- 04 October, 2021
- 0 Comment(s)
- 721 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
‘ইনসুলিন’, এই শব্দটা এখন কানে শুনলেই বিপদ। মধুমেহ বা ডায়াবেটিসের দাপটে আমজনতা থেকে শুরু করে নেতা-নেত্রী-মন্ত্রী-সান্ত্রী অবধি সকলেই আতঙ্কিত। এঁদের সকলেরই কি আর ওয়াসিম আক্রমের মতো মনের বা পকেটের জোর থাকে ? এখন সেই ইনসুলিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করতে গেলেও তো প্রথমেই জানতে হবে তার গঠনতন্ত্রকে। তার রাসায়নিক বিন্যাসকে। সেই বিন্যাসকেই আবিষ্কার করেছিলেন ডরথি হজকিন। নয় নয় করে ৩৫টা বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম পেরিয়ে – তবেই তাঁর সেই সাফল্য এসেছিল। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক রাসায়নিক জৈববস্তুর গঠনকে তিনি উন্মোচিত করতে পেরেছিলেন। ফলস্বরূপ ১৯৬৪ সালে তিনি জিতে নিয়েছিলেন রসায়নের নোবেল। আজ সেই ইনসুলিন আর সাড়ে তিন দশকের অধ্যবসায়ের ইতিবৃত্ত ...
১৯১০ সালের ১২ই মে জন্ম ডরথি ক্রফুটের, পরে বিবাহসূত্রে নাম হয় হজকিন। কর্মসূত্রে তাঁর পিতা ইজিপ্টের শিক্ষাবিভাগে নিযুক্ত ছিলেন। তাই ডরথির জন্ম হয় সেদেশের রাজধানী কায়রোতে। পড়াশোনা করেছেন ইংল্যান্ডে, ছুটিতে ডরথি ও তাঁর ভাইবোনেরা বাবা-মাকে দেখতে পেতেন। ছুটি নিয়ে ক্রফুট-দম্পতি ইংল্যান্ডে ফিরতেন তখন। অনেক পরে ডরথিকে যখন তাঁর শৈশবকালের কয়েকজন ‘হিরো’র বিষয়ে বলতে বলা হয়েছিল – তিনি তিনটি নাম বলেছিলেন। তিনজনই মহিলা। প্রথমজন তাঁর মা মলি, দ্বিতীয়জন মেডিকেল মিশনারি মেরি স্লেসর, এবং তৃতীয়জন তাঁর প্রথম কলেজ ‘সমারভিল কলেজ’এর অধ্যক্ষা মার্জারি ফ্রাই। ডরথির ১৬ বছরের জন্মদিনে তাঁর মা তাঁকে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির উপরে একটি বই উপহার দেন। সেই বইটিই শেষ অবধি ডরথির জীবনকে নির্ধারিত করে দেয়। সমারভিল কলেজ থেকে রসায়নে স্নাতক হওয়ার পর, কেমব্রিজে অধ্যাপক জন ডেসমন্ড বার্নালের অধীনে তিনি পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির সাহায্যে তিনি পেপসিন-সহ অন্যান্য প্রোটিনবস্তুর রাসায়নিক গঠন নির্ণয় করতে চেষ্টা করছিলেন। ১৯৩৭ সালে ডরথি হজকিন তাঁর পিএইচডি শেষ করেন। কিন্তু এই পিএইচডির কাজগুলিই ভবিষ্যতে তাঁকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। সে খবর তখনও মহাকালের গহ্বরে, অনন্ত প্রতীক্ষায়।
১৯৩৩এ সমারভিল কলেজে রিসার্চ এ্যাসোসিয়েট হিসেবে ফিরে আসেন ডরথি হজকিন। ১৯৩৬ সালে তিনি সেই কলেজে অধ্যাপনার সুযোগ পান। চল্লিশের দশকে তাঁর গ্র্যাজুয়েট ছাত্রীদের মধ্যে একজন, মার্গারেট রবার্টস ডরথির অধ্যাপনার প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেই আকর্ষণ এতটাই ছিল যে, অনেক পরে সেই মার্গারেট রবার্টস যখন দেশের একটি উচ্চপদে আসীন হলেন – তখনও তিনি তাঁর অফিসঘরে ডরথি হজকিনের একটি ছবি টাঙিয়ে রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ততদিনে অবশ্য বিবাহসূত্রে তাঁর নাম রবার্টস থেকে পালটিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্গারেট থ্যাচার। তিনি তখন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এই ‘আয়রন লেডি’ মার্গারেট থ্যাচারই একদা সমারভিল কলেজে ডরথি হজকিনের অন্যতম ছাত্রী ছিলেন।
দেখতে দেখতে কেটে যায় ২০টা বছর। ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে, এক বসন্ত দুপুরে হঠাৎই কেমব্রিজ থেকে জরুরি তলব আসে হজকিনের দপ্তরে। রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন এবং মরিস উইলকিনসের তত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে কেমব্রিজের দুই অধ্যাপক ফ্রান্সিস ক্রিক এবং জেমস ওয়াটসন নাকি মানবশরীরের ডিএনএ’র একটি গঠনকে আবিষ্কার করেছেন। চার সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে দু’দুটি গাড়িতে চেপে সেদিন অক্সফোর্ড থেকে কেমব্রিজে ছুটেছিলেন ডরথি। সচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন মলিকিউলার বায়োলজির এক যুগান্তকারী পদক্ষেপকে। তার উচ্ছ্বাসকে অনুভব করতে চেয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে ডরথির নিজস্ব গবেষণার কাজ কিন্তু থেমে থাকেনি। পিএইচডি গবেষণার সময়ই ক্লোস্টেরাইল গোত্রের রাসায়নিকগুলির গঠন বিষয়ে তিনি উৎসাহী ছিলেন। ১৯৪৫ সালে সহযোগী গবেষক সি. এইচ. কার্লাইলের সঙ্গে যৌথ গবেষণায় তিনি ক্লোস্টেরাইল আয়োডাইডের গঠনবিন্যাস নির্ণয় করেন। ক্লোস্টেরাইল শব্দটিকে শুনতে অনেকেরই খটোমটো লাগতে পারে। তাঁদের সুবিধার্থে বলে রাখি এই গোত্রের রাসায়নিকগুলি আমাদের অতিপরিচিত যে রাসায়নিক শ্রেণিবিভাগের মধ্যে পড়ে – তাদেরকে আমরা সহজ ভাষাতে স্টেরয়েড বলে থাকি। যে স্টেরয়েড গোত্রের রাসায়নিকের এখন রমরমা ব্যবহার সর্বত্র, তেমনই একটি স্টেরয়েড গোত্রের রাসায়নিকের গঠনবিন্যাসকে নির্ণয় করতে ডরথি হজকিনই সর্বপ্রথম সক্ষম হয়েছিলেন।
সেই একই বছরে আরেক যুগান্তকারী গবেষণার নেতৃত্ব দেন হজকিন। তাঁরই উপদেষ্টায় অক্সফোর্ডের গবেষকেরা পেনিসিলিনের রাসায়নিক গঠন নির্ণয় করেন। যদিও এই গবেষণাটি ১৯৪৯ সালের আগে অবধি কোথাও প্রকাশিত হয়নি। ১৯৪৮ সালে ডরথি হজকিন ভিটামিন বি-১২এর রাসায়নিক গঠন নির্ণয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। একান্ত পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে তারও রহস্যভেদ করতে সক্ষম হন হজকিন। পদার্থবিদ লরেন্স ব্র্যাগ এই আবিষ্কারটিকে নিয়ে কার্যত শিশুর মতোই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। ১৯৫৫ সালে ভিটামিন বি-১২এর সম্পূর্ণ রাসায়নিক গঠনটিকে নির্ণয় করেন ডরথি। এই আবিষ্কারের জন্যই ১৯৬৪ সালে তিনি রসায়নের নোবেলে সম্মানিত হন।
এরপর আসে ইনসুলিনের আবিষ্কার। ১৯৩৪ সালে পিএইচডি গবেষণার সময়ই রবার্ট রবিনসন, ডরথি হজকিনকে কেলাসিত ইনসুলিনের একটি ছোট্ট নমুনা পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন। এই সময়ই নতুন এই পদার্থটির এমন জটিল গঠন এবং মানবশরীরের উপরে তার এতখানি সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে ডরথি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু ইনসুলিনের এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির পর যে জটিল রাশিতথ্যের পাহাড়কে কেটেকুটে তার বিন্যাসটিকে নির্ণয় করতে হতো, সেটা ১৯৩৪ সালে দাঁড়িয়ে সাধারণ গণনপদ্ধতির সাহায্যে করাটা অসম্ভব ছিল। এরই জন্য ডরথি অপেক্ষা করে থাকেন আরও সাড়ে তিন দশক। ১৯৬৯এ অবশেষে আধুনিক কিছু গণনাপদ্ধতির সূত্রপাত হলে - অল্পবয়সী, তরুণ একগুচ্ছ নতুন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে হজকিন আবার নতুন করে তাঁর ইনসুলিন-রহস্য উদ্ধারের কাজে নেমে পড়েন। এই গবেষণা চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে এক বিপ্লব নিয়ে আসে। ডরথিদের গবেষণার কারণেই কৃত্রিম উপায়ে ইনসুলিন উৎপাদন সম্ভব হয়। এছাড়াও তার রাসায়নিক গঠন, রাসায়নিক ধর্ম, মানবশরীরে তার প্রভাব ইত্যাদিকে নিয়ে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন ডরথি হজকিন।
এতকিছুর পরেও বিতর্ক তাড়া করেছে তাঁকে। স্বামী থমাস হজকিন অথবা গুরু জন বার্নালের কমিউনিস্ট-সখ্যতার কারণে ১৯৫৩ সালে সিআইএ’র অনুমতি ছাড়া তাঁর মার্কিন মুলুকে প্রবেশের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তিনি পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। একাধিক বার চীনদেশে যাওয়ার কারণে তিনি নিজে সেখানকার বিজ্ঞানীদের উপরে বহাল থাকা নানা সরকারি বিধিনিষেধের গণ্ডিকে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। বেশ কিছু চীনা বৈজ্ঞানিককে তিনি আন্তর্জাতিক একাধিক সংগঠনের সদস্য করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। মহীয়সীরা বোধহয় এরকমই হয়ে থাকেন। তাঁদের সবটুকুতেই যে ‘ইনক্লুসিভনেস’। তাঁরা যে সকলকে নিয়ে চলতে ভালোবাসেন।
... তাঁদের যাত্রা কেবল সত্যের অভিমুখে, জ্ঞানের প্রয়োজনে, আনন্দের উদ্ভাসে। ১৯৯৪ সালের ২৯শে জুলাই ইংল্যান্ডে পরলোকগমন করেন ডরথি হজকিন। পৃথিবীর জন্য তিনি রেখে গেলেন ‘ইনসুলিন’এর রাসায়নিক বিন্যাস – যে বিন্যাস থেকেই কৃত্রিম ইনসুলিনের জন্ম। যে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন আজ হাজার হাজার মানুষকে লড়াই করতে সাহায্য করছে। অবদান তো এমনই হওয়া উচিত!
সূত্রঃ
[১] ডরথি মেরি ক্রফুট হজকিন, ‘এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি এ্যান্ড দ্য কেমিস্ট্রি অব দ্য স্টেরলস’, পিএইচডি ডিসার্টেশন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৭
[২] জুডিথ এ্যানি ক্যাথলিন হাওয়ার্ড, ‘টাইমলাইনঃ ডরথি হজকিন এ্যান্ড হার কন্ট্রিবিউশনস টু বায়োকেমিস্ট্রি’, নেচার রিভিউস মলিকিউলার সেল বায়োলজি, খন্ড ৪, সংখ্যা ১১, ২০০৩
[৩] জন ব্লান্ডেল, ‘মার্গারেট থ্যাচার – এ পোর্ট্রেট অব দ্য আয়রন লেডি’, ২০০৮
[৪] জর্জিনা ফেরি, ‘ডরথি হজকিনঃ এ লাইফ’, গ্রান্টা বুকস, লন্ডন, ১৯৯৮
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক
ছবি: সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment