“কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন”

  • 28 June, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1307 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
উপনিবেশিত ভারতবর্ষেই সম্ভবত কালো রঙের সঙ্গে অশুভের সমীকরণ। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। মাঝখান থেকে বলিপ্রদত্ত হচ্ছেন আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ বাদামি ত্বকের মহিলা। একদিকে সামাজিক ও মানসিক মনস্তাপ, অন্যদিকে পুঁজিবাদের ফাঁদ। এই দুই ফাঁসকলে মহিলাদের শ্বাসরুদ্ধ অবস্থার বিরুদ্ধে হোক প্রতিবাদ।

১.

‘পয়োমুখম্‌’। জগদীশ গুপ্তের গল্পের কথা বলছি। গল্পের দৌর্দণ্ডপ্রতাপ চরিত্র কৃষ্ণকান্ত কবিরাজ। তাঁর ছেলে ভূতনাথ। পিতার দাপটের কাছে একেবারে নিষ্প্রভ। নিজের বিবাহ নিয়েও মত প্রকাশের কোনো দৃঢ়তা তাঁর নেই। ফলে তৃতীয়বার বিয়ে করতে বাধ্য হন কৃষ্ণকান্তের জোরাজুরিতে। পরপর দু-বার বিপত্নীক হওয়ার ফলে পাত্র হিসাবে তাঁর বাজারদরে স্বাভাবিকভাবেই একটু মন্দা এসেছে। সেই খামতিটুকু পুষিয়ে দেওয়ার জন্য কৃষ্ণকান্তের এবার পছন্দ একজন কালো মেয়ে। নাম বীণাপাণি। মেয়ের গায়ের রং কালো বলে পণ আটশো টাকা। সঙ্গে মাসে মাসে দশ টাকা করে জরিমানা। 

২.

‘পলাতকা’ কাব্যগ্রন্থ। কবিতার নাম ‘কালো মেয়ে’। সেই একই সমস্যা। মেয়েটির গায়ের রং কালো। এদিকে তাঁর বয়স বেড়ে যাচ্ছে। মানে, বিবাহের বয়স হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির বাবা প্রতিনিয়ত চিন্তিত। কেবল মেয়েটির বাবাই নন, সামাজিক এই ব্যাধির ফলে সমস্ত পরিবার জুড়েই চলে এক অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণা। মনস্তাপ। কীভাবে ভালো পাত্রের হাতে মেয়েকে ‘সমর্পণ’ করা যাবে?

৩.

উপরের একটি গল্প, অন্যটি কবিতা। কিন্তু বক্তব্য একই। মেয়েদের গায়ের কালো রং একটা অভিশাপ। বিবাহ নামক একটি বিশাল বাজারে মেয়েদের মূল্য অনেক কমিয়ে দেয় তাঁদের গায়ের কালো রং। কালো রং-এর সঙ্গে অশুভ বা খারাপের এই সমীকরণ কিন্তু আগে ছিল না। সম্ভবত উপনিবেশিত ভারতবর্ষে এর জন্ম। এডওয়ার্ড সাইদ তাঁর ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইতে দেখিয়েছেন, ইউরোপীয়রা সব সময়ই নিজেদেরকে সভ্যতার কেন্দ্রস্থলে রেখে পূর্ব বা প্রাচ্যের সভ্যতাকে বিচার করতেন। তাঁদের বিচারে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ, কর্মঠ, নিয়মানুবর্তী, সংযত এবং অবশ্যই ফরসা। অপরদিকে প্রাচ্যের লোকেরা অলস, কুঁড়ে, যৌনতা সম্পর্ক অসংযত এবং অবশ্যই কালো। সাদা ইউরোপীয়দের এই বিশ্বাস ক্রমশ ইউরোপীয় সাহিত্যে ও ভ্রমণবৃত্তান্তে প্রচার পেতে পেতে সকলের কাছে স্বাভাবিক বলে পরিগণিত হল। প্রাচ্যের লোকেরাও ইউরোপীয়দের পাতা এই ফাঁদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারলেন না। মেনে নিলেন, কালো মানুষেরা অনুন্নত, অসভ্য। আস্তে আস্তে কালো রং হয়ে গেল ‘অশুভ’। যা কিছু খারাপ, তার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে গেল কালো রঙের অনুষঙ্গ।

৪.

তত্ত্বের বদলে এবার ফলিত প্রয়োগের দিকে তাকানো যাক। ভেবে দেখেছেন কি, আমরা এখনও কেন বলি ‘কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’? কেন বলি ‘কালোবাজার’? কোনো খারাপ লোককে কেন ‘কালো তালিকাভুক্ত করি’? কেউ যদি আপনাকে ভয় দেখিয়ে কিছু আদায় করতে চায়, তাহলে কেন বলি ‘কালো হুমকি’? এখন আবার দেখছি অন্যের নজর যাতে না লাগে সেইজন্য অনেকেই পায়ে কালো সুতো বাঁধছেন। পৃথিবীতে তো রঙের কোনো অভাব নেই। তাহলে সব ঋণাত্মক অনুষঙ্গেই কেন ‘কালো’ রং আসছে? এর উত্তর আগের পরিচ্ছেদেই আপনারা পেয়ে যাচ্ছেন। ইউরোপীয়রা এভাবেই আমাদের ভাবতে শিখিয়েছেন, আর আমরাও তাঁদের বশংবদ হয়ে অবলীলায় তা মেনে নিয়েছি।

৫.

ইউরোপীয়রা কিন্তু এই প্রাচ্যতত্ত্ব প্রচার করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদকে অক্ষুণ্ণ রাখতে। অশ্বেতাঙ্গরা যাতে শ্বেতাঙ্গদের নির্দ্বিধায় প্রভু বলে মেনে নিতে পারেন। বর্তমানে সাদা চোখে অবশ্য সেরকম কোনো অস্ত্রশস্ত্রের সাম্রাজ্যবাদ চোখে পড়বে না। তবুও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিয়াছে। বরং বেশ একটু সূক্ষ্মভাবেই চলিতেছে। কারণ পুঁজিবাদি সাম্রাজ্যবাদের চক্রব্যূহে আমরা প্রবেশ করেছি অভিমন্যুর মতো। নিষ্ক্রমণের পথ জানা নেই। ‘ভাবি আমার মুখ দেখাব’, কিন্তু ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। কীসের বিজ্ঞাপনে? ত্বকের উজ্জ্বলতা-বর্ধক ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি জাতীয় বিজ্ঞাপনে। ফরসা ত্বক লাভ করাই মেয়েদের কাছে যেন একমাত্র কামনার মোক্ষধাম। অনেকেই এই ফাঁদে পা দিয়েছেন। পা বাড়িয়ে রেখেছেনও অনেকে। কিছুতেই বুঝতে পারছেন না বিজ্ঞাপনের ফাঁদ পাতা এই ভুবনে অজান্তেই তাঁরা নিজেদের পণ্য করে ফেলছেন। নিজেদের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছেন। একটি বিজ্ঞাপনে এরকমও দেখিয়েছিল যে, সুকণ্ঠের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও একটি মেয়ে কিছুতেই জাতীয় একটি গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ পর্যন্ত করতে পারছেন না। সেই মেয়েটিই টানা ছ-সপ্তাহ ধরে ফরসা হওয়ার ক্রিম মাখলেন। ব্যস্‌। অসাধ্যসাধন। সরাসরি প্রথম স্থান। কী লজ্জার। এই লজ্জা তো কেবল মেয়েটির নয়, বিচারকদেরও। গানের প্রতিযোগিতার বিচারকরা কি তাহলে গুণের সমজদার, না রূপের? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কেবল স্বাভাবিক নয়। প্রশ্ন তুলতেই হবে। বন্ধ করতে হবে বর্ণবিভেদ উসকে দেওয়া এই সব বিজ্ঞাপন। একজন শিক্ষিকার খবর বেরিয়েছিল সংবাদপত্রে। গায়ের রং কালো হওয়ায় নিত্য গঞ্জনা শুনতে হত তাঁকে। সহ্য করতে না-পেরে আত্মহত্যা করেন তিনি। এত কিছুর পরেও কিন্তু ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনে বা ব্যবহারে কোনো ভাটা পড়েনি। বিশ্ব জুড়ে চলছে তাদের বিপুল মুনাফা। বেদনার বিষয়।

৬.

মনে পড়ছে টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় রিয়ালিটি শো-র কথা। বিলেতের অবশ্য। একটি বিরাট বাড়িতে অনেককে একসঙ্গে থাকতে হয়। চলে নানান প্রতিযোগিতা। ক্রমশ তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে বিজয়ী নির্বাচিত করা হয়। বিলেতেই এই অনুষ্ঠানে একজন জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেত্রীও অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্য করলেন একজন বিলাতি নারী। উঠল প্রতিবাদের ঢেউ। বিলেতে। এদেশেও। খুব ন্যায্য কাজ সন্দেহ নেই। অথচ এদেশে যাঁরা প্রতিবাদ করলেন, তাঁদের কাউকেই দেখা গেল না ফেয়ারনেস ক্রিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। বরং অনেককেই দেখা গেল কোটি টাকার বিনিময়ে সেই সব রূপবর্ধক পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতে। এখানেই দুশ্চিন্তা। অর্থের লোভের কাছে হার মানছে মানবিকতা। মজার ব্যাপার, এঁরাই আবার গর্জে ওঠেন আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে।

৭.

তাহলে সমাধানের পথ কী? এক শব্দে উত্তর : আত্মজাগরণ। সেই কাজ সহজ নয়। একদিনে সম্ভবও নয়। দরকার মনের অনুশীলন। শিরা-উপশিরার মধ্যে গেঁথে যাওয়া মিথ্যাকে মূল থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। খুব শক্ত কাজ। অনেক পূর্বসূরিই এই কষ্টসাধ্য কাজে ব্রতী থেকেছেন। এমনই একজন শ্রদ্ধেয় অগ্রজ হলেন লেওপল সেদার সেনগর। কালো মানুষ। বিপ্লব সংগঠিত করেছেন দেশে এবং বিদেশে। হয়েছিলেন স্বাধীন সেনেগালের প্রথম প্রেসিডেন্ট। দু-দশক ছিলেন এই পদে। আসুন, আজ তাঁর একটা কবিতা পড়েই আমরা এই বক্তব্যের ইতি টানি।

সাদা ভাইয়ের প্রতি কবিতা

হে শ্বেতাঙ্গ ভাই,

আমার জন্মের সময়, আমি কালো ছিলাম

যখন বেড়ে উঠি, তখনও কালো

আমি যখন রোদে যাই, তখন আমি কালো

আমার অসুস্থতার সময়ও, আমি কালো

যখন আমি ভয় পাই, তখনও আমি কালো

যখন মারা যাবো, তখনও কালোই থাকবো

 

যদিও তুমি, হে শ্বেতাঙ্গ

জন্মের সময় তুমি ছিলে গোলাপি

বড়ো হওয়ার সময় সাদা

যখন রোদে বেরোও তখন লাল

ঠান্ডা লাগলে নীল

তুমি যখন ভয় পাও, তখন সবুজ

অসুস্থতার সময় হলুদ

আর মারা যাওয়ার সময় হবে ধূসর

সুতরাং, আমাদের দুজনের মধ্যে

কে আসল রঙিন মানুষ?

 

প্রতীকী ছবি

লেখক: অধ্যাপক ও সমাজকর্মী

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৮ জুলাই, ২০২০

0 Comments

Post Comment