এ লড়াই ছিল হকের, সমানাধিকারের!

  • 30 November, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 567 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সুপ্রিম কোর্টের সেই রুলিংয়ের পর মহিলাদের ভিতরকার রোখটুকু যেন বোমার মতোই ফেটে পড়েছিল। আন্দোলনের পুরুষ সাথীদের বা পুরুষ নেতৃবর্গের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই মহিলারা সোচ্চারে জানালেন – অক্সফ্যামের রিপোর্ট অনুসারে ভারতের গ্রামীণ সমাজের ৮৫% মহিলাই কোনও না কোনও ভাবে কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত অথবা কৃষিকাজে শ্রম দিয়ে থাকেন। অথচ এই মহিলাদের মাত্র ১৩%এরই নিজেদের নামে কোনও জমি বা চাষের জায়গা রয়েছে। এই কৃষক আন্দোলন সেই দিন থেকে হয়ে উঠল সমানাধিকারের আন্দোলন। সমান হকের আন্দোলন।

স্টিরিওটাইপ অর্থে গতানুগতিকতা।

বর্ষব্যাপী কৃষক আন্দোলন অবশেষে আজ অন্তিম বিজয়ের অপেক্ষায়। এই লেখা যে সময়ে বসে লিখছি, কিছুক্ষণ আগেই খবর এসে পৌঁছিয়েছে যে সংসদ কক্ষে সরকারি ভাবে বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করেছেন মোদী সরকারের সদস্যেরা। ঐতিহাসিক ভাবে দেখলে এই প্রথম বোধহয় আরএসএস-বিজেপি তথা সংঘ পরিবার তাঁদের কোনও ঘোষিত ইস্যুতে পিছু হটতে বাধ্য হলো। একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারের যে ইতিহাস এই পরিবারের, তাকে ঘেঁটে দেখলে পরে নিঃসন্দেহে বোঝা যাবে কি বিপুল সাফল্য পেয়েছে এই কৃষক আন্দোলন। আমরা যারা সামান্য থেকে সামান্যতর ভাবেও এর স্বপক্ষে কলম ধরেছি, মিছিল করেছি – আমরাও কৃতজ্ঞ সেই বিপুল জনসমাবেশের কাছে ... টিকরিতে, সিঙ্ঘুতে, অথবা গাজিপুর সীমান্তে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ভরে অপেক্ষা করা সেই শতসহস্র যোদ্ধাদের কাছে, যাদের সংগ্রামে আমরাও রামায়ণের কাঠবেড়ালীর মতোই সাথী হতে পেরেছি। এই লড়াই পৃথিবীর বুকে ইতিহাস হয়ে থাকবে।

তবুও বলব, স্টিরিওটাইপ অর্থে গতানুগতিকতা। কেন বলব? কারণ মূলস্রোতের মিডিয়ারা এখনও পুরোপুরি ভাবে এই আন্দোলনের গভীরে পৌঁছিয়ে উঠতে পারেনি। কেন পারেনি, সেই নিয়ে অনেক তত্ত্ব, অনেক বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু পারেনি যে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো – এই সুবিশাল আন্দোলনে নারীদের অংশ নেওয়া নিয়ে অধিকাংশ মূলধারার মিডিয়াতেই যে ধরনের রিপোর্টাজ হয়েছে তাদের অধিকাংশেরই পোস্টার-চিত্র হলো বিশাল বড় বড় একেকটি উনুন অথবা কড়াইয়ের সামনে মেয়েরা বসে আছেন। “কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁরা তাঁদের পুরুষ সাথীদের জন্য অন্নের যোগান দিচ্ছেন!” অস্বীকার করব না, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বা হরিয়ানার মতো একেকটি পুরুষতান্ত্রিক রাজ্য থেকে মহিলারা এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে যদিও বা এতটুকুও করতে পারতেন, নিঃসন্দেহে তাতেই তাঁরা ইতিহাস হয়ে থাকতেন। কিন্তু বাস্তবচিত্র যা বলছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এই আন্দোলনে মহিলারা আরও বিপুল পরিসরে, বিশাল এক ব্যাপ্তিতে গোটা দেশ তথা পৃথিবীতে, গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা প্রসঙ্গে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ রচনা করেছেন।

এই আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ এতটাই বিপুল ও ঐতিহাসিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, মার্চ ২০২১এ বিশ্ববিখ্যাত টাইমস ম্যাগাজিনেও ভারতের কৃষক আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আন্দোলনের এই নারীরা কেবল হেঁশেল ঠেলতে বা রুটি সেঁকতে টিকরি বা সিঙ্ঘু সীমান্তে এসে পৌঁছননি। তাঁরা কেবল সংসার বা পুরুষতন্ত্রের নয়, নিজেদের মনের স্বাধীনতা – চিন্তার স্বাধীনতারও আগল ভেঙেছিলেন। নভেম্বর ২০২০ থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন যখন ক্রমেই বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে উঠছে, সেই সময় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট একটি রুলিংয়ের মাধ্যমে আন্দোলনের নেতৃবর্গের উদ্দেশ্যে জানায়, অশক্ত বৃদ্ধ ও নারীদেরকে তারা যেন সরাসরি আন্দোলন ক্ষেত্রে না রেখে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করে। এতেই যেন আগুনে ঘৃতাহুতি হয়। প্রজন্মের পরে প্রজন্ম ধরে দুর্বল, অবলা, ক্ষীণকায়া, মনুষ্যেতর জীব হিসেবে হরিয়ানা অথবা রাজস্থানের যে মহিলারা অপবাদ শুনে শুনে ক্ষয়ে ক্ষয়ে বেঁচেছিলেন, এই কৃষক আন্দোলনে তাঁদের যতটুকুও বা অংশগ্রহণ ছিল – সুপ্রিম কোর্টের এই রুলিংয়ের পর তাতে যেন বারুদে অগ্নিসংযোগ হলো। গ্রাম উজাড় করে মহিলারা শহরে এলেন। মুখাবরণকে অবজ্ঞা করে তাঁরা ট্রাক্টরে সওয়ার হয়ে, পুরুষ সাথীদের সঙ্গে ময়দানে এলেন। পুরুষ নারীর ভেদাভেদ এই আন্দোলন দেখেনি। এই আন্দোলন সেই দিক থেকে দেখলে এক সার্থক গণআন্দোলনের চেহারা নিয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সেই রুলিংয়ের পর মহিলাদের ভিতরকার রোখটুকু যেন বা বোমার মতোই ফেটে পড়েছিল। আন্দোলনের পুরুষ সাথীদের বা পুরুষ নেতৃবর্গের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই মহিলারা সোচ্চারে জানালেন – অক্সফ্যামের রিপোর্ট অনুসারে ভারতের গ্রামীণ সমাজের ৮৫% মহিলাই কোনও না কোনও ভাবে কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত অথবা কৃষিকাজে শ্রম দিয়ে থাকেন। অথচ এই মহিলাদের মাত্র ১৩%এরই নিজেদের নামে কোনও জমি বা চাষের জায়গা রয়েছে। এই কৃষক আন্দোলন সেই দিন থেকে হয়ে উঠল সমানাধিকারের আন্দোলন। সমান হকের আন্দোলন।

আমনদীপ কউর, পঞ্জাবের কৃষক পরিবারের গৃহবধূ (ও কৃষক, কারণ তিনি নিজে কৃষিক্ষেত্রে শ্রম দিয়ে থাকেন) সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, তাঁর স্বামী ইতিপূর্বে দেনার দায়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রথাগত লেখাপড়ায় বিশেষ পোক্ত না হওয়ার কারণে সরকার থেকে স্বামীর আত্মহত্যার জন্য যে ক্ষতিপূরণটুকুও বা তাঁর প্রাপ্য ছিল তা তিনি আদায় করতে পারেননি। কারণ, সেই ক্ষতিপূরণ পেতে গেলে তাঁর স্বামীর মৃত্যু যে আত্মহত্যার ফলে হয়েছে – সেই সিদ্ধান্ত-সমেত একটি পোষ্ট-মর্টেম রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দিতে হতো। কিন্তু তেমন কোনও রিপোর্ট যে পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে, বা তা যে নিয়ে রাখা উচিত এই বিষয়েই আমনদীপের কোনও ধারণা ছিল না। আজ সেই আমনদীপ জানাচ্ছেন, সরকার বলেছে কৃষি আইন কার্যকরী হলে সরাসরি কর্পোরেট কর্তাদের সঙ্গেই চাষীদের আদানপ্রদান হবে। সরকারের কোনও ভূমিকা থাকবে না। তাহলে যাঁরা আমনদীপের মতো জায়গায় রয়েছেন, তাঁরা কিভাবেই বা সেই কর্পোরেট হাঙরদের সঙ্গে বুদ্ধির খেলাতে টক্কর দেবেন ? এই কথা আমনদীপ সাংবাদিকদের বলেছেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমাবেশে চিৎকার করে বলেছেন। মেয়েদের শেকল ভাঙার লড়াই সেদিন পূর্ণতা পেয়েছে।

দলিত, আদিবাসী, প্রান্তিক মহিলারা সমাবেশগুলিতে ভিড় করে এসেছেন। তাঁদের কোনও মস্তকাবরণ ছিল না। জীবনে প্রথমবার ঘোমটাখোলা অবস্থায় প্রকাশ্যে বের হয়ে এসে, তাঁরা লক্ষ মানুষের সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন। কেবল রুটি সেঁকাতেই তাঁদের কাজ শেষ হয়ে যায়নি। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধারা ঠায় মঞ্চে বসে থেকেছেন, হাতে মাইক তুলে নিয়ে বলেছেন, “আমরা লেখাপড়া জানিনে, বক্তৃতা করতে পারিনে – কিন্তু বসে থাকতে পারি। প্রয়োজন মনে হলে ২০২৪ অবধি এভাবেই বসে থাকব।” মাননীয় মোদী-শাহের সরকার এই আন্দোলনকে নিয়ে আসলে বড্ড বেশি করে নিজেদের অহমিকাকে প্রকাশ করে ফেলেছিল। ভাগ্যিস ফেলেছিল! তাই তো এই আন্দোলন এমন এক সার্বিক চেহারা নিয়ে উদযাপিত হতে পারল।

সাড়ে সাতশোর উপরে কৃষক শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত পঞ্চাশজন মহিলা। দীর্ঘদিন আন্দোলনে থাকতে থাকতে বৃদ্ধা কৃষকরমণী দেখেছেন বয়সজনিত অসুস্থতায় মঞ্চের সহ-আন্দোলনকারী বৃদ্ধাকে একদিন মৃত্যুবরণ করতে। তবু শীত, বয়স, মৃত্যু – কোনওকিছুই তাঁদের ইস্পাতকঠিন মনোবলকে দমাতে পারেনি। শহীদতর্পণ নিয়ে বিগত বছরে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, সেই প্রবন্ধ প্রকাশের দিন অবধি শহীদের সংখ্যাটা ছিল তেত্রিশ। সেই সংখ্যা আজ সাতশোর কোঠা ছাড়িয়েছে। এই সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে সাথেই বেড়েছে আন্দোলনের পরিসর। কৃষক আন্দোলনের মঞ্চকে ব্যবহার করে গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতা প্রচার করা হয়েছে। স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার ও অন্যান্য নারীস্বাস্থ্য-বিষয়ক যে ইস্যুগুলিকে নিয়ে এই আন্দোলনকে ব্যবহার করে মহিলাদের মধ্যে সচেতনতা বিস্তার করা গেল, সেটিই বুঝিয়ে দিচ্ছে এই আন্দোলনের সার্থকতা। এই আন্দোলনের লিঙ্গ-নিরপেক্ষ চেহারার কথা। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর সমস্ত গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান হকদারির কথা সোচ্চারে উচ্চারিত হলো। যেমনটা টিকরির সীমান্তে দাঁড়িয়ে আরেক কৃষক-রমণী সুদেশ নাদেল্লা সাংবাদিকদেরকে বলেছিলেন, “আমি জীবনে কোনোদিন এমন কোনও আন্দোলন বা সমাবেশে আসিনি। কিন্তু আজ এসে পৌঁছলাম। এখন আমি এখানেই থাকব। না আমাকে শাসন করা যাবে, না আমাকে দমন করা যাবে – না আমাকে ভয় দেখানো যাবে, অথবা কিনে নেওয়া যাবে আমার ইজ্জত!”

অনেক উপরে আকাশের কোথাও জ্যোতিবা ফুলে অথবা তেভাগার শহীদ অহল্যারা তখন, হয়তো বা মুচকিয়ে হেসে নিচ্ছিলেন!

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

ছবি: সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment