করোনা: প্রহসন বনাম প্রশমন

  • 18 May, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1102 view(s)
  • লিখেছেন : লীনা ভট্টাচার্য্য
বিলেত ফেরত বেশ কিছু ধনীবর্গীয়ের শরীরে চাপিয়া করোনা পৌঁছলো ‘গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া’-তে। ভারতবাসী প্রথমেই ভাবিল এ আর এমন কি? এমন সর্দি জ্বর তো নিত্যই হইয়া থাকে। কিন্তু ভুল ভাঙিলো। করোনার কামড় চাপিয়া বসিতেই “লক-ডাউন” বলিয়া একটি ব্যবস্থা চালু হইল। তাহা খায় না মাথায় দেয় বুঝিবার আগেই।

দৃশ্য: ১

হৈ হৈ রৈ রৈ করিয়া সে হাজির হইলো। মহাসমারোহে ‘রাজ সমারোহে এসো...’ চারিদিকে কলরব। ‘কোলাহল তো বারণ’ হইলোই না, বরং কথা বাড়িতে লাগিল কানে কানে। গ্রহান্তরের কোনো জীব বা অজীবজাত বস্তু নহে। বিজ্ঞান গরবে বলীয়ান বিদগ্ধ মনুষ্যজাতির মধ্যে আবির্ভূত হইলেন জড় ও জীব্বে মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম এক কণা-ভাইরাস। আসিয়া পড়িয়াছেন, না কি আনয়ন করা হইল! এই নিয়ে চলিল তুমুল তর্ক। প্রকান্ড বিশ্বব্যাপী দ্রুতগতিতে সঞ্চরনশীল এই ‘আপদ’টিকে, কে বা কারা প্রস্তুত করিল তাহা লইয়া চলিতে লাগিল গা ঠেলাঠেলির পর্ব। ২০১৯-এর শেষ পর্যায়ে সামান্য আভাসমাত্র দিয়া, মনুষ্য সমাজকে ন্যূনতম হিসাব কষিতে না দিয়া, ‘বিপুল তরঙ্গ রে...’ উদ্ববেলিত, পদানত করিতে লাগিল প্রতি পলে। গুজবে কান দিবেন না জেনেও, কারা যেন রটাইয়া দিল চিন দেশের উহান প্রদেশের একটি গবেষণাগারে এনাকে জন্ম দেওয়া হইয়াছে। স্বাভাবিক ভাবে নহে তাহা সুনিশ্চিত। প্রযুক্তি-জাত। সক্ষমতা প্রমাণের জন্য প্রয়োগ করা হইল বহু মানুষের উপর। প্রয়োগ সম্পূর্ণ হইলে আকাঙ্ক্ষিত ফলকে বিন্দুমাত্র অপদস্থ না করিয়া মৃত্যু সুনিশ্চিত করিল ইহার ক্রিয়াকলাপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলিয়া একটি সবজান্তা গোষ্ঠী প্রথমে কিছুতেই প্রকাশ্যে আনছিলেন না এই ভয়ানক মারন ব্যাধির তথ্য; শাক দিয়া মাছ ঢাকতেই প্রভূত সময় ও বাক্য ব্যয় করিতেছিলেন তেনারা। তথাপি মৃত্যু যখন হইতেছে, লাশ কবরস্থ হইবে এমনটাই সঙ্গত। কিন্তু এত সহস্র মরণ সামলাইতে হিমশিম চৈনিক সরকার লাশ পুড়াইয়া দিলেন। নিন্দুকেরা ধোঁয়া দেখিয়া এমনটাই ভাবিতেছেন।

দৃশ্য: ২

আসিয়া যখন পড়িল তখন ভারতবর্ষের মত ঐতিহ্যশালী, পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ তাহাকে ফিরাইয়া দিবে এমন ভাবিবার অবকাশ রহিল না। বিলেত ফেরত বেশ কিছু ধনীবর্গীয়ের শরীরে চাপিয়া সে পৌঁছলো ‘গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া’-তে। বিশ-বিশ বছরের প্রথমেই এটির আবির্ভাব।

সম্পূর্ণ অগোচরে, অজান্তে ছড়িয়ে পড়িতে লাগিল সংক্রমণ। প্রায় দুই মাস অতিক্রান্ত হইবার পর মহামানবরা বুঝিলেন, এইবার আর সামাল দিতে পারিবেন না। অতএব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালেবর বুদ্ধিজীবী বৈজ্ঞানিকদের এতদিনের আশ্বাস নিমেষে বদলাইয়া গেল। মহামারি ঘোষিত হইল নতুন এই সংক্রমণ “করোনা” নাম লইয়া। আদপে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সামান্য জ্বর, হাঁচি, কাশি, গলা খুশ-খুশ সামান্য উপসর্গ কয়টিকে সাথে লইয়া। তাই ভারতবাসী প্রথমেই ভাবিল এ আর এমন কি? এমন সর্দি জ্বর তো নিত্যই হইয়া থাকে; প্রথম হইতেই গাণিতিক অগণনের কৌতুক শুরু হইল। অতঃপর বেশ কিছু আন্তর্জাতিক উড়ান উড়াইয়া, গণপরিবহন চালু রাখিয়া “জনতা কার্ফু” নামক একটি ২০-২০ ম্যাচ খেলিয়া, চিকিৎসক সহনাগরিকের প্রশংসায় ও মনোবল বাড়াইবার উদ্দেশ্যে থালা-বাসন-কাঁসর-ঘণ্টা বাজাইয়া (অত্যুৎসাহীরা এই সুযোগে যদিও একটু কোমর নাচাইয়া লইলেন) “লক-ডাউন” বলিয়া একটি ব্যবস্থা চালু হইল। তাহা খায় না মাথায় দেয় বুঝিবার আগেই লাগু হইয়া গেল। তাহা বেশ; কিন্তু জনতা মানিবে কেন? তাহারা লক-আপ” ভিন্ন কোনও স্থানেই বাধ্য, শৃঙ্খলাপরায়ণ হইতে শেখেননি। তাই বিশেষ দোষ তাঁহাদের বলি কি করিয়া; অন্যদিকে গুজবে কান দিবেন না শীর্ষক বহুমাত্রিক প্রচারেও গৃহবন্দি মানুষ ক্রমাগত স্ক্রীন-বন্দি (মোবাইল) হইয়া রোগ সংক্রান্ত মুখরোচক টক-ঝাল-মিস্টি, টিক-টক, ঠিক-টক, মিম-থিম বানাইল। পুজোর গান কিম্বা প্যান্ডেল প্রেমের মতো কত শত যে কোয়ারেনটাইন সোহাগ বা ভালোবাসার ভাইরাস জন্মিল তাহা পরবর্তী যুগে গবেষণার বিষয় হইতে পারে। কি করিবে মানুষ ঘরে বসিয়া? বলাই বাহুল্য গুজবে কিন্তু সবাই ধ্যান না দিলেও কান দিলেন। গুজব ছড়াইয়া গেল বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নিয়ম ভাঙ্গিয়া “এস গো, জ্বেলে দিয়ে যাও” করোনাখানি গাহিয়া COVID-19 কে স্বাগত জানাইতেছেন এবং তাঁহাদের কারণেই নাকি এই বিপদ এখন অতিমারিতে পরিণত হইয়াছে। এমনই হইল যেন কোনও গাজি কিম্বা খান-মোহম্মদকে ধরিতে পারিলেই রোগের প্রাদুর্ভাব কমিয়া যাইবে বা প্রতিষেধক বাহির হইয়া আসিবে।

জানা গেল গোটা বিশ্বব্যাপী নিরীহ, আপাত নিরীহ, অহংকারী, অতি অহংকারী, বলশালী, ক্ষুদ্র কিম্বা বৃহৎ দেশ মায় হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন, নাসা-র মতো নিরাপত্তার বেষ্টনীতেও পরম নিরাপদে সিঁধ কাটিয়াছে এই COVID-19; ট্রাম্পের লম্ফঝম্ফ, বরিস জনসনের আত্মগরিমা মুহূর্তে নস্যাৎ করিয়া প্রবল হুংকারে এগিয়ে চলিল; মৃত্যু মিছিল চলিল পিছু-পিছু। সেই স্থলে জাত, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ কোনটিই বিবেচ্য হইল না। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুম্ফা দুয়ার বন্ধ করিল। এমতাবস্থায় বাঁধ দিতে একমাত্র ভরসা স্থল হইল চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান চর্চা। যেখানে ধর্মীয় প্রার্থনা স্থল স্থবির সেইখানে যুক্তি গ্রাহ্য বিজ্ঞান, সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হইল। কলকারখানা, শিল্প তালুক, গণপরিবহন, দোকানপাট বন্ধ।

ইত্যবসরে এই অবকাশে প্রকৃতি নিজেকে সাজাইয়া লইল। আকাশ বাতাস মুখরিত, এত সবুজ পৃথিবী, বন-বনানী, অবলুপ্ত জীব সকলেই এই দূষণ মুক্ত পরিবেশে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল।

আমরাও সমৃদ্ধ হইলাম। কত নূতন ভাষা, শব্দ অভিধানে আসিল। জানিলাম সামাজিক দূরত্ব হইল সোশ্যাল ডিসটেনশিং। পরিযায়ী শ্রমিক হইল Migrant Labour। এতদিন পরিযায়ী মানে পাখিই বুঝিতাম। সত্যি কত জ্ঞান আহরণ করিবার সুযোগ আইল বলাই বাহুল্য। গুগুলদার সহায়তায় ইনটারনেট হইতে প্রতি বাড়িতে, অস্থায়ী ছাউনিতে সব্বাই ছোটখাটো Virologist বা নিদেন পক্ষে Immunologist-এর তকমা পাইলেন, কেহ রৌদ্রে শুকাইয়া ভাইরাস মারিতে বলেন তো কেহ আবার  শুধুমাত্র ভিটামিন সি আর হলুদ খাইয়া Immunity বাড়াইতে থাকিলেন। মুখে-মুখে ফিরিতে লাগিল এন কে সেল, ইন্টারফেরন, অ্যান্টিবডির বার্তা। এমনকি বিশেষভাবে সারিবদ্ধ করিয়া উবু হইয়া বসাইয়া কিছু ভিন রাজ্য ফেরত শ্রমিকদের উপর জেট গতিতে জীবাণুনাশক ছিটাইয়া দেয়া হইল; অনেকটা মশা মারিবার মত। মুলত প্রান্তিক মানুষগুলি সামাজিক দূরত্বের নামে সামাজিক বহিষ্কারের শিকার হইলেন। সামাজিক দূরত্ব বিভাজন, বিভেদ এবং পৃথকীকরণের কাজ করিল। শব্দটি অতি সংবেদনশীল। লক ডাউন নীতি বলবত করিতে মূলত কাজ খোওয়ানো শ্রমিক, অসহায় গৃহহীন, বি-পি-এল তালিকাভুক্ত, দরিদ্র, অভুক্ত মানুষগুলির ওপর রাষ্ট্র বল প্রয়োগ করিল। এমনটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে অভিজাত এলাকায় গৃহবন্দিদের মনোবল বাড়াইতে পুলিশ যন্ত্রানুসঙ্গ সহযোগে গান শুনাইল। একদিকে সারিবদ্ধ অনাহারক্লিষ্ট, দুশ্চিন্তাজর্জর পরিযায়ী শ্রমিক, অভুক্ত শিশু, শীর্ণ মহিলা, অন্যদিকে প্রতিদিন মোবাইল টিভি স্ক্রীনে ভাসিয়া বেড়াইতেছে সেলেবদের রান্নাঘর, খেলনাবাটি-র ছবি, সুস্বাদু খাবারের রেসিপি, কিম্বা “গেন্দা ফুলের” কোমর মে তেরা বাটারফ্ল্যাই-এর সস্তা রিমিক্স। প্রথমটি ভারত, দ্বিতীয়টি ইন্ডিয়া।

দৃশ্য: ৩

মড়কের হারের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ এখন বিভিন্ন জোনে বিভক্ত। প্রতিদিনই ভোটের ফলাফলের মতন দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার বাম দিকের খোপে কিছু সংখ্যার আনাগোনা দেখি। জোনগুলিও উৎসাহব্যঞ্জক। দ্যোতনা যুক্ত। রেড, অরেঞ্জ, গ্রীন; অর্থাৎ লাল, কমলা (গেরুয়া), সবুজ। নিন্দুকেরা যাই ভাবুন, আমার ভাবনা ভারি “স্বচ্ছ”। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী ঝাঁটা হস্তে সাফাই কর্মীদের শিক্ষা দেন, রাস্তার মাঝে বৃত্ত অঙ্কন করিয়া “বৃত্তের বাইরে” বুঝান, প্রধানমন্ত্রী মোমবাতি কিম্বা পিদিমের আলোয় আঁধার ঘোচান সেইখানে থালা বাসন বাজাইবার সময় সামান্য কোমর নাচাইলে ক্ষতি কি! এতো করোনা ফেস্টিভাল। দেশের মানুষ বরাহনন্দন, তাই তাহারা ইহার ভাল দিকটুকু লইলেন না। আফসোস রহিয়া গেল। চিকিৎসকের সুরক্ষা কবচ কিম্বা রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতিজনিত ত্রুটি তালিকার অনেক পশ্চাতে  ঠাঁই পাইল। তথাপি সদৃশ পি-পি-ই কাহার ভাগ্যে জুটিল কাহার তাহাও জুটিল না। সাধারণ কাপড়ের মুখোশে নাকমুখ আড়াল করিলেই ভাইরাসের প্রবেশ নিষেধ। কিম্বা “আরোগ্য অ্যাপ” মোবাইলে নামাইলেই কাছাকাছি ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিকে সনাক্ত করিয়া বিপ-বিপ শব্দ দিবে এমনটাই ভাবা হইল। এমতাবস্থায় ভাইরাস বাবাজীবন নিজস্ব ছন্দে, বর্ণে, গন্ধে, গীতিতে গতিশীল, প্রগতিশীল সমাজের প্রতি স্তরের রন্ধ্রে ঢুকিয়া পড়িল। রেশন দুর্নীতি, ত্রাণ বিলি এই মুল বিষয়গুলি যথাযথ ভাবে ব্যর্থ হইল। এটি না হলেই আশ্চর্য। টিভি-র পর্দায় দুর্নীতি বিষয়ক আলোচনা ঝড় তুলিয়া ঘর্মাক্ত কলেবর করিয়া তুলিল, তবুও রেশন কিম্বা ত্রাণ সব দরিদ্র মানুষগুলির কাছে পৌঁচচ্ছিল না। বিকাল হইতে সন্ধ্যা গড়াইয়া রাত অবধি কত অসুবিধা এই গৃহবন্দিদের হইতেছে তাহা মুখস্থ হইয়া গেল। কোন প্রকাশনীর বই পরীক্ষায় সাফল্যর জন্য “অন্যস্বীকার্য” অথবা বাড়ি তৈরির সময় কোন ফ্লেক্সি টি-এম-টি ব্যবহার করিবেন তাহা বিরুস্কার কথায় জনগণ বিশ্বাস করিতে শুরু করিল। গৃহবন্দি দশায় টিভি-ভিন্ন পরম বন্ধু আর কে আছে! রাষ্ট্রের চেষ্টার খামতি নাই। রাজ্য মড়ক মহামারিতে মৃত্যু পরিসংখ্যানে জল মিশানোর কাজটা প্রথম দিকে সুনিপুণ ভাবে করিতে গিয়াও অন্তিম পর্বে একটু ঘাঁটিয়া ফেলিলেন। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকের দল আসিয়া পড়িল। দিস্তা-দিস্তা চিঠিসহ নোটিস পাঠাইতে লাগিল। বলা বাহুল্য তাতে রাজ্যের গাফিলতির ইঙ্গিত স্পষ্ট। বাক চালাচালি হইল বিস্তর তথাপি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা কবচ, টেস্ট কিট সংক্রান্ত কোনও সুরাহা মিলিল না। ওপর দিকে রাজ্যপাল (পদ্মপাল?) রাজ্যের গণতান্ত্রিক প্রধানের সাথে অনেক টুকটাক বিষয়ে ক্রমবর্ধমান বাকবিতণ্ডায় জড়াইয়া পড়িলেন। অথচ কাজের কাজ কিছুই হইল না।

ইত্যমধ্যে আমেরিকা হুঙ্কার ছাড়িল তাহাদের হাইড্রক্সিক্লোরকুওনিন নামক ওষুধ লাগিবে এবং ভারত ম্যালেরিয়া প্রবণ দেশ বলিয়া তা তাহারা দিতে বাধ্য। বাধ্য অনুগত শিশুর মতোই দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা বিবেচনা না করিয়া, সুড়সুড় করিয়া তাহা দেওয়া হইল। এদিকে গৃহহীন, কর্মচ্যুত ,অভুক্ত, পরিযায়ী শ্রমিকের ঢল নামিল রাস্তায়। রাষ্ট্রের উপর ভরসা রাখিতে না পারিয়া নিরুপায় তাহারা হাঁটিয়া গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হইল। কিছুজন পথশ্রমে মারা গেল। রেল লাইন ধরে হাঁটিবার পথে ঘুমন্ত শ্রমিকদের পিষে দিল মালবাহী ট্রেন। রাষ্ট্রের কাছে ঘর ফেরতা মৃত শ্রমিক কেবল একটি সংখ্যা মাত্র। তাহাদের মুর্খামির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইল। অসীম টালবাহানার পর ও শারটল কর্কের মত রাষ্ট্র বনাম রাজ্যের পিংপং খেলায় অবশেষে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা হইল এই সেদিন। শিশু শ্রমিক জামলো মকদম; বয়স ১২, তেলেঙ্গানার লঙ্কা ক্ষেতে কাজ করিত। বাড়ি ছত্তিশগড়ের বীজাপুর। হত দারিদ্র পরিবারে লেখাপড়ার মত সৌখিনতা নিতান্ত বাতুলতা; এ আর কে না জানে! লকডাউন ঘোষণা হইতেই মালিক কাজ হইতে ছাঁটাই করিলেন। প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত, অভুক্ত, অনাহারক্লিষ্ট, আশ্রয়হীন মানুষগুলি উপায়ান্তর না দেখিয়া হাঁটিয়া নিজ নিজ গ্রামে ফিরিতে উদ্যত হইলেন। অর্থ নাই। মূল সড়ক পথে পুলিশ আটকাইল। অবশেষে বনবাদাড় ডিঙ্গাইয়া ১৫০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিবার পরিকল্পনা করিলেন জনা ১৩র একটি দল। ক্ষুধা তৃষ্ণায় শরীর ঝিমাইয়া পড়িল। বীজাপুর আর ১৪ কিলোমিটার, ১২ বছর আর যুঝিতে পারিল না। হার মানিল। মারা গেল শৈশব। কথিত আছে ভারতে নাকি শিশু শ্রম বৈধ নয়। বাস্তব কি দেখাইল তবে! এ কি তবে ভ্রম? ছত্তিশগড় সরকার অবশ্য অ্যাম্বুলেন্স পাঠাইয়া লাশ বাড়িতে পাঠাইয়া ছিলেন, এক লাখ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন! কত অনুকম্পার স্রোত বহিয়া গেল তাহা অকল্পনীয়। সর্বশিক্ষা মিশন যে শিক্ষার অধিকার আইনে বলেছিলেন সবার জন্যে শিক্ষা, তা আবার জনগণ ভুলিয়া গেলেন, স্মৃতিশক্তি বড্ডই দুর্বল কিনা! প্রাপ্য মিড ডে মিলের থেকে বঞ্চিত ১২ বছরের একটি কন্যা “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও” কর্মসূচীর তালিকা ভুক্ত কেন হইল না এ প্রশ্ন চাপা পড়িয়া রহিল। একদিনের পর দিন খবর, বাসি খবরের কাগজের ঝুড়িতে। ভাগ্যিস এই স্মৃতি বৈকল্য আছে তবেই না আবার নূতন করিয়া “ঘণ্টা খানেক সঙ্গে” কাউকে লইয়া তর্ক করিতে উদ্যত হই!       

দৃশ্য: ৪

দেখিবার কেহ রহিল না। ভাইরাস-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর শেষ অংশে পড়িয়া রহিল সেই হিংসা, দ্বেষ, গর্বিত পদলেহন, প্রান্তিক শ্রমিকের রক্ত, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, বিভেদনীতি, বৈষম্যমূলক আচরণ, অবিমৃষ্যকারি, হঠকারি সিদ্ধান্ত। যদি নূতন ভোরে কখনো আমাদের সাক্ষাত হয়, তখনও আমরা কহিব না “বিজ্ঞানের জয়” কিম্বা “চিকিৎসা বিদ্যার জয়” বরং বিনয়ের সাথেই আমরা কহিব “ভাগ্যিস আমেরিকা ছিল। উহাদের দেশে মড়ক লাগিল বলেই না আমরা মহামারিজনিত ২০ লক্ষ হাজার কোটি টাকার অনুদান পাইলাম”। আত্মনির্ভর পরিকল্পনা খাতে।

নোভেল করোনা ভাইরাস নাকি ক্ষণে-ক্ষণে রূপ বদলাইতেছে, (মিউটেশান)। তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। অন্য একপ্রকার ইনফ্লুয়েঞ্জা সৃষ্টিকারী আপদটি আসলে পৃথিবীর বুকেতে পড়িয়া নিজেরাও ধন্ধে পড়িয়াছে সন্দেহ নাই। মাফ করিবেন ঐ আত্মনির্ভর যোজনা খাতে বরাদ্দ ২০ লক্ষ হাজার কোটি, অঙ্কে লিখিতে গিয়া শূন্যের চক্করে পড়িয়া আমার আত্মা নাম খাঁচা ছাড়া হইবার জোগাড়!

প্রতীকী কার্টুন নেট থেকে সংগৃহীত

লেখক স্কুল শিক্ষক, নাট্যকর্মী, সংগীতশিল্পী এবং সমাজকর্মী

0 Comments

Post Comment