- 11 January, 2023
- 0 Comment(s)
- 465 view(s)
- লিখেছেন : সুচেতনা মুখোপাধ্যায়
ফাতিমা শেখ.. ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম প্রশিক্ষিত মুসলমান স্কুলশিক্ষিকা… এবছর তাঁর ১৯২তম জন্মজয়ন্তী। তাই ইচ্ছে হল এই অনন্যা প্রথমার কথা একটু ভাগ করে নিই সবার সাথে...।
১৮৪৮। পুনে শহরে নিজেদের বাড়িতে ভারতের প্রথমতম মেয়েদের স্কুলটি খুলে ফেলেছেন সমাজকর্মী দম্পতি জ্যোতিবা আর সাবিত্রীবাঈ ফুলে। কিন্তু মেয়েদের পড়ানোর মত মহাপাপ করার অপরাধে জ্যোতিবার বাবা তাঁদের একবস্ত্রে বের করে দিলেন বাড়ি থেকে।
এই অবস্থায় সহায়-সম্বলহীন তরুণ ফুলে দম্পতিকে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন জ্যোতিরাওয়ের বাল্যবন্ধু ওসমান শেখ ও তাঁর বোন ফাতিমা শেখ। জাত-ধর্মের সকল কুসংস্কার থেকে মুক্ত সেই বাড়িতেই সানন্দে থাকতে শুরু করলেন তাঁরা।
ফাতিমা শেখ শুরু থেকেই ছিলেন তেজস্বিনী। তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের শত বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি ভাইয়ের কাছে প্রাথমিক পড়ালেখা শিখেছিলেন। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, তরুণী ফাতিমা নিজের অর্জিত শিক্ষাকে তাঁর সমাজের বৃহত্তর অংশের মেয়েদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান শিক্ষিকা হওয়ার কাহিনীটা তাই মোটেই সহজ হয়নি ফাতিমা শেখের। সমমনস্ক ফাতিমা ও সাবিত্রীর মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল আগে থেকেই। যখন দুজনেই খ্রিষ্টান সন্ন্যাসিনী সিনথিয়া ফেরারের শিক্ষক শিক্ষণের স্কুল থেকে শিক্ষকতার পাঠ নিয়েছিলেন। এবার ১৮৪৯ সালে পুনের নর্মাল স্কুল থেকেও ফাতিমা আর সাবিত্রী একসঙ্গে শিক্ষক শিক্ষণের কোর্স করলেন। ফাতিমা-ওসমানের বাড়ির উঠোনে সেই বছরেই খোলা হল পুনেতে মেয়েদের দ্বিতীয় স্কুলটি। যার প্রধান শিক্ষিকা হলেন সাবিত্রীবাঈ। আর পড়ানোর দায়িত্বে রইলেন ফাতিমা। স্কুলের সময়সীমার বাইরে পুনের হতদরিদ্র দলিত আর মুসলমান পাড়াগুলিতে দিনের পর দিন ঘুরে মেয়েদের পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করতেন এই ফাতিমা আর সাবিত্রী।
হাজার হাজার বছর ধরে শিক্ষাসহ জীবনের প্রায় প্রাথমিক সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষগুলির মনে প্রথমে ছিল তুমুল ভয় আর সন্দেহ। কিন্তু শিক্ষিকাদের নিরলস প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে তাঁদের স্কুলে আসতে শুরু করল মাঙ, মাহার, মাতঙ, মালি, মালিক জাতির বালিকারা। সাবিত্রী আর ফাতিমার স্নেহময় ব্যবহার আর পাঠদানের অভিনবত্বের কারণে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল এই স্কুল। ১৮৫২-তে সাবিত্রী ও ফাতিমার তিনটি স্কুলের মোট ছাত্রীসংখ্যা ছিল দেড়শোর বেশি, যা সেযুগের প্রেক্ষিতে ছিল যথেষ্ট বড় এক সংখ্যা। ‘পুনে অবজারভার’ পত্রিকা লিখল, সরকারি স্কুলের ছেলেদের থেকেও ফাতিমা-সাবিত্রীর ‘নেটিভ ফিমেল স্কুল’-এর মেয়েরা পড়াশোনায় অনেক ভালো করছে।
১৮৫১-তে ফাতিমা শেখ বোম্বাই গিয়ে নিজের হাতে তৈরি করে এসেছিলেন দুটি বড় আকারের বালিকা বিদ্যালয়। ১৮৫৮ সালের মধ্যে পুনেতে ফাতিমাদের মেয়েস্কুলের সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৮। সেই বছরেই স্কুলগুলির সমস্ত দায়িত্ব সহযোদ্ধা ফাতিমার ওপর ন্যস্ত করে সাবিত্রী ও জ্যোতিবা সমাজের আরও অগণিত দুরাচারকে উৎখাত করার জন্য নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। ফলে পরবর্তী দশকগুলিতে ফুলে দম্পতির নারীশিক্ষা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের মূল কর্ণধার হয়ে ওঠেন ফাতিমা শেখই।
কিন্তু অনলস সমাজকর্মী ফাতিমা তাঁর গোটাজীবন জুড়ে রয়ে গিয়েছিলেন এক নীরব একনিষ্ঠ যোদ্ধা। নিজের জীবন ও বিপুল কাজ সম্পর্কে একটি বাক্যও তিনি লিখে যাননি কোথাও। ফলে এখনও পর্যন্ত, সাবিত্রীবাঈ ও জ্যোতিবার ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ও তাঁর শিক্ষকতার আনুষ্ঠানিক দস্তাবেজ ছাড়া আর অন্য কোনও সমকালীন সূত্র থেকে ফাতিমা শেখ সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। তাই জন্মদিনটি জানা গেলেও আমরা আজও জানি না তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বা প্রয়াণের সাল-দিন কোনও কিছুই।
আধুনিক ভারতের মুসলমান সমাজের অগ্রগতির কারিগর হিসেবে বহুবছর ধরে বহু আলোচিত/সমালোচিত হন আলিগড়ের সৈয়দ আহমদ খান। কিন্তু মহিলা বলেই কি সৈয়দ আহমেদের তিনদশক আগে থেকে মুসলমান সমাজকে বদলানোর কাজ করেও বিস্মৃত হতে হয় আধুনিক ভারতের অন্যতম প্রথম শিক্ষিকা ফাতিমা শেখকে?
আমরা ভারতীয়রা সত্যিই লজ্জাজনকভাবে আত্মবিস্মৃত। কোনও দিবস-টিবসের ছলেও ৯ জানুয়ারি দিনটায় অন্তত একবারও তাঁকে মনে করি না আমরা। তার ওপর এদেশের গুগলে ফাতিমা শেখকে খুঁজলে গত ক’বছর ধরে সত্যিই অভিনেত্রী ফাতিমা সানা শেখের ঠিকুজিকুষ্ঠী বেরিয়ে পড়ে।
কিন্তু ব্যবসার তাগিদে হলেও উপভোক্তা দেশগুলোর ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে ভুললে চলে না মাল্টিন্যাশনাল জায়ান্টদের। তাই গতবছর ফাতিমা শেখের ১৯১তম জন্মদিনে তাঁর এক ডুডল ছবি তৈরি করে এই প্রাতঃস্মরণীয়াকে সম্মান জানিয়েছিল মার্কিনি গুগল। তেমন এবছরও মার্কিন ফেসবুকই আমায় তাঁর জন্মদিনটি মনে করিয়ে দিল।
আর এক ব্যস্ত-শীতল ৯ জানুয়ারিতে নতুন করে প্রণম্যা ফাতিমা শেখ ফিরে এলেন আমার-আমাদের কাছে।
তথ্যসূত্রঃ
১) Honouring the Contribution of Fatima Sheikh: daily history month
২) Women Writing in India: 600 B.C to the Early Twentieth Century. edited by Susie Tharu, K. Lalita
সৌজন্য ইতিহাস, তথ্য ও তর্ক
0 Comments
Post Comment