- 03 July, 2023
- 0 Comment(s)
- 176 view(s)
- লিখেছেন : গোলাপসা খাতুন
সমাজে যে সব কুকর্ম বিদ্যমান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি সামাজিক ব্যাধি হল বিবাহের সময় পণ দাবি করা। বিবাহ হল একটি সামাজিক চুক্তি, যার উদ্দেশ্য সংসার করা, সন্তান উৎপাদন করা এবং তাকে বৈধতা প্রদান করা। পিতৃতন্ত্র নারীর জন্য যে পেশাটি রেখেছে তা হল বিয়ে বা সংসার। এটাই একজন নারীর নির্ধারিত নিয়তি বলে তারা মনে করে। এর মধ্য দিয়েই তার বিস্তৃত জীবন সংকুচিত করে মনুষ্যত্বকে ছেঁটে ফেলে তাকে এমন এক প্রাণীতে পরিণত করা হয় যা সম্ভাবনাশূন্য অবিকশিত। এই বিবাহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে এই পণ নামক ব্যাধিটি। আধুনিক ভারতীয় আইনে Dowry বা পণের লক্ষণ দেওয়া হয়েছে Dowry বা পণকে বরপণ বা কন্যাপণ উভয় অর্থেই স্বীকার করে নিয়ে। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে Dowry Prohibition Act–এ Dowry শব্দটির পারিভাষিক অর্থ করা হয়েছে এই ভাবে –
Dowry means any property or valuable security given or agreed to be given either directly or indirectly by any party to a marriage to the other party to the marriage or by the parents of either party to a marriage or by any other person; to other party to the marriage or to any other person, at or before or after marriage as consideration for marriage of the said parties.
অর্থাৎ বিয়ের সাথে যুক্ত যে কোনও এক পক্ষ পিতা মাতা বা দুপক্ষের যে কোনও ব্যক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিয়ের সময়, বিয়ের আগে বা বিয়ের পর কোনও সম্পত্তি বা মূল্যবান দলিল দেয় বা দেবার অঙ্গীকার করে তাহলে সেটা পণ হিসাবে গণ্য হবে।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিবাহ সম্পর্কিত এই পণ বা শুল্ক বোঝাতে নানা শব্দ ব্যবহার হয়ে থাকে। দিও পণ শব্দটি প্রতিজ্ঞা অর্থেই বেশি ব্যবহৃত হয়। বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে পণ শব্দটিকে ‘দহেজ’ শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়ে থাকে। মারাঠিভাষিদের মধ্যে কন্যা শুল্ক ও বরকটনম্ আবার কেরালায় বরপণ অর্থে স্ত্রীধন শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিবাহের সঙ্গে যুক্ত হলে অবশ্য পণ শব্দের মানে কখনও কন্যাপণ বা Bride Price আবার কখনও Dowry বা বরপণ।
কন্যাপণ সম্পর্কে বলতে গেলে এথেন্সের কথা এসে পড়ে যেখানে বাগ্দান অনুষ্ঠানে কন্যাপণের অর্থ বুঝে নিয়ে তবেই কন্যাকে বরের হাতে তুলে দেওয়া হত। এথেনীয়দের কাছে এই কন্যাপণ ছিল বিবাহিত নারীর সামাজিক মর্যাদার সূচক। ওডিসি (XV:367) মহাকাব্য থেকেও জানা যায় যে, কন্যাপণ বিধি মতো কন্যার পিতাকেই দেওয়ার নিয়মের কথা। ঐতিহাসিক যুগে কন্যাপণের অর্থ সবসময় কন্যার নিজস্ব ধন হিসাবেই দেওয়ার নিয়ম ছিল। প্রাচীনকালে কন্যাপণ নির্ধারিত হত উভয় পক্ষের সম্মতি অনুসারে। প্রাচীন গ্রিসের আইনে গোরুর বিনিময়ে কন্যা ক্রয় হত। এই কেনা বেচার পদ্ধতির নাম ছিল Bargain। চিনেও এই ধরণের কন্যাপণের কথার উল্লেখ রয়েছে যেখানে দেখা যায় যে, বিবাহের অনুষ্ঠান পণ না পাওয়া পর্যন্ত শুরু হত না। সাধারণত অর্থমূল্যে কন্যাপণ দেবার রীতি ছিল। তবে কখনও কখনও সোনা, রূপো, ব্রোঞ্জ, কাপড়, দামি সিল্ক, ঘোড়ার জিন, গোরু, শূকর, চাল, ফল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও কন্যা পিতাকে কন্যাপণ হিসাবে দেওয়ার নিয়ম ছিল। তবে হামুরাবির অনুশাসন থেকে জানা যায়, কন্যাপণ এক ধরনের সেই সময়কালের সামাজিক প্রথা হলেও এর প্রয়োগ সার্বত্রিক ছিল না। প্রাচীন ইস্রায়েলে কন্যাপণের সংজ্ঞা ছিল ‘মোহর’ বা ‘ডাওয়ার’। Old Testament-এ দেখা যায় জাকোব, রাচেলকে বিবাহ করার জন্য সাত বৎসর শ্রমদান করেছিল। প্রাচীন আরবদের মধ্যে বিবাহের সময় কন্যার পিতাকে মোহর দিত। ইসলাম ধর্ম প্রবর্তিত হবার পর এই ধন সাদাক্ এর সাথে অভিন্ন হয়ে গিয়েছে। এই মোহর বা সাদাক্ হল বিবাহের সময় স্বামীর স্ত্রীকে দেবার কথা। অনেক ক্ষেত্রে অর্থ না থাকলে সেই মূল্যের জমি ইত্যাদিও অনেকে ধার্য করেন। ইসলামে দেনমোহর বা মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ দশ দিরহাম করা হয়েছে। যদিও তা ইসলামের আইন অনুসারে। বর্তমানে বাড়ির রীতি অনুসারেও দেনমোহর ধার্য হয়। পরিবারে হয়তো ৫০০ টাকা দেনমোহর আছে, সেটা কয়েক পুরুষের নিয়ম ১০০ বছর আগে সেটি দেওয়া হত। এখনও অর্থাৎ বর্তমান সময়েও সেই পরিমাণ টাকায় দেওয়া হয়। মোহর সাধারণত দুই ধরনের হতে পারে – মুআজ্জল অর্থাৎ যা বিবাহের সময়ই স্ত্রীকে দেওয়া হয় এবং মুওয়াজ্জল – যা পরে (বিবাহের) দেবার আশ্বাস দেওয়া হয়। দ্বিতীয় প্রকারের মোহর বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামী মারা গেলে স্ত্রী দাবি করতে পারে তবে এটা তিন বছরের মধ্যে করতে হবে। বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামী মারা গেলে এই মোহর নীড়ের ডিমের মতো কাজ করে যা দিয়ে সে অর্থাৎ একজন মহিলা নতুন জীবন শুরু করতে পারে, তবে এর অর্থ প্রদান কার্যকর করার জন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা না থাকায় খুব কম মহিলাই এটি ভোগ করতে পারেন। ইসলামিক নারীবাদীদের মতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বামীর মৃত্যুর পর যদি শ্বশুরবাড়ির কাছে কোনো মহিলা মোহর বা সম্পত্তির অধিকার দাবি করে তাহলে তাকে বিশ্বাস করিয়ে দেয় তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যে তার এই মোহর বা সম্পত্তির ভাগ চাওয়াটা পাপ, এসব চাইলে তার স্বামীর আত্মা কষ্ট পাবে। এসব শুনে বেশিরভাগ মহিলারাই আর নিজেদের অধিকার চায় না। সামাজিক ও আইনের দৃষ্টিতে স্ত্রীকে দেনমোহর নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেনমোহর পেয়ে থাকেন খুব অল্প সংখ্য মহিলারাই। বিয়ের সময় শ্বশুর বাড়ি ও বাবার বাড়ির লোকজন এবং আত্মীয় স্বজনরা নবদম্পত্তিকে যে সমস্ত উপহার দেন তা সব কিছুই ‘স্ত্রীধন’ নামে পরিচিত। একান্তভাবে তাতে নারীরই অধিকার থাকে। কিন্তু সেই সমস্ত কিছুই শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই নিয়ে নেয়।
Dowry Prohibition Act-এর শেষাংশে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কোনও প্রকার প্রীতি উপহার এর আওতায় পড়বে না। ভারত সরকার আইনে পণ ও প্রীতি উপহারকে এক করে ফেলেনি। অবশ্য একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই আইনের প্রয়োগের দূর্বলতা এখানেই। লোকে প্রায়ই প্রীতি উপহারের নাম করে পণ নিচ্ছে এবং আইন সেক্ষেত্রে কার্যকর হওয়ার সুযোগই পাচ্ছে না। এই কারণে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে Dowry Prohibition Act-এর যে সংশোধন করা হয়েছে তাতে উপহারের একটি তালিকা রাখতে বলা হয়েছে এবং উপহারের একটি তালিকা রাখতে বলা হয়েছে এবং উপহারের পরিমাণ কোনো মতেই যেন দাতার আর্থিক সংগতির উপর চাপ সৃষ্টি না করে সেদিকে নজর দিতে বলা হয়েছে। ভারতে নারীর স্থান নিরূপণের জন্য সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে ভারত সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সেই কমিটি তার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেখানে কন্যাপণ অর্থে ‘Bride Price’ এবং বরপণ অর্থে ‘Dowry’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এই উভয় পণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে –
“Two major types of transfer of material wealth accompany marriage in one the wealth travels towards the opposite direction of the bride and in another at travels alone with the bride in the same direction. The former is bride price and the latter is Dowry. They need to be considered as accomponents of marriage because of their implication for the status of women. Technically Dowry is what is given to the son-in-law or to his parents on demand either in cash or in kind.”
সমীক্ষা অনুসারে Dowry তিনটি উপায়ে প্রধানত নেওয়া হয়ে থাকে –
ক) কন্যাকে স্ত্রীধন হিসাবে যা দেওয়া হয় তার প্রকার ও পরিমাণ পূর্বেই নির্ধারিত হয় কখনও প্রকাশ্যে আবার কখনও খুব গোপনীয়তা বজায় রেখে পাত্রপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এটা কন্যাকে দেওয়া হলেও এর উপর নিয়ন্ত্রণ কন্যার থাকে না।
খ) বিবাহের সময় অথবা তার আগে পাত্রকে যা কিছু দেওয়া হয়।
গ) বরের পিতামাতা ও নিকট আত্মীয়দের যা কিছু দেওয়া হয়। যদিও বিবাহের অনুষ্ঠান শেষ হলেও এই পণ পর্বের অনুষ্ঠান কিন্তু থামে না, এই দীর্ঘস্থায়ী প্রীতিদানের উপর শ্বশুরবাড়িতে কন্যার মর্যদা অনেকখানি নির্ভর করে বলে কন্যার পিতামাতা এই বিপুল ব্যয়ভার বহন না করে পারেন না। বরপণের অর্থবিস্তৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে কমিটি শ্রীযুক্ত তাম্বিয়ার একটি মন্তব্য দিয়ে নিজ বক্তব্য সমর্থন করেছে (Towards Equality, p. 11/3.192) : ‘Dowry is not one isolated payment but one array of gifts given over time but it is also clear that amongst the way of payment that constitute Dowry, that given at the time of marriage is most important and conspicuous.’
এবার আসি উনিশ শতকের কিছু পণপ্রথা জনিত সমস্যার আলোচনায়। উনিশ শতকে সমাজ সংস্কারকরা যে সব নারীকেন্দ্রিক সামাজিক সমস্যা তুলে ধরেছিলেন, পণপ্রথা তার মধ্যে ছিল না। সতীদাহ, বিধবাবিবাহ, সঙ্গমের জন্য সম্মতির বয়স ইত্যাদির তুলনায় পণপ্রথা সমস্যা হয়তো অনেক ছোটো মনে হয়েছিল। তবে পণপ্রথার প্রভাব যেহেতু বিবাহিত জীবনে সুদূরপ্রসারী এর সামাজিক সমস্যাগুলি সাহিত্যেও আলোচিত হতে দেখা গিয়েছে। বঙ্কিমের প্রফুল্ল গরিব বিধবার মেয়ে, অতএব সে বিতাড়িত হয়ে পরিণত হয়েছে দেবী চৌধুরাণীতে। যৌতুক বা পণের কথা এখানে উহ্য কিন্তু সমাজে ক্ষমতার যে বৈষম্য পণপ্রথাকে টিকিয়ে রেখেছে, সেটি দেবী চৌধুরাণীতে খুব ভালো ভাবে ফুটে উঠেছে শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁদের পরবর্তী কথাশিল্পীরা অনেকেই এই সামাজিক বিভীষিকাকে তুলে ধরেছেন, তাঁদের কথা মিলেছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা ধরনের গল্পের সন্ধান। যা অত্যন্ত মর্মান্তিক। পণপ্রথা সমাজসংস্কারকদের প্রধান প্রধান বিষয়গুলির অন্তর্ভুক্ত না হলেও এর প্রভাব অনেক বেশি সমাজে লক্ষণীয়। মেয়েদের হীনমন্যতা অনেক বেশি সূচিত হয় এই যৌতুক প্রথার থেকে। মেয়ে মানেই হচ্ছে প্রতিটি সমাজে কন্যাদায়। তাকে ‘পার’ করতে হবে বিয়ে দিয়ে। কারণ বিয়ে না হলে মেয়েদের জীবন বৃথা বলে মনে করা হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আলোচনা সভাতে আশাপূর্ণা দেবী বলেছিলেন – বিয়ে যেন শুধু মেয়েদেরই হয় এবং প্রয়োজন যেন শুধু তাদেরই যে সাজ-সরঞ্জামের ভরতুকি দিয়ে তাদের বিয়ের আসরে নামাতে হয়।
স্ত্রীভ্রূণ হত্যা থেকে বধূহত্যা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের পেছনে রয়েছে পণপ্রথার করাল ছায়া। মেয়েদের সামাজিক মূল্য এতই কম যে তাকে টাকা পয়সা গহনা গাটি আসবাবপত্র দিলে তবেই তাকে একটি সংসারে নেওয়া যেতে পারে। যদিও বাবা-মা ভাবেন মেয়ের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তাঁরা খরচ করবেন। অতএব মেয়ের জনমের আগে থেকেই বাবা মায়ের চিন্তা থাকে ঐ টাকা কীভাবে জোগাড় করবেন।
‘On Kidneys and Dowry’ নামক আলোচনাতে সি.এস. লক্ষ্মী একটি গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন যে, কীভাবে একটি কারখানাতে সুপার ভাইজার পদে কর্মরত একজন ব্যক্তি তাঁর একটি কিডনি দশ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে ছিলেন তাঁর তিনমেয়ের পণের জোগাড়ের কারণে। শুধু তাই নয় ঐ টাকা ব্যাংকে সুদে খাটিয়েছিলেন। তাঁর মেয়েরা জানতেই পারল না কি মূল্য দিয়ে তাদের বাবা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের স্থায়ী সুখ কিনতে গিয়েছিল। তবে অনেকে এমন আছেন যাঁরা পণপ্রথাকে মেয়েদের সহায়ক বলে মনে করেন। ‘মানুষী’ পত্রিকার সম্পাদিকা মধু কীশ্বরের মতে যে সম্পত্তিতে সমান অধিকারের লড়াই আসল, যতদিন সেটা আদায় না হচ্ছে ততদিন পণপ্রথা বিরোধী আন্দোলন যে শুধুমাত্র কার্যকরী হবে না তাই নয়, পণ থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করাটা হবে নারীস্বার্থের পরিপন্থী। এই বক্তব্যের বিতর্কে সি.এস. লক্ষ্মী জবাব দিতে গিয়ে বলেছিলেন মধু কীশ্বরের যে বক্তব্য তার মধ্যে একটি ভাব রয়েছে সেটি হল পণের টাকা পয়সাতে মেয়েদেরই অধিকার, কিন্তু চারপপাশে সমাজের অবস্থাটা তাকিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে এই বিশ্বাস জাগিয়ে রাখা কঠিন কাজ। কারণ স্ত্রীধন যাতে মেয়েদেরই অধিকার আছে – লিখে দেওয়া হলেও সচরাচর মেয়েদের অধিকার থাকে খুব কম ক্ষেত্রে। আইনে যাই বলা থাক না কেন মেয়েদের হাতের বাইরে রয়েছে – সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ এবং সেই সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়গুলিও। সুতরাং স্ত্রীধনের দোহাই পেড়ে – পণপ্রথাকে মেনে নেওয়ার প্রায় কোনো অর্থ হয় না। এর সব থেকে ভালো উদাহরণ হল দেবযানী বণিক। পণের ব্যাপারে নারী সংগঠনের দিক থেকে একটি চাহিদা ছিল যে বিবাহের সময় মেয়েদের কিছু দিলে সেটি মেয়েদের নামে লিখে দিতে হবে, যাতে সেই সম্পত্তির ওপর তার নিজস্ব অধিকার বজায় থাকে। কিন্তু এও মেয়েদের শেষে বাঁচাতে পারেনি। দেবযানী বণিকের নামে তার বাবা টাকা লিখে দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও দেবযানীর ওপরে চাপ আসতে থাকে আরও টাকার জন্য যদিও এবারে শ্বশুরের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে নির্যাতন করতে করতে মেরেই ফেলা হয়েছিল। এরকম বহু মেয়েদের মেরে ফেলা হয় শুধুমাত্র কিছু পণের দাবি মেটাতে না পারার জন্য। Government of India-এর Ministry of Home Affairs প্রদত্ত একটি রিপোর্ট যেটি ২৫.০৬.২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে জানা যায় পশ্চিমবঙ্গে পণপ্রথা জনিত কেসে দেখা গেছিল ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫০১টি কেস রেজিস্টার হয়েছিল, তারমধ্যে ৯৯৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং দোষী প্রমাণিত হয়েছিল ৪৩ জন, কেবলমাত্র এটি ২০১৪ সালে। আবার ২০১৫ সালে ৪৯৮টি কেস নথিভুক্ত করা হয়েছিল ৮৩৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কিন্তু দোষী বলে প্রমাণিত হয়েছিল মাত্র ৩০ জন। ২০১৬ সালেও দেখা যায় ৫৩৫টি কেস নথিভুক্ত হয়েছিল তার মধ্যে ৮৮৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, আর দোষী প্রমাণিত হয়েছিল মাত্র ৪৬ জন। পুরো ভারতে ২০১৪ সালে কেস নথিভুক্ত হয়েছে ৮৪৫৫টি, দোষী বলে প্রমাণিত হয়েছে মাত্র ৪০৫৪ জন। একইভাবে ২০১৬ সালে মোট পণপ্রথাজনিত কেস নথিভুক্ত হয়েছিল ৭৬২১টি, দোষী বলে প্রমাণিত হয়েছে মাত্র ৩৪০০ জন। এই অধিকাংশ কেসেই দেখা যায় উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে আবার অনেকে টাকার জোরে ছাড়া পেয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে তো কেসগুলো নথিভুক্ত করা হয় না এমন ঘটনাও সমাজে প্রচুর চাপা পড়ে সময়ের সাথে হারিয়ে যায়।
পণপ্রথা আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিষয় হল ৪নং ধারা যেখানে রয়েছে পণ দাবির জন্য শাস্তি। এই ধারায় বলা হয়েছে যদি কোনও ব্যক্তি বর বা কনের পিতা বা আত্মীয় বা অভিভাবকের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পণ দাবি করে তাহলে কম পক্ষে ছয় মাস (এমনকি দুবছরও হতে পারে) কারাদণ্ড এবং দশহাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এই আইনের ৫নং ধারায় পণ দেওয়া ও নেওয়ার যে কোন চুক্তি বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ৬নং ধারা অনুযায়ী বিবাহ সম্পর্কিত যে কোনও উপহার যদি অন্য কেউ নিয়ে থাকে তাহলে সেগুলি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে মহিলার বিয়ে উপলক্ষ্যে নেওয়া হয়েছিল তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি ঐ মহিলা মারা যান তাহলে তার সন্তান কিংবা তার পিতামাতাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। ৭নং এবং ৮নং ধারায় পণ দেওয়া নেওয়ার অপরাধের জন্য আদালতের ক্ষমতা ও কার্যপ্রণালির কথা বলা হয়েছে। ৯নং ও ১০নং ধারায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিধি তৈরির ক্ষমতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
১৯৬১ সালের পণপ্রথা রোধ আইন যে সেভাবে বাস্তবে কার্যকর হয়নি সেটা ভারতের ক্রম বর্ধমান বহু ঘটনা যেমন – বধূহত্যা, বধূ আত্মহত্যা বা বধূর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে দিয়েই দেখতে পাই। এই আইনের কঠোরভাবে প্রয়োগের উদ্দেশ্যে ১৯৮৬ সালের ফৌজদারি সংশোধন আইনের মাধ্যমে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ৩০৪বি নামে একটি নতুন ধারা যুক্ত করা হয়। এখানে প্রথম অংশে বধূহত্যার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, যে কোন মহিলার বিবাহের সাত বছরের মধ্যে – (ক) যদি প্রমাণ হয় যে মৃত্যুর আগে ঐ বধূর ওপর তার স্বামী বা স্বামীর কোনো আত্মীয় অত্যাচার করেছিল অথবা (খ) যদি পণের দাবির কারণে বা ফলস্বরূপ ঐ বধূর মৃত্যু হয় কোনও অস্বাভাবিক ঘটনায় যেমন অগ্নিদগ্ধ হলে বা দৈহিক আঘাত ইত্যাদি তাহলে সেটা পণজনিত মৃত্যু বলে গণ্য হবে।
পণজনিত অপরাধ যেহেতু বাড়ির অভ্যন্তরে ঘটে এবং অপরাধীরা victim–এর আত্মীয়, স্বামী, শাশুড়ি বা ননদ, জা একই ছাদের তলায় বসবাস করে। সেইজন্য প্রত্যক্ষদর্শী কোনও সাক্ষী অপরাধ প্রমাণে এগিয়ে এসে সত্য ঘটনা প্রকাশ করতে পারে না। ১১৩বি ধারায় বলা হয়েছে তাই যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে কোনও বধূর মৃত্যুর পূর্বে কোনো ব্যক্তি পণের দাবিতে ঐ বধূর উপর নির্যাতন বা অত্যাচার করেছে তাহলে আদালত ধরে নেবে যে ঐ ব্যক্তিই হত্যার জন্য দায়ী।
১৯৬১ সালের আইনটি বাস্তবে কার্যকরি না হওয়ায় পার্লামেন্টে ১৯৮৩ সালে ভারতীয় দণ্ডিবিধ ১৮৬০ এবং ভারতীয় সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ সংশোধনী করে (১৯৮৩ সালে) ভারতীয় দণ্ডবিধির মধ্যে ৩০৪বি ও ৪৯৮-এ এই দুটি ধারা ফৌজদারী বিধির প্রয়োগ বিবাহিত মহিলাদের পক্ষে সহজতর করার লক্ষ্যে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করার মত। অনেকে আবার ৪৯৮-এ ধারাটি অপব্যবহারের সুযোগ থাকায় অনেকেই এই ধারাটির পূর্ণমূল্যায়নের কথা বলেছেন। ১৯৮৩ সালে ফৌজদারি সংশোধনী আইনটি যদিও কিছুটা হলো মহিলাদের প্রতি অত্যাচার কমাতে সচেষ্ট হয়েছিল। তবে সেই সংখ্যাটা খুবই অল্প। সময়ের সাথে সাথে আমরা আধুনিক হয়েছি তবে এই আধা শিল্পায়িত সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থার যেমন কোনো উত্তরণ ঘটেনি আবার অন্যদিকে নয়া ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি আমাদের উপর চেপে বসেছে। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বর্তমান সমাজে হু হু করে বেড়ে চলেছে। এই আধুনিক পণপ্রথা আর আগেকার মতো মাত্র কয়েক হাজার টাকা বা কয়েক ভরি সোনাতে সন্তুষ্ট থাকেনি – বাড়ি, গাড়ি, মোটর সাইকেল ইত্যাদি ইত্যাদি তবে ঘড়ি, আংটি এসব কিছু বাদ দিয়ে নয়। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কেবলমাত্র বাইরের জিনিস নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বিশেষ মূল্যবোধ। পণের চাহিদার শিকার তাই অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা নিজেরাই। বহু পণপ্রথাজনিত ঘটনা নথিভুক্ত হয় না আবার যে ঘটনাগুলি রেজিষ্টার হয় তার অল্প সংখ্য বক্তিই দোষী বলে প্রমাণিত হয়। বাকিরা উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। পণ নেওয়া দেওয়া অপরাধ হলেও সমাজের চোখে এটি কোনো ব্যাধি নয়, এটি বিবাহের একটি মূল্যবান রীতিনীতি বলে ধরে নিচ্ছে। বর্তমানে দেখা যায় পাত্রপক্ষ পাত্রীপক্ষকে বিবাহের জন্য বলেন আপনারা মেয়েকে যা কিছু ভালোবেসে দেবেন, আমাদের কোনো দাবি দাওয়া নেই। আসলে মেয়েকে দেন এটা তারা বলেই দেয় এবং পরবর্তীকালে মেয়েকে দেওয়া সমস্ত কিছুকেই তারা হাতিয়ে নেয় কোনো না কোনো কারণে। সমাজ ব্যবস্থা পাল্টেছে ঠিকই তবে সমাজে প্রচলিত পণপ্রথার ধরনটা বদলেছে, পণপ্রথা বন্ধ হয়নি। পণের আড়ালে ভোগ্যপণ্যে চাহিদা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। যার কারণে কত বিপুল সংখ্যক মহিলাকে প্রাণ দিয়ে সেটা শোধ করতে দেখা যাচ্ছে। কিছু ঘটনা পেপার, নিজ চ্যানেল, টিভিতে, খবরের কাগজে আবার এমনকি যেখানে বাস করি ঠিক পাশের বাড়িতেই পণপ্রথাজনিত হত্যার খবর শুনতে পাই আবার কিছু ঘটনা সামনেই আসতে পারে না, আবার সামনে এলেও কিছু সময়ের সাথে চাপা পড়ে যায়, তাদের কোন কেস ফাইল হয় না এ যেন দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিনের চলতি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে আইন তো আছে তবে বাস্তবে সেটি প্রতিফলিত হতে খুব কমই দেখা যায়। তবে আইনটি হয়তো পরবর্তী প্রজন্মকে পণপ্রথা নিবারণের পথে এগিয়ে আসতে সাহায্য করবে এটিই আমাদের আশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পণপ্রথা প্রসারিত হওয়ার জন্য মূখ্যত দায়ী পণগ্রহীতার লোভ ও আত্মমর্যদাহীনতা। জীবনের সর্বস্তরে নারী পরাধীন এবং কন্যা অরক্ষণীয়া এই বোধ সঞ্জাত কন্যাপিতা ও কন্যার হীনমন্যতা। জীবনের সর্বস্তরে নারী কোনও না কোনও পুরুষ অভিভাবকের অধীনে থাকবে এই উপদেশও রয়েছে (মনুস্মৃতিতে)। যুগের পরিবর্তনে মেয়েরা লেখাপড়া শিখে উপার্জনক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কিছুতেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না, গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কর্মে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও যোগ্যতার নিরূপণে দ্বিধাগ্রস্ততা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। বিবাহ ছাড়া যে বিকল্প কোনো কথা মেয়ে বা মেয়ের পিতা ভাবতে পারছে না। মেয়েরা যতদিন না পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবার মতো মানসিকতা অর্জন না করবে এবং অভিভাবকরাও সেই মর্মে মেয়েদের শিক্ষিত না করবেন ততদিন পণপ্রথা উঠতেই পারে না। অন্যদিকে ভারতবর্ষের বর্তমান প্রজন্মের উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা, যাঁরা উচ্চপণ নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছেন, তাঁদেরও আত্ম সমীক্ষার প্রয়োজন আছে। এমন অনেক খবরও রয়েছে যে মুখ্যমন্ত্রী প্রদত্ত কন্যাশ্রীর টাকা নিয়ে ছেলেপক্ষকে পণ দেওয়া বা যৌতুক দেওয়া হয়। সেই সব দিকগুলিও আমাদের ভাবতে হবে আমরা কী অপরাধ করছি অর্থাৎ সেক্ষেত্রেও আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন আছে।
পণপ্রথা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সফলভাবে উদ্যোগ নিতে পারে ছাত্র যুব সংগঠন, মহিলা সমিতি, বিভিন্ন মহিলা সংগঠন এবং প্রচার মাধ্যমগুলি। এদের মাধ্যমে বর্তমান পণ প্রতিষেধক আইনের উল্লেখযোগ্য ধারাগুলি সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা যায়, নিজ নিজ এলাকায় বিবাহ অনুষ্ঠানে পণ নেওয়া বা দেওয়া হচ্ছে কী না সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। কিছুকাল যাবৎ একটি পত্রিকা নিয়মিতভাবে বিনাপণে বিবাহের ঘটনা প্রচার করছিল। আরও জানা গিয়েছে হাওড়ার একটা গ্রামে একটি সংগঠন বিনাপণে বিবাহের আয়োজন করে থাকে। মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মধ্যে পণের হাত থেকে উদ্ধার পেতে গণবিবাহ প্রথা চালু হয়েছে। উল্লেখ্যযোগ্য সংবাদ হল বিবাহের আসরে বর পণের পরিমাণ বাড়াবার দাবি করায় সদ্য পরিণীতা বধূটি দৃঢ়চিত্তে সেই বিবাহ অস্বীকার করেছে। এই অনন্য সাধারণ দৃশ্য যদি দেখে দেশের অন্য তরুণীরা উদ্বুদ্ধ হয় তবে পণপ্রথার উচ্ছেদ ত্বরান্বিত হবে তাতে সন্দেহ নেই। সমাজে কোলিন্য প্রথার মতো অপপ্রথাও দীর্ঘকাল আধিপত্য করেও অবশেষে বিদায় নিয়েছে যেমন তেমনি পণপ্রথাও অনুরূপ ভাবে একদিন সমাজ পট থেকে মুছে যাবে এই আশা যে কোনও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই করবে।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment