়েছিলাম এই পরিবারটার সাথে। দুই আড়াই বছর পর যখন সেই সন্দেহের কথাটা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায় ঠিক তখনই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সেই বীভৎস ঘটনাটা ঘটলো। ঘটনাটা তবে খুলে বলি। আমার একমাত্র মেয়ে পুতুলের ডেলিভারির জন্য আমাকে শহরের সবচেয়ে নামী হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন আমার শ্বশুরমশাই। ডেলিভারির পর যখন আমার জ্ঞান ফেরানো হল তখন চোখ মেলে চারিদিকে চেয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার হৃৎপিণ্ডটা ধক করে উঠল। শ্বশুরমশাইয়ের মুখ গোমড়া, আমার বাবা চোয়াল শক্ত করে তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মা, শাশুড়ি মা, ননদেরা একে অপরকে সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে চলেছেন ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে। শুধু অনিরুদ্ধকে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমি উতলা হয়ে উঠলাম কী হয়েছে তা জানার জন্যে। কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিতে পারল না। কেবল শ্বশুরমশাই অনেক কষ্টে বললেন যে আমি মৃত সন্তান প্রসব করেছি। শুনে আমি তখনকার মত বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমার অন্যতম একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল এই, যাই কিছু হয়ে যাক না কেন এমনকি আমার হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে গেলেও আমার মুখে কোনো রা কাড়ে না। চিৎকার, চেঁচামেচি করে কান্নাকাটি করা কোনদিনই আমার স্বভাবের মধ্যে পড়ে না। আমি চোখ বুজে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু একবার ভাবার চেষ্টা করলাম। কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনি তখন জানিস, এমনকি বিশ্বাস করার মত কোনো কারণ খুঁজে পাইনি আর ঠিক তখনই আমার মনের মধ্যে ভেসে উঠলো একটা কথা অনিরুদ্ধর আগের পক্ষের স্ত্রীর মৃত্যু… এক ঝটকায় মাথাটা আমার একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি বাইনা ধরলাম, মৃত বাচ্চাটাকেই আমি একবার চোখের দেখা দেখব। দেখলাম বাবা আমার ইচ্ছাপূরণে উদ্দত হলেন কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। আমি জানতাম আমার শ্বশুর পেনশনে অনেক টাকা পান। সুতরাং টাকার জোরে তিনি করাতে পারেন না হেন কাজ নেই। শ্বশুরবাড়ির সকলের আপত্তি ঠেলে, হাসপাতাল থেকে বহু কষ্টে পারমিশন জোগাড় করে বাবা আমাকে সেদিন নিয়ে গিয়েছিলেন পুতুলের সেমেট্রিতে। আমার প্রতি বাবার দৃঢ় আস্থা ছিল। ছোটবেলা থেকে বাবার থেকে ভাল আমাকে আর কেউ চেনে না। বাবা জানতেন নিজের চোখে না দেখলে যে যতই বলুক না কেন আমি বিশ্বাস করব না।’

জয়তী আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে বলল, ‘কিন্তু তুই কাল যে বললি, তোর একমাত্র মেয়ে পুতুল। তার স্কুলে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। পুতুল ক্লাসে ফার্ষ্ট হয়েছে। তাহলে সে কীভাবে…’

‘হ্যাঁ, পুতুল কোনোদিনই মারা যায়নি, ও মারা যেতে পারে না। আমি তখন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পাগলের মতো ছুটে গিয়ে পুতুলের সমাধির ধার ঘেঁষে মাটিতে বসে পড়লাম। বুক ঠেলে এবার কান্না উঠে আসছে। আমি মাটিতে আছাড় খেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম আর আমার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দুটো মাটিতে ক্রমাগত আঘাত করতে লাগল। মনে হচ্ছিল আমার জীবনের আশাভরসা সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আর কী নিয়ে বাঁচব আমি? তখন ইচ্ছা করছিল পুতুলের সঙ্গে আমিও মিশে যায় মাটিতে। কতক্ষণ এভাবে মাটিতে মুখ গুঁজে কেঁদে গেছি জানি না তবে আমার সংবিৎ ফিরল একটা বাচ্চার কান্নার শব্দে। মনে হল সেও যেন আমার কান্নার সুরে সুর মেলাচ্ছে। কিন্তু শব্দটা আসছে কোথা থেকে? মাটির তলা থেকে কি? মা আর বাবা আমাকে তুলে নিয়ে যেতে এলে আমি তাদের শিশুর কান্নার আওয়াজের উৎসটা দেখালাম। প্রথমে ওঁরা ভাবল আমার মানসিক অবস্থা ঠিক নেই, মনের ভুল হতে পারে। কিন্তু বাচ্চার কান্নার শব্দটা ক্রমশ বেড়েই চলল। শিশুটি যেন আর্তনাদ করে জানান দিতে চাইছিল তার উপস্থিতি। অবশেষে শিশুর সেই মর্মভেদি আর্তনাদ মাটির আস্তরণ ভেদ করে প্রবেশ করলো আমার বাবার কানে। এর পরবর্তী কাহিনি সংক্ষিপ্ত। মূলত বাবার নির্দেশেই কবর খোঁড়া হল। আমার শ্বশুরমশাই শুধু বললেন, ‘এ আপনার পাগলামি মশাই। যে মাটির তলায় শান্তিতে শুয়ে রয়েছে তাকে আবার টেনে বের করে আনা কেন?’ কিন্তু তাঁর আপত্তি ধোপে টিকল না। মাটি খোঁড়া শেষ হতেই সবাইকে হতবাক করে দিয়ে বাবা আমার কোলে আমার জলজ্যান্ত সদ্যজাত কন্যাটিকে তুলে দিলেন। হসপিটালে গিয়ে দ্রুত চিকিৎসা করানো হল পুতুলের। তার রক্তে অনেকটাই অক্সিজেন মাত্রা কমে এসেছিল। বাঁচার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে কাঁদতে কাঁদতে অবসন্ন হয়ে এসেছিল পুতুলের ক্ষুদ্র দেহ খানি।’

ইন্দিরা বাকি গল্পটা বেশ পুলিশি মেজাজে শেষ করল, ‘ঠিক এরপর সুরলতা দেবী তার মেয়েকে হাসপাতাল থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ করিয়ে এনে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। পুতুল মাতৃ আলয়েই লালিতপালিত হতে থাকল এবং তার দেখভালের জন্য ঈশ্বর তোকে কনস্টেবলের চাকরিটা ম্যাজিকের মত পাইয়ে দিলেন, তাই তো?’

সুরলতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘একদমই তাই। ওদের সাথে আমার আর কোনো সম্বন্ধ নেই। আমার শ্বশুর-শাশুড়ির বড় সাধ ছিল, তাদের ঘর আলো করে নাতি আসবে, বংশে প্রদীপ জ্বালবে। যারা আমার মেয়েকে নিয়ে খুশি নয়, হাসপাতালে টাকা খাইয়ে তাকে খুন করতে চায় আমি তাদের কোনোদিনও ক্ষমা করব না। দেখিয়ে দেব যে পুতুল পারে না হেন কাজ দুনিয়াতে নেই, আর সেটাই হবে ওদের যোগ্য জবাব।’

জয়তী কিছু বলতে গিয়েও থেমে যেতে বাধ্য হল। দূরে কোথাও থেকে একটা গন্ডগোলের শব্দ ভেসে আসছে। কাল বিলম্ব না করে সুরলতা একটাতে আর অপর বাইকটাতে জয়তী ও ইন্দিরা চেপে বসল। সুতীব্র হর্ণে নৈশব্দ্যকে ভেঙে খানখান করে দিয়ে পুর্ণ শক্তিতে বাইক দুটো ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলল রাতের মায়াময় শহরটাকে শাসন করতে।

লেখক : শিক্ষার্থী, গল্পলেখক

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment