বউ বাসন মাজিয়ে নিচ্ছে, অফিস চালু করুন স্যার  

  • 18 June, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1315 view(s)
  • লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
ঘরের কাজের দায়িত্ব ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে  পরিবারের সব সদস্যের, এটা ছোট থেকে শেখানোর সিলেবাস না আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরের বৃহৎ জীবনে। শারীরিক অবয়ব দেখে ঠিক করা হচ্ছে ছেলের কাজ আর মেয়ের কাজ। পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থা বিপদে ফেলছে ছেলেদের। তাদের থাকতে হচ্ছে পরনির্ভরশীল হয়ে।

চটুল রসিকতা হোয়াটসঅ্যাপ, সোশ্যাল মিডিয়ায়। উদাহরণ এক - লকডাউন শেষে বাচ্চাদের স্কুল খুলেছে। অভিভাবকদের সঙ্গে মিটিং করছেন শিক্ষক। এক ছাত্রীর বাবার দিকে তাকিয়ে শিক্ষক বললেন, ভালো আছেন তো?  ছাত্রীর মা বেশ কিছুটা অবাক  হয়ে জানতে চান, আমার স্বামীকে কী করে চিনলেন? শিক্ষক উত্তর দিলেন, অনলাইন ক্লাস নেওয়ার সময় প্রায় প্রতিদিন উনাকে দেখতাম ঘর মুছতে।
উদাহরণ দুই - কোন এক অফিসকর্মী বাসন মাজতে মাজতে তাঁর অফিসের বসকে ফোন করে অনুরোধ করছেন, স্যার তাড়াতাড়ি অফিস খোলার ব্যবস্থা করুন। খুব কষ্টে  আছি বাড়িতে। বস বললেন, মাসে মাসে মাইনে তো পাচ্ছো। তাহলে আবার কষ্ট কেন? অফিসকর্মী অসহায় ভাবে বলেন, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা, সব কাজ বউ করিয়ে নিচ্ছে। বস বললেন, আমার কিছু বাসন মাজা এখনো বাকি আছে।  সেগুলো শেষ করে নিয়ে তোমাকে ফোন করে এ ব্যাপারে কথা বলব।  
আবার কোন পোস্টে লিখছেন, মহিলাদের অনুরোধ করা হচ্ছে, অযথা বাড়িতে তান্ডব  করবেন না। শান্তি বজায় রাখুন ও পুরুষদের বাড়িতে টিকতে দিন।
ঘরের শান্তি, বাড়ির শান্তি, পরিবারের মানসিক শান্তি পূরণ করার পুরো দায়িত্ব যেন  মেয়েদের। 'সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে' এই মন্ত্র শিশু বয়স থেকে বাচ্চাদের মনে পোক্ত ভাবে গেঁথে দেওয়া হয়। তাই গৃহকর্মের বোঝা যতই কষ্টের হোক, যতই ক্লান্তিকর একঘেয়ে লাগুক, তবু তা মেয়েদের কাঁধেই চাপে। রান্না  করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা, ঘর সাজানো, খাবার পরিবেশন করা, পুরুষদের মন জুগিয়ে চলা সে শুধু একপাক্ষিক মেয়েদের ওপরই চাপানো হয়। ছেলেদেরও খিদে পায়, খেতে হয়। অথচ রান্না শিখতে হয় না। পোশাক পরতে হয় কিন্তু  পোশাক  কেচে গুছিয়ে রাখতে শিখতে হয় না। ঘর মোছার দায়িত্ব পড়ে না। ভার পড়ে না রুটিনমাফিক খাবার পরিবেশনের। মোদ্দা কথা পিতৃতান্ত্রিক সমাজদৃষ্টিতে গৃহের  কাজ নিম্নমানের। আর নিম্নমানের কাজ করলে পুরুষের সম্মান থাকে না। পুরুষ হবে বলশালী। বাইরের দৌড়ঝাঁপ সেরে বাড়ি ফিরবে। বাড়ির মেয়ে সদস্যরা সাজিয়ে রাখবে পুরুষদের  আরামের উপাদান। এই ভাবনা প্রসূত আমাদের সমাজ শারীরিক অবয়ব অনুযায়ী ঠিক করে রেখেছে, কে কোন কাজটা করবে। ঘরের ওসব ছোট (?) কাজ বাড়ির মহিলা  নয়তো গৃহপরিচারিকা করবেন।

তবে বিভ্রাট ঘটে করোনাকালের অসময়ে। যখন লকডাউনে গৃহপরিচারিকা আসা বন্ধ।  যখন পরিবারের সব সদস্য গৃহবন্দি। যখন বাইরে কর্মরত মহিলাকেও ঘর থেকে  অফিসের কাজ করতে হচ্ছে। বা বাইরের কাজে যুক্ত না থাকা কোন মহিলাও হতে  পারেন। যিনি একা সামলাতে পারছেন না চব্বিশ ঘণ্টা ঘরে থাকা এতগুলো মানুষের  কাজ। তখনই পাল্টে গেল অনেক বাড়ির চিত্র। লকডাউনে স্বেচ্ছ্বায় বা অনিচ্ছায় বহু পুরুষ ঘরের দৈনন্দিন কাজে অংশ নিলেন। কিন্তু অনভ্যস্ত মন তা মানবে কেন? পুরুষ করছে নিকৃষ্ট কাজ! তাই বুঝি হাসি মস্করা? অথবা ব্যথার আড়াল খোঁজা? পুরুষের বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা নিয়ে তৈরি হওয়া ভিডিও, অডিও, নানা মন্তব্য পোস্ট অথবা ফোনালাপ সমাজের এই ক্ষতকেই প্রকট দৃশ্যমান করছে।    

 তবে এই আলোচনা শুধু পুরুষরা করছেন না। মহিলাদের মুখে মুখেও চলছে। প্রতিবেশী এক মহিলা বললেন, আমার অনেক কাজ এখন বর করে দিচ্ছে। আর একজনের মুখে শুনলাম, ছেলেদের বাসন মাজতে দেখতে ভাল লাগে কী? কিন্তু এমন  বিপদ। একা আর পারছি না বলে বর আমাকে সাহায্য করছে। এই মেয়েরা তাদের বাড়ির পুরুষদের ঘরের কাজে অংশগ্রহণ করতে দেখেননি আগে। এই প্রথম স্বামী, সন্তান, বাবা বা দাদাকে ঘরের কাজে হাত লাগাতে দেখে মহিলাদের চোখেও কৃতজ্ঞতা। আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে, পুরুষ সদস্যদের ঘরের কাজ করা নিয়ে তাই  গদগদ গল্প। গৃহের সদস্যদের গৃহকাজেও সমান দায়িত্ব রয়েছে, এই বোধ থেকে শত যোজন  দূরে বাস করেন বলেই, পুরুষ ঘরের কাজ করছে এমন বিস্ময়ের ভিডিও তৈরি করতে  হয়। কোন এক সমাজকর্মী (পুরুষ) রসিকতা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন -- এখন বাসন মাজা, ঘর মোছা, কাপড় কাচার  চাকরি আমি নিতে পারবো। একজন সমাজকর্মীর চেতনা নিয়েই তখন সন্দেহ তৈরি হয় বৈকি।

আমার কাজটা বর করে দিচ্ছে বা আমাকে সাহায্য করছে এই ভাবনাটাও তো গড়ে দিয়েছে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সিলেবাস, মিডিয়া, দেশ। ঘরের কাজের দায়িত্ব মেয়ে-ছেলে নির্বিশেষে  পরিবারের সব সদস্যের এটা ছোট থেকে শেখানোর সিলেবাস না আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরের বৃহৎ জীবনে। পরিবার প্রথম বিভাজন করে ছেলের কাজ আর মেয়ের কাজ। সেখান থেকেই শুরু হয় ছেলেদের পরনির্ভরশীলতা। এরপর পাঠক্রম, সাহিত্য, গণমাধ্যমের প্রভাবে আরও স্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ হয়ে যায়। তাই যে মেয়েরা বাইরের কাজে যুক্ত নন, তাঁদের  ওপর তো ঘরের সব দায়িত্ব চাপেই। কিন্তু যাঁরা বাইরে বেরোচ্ছেন কর্মক্ষেত্রে? তাঁরা  রেহায় পাচ্ছেন ভাবারও কোন কারণ নেই। ঘর তাঁদের পিছু ছাড়ে না। যে দিনগুলি গৃহপরিচারিকা ছুটি নেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে পড়ে থাকা  কাজগুলো যতটা সম্ভব  তাঁদের করতে হয়। ঘরের চিন্তা মাথায় নিয়ে বেরোতে হয় কাজে। গৃহপরিচারিকা উপস্থিত থাকলেও যে তারা নিশ্চিন্তে বাইরের কাজ করেন তেমনটাও নয়। হয়তো তাড়াহুড়ো করে কর্মক্ষেত্রে বেরিয়ে গেছেন। ফোনে নির্দেশ দেন কোনটা রাঁধবে, কোনটা রাখবে, কার পাতে কি সাজাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন বাড়িতে যদি পুরুষ সদস্য থাকেনও। তবু ফোন করে ঘর সামলানোর দায়িত্ব মেয়েকেই নিতে হয়। মেয়েদের জন্য মেনু ঠিক করে, নিজে রান্না করে বা রাঁধুনিকে দিয়ে রান্না করিয়ে, পাত  সাজিয়ে খেতে দেওয়ার  অনুশীলন পুরুষবাবুরা করেননি। কারণ পরিবার তাঁদের শেখায়নি, সামাজিক পরিবেশ শেখার উৎসাহ দেয়নি। বরং শুনতে হয়েছে তফাত যাও, ওটা মেয়েদের কাজ। অমন কাজে হাত দিলে ছেলেদের পৌরুষত্ব নষ্ট হয়। এমন এক সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পুরুষদের বেড়ে ওঠা। বাইরে  থেকে ফিরে পুরুষ নেবেন ঘরের আরাম, সেবা। অথবা পুরুষ ঘরে বসে থাকলেও, পরিবারের মেয়ে সদস্য বাইরে থেকে এসেই তাকে যত্ন করে খাবার দেবেন, সেবা করবেন। স্কুল শিক্ষক এক মহিলা বলছিলেন, ক্লান্ত হয়ে ফিরে নিজের দিকে আর তাকানোর সময় থাকে না। স্বামী-সন্তানের খাওয়ার তদারকিতে মনোযোগ দিতে হয়। স্বামী দোকান বন্ধ করে দুপুরে বাড়ি এসে নিজের খাবার নিজে নিয়ে খান। মাঝে মাঝে সেটা এমন ভাবে  শোনান যেন আমার কাজটা উনি করে দিয়েছেন। ওঁর খাবারটা মুখের সামনে বেড়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমারই তা কথার ইঙ্গিতে মনে করিয়ে দেন। এরকম একটা  সামাজিক ফ্রেমই পুরুষদের আত্মনির্ভরশীল হতে দিচ্ছে না। তবে ব্যতিক্রম আছে। কিছু পুরুষ নিজের বোধ -বিবেচনায় অথবা অনুকূল পারিবারিক পরিবেশে এই ছক ভেঙে বেরিয়েছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম তো নিয়ম নয়। নিয়ম হল ছেলে-মেয়ে ভেদে কাজের বিভাজন হয় না। আর পুরুষদের জীবনের লকডাউনও ঘুচবে না ঘরের কাজকে  মেয়েদেরই কাজ বলে ট্যাগ দিয়ে রাখলে।   

প্রতীকী ছবি

লেখক : অধ্যাপক ও সমাজকর্মী

0 Comments

Post Comment