- 14 May, 2020
- 0 Comment(s)
- 918 view(s)
- লিখেছেন : সিরাজউদ্দিন মল্লিক
স্বামী থাকলে সধবা; না থাকলে বিধবা। কিন্তু ধর্মমতে বিবাহিত স্বামী আছে বেঁচে। রেশন কার্ড, সন্তানের স্কুলের ভর্তির খাতায় আছে জীবিত স্বামীর নাম— কিন্তু নেই স্বামীর সাহচর্য, নেই সেই স্বামীর আর্থিক দায়িত্ব। স্বামীর ভালোবাসা! সে তো অন্য গ্রহের স্বপ্নসম কিছু বিষয়, যা গেছে বহু পূর্বেই বিস্মৃতির অতলে। তাহলে আছে কী? আছে মাতাল স্বামীসহ স্বামীর পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার, নিজ পিতৃগৃহের সব দেখেও চোখ বন্ধ করে থাকার নিরলস প্রয়াস। আছে আশ্রয় হীনতা, আর আছে অন্য কারোর সঙ্গে সংসার পাতা স্বামীর মাঝে মাঝে স্বামীর অধিকার নিয়ে ফিরে এসে দৈহিক নিপীড়নের দুর্ভাবনা। আর আছে কিছুদিনের দাম্পত্য জনিত কারণে স্বামীর ঔরসে রেখে যাওয়া একটি সন্তানের গুরুদায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে সর্বস্বান্ত হতে থাকা অগণিত নারী, সাম্প্রতিককালে বাংলা অভিধানে যারা নতুন শিরোনাম পেয়েছে অধবা হিসাবে। অর্থাৎ স্বামী বেঁচে থেকেও প্রায় না থাকার মতো নারীদের মর্মবেদনা নিয়ে সাহিত্যে বা সমাজবিজ্ঞানে কিছু লেখালেখি হলেও করোনা মহামারী এবং লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অবস্থা কী? একটি ছোট অঞ্চলের ক্ষেত্রসমীক্ষার মধ্য দিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত আকারে এটি তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
হাওড়া জেলার মহকুমা শহর উলুবেড়িয়া, ভাগীরথী নদী তীরস্থ পুরোনো এক জনপদ। শেষ কুড়ি বছরে এখানে লেগেছে আধুনিক শহরের প্রলেপ। ফ্লাইওভার, স্টেডিয়াম মাঠ, ঝকঝকে রবীন্দ্রভবন, বইমেলা, ফুলমেলা, অগণিত আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট বাড়ির শিক্ষিত সরকারি চাকুরের, সচ্ছল ব্যবসায়ী মধ্যবিত্তদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। এই শহরের মূল সড়ক জি টি রোডের পাশ দিয়ে প্রবাহিত খাল আর তার দুপাশে গড়ে ওঠা অস্বাস্থ্যকর ছোট ছোট ঘরে দিন গুজরান করা মানুষ— যাদের একটি বড় অংশই হল এই অধবা এবং তাদের সন্তানরা। এদের অবর্ণনীয় জীবন কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত হতে হতে আমার মনে একটি প্রশ্ন বারে বারে ফিরে এসেছে— স্বাধীনতার প্রায় পঁচাত্তর বছর পর Shining India-র আড়ালে এ কোন যন্ত্রণাগ্রস্থ ভারত?
খালপাড়ের এই অধবাদের আবাসস্থলকে কী বলা যাবে? বাড়ি? না ঘর? না কি কুঁড়ে ঘর? বা গোয়াল ঘর? বাঁশ, বাখারি, কাদামাটি, পলিথিন বা হোগলা সহকারে নির্মিত রাত্রিযাপনের স্থল। বারান্দা কিংবা উঠান বলতে সরকারি রাস্তা। অনেকগুলি আবার বিদ্যুৎহীন। পাঠকগণ না হয় কিছু একটা নাম দেবার চেষ্টা করবেন দয়া করে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় সরকারি পাকা বাড়ি এদের কাছে চিরকাল অধরা মাধুরী হয়ে থাকবে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়মের যাঁতাকলে। কারণ এদের না আছে দলিল না আছে পরচা। তাই মাথার উপর পলিথিন বা হোগলা এটাই হলো এদের রাজপ্রাসাদ। স্বামী পরিত্যক্ত এই অধবাদের দিন গুজরানের অবলম্বন বা জীবিকা হল মূলত শহরের মধ্যবিত্তদের বাড়ির কাজ। সেই অর্থে এদের নামকরণ ঘটেছে 'কাজের মাসি'। একটি থেকে তিনটি বাড়িতে কাজ করার সুবাদে মাসিক আয় দেড় হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। কেউ আবার সেলাই বা জরির কাজ করেও নিজের এবং সন্তানদের গ্রাসাচ্ছাদন করে থাকেন।
ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে হিন্দু-মুসলিম মিলিতভাবে এই অধবাদের সন্তান সংখ্যা গড়ে তিন জন। জীবনের কঠিন লড়াই লড়তে লড়তে এদের মধ্যে ক্রমাগত গড়ে ওঠে আত্মপ্রত্যয়। নতুন করে ডানা মেলে স্বপ্ন। এরা সন্তানদের মধ্য দিয়ে খুঁজতে থাকে ভবিষ্যতের সুদিনের হাতছানি। আর সেই স্বপ্নের মন্দির হয়ে ওঠে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি। বেলা এগারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত বিদ্যালয়ের সময়টিতে এরা অনেকটা নিশ্চিন্ততা অনুভব করে। তাছাড়া বিদ্যালয়ের মিড ডে মিলের খাদ্য এদের কাছে অমৃত সমান। সমীক্ষায় উঠে এসেছে এদের স্কুল আগমনের একটি বড় কারণ মিড ডে মিলের খাবার। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের সবজান্তা সমালোচকদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, বিদ্যালয়ের মিড ডে মিলের ব্যবস্থা নাকি লেখাপড়াটাকেই শেষ করে দিচ্ছে। সমীক্ষা কিন্তু অন্য কঠিন বাস্তবতাকে তুলে ধরছে।
করোনা মহামারী জনিত লকডাউন সমগ্র বিশ্ববাসীকে আর্থিক, মানসিকভাবে কমবেশি আঘাত করেছে এটি সত্য। কিন্তু সমাজের প্রান্তিক মানুষদের উপর এর আঘাত সর্বাধিক, এটাও প্রমাণিত। এমন অবস্থায় অতি প্রান্তিক এই অধবাদের জীবনকে একেবারে ধ্বংসের কিনারে এনে উপস্থিত করেছে এই লকডাউন। কোভিড-১৯ ভাইরাসের ভয়ে অধিকাংশ মানুষ নিজ গৃহের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সোশ্যাল ডিসট্যান্স পালন করছে। তার ফলে এই কাজের মাসিরা অধিকাংশই আজ কর্মহীন, অন্নহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয়গুলি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায়, এদের সন্তানরা আজ মিড ডে মিলের পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত। সরকারি হাসপাতালে টিকাকরণ কর্মসূচি বন্ধ থাকায় এদের শিশু সন্তানরা আজ টিকাকরণ থেকে বঞ্চিত। কারণ বেসরকারি ব্যবস্থাই ব্যয়বহুল টিকাকরণের সুযোগ গ্রহণ করা এদের কাছে দিবা স্বপ্নের ন্যায়। ফলে ভবিষ্যতে বিরাট শারীরিক বিপদের ভ্রূকুটি দেখা যাচ্ছে। সরকারি তরফ থেকে বৃদ্ধ ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, চালু থাকলেও চরম অবহেলিত এই অধবাদের জন্য কোন ভাতা আজ অবধি চালু হয়নি। অদূর ভবিষ্যতেও চালু হবে বলে মনে হয় না। কারণ সরকার বাহাদুর অধবাদের এই জীবন যন্ত্রণা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রায় ধারণাহীন।
দীর্ঘ লকডাউন জনিত কারণে সমাজের অধিকাংশ মানুষ তীব্র মানসিক অবসাদে ভুগছে। ফলে পারিবারিক অশান্তি ও হিংসা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত মাদকাসক্ত মানুষরা মদের দোকান বন্ধ থাকায় 'উইদড্রল এফেক্ট' হিংস্র হয়ে উঠছে, যৌন হিংস্রতাও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। খালপাড়ের ঝুপড়িতে বসবাসকারী এই অধবাদের গৃহগুলি নিরাপত্তাহীন। স্বামী পরিত্যক্ত এই নারীরা অবস্থানগত কারণে সমাজের চোখে কিছুটা হীন প্রতিপন্ন হয়ে থাকে, ফলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এদের উপর প্রলুব্ধ হয় বিকৃত যৌন সুখ লাভের আশায়। ফলে এই দরিদ্র অধবারা বর্তমান পরিস্থিতিতে আরো অসহায় হয়ে পড়ছে। যৌননিগ্রহের বেশ কয়েকটি অভিযোগ এলেও থানার পুলিশরা এদের ব্যাপারে ভীষণরকম উদাসীন। আর ব্যয়বহুল বিচার ব্যবস্থার সুযোগ নেওয়া কোনভাবেই এদের পক্ষে সম্ভব নয়।
১৯৭০-এর দশক থেকে সুইডেন, ব্রিটেন এবং কানাডাতে শুরু হয় অ্যাডভোকেসি মুভমেন্ট, যার লক্ষ্য ছিল চরম শোষণের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে থাকা অসহায় মহিলারা যারা ভাবতে শুরু করেছিল এই অত্যাচার এবং অসম্মান এটা হলো জীবনের এক স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু ওই দেশের একাধিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান তাদের বুঝিয়ে ছিল এটা কোন জীবন নয়। তাদের বিশ্বাস ছিল অসহায় নারীদের যদি বোঝানো যায় ‘একে জীবন বলে না’ তাহলেই সে এক নতুন জীবনের সন্ধান করবে। আর সেই নতুন জীবন পাওয়ার জন্য সে নতুন লড়াইয়ের পথ বেছে নেবে। ইউরোপ এবং আমেরিকা আজ সেই লড়াইয়ের সুযোগ পাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত পঞ্চাশ বছর পরেও ভারতবর্ষে অ্যাডভোকেসি মুভমেন্টের সূচনায় সেভাবে হল না। তাই আমাদের দেশে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা নীরবে কাজ করে যাওয়া বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে এই অধবাদের কঠিন জীবন সংগ্রামের সঙ্গী হতে হবে। তারা যে একা নয়, এই আত্মপ্রত্যয় প্রদান করতে হবে। তাহলে হয়ত এই অধবারা বঞ্চিত প্রান্তিক অংশ না থেকে আমাদের সমাজের মূল স্রোতের অগ্রণী অংশ অংশ হয়ে উঠতে পারবে।
ছবি: প্রতীকী
0 Comments
Post Comment