- 06 March, 2024
- 0 Comment(s)
- 738 view(s)
- লিখেছেন : শ্রীরূপা মান্না
তত্ত্বে তর্কে নারীবাদ হয়তো জানা নেই অথচ জীবন দিয়ে বাস্তবের মাটিতে লড়াই করে নারীবাদের নির্যাসটুকু মননে গেঁথে নিয়েছেন এমন শ্রমজীবী মেয়েদের কথা না লিখলে নারীবাদী আন্দোলনের চর্চা অপূর্ণ রয়ে যায়। ভারতবর্ষের বুকে নারী নির্যাতনের বিরদ্ধে সংঘটিত বিভিন্ন আন্দোলনের ইতিহাস কম নেই। নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে দা বঁটি কাটারি নিয়ে মেয়েদের লড়াই কিংবা তেভাগা-তেলেঙ্গানায় দেশীয় জোতদার জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষিজীবী মেয়েদের লড়াই আমরা দেখেছি। আমরা শুনেছি দেশভাগের সময় অকথ্য অত্যাচার সয়ে তবুও বীজ থেকে চারার মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে উদ্বাস্তু মেয়েরা। জঙ্গল জমি রক্ষার তাগিদে গাছ আঁকড়ে চিপকো আন্দোলন করেছে, কখনও রাষ্ট্রের বেয়োনেটের মুখে নগ্ন মিছিল করেছে। তবু নারীদিবস এলে কোথায় যেন হারিয়ে যায়, "শ্রমজীবী নারীদিবস" এর কথা। বাজারের হাত ধরে উঠে আসা বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া ভাবনায় নারীদিবস যেন বিজ্ঞাপনী চমকে মোড়া শুধু গহনার মজুরীতে ছাড়ের গল্প না হয়ে দাঁড়ায়, তাই বারবার আমাদের অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে মনে করতেই হবে শ্রমজীবী মেয়েদের আখ্যান। ইতিহাসে যারা রুটি আর ফুলের জন্য জান দিয়েছে, তাদের স্মরণ করে উত্তরসূরীদের দায় বর্তায় আজকের শ্রমজীবী মেয়েদের শৃঙ্খল ভাঙার শব্দগুলোকে চেনার, জানার। এই মুহূর্তে সন্দেশখালির নারী নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মেয়েদের সম্মিলিত প্রতিবাদ, কিছুদিন আগে রাজধানীতে এনআরসি সিএএ এর বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠা শাহীনবাগ, রাজপথ কাঁপানো কৃষক মেয়েদের লড়াই আমাদের মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসে, রূপরেখা দেয়, পথ দেখায় ভাবীকালের নারী আন্দোলনের। এছাড়া প্রতিনিয়ত যে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বস্তিতে-ফুটপাথে মেয়েরা বেঁচে আছে, বেঁচে নিচ্ছে তাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু সেটাকেও পূর্ণ সমমর্মিতার সাথে চিনতে না পারলে আমাদের পায়ের তলার জমি শক্ত হবে না। তাই এই লেখা সেইসব মেয়েদের জন্য, সেইসব মেয়েদের হয়ে, সেইসব মেয়েদের লড়াইকে কুর্নিশ করে।
নারী স্বাধীনতা থিওরিটিক্যালি যা বলে তার অন্যতম একটি উপাদান যেমন স্বোপার্জিত শাকান্ন অন্যটি হল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক পরিবার থেকে আরম্ভ করে সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত বিস্তৃত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবারের মধ্যে নারীর অবস্থান ভারতবর্ষের মত দেশে আজও 'দ্বিতীয়', যদিও দেখা যায় উইমেন হেডেড হাউসহোল্ডের ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রমী। কিন্তু সেক্ষেত্রেও উপার্জনের দায়ভার যদি শ্রমজীবী একটি পরিবারে মেয়ের ওপরেও ন্যস্ত থাকে পুরোপুরি, তবুও পরিবারের সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার মতামত খুবই নগণ্য। এমনকি, ভারতবর্ষে আইনসভার সিদ্ধান্ত অনুসারে পঞ্চায়েত স্তরে নারীদের প্রতিনিধিত্ব পঞ্চাশ শতাংশ নিয়ম মোতাবেক হলেও সেই পদগুলি বেশিরভাগই 'নারী ও শিশুকল্যাণ ও সমাজ উন্নয়ন' এর আওতাতেই থাকে, অর্থবিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়ভার বেশ কম দেখা যায়। অর্থাৎ অলিখিত ভাবেই যেন কাজের জেন্ডার ভাগ করে দেওয়া আছে। নারীরাই সমাজকল্যাণমূলক কাজ, নারী ও শিশুদের সেবামূলক কাজ দেখাশোনা করবে, এবং পুরুষ সদস্যরা তথাকথিত অপেক্ষাকৃত উন্নত কাজ অর্থাৎ গ্রামের রাস্তা তৈরি করা, নলকূপ বসানো, বাড়ি বানানো এই জাতীয় কাজ দেখাশোনা করবে। এমনকি পঞ্চায়েত প্রধান কোনও নারী হলেও দেখা যায় বহু ক্ষেত্রেই সেই পদটি কার্যত সামলান তার বাড়ির অথবা সংগঠনের পুরুষ কর্মী। সাম্প্রতিক কালে খুব বিখ্যাত এবং চর্চিত একটি ওয়েব সিরিজ, 'পঞ্চায়েত' এও আমরা দেখেছি এই সমস্যাটির একটি ছবি যেখানে প্রধানের স্বামী তার কাজটি করে যাচ্ছেন। ফলে খাতায় কলমে অধিকার প্রাপ্ত হলেও মেয়েদের কাছে সক্রিয় অংশগ্রহণ বা কাজ করার বাস্তবতা খুবই কম উপস্থিত হয়েছে এতকাল। কিন্তু এই হতাশাজনক চিত্রটুকুই সার্বিক নয়। ক্ষমতায়ণের প্রথম ধাপ যদি ক্ষমতাসীন হওয়া হয়, দ্বিতীয়টি অবশ্যই সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারা। নব্বই পরবর্তী গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবে বিশ্ববাজারে মেয়েদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মত বৃদ্ধি পেয়েছে। বাড়ির চার দেওয়ালের বাইরের জগতে উৎপাদনমূলক ও পরিষেবামূলক কাজে মেয়েরা অনেক বেশি যোগদান করেছে, ফলে উপার্জনকে সে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের হাতিয়ার করতে অনেক বেশি শিখেছে। বাজার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মেয়েদেরকে তাদের উপার্জন দিয়ে ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে পেরেছে, যা তাদেরকে একটু হলেও বেশি সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে শিখিয়েছে, অন্তত ব্যক্তিগত বিষয়ে তো বটেই। আবার একইসাথে দেখা যাবে এই বাজারই তুলনায় নিম্নবিত্ত শ্রেণির মেয়েদের ওপর 'ঘর এবং বাহির' সামলানোর জন্য দ্বৈত চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ দেখা গেল, এই ডাবল বার্ডেনের ফলে শ্রমজীবী মেয়েদের ওপর ভয়ানক বোঝা এসে দাঁড়ালো। তার শ্রমিক সত্তার সাথে গৃহিণী সত্তাটিকে আলাদা করতে চায়নি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, এবং তাই পরিকল্পিতভাবেই গৃহশ্রমটিকে সামাজিক শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। যেহেতু গৃহশ্রমটির লৈঙ্গিকীকরণ বহুযুগ ধরে সমাজে তৈরি হয়ে আছে, সেটি বিনা পারিশ্রমিকের কাজই হোক বা অর্থের বিনিময়েই হোক, মেয়েরাই টেনে নিয়ে চলছে। এমতাবস্থায় যখন বাজারের তৈরি চাপে শ্রমজীবী মেয়েরা ন্যূনতম সুযোগ বা সময় কোনওটিই পাচ্ছেন না তাদের এই অবস্থান্তর ঘটানোর উপায় খুঁজে বের করতে, তখনই কিন্তু বিভিন্ন বিস্ফোরণের মতো আন্দোলন দানা বাঁধছে এই সময়ের বুকে। কখনও ন্যূনতম মজুরীর দাবিতে কখনও বা কাজের পরিবেশে নিজের সুরক্ষার অধিকার মজবুত করতে তারা সংগঠিত হচ্ছেন, সম্মিলিত প্রতিবাদ করছেন। উদাহারণ হিসেবে দাউদাউ করে চোখের সামনে উপস্থিত মুন্নারের চা বাগানের শ্রমিক আন্দোলন এবং বেশ চমকপ্রদ একটি বিষয় ছিল এই আন্দোলনে; মজুরী বাড়ানোর দাবি, ক্রেশের দাবি, মাতৃত্বকালীন ছুটির দাবি এবং কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার দাবি এগুলির সাথে এখানে মূল একটি দাবি ছিল শ্রমিক অ্যাসোশিয়েশনে মেয়েদের নেতৃত্ব করার দাবি। অর্থাৎ শ্রমজীবী মেয়েরা দেরিতে হলেও বুঝছেন নিজেদের হকের লড়াইতে নিজেদের ক্ষমতা থাকতে হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের। এইজন্য এতোগুলো কথা উত্থাপন করলাম, যাতে 'সিদ্ধান্ত গ্রহণ' বিষয়টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, সেটা প্রকাশ করতে পারি। একই রকমভাবে গ্রামের যে সমস্ত মেয়েরা হয়তো সাংবিধানিক মতে সংরক্ষণের ফলেই, পঞ্চায়েতের ছোট ছোট সমিতি ও উপসমিতিগুলোতে সামান্য হলেও ক্ষমতা পেয়েছেন, দেখা গেছে তারা কোথাও গিয়ে পঞ্চায়েত স্তরেই, নারীপ্রশ্নে এবং বেশ কিছু সামাজিক প্রশ্নে অনেক বেশি আগুয়ান হয়েছেন। রাষ্ট্রস্বীকৃত ক্ষমতাই হয়তো, কিন্তু তার সদ্ব্যবহার করতে চাইছেন, বা কিয়দংশে পারছেনও। কয়েকটি বেশ আলোচিত ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। কিছু বছর আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের কন্ঠিপাড় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি উমা মাইতি পঞ্চায়েত স্তরের আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন। ইন্দিরা আবাস যোজনার অর্থ কেন উপভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না, সেই নিয়ে অনেক সংগ্রাম করেছেন। আবার ২০১২ সাল থেকেই মহারাষ্ট্রের ইয়াবথাল জেলাতে পঞ্চায়েতের নারী প্রতিনিধিরা পণপ্রথা ও নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে যেভাবে সংগঠিত প্রতিবাদ করে চলেছেন, তা দৃষ্টান্ত হিসেবে মহারাষ্ট্রের অন্যান্য জেলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। আর একটি গল্প সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। হিমাচল প্রদেশের কাশলগ জেলার পঞ্চায়েতের মেয়েরা সংগঠিত প্রতিবাদ করেছেন নির্বিচারে জঙ্গল কেটে ফেলে অম্বুজা সিমেন্টের কারখানা তৈরির বিরুদ্ধে, যা পুরো হিমাচল প্রদেশ জুড়েই পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। এই প্রতিটি গল্প উদাহারণ মেয়েদের ক্ষমতায়ণের সামাজিক প্রভাব নিয়ে কথা বলে।
এরপর আসি গ্রামেগঞ্জে শহরে বস্তিতে ফুটপাথে থাকা মেয়েদের রোজকার জীবন সংগ্রামের কথায়। একটা গল্প দিয়েই শুরু করি। শহর কলকাতায় মুসকান বলে একটি সংগঠনের সাথে কিছুদিন আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছিল কর্মসূত্রে। এরা মূলত কাজ করেন কলকাতার রেডলাইট এরিয়ার প্রস্টিটিউটদের নিয়ে। প্রস্টিটিউট কথাটিই ব্যবহার করলাম কারণ এনারা নীতিগত ভাবে যৌনতা বিক্রীর বাজারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও যৌনতাকে কোনও পণ্য হিসেবে দেখেন না, ফলে 'যৌনকর্মী'- এই তকমা ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য নন। বিকল্প পেশার সন্ধান ও ব্যবস্থা করা থেকে আরম্ভ করে এই 'পেশা'য় যুক্ত মেয়েদের ছেলেমেয়েদের পড়ানো, এনাদের সামাজিক ও মানবিক অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক লড়াইটি লড়ছেন এই সংগঠন। এদের কর্মক্ষেত্রে গিয়ে দেখাছি, যৌনপল্লীতে জন্মানো সঠিক পিতৃপরিচয়হীন বাচ্চাদের বা অনাথ বাচ্চাদের এই মেয়েরা একসাথেই লালনপালন করেন। এমনকি মায়েদের অনুপস্থিতিতে বা অভাবেও মেয়েরা খুব সহজেই আদর যত্ন দিয়ে বড় করে তোলে যে কোনও গৃহহীন বাচ্চাকেই। এইভাবে যে তথাকথিত পরিবার ব্যবস্থার বাইরে বেরিয়ে বিকল্প পারিবারিক আস্তানা গড়ে তোলা সম্ভব, তা সমাজের বাকি অংশের কাছেও শিক্ষনীয় হতে পারে। হয়তো এই গল্পগুলি আমাদের অজানা নয়, তবু আলোচনা আমাদের করতেই হবে বিভিন্ন অংশের এইসমস্ত খেটেখাওয়া মেয়েদের নিয়ে, নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে।
যাই হোক, যে উদাহারণ একদম শুরুতে দিয়েছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। সাম্প্রতিকতম ঘটনা, সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মেয়েদের সম্মিলিত প্রতিবাদ কী রূপ নিয়েছে আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এই যে মেয়েরা এগিয়ে এসেছে, এনারা দীর্ঘদিন ধরে মুখবুজে অত্যাচার সহ্য করেননি, বরং দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভগুলিকে একত্রিত করছিলেন। খুব সংগঠিত না হলেও এনাদের বক্তব্যেই উঠে এসেছে গ্রামে কাজ করা আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ির কর্মীরা যে ছোট ছোট সভা সমিতি করেন, তারা অনেকেই এই আন্দোলনের পুরোভাগে থেকেছেন। অর্থাৎ সংগঠিত হবার মত সুযোগ থাকলেই নারীদের অধিকারের লড়াইয়ের পথটি সত্যিই যে সুগম হয় সেটির প্রকৃষ্ট উদাহারণ এটি। কিন্তু সংগঠিত হওয়া বা করা কি এতোই সহজ? একেবারেই নয়। এমনকি ইতিহাসের পাতাতেও দেখেছি নারীদের গৃহ-পরিবারের শৃঙ্খল পেরিয়ে সংগঠিত হওয়া বা করতে পারা খুবই দুরূহ একটি কাজ। হয়তো সেই জন্যেই বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম বড়সড় যে মেয়েদের কনফারেন্স, ১৮৪৮ এর সেনেকা ফলস, সেখানেও নারীমুক্তির আলোচনার কর্মসূচীর মাঝে কিছুটা সময় রাখা হয়েছিল, মেয়েদের গল্প করার জন্য। প্রায় সতেরোটি বিভিন্ন দেশের মেয়েরা নিজেদের মধ্যে নিজেদের জীবনের গল্প বলা কওয়ার মধ্যে দিয়েই হয়তো বুঝতে শিখেছিল তাদের অভিজ্ঞতা তাদের একক নয়, সমষ্টিগত এবং রাজনৈতিক। নারী আন্দোলনের ভাষায় যাকে বলা হয়, 'পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল'। এই ব্যক্তিগত গল্পের পরিসর অনেক সময় শ্রমজীবী মেয়েদের হয় ট্রেনে, মেয়েদের সংরক্ষিত কামরায়, কিংবা কর্মক্ষেত্র কিংবা নিছকই সান্ধ্যকালীন আড্ডায়। কর্মসূত্রে দেখেছি বস্তিতে বাস করা শ্রমজীবী মেয়েরা একে অপরের সাথে ব্যক্তিগত সুখ দু:খ বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে একটা মোটামুটি নিজেদের রক্ষাবলয় তৈরি করেন। হয়তো তেমন শক্ত নয়, কারণ সমাজের পিতৃতান্ত্রিক যে মূল্যবোধ শোষিত বর্গকেও পিতৃতন্ত্রের ধারক ও বাহক বানিয়ে শিখিয়েছে 'মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু' সেই বোধ অতিক্রম করতে পারা একটি সচেতন রাজনৈতিক প্রয়াসের ফল হতে পারে, বাস্তবতায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গড়ে ওঠা কঠিন। কিন্তু ওই যৎসামান্য যেটুকু যোগসূত্র গড়ে ওঠে তার মধ্যে দিয়েই তারা অন্তত গৃহহিংসা, যৌনহিংসার মতো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাগুলোকে খানিকটা হলেও প্রতিরোধ করতে পারেন। আবার বস্তি উচ্ছেদের মতো প্রবল বিধ্বংসী সময়ে দাঁড়িয়ে তাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বন্ধন অনেক দৃঢ় হয়ে ওঠে, কখনও কখনও তা রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অধিকারের জন্য সক্রিয় আন্দোলনের রূপও নেয়। নারী আন্দোলনকে সম্যকরূপে সমাজে জীবিত রাখতে গেলে শ্রমজীবী মেয়েদের সংগঠিত হওয়া বা সংগঠিত করা খুব গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে আমাদের।
নারী মুক্তির চেতনা ও আন্দোলনের বিষয়টি শুধু জেন্ডারের আতসকাঁচ দিয়ে দেখলে খণ্ডদর্শন হবে শুধু। বুর্জোয়া শ্রেণির নারীবাদী দাবিদাওয়া সাধারণ শ্রমজীবী মেয়ের দাবিদাওয়া সর্বোতভাবে এক নয়। নারী আন্দোলনের গোড়ার দিকে যখন ভোটাধিকারের লড়াই শুরু করেছিলেন ব্রিটেনের বুর্জোয়া অংশের মেয়েরা সমকালীন সময় থেকেই শ্রমিক মেয়েদের শ্রমক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের অধিকার রক্ষার লড়াইও চলেছে। ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রমের পরেও ন্যূনতম আহার বাসস্থানের জোগান দিতে না পেরে বিভিন্ন দেশে কারখানার মেয়েরা সংগঠিত হয়েছে। মেয়েরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই ঘর এবং বাইরের ডাবল বার্ডেনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে। এই লড়াই নারীমুক্তির দাবির সাথেই পালটা সমাজ গড়ার পথ দেখায়, নিপীড়িত শ্রেণির অধিকারের কথা বলে। এই আন্দোলনগুলোরই উত্তরসূরী আমরা। আজকের সময়ে তাই বাজারের তৈরি করা "মাই_ড্রেস_মাই_চয়েস" এর স্লোগান নারীবাদের পরিচায়ক নয়। বরং যে রাষ্ট্রে হিজাব পরে কলেজে পড়তে আসলে, একজন সংখ্যালঘু ধর্মের মেয়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, তা কখনওই পূর্বোক্ত স্লোগানকে জাস্টিফাই করে না। বরং ওই উচ্চকিত স্লোগান নারীবাদকে শ্রেণিচেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এই বিচ্ছিন্নতা দীর্ঘদিন ধরে সুচারু ভাবে করা হয়েছে। গৃহশ্রমের বোঝা কমাতে, বাজার নিয়ে এসেছে, "বুক মাই বাই" অ্যাপ, যার মধ্যে দিয়ে কাজের লিঙ্গবিভাজন টিকে গেছে এবং শ্রেণি আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। আজকের সময়ে তাই নারীবাদী আন্দোলনের কর্মীদের ক্লাস কাস্ট জেন্ডারের একটা ইন্টারসেকশনে দাঁড়িয়েই নিজেদের পথ নির্মাণ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবসে এই আমাদের শপথ হোক।
লেখক : সমাজকর্মী
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment