- 24 February, 2024
- 0 Comment(s)
- 374 view(s)
- লিখেছেন : খালিদা খানুম
লোকটি এলো। হসপিটালে তখন 'গ্যাদে' ভীড়। পুরুলিয়ায় 'গ্যাদে' মানে অনেক। আমি বললাম, বলুন কী সমস্যা?
সে থতমত করে বলল, পরে বলবো। বাইরে বসছি।
ভীড় কমল কিছুটা। প্রাণী মাত্র দুজন বসে আর দু একজন অফিসের লোক। আমি তাকে ডেকে পাঠালাম।
লোকটি বাইরে থেকেই মাথা নাড়লো, এখন না পরে। পরে পরে করতে করতে আরও কিছুক্ষণ গেলো।
বিরক্ত হচ্ছিলাম। অপেক্ষা করে বসে আছে অথচ বলছে না। আমি সহকারীটিকে বললাম, বাইরে গিয়ে জেনে আসুন, কী সমস্যা।
জানাতে পাঠিয়ে সমস্যা বাড়লো আরও। সে জানিয়েছে, একমাত্র দিদিমুনিকেই বলবে।
আজব ব্যাপার। হসপিটাল ফাঁকা হবে না।
আমার কাছে যারা বসেছিল তাদের বাইরে পাঠিয়ে লোকটিকে ভেতরে ডাকলাম, বললাম এবার বলেন, কী সমস্যা!
- গাই গরম হয়েছে।
আমি তাজ্জব।
- গাই গরম হয়েছে তো সবার সামনে বলতে কী সমস্যা?
- না বলা যাবে না সবার সামনে।
- সবাই তো সবার সামনে বলে, আপনার সমস্যা কী?
লোকটি কিছু বলে না।
আমি বলি - কেন নজর লেগে যাবে?
সম্মতির মাথা নাড়ায় লোকটি।
বিশ্বাস বড় আজব জিনিস। একবার এই জিনিস মাথায় ঢুকে গেলে বের করা মুসকিল হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বাস করতে করতে আমরা একটা মতবাদ তৈরি করি, বিশ্বাস করতে করতে সেই জিনিসটাকে সত্য বলে ঘোষণা করে দিই। যেমন এই লোকটি বিশ্বাস করে, গাই গরমের কথাটি সবার সামনে বলতে নেই, নজর লেগে যাবে। তো এই বিশ্বাসটি তার কাছে সত্য। কেউ কখনও কিছু বিশ্বাস করে নিলে সেটাই তখন তার আইডেনটিটি হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। যেমনভাবে ইসলামিটি বিশ্বাস করে মুসলিম, মুসলিম হয়েছে। হিন্দুত্ব বিশ্বাস করে হিন্দু, হিন্দু হয়েছে। এবং আরও অনেক কিছু 'বিশ্বাস '- এর উপর আরও অনেক কিছু দাঁড়িয়ে আছে।
যেমন একটা সময় এখানে লোকে বিশ্বাস করত, মনসা পূজার পাঁঠাকে ইঞ্জেকশন দিলে পাপ হয়। এই বিশ্বাসটা অনেক কষ্ট করে কিছুটা দূর করেছি, যদিও সেটা কেবল আমার সুবিধার জন্য। ইঞ্জেকশন- এর মাধ্যমে ঔষধ প্রয়োগে পশুর দ্রুত আরোগ্য হয়।
মনসা পুজো এই অঞ্চলের বড় পুজো। কিন্তু এবার গোল বেঁধেছে তিথিতে। জন্মাষ্টমী আর মনসাপুজো এক সাথে পড়েছে। মনসাপুজো বলি ছাড়া সম্পুর্ণ হয় না। সে পাঁঠা হোক বা হাঁস, বলি লাগবেই। কিন্তু জন্মাষ্টমী পুরো নিরামিষ। গল্প করছিল শিবানী মাহাতো। "যে পুজো-আচ্চাই হোক ঝামেলা তো সেই আমাদের, এবার দুইরকম হাঁড়ি করতে হবে, বলি বাইরে হয়, ছেলেরা করে। আমি একেবারে দেখতে পারি না। আমি এবার বলে দিয়েছি, আমি মনসা পুজোর কিছু করতে পারবো না, জন্মাষ্টমীর পুজো করতে হবে। তাও কী হবে, হবে না!
তারপর একটু থেমে বলে, এই ম্যাডাম আমরা পুজো করি তাতে কী সাপের কামড় সত্যি বন্ধ হয়? হয় না। সাপে কামড়ালে কেউ কী হাসপাতালে না নিয়ে বাড়িতে বসে থাকতে পারবে? পারবে না। তবু একটা মানত্যা, একটা বিশ্বাস চলে আসে, আমরাও করি।"
শ্রাবণ মাসে সোমবারগুলো একটা পুজো পুজো ব্যাপার চলে এখানে রাস্তাঘাটে। ছোট থেকে বড়, মেয়ে বৌবাচ্চারাও খালি পায়ে বাবা-র মাথায় জল ঢালতে যায়। বিহারিনাথে মন্দির বাঁকুড়াতে, তবে সাঁতুড়ি থেকে খুব কাছে। বিহারিনাথের পাহাড়ের সাথে ওখানের শিবমন্দির খুব বিখ্যাত। আমাদের হসপিটালের পাশের বাড়ির বৌটি গিয়েছিল বিহারিনাথে বাবার মাথায় জল ঢালতে। আমাকেও প্রসাদ দিয়ে যায়। স্বামীর সাথে গণ্ডগোল চলছে একবছর। সে ডিভোর্স চাই।
অদ্ভুত এই মানুষের বিশ্বাস। স্বামীর কাছে ডিভোর্স চাই, অথচ বাবার মাথায় জল ঢালতে যাচ্ছে!
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৪ আগস্ট ২০২২
0 Comments
Post Comment