- 23 September, 2022
- 0 Comment(s)
- 333 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
একদিকে মাহসা আমিনির খবর। সেই খবর দেখলে পরেই আমার কেন জানি না মহম্মদ বুয়াজিজির কথা মনে পড়ছে। তিউনিশিয়ার ফলবিক্রেতা মহম্মদ বুয়াজিজি, বেকারত্বের তিউনিশিয়ায় পুলিশের হাতে অপমানিত হয়ে পরে আত্মহত্যা – আর সেই আত্মহত্যা থেকেই আগুন হয়ে, দেশ জুড়ে সেই আগুনের ফুলকি হয়ে উঠে, ছড়িয়ে পড়ে আরব বসন্তের শুভ সূচনা ঘটানো - ঠিক এই কারণেই চিরবিখ্যাত হয়ে রয়েছেন মহম্মদ বুয়াজিজি। বুয়াজিজির মৃত্যুই সূচনা ঘটিয়েছিল আরব বসন্তের। আজ কি তাহলে মাহসার মৃত্যুও নতুন কোনও বিপ্লবের সূচনা ঘটাতে প্রস্তুত? ইরানের রাজপথে কিন্তু তারই ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এছাড়াও এই সপ্তাহে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মেয়েরাও কিন্তু গর্ব করে বলবার মতোই দারুণ একটা কাজ করে ফেলেছে। সাফ মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতায় এবারের সেরার শিরোপা উঠেছে বাংলাদেশের মেয়েদের মাথায়। সেখানে হিজাব-নিকাবের হুকুমদারি ইরানের পুলিশ-রাষ্ট্রের মতো অতখানিও জোরদার না হলেও, সেখানে মৌলবাদী মোল্লাদের উপস্থিতি গত কয়েক দশকে বিশেষ ভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পেরেছে। কাজেই তার বিপরীতে সেদেশের মেয়েদের এই সাফল্য উদযাপন করবার মতোই।
আর এরও বিপরীতে আমরা এবারে ইয়োরোপে পাড়ি দিই চলুন। রাশিয়ার একনায়ক (‘মানুষের ভোটে’ জিতে এলেও, আজ তাঁকে একনায়ক বলা ভিন্ন আর কোনও উপায় নেই), ভ্লাদিমির পুতিনের ক্রমাগত যুদ্ধ-জিগিরের বিরুদ্ধে সেদেশের মানুষ যখন আওয়াজ তুলতে শুরু করেছেন, রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন – তখন সেখানেও সকলের প্রথমে মেয়েদেরই সোচ্চার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। একদিন মাত্র আগেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সেদেশের বিশেষ সামরিক আইনের সুবিধা নিয়ে নানাবিধ নিয়মকানুন জারি করেছেন। সেই ঘোষণা অনুযায়ী পুতিনের নির্দেশবলে রাশিয়ার তিনলক্ষ সাধারণ নাগরিককে জরুরি ভিত্তিতে সামরিক বাহিনীতে ভর্তি করে নেওয়ার (অথবা নিজেদেরকে নথিভুক্ত করার) আদেশ জারি হয়েছে। অবশ্যই এই ভর্তি (অথবা নথিভুক্তির) প্রক্রিয়াতে সাধারণ মানুষের ‘স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন’ থাকবে বলেই প্রেসিডেন্ট ‘বিশ্বাস করেন’। সেই ‘বিশ্বাস’ আছে বলেই এও নির্দেশ জারি করা হয়েছে যে, কোনও ব্যক্তি যদি এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনীতে নিজেকে নথিভুক্ত করতে অস্বীকার করে – তাহলে সেই ব্যক্তিকে ১৫ বছর অবধি সশ্রম কারাবাসের সাজা শোনানো হবে। এই সমস্ত ঘোষণার পরেপরেই রাশিয়া ছেড়ে পালানোর জন্য প্লেনের টিকিট কাটতে সেদেশের মানুষের মধ্যে হাহাকার পড়ে গিয়েছে। বিশেষ সূত্রে জানা যাচ্ছে, কেবল তিনলক্ষ নয়, বাড়তে বাড়তে সেই সংখ্যাকে দশলক্ষে নিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা এই আদেশনামার ভিতরে সুকৌশলে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ কি না ইউক্রেনে নিজের নগ্ন সামরিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে চরিতার্থ করতে এখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সেদেশের সাধারণ নাগরিকবর্গকেও কামানের মুখে ঠেলে দিতে পিছপা হচ্ছেন না। ফলস্বরূপ আবারও রাশিয়া জুড়ে শত দমনপীড়ন-অত্যাচারের মধ্যে দিয়েও মানুষের মিছিল রাজপথে নেমে এসেছে। তাঁরা যুদ্ধবিরোধী শ্লোগান দিয়ে চলেছেন। এই লেখা লিখতে বসেছি যখন, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ – ভারতীয় সময় অনুযায়ী রাত ১১টা অবধিও রাশিয়ার ৩৭টি শহরে ১৩০০জনেরও বেশি মানুষকে যুদ্ধবিরোধী মিছিল-প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রুশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে জারি করা বিজ্ঞপ্তি অনুসারে গ্রেপ্তার হওয়া মানুষদের যে তালিকা আপাতত প্রকাশ করা হয়েছে তা থেকে জানা যাচ্ছে, গ্রেপ্তার হওয়া মানুষদের মধ্যে ৫১% শতাংশই মহিলা। নিখাদ সংখ্যার হিসেবেই পুরুষদেরকে ছাপিয়ে গিয়েছে এই আন্দোলনের মেয়েদের অংশগ্রহণের পরিমাণ। মেয়েরা পথ দেখাচ্ছে আজ।
মস্কোর রাস্তাতে লুটিয়ে পড়া এক জ্ঞানহারা মহিলাকে প্রায় বিবস্ত্র করে পুলিশের টেনে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে। জানা যাচ্ছে নির্মম ভাবে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ অত্যাচার চালাচ্ছে, এবং তারই সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া প্রতিবাদীদের অনেককেই নাকি জোর করে সামরিক বাহিনীতে নথিভুক্তিকরণে বাধ্য করা হচ্ছে। ‘স্বেচ্ছায় রাজি’ না হলেই যে ‘১৫ বছরের নির্বাসন’। একনায়ক ভ্লাদিমির ঘুঁটি সাজিয়ে চলেছেন। হাল্লার অভিযান এখনও থামেনি। কোনও দেশেই।
খুব গুছিয়ে বিশেষ কোনও একটি বিষয়কে নিয়ে লিখতে বসিনি। সবসময় তার দরকারও পড়ে না। এসব লেখার উদ্দেশ্য হলো নিজেদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া, লড়াই থেমে নেই কোথাও। দিকে দিকে, দেশে দেশে, মেয়েরাই আজও পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। তাদের মতো করে, তাদেরই সংগ্রামের মাধ্যমে। মাহসা আমিন, অথবা রুশ প্রতিবাদী যে কেউই হোক, প্রত্যেকে, প্রত্যেকের মতো করে ইতিহাসের জন্ম দিয়ে চলেছে। আমরা সেই কথাগুলোকেই শুনতে চাই, শোনাতে চাই, ছড়িয়ে দিতে চাই। মেয়েরা জানুক যে মেয়েরাও, মেয়েরাই - ইতিহাসকে পালটিয়ে ফেলার ক্ষমতা দেখিয়েছে বারংবার।
আমার এখন য়ুলিয়া নাভালনায়ার কথা মনে পড়ছে। পুতিন-বিরোধিতার অন্যতম মুখ, বারেবারে চোরাগোপ্তা আক্রমণে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এ্যালেক্সেই নাভালনির সহযোদ্ধা, সহধর্মিণী। কিন্তু তাঁর পরিচয় কেউ ‘স্ত্রী’ বলে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইবে না। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। রাশিয়ায় বিরোধী রাজনীতির ‘ফার্স্ট লেডি’ হিসেবে পরিচিত। নাভালনিকে এই মুহূর্তে যখন সাইবেরিয়ার কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে, তখন একা হাতেই নাভালনির আন্দোলনকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন য়ুলিয়া। অথবা দারিয়া, দারিয়া নাভালনায়া, এ্যালেক্সেই-য়ুলিয়ার কন্যা। অথবা কিরা ইয়ারমিশ, এ্যালেক্সেই নাভালনির প্রেসসচিব; মারিয়া পেখভিচ, তদন্তমূলক সাংবাদিকতায় রাশিয়া জুড়ে অন্যতম নাম; অথবা ল্যুবভ সোবোল, রুশ বিরোধী রাজনীতিক ও সেদেশে সংগঠিত বিরোধী কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। রাশিয়া জুড়ে এখন মেয়েরা সামনের সারিতে এগিয়ে এসে পুতিন বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কেবল এঁদেরকে নিয়েই বোধ করি একটি নিবন্ধ লেখা উচিত। সুযোগের অপেক্ষায় থাকব।
আজকের ইরানে খোমেইনি অপশাসনের বিরুদ্ধে পথে নেমে এসেছেন সেদেশের মহিলারা, সেই বিপ্লব সাফল্যের দিকেই এগুবে।
আজকের রাশিয়াতে পুতিনের বিরুদ্ধে সামনের সারিতে এসে দাঁড়িয়ে বিরোধী আন্দোলনে মহিলারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা তারও সাফল্য কামনা করি।
মেয়েরা এখন আকাশ অথবা অর্ধেক আকাশকে ছাপিয়েও, সংগ্রামের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্বে এগিয়ে এসেছে। তারা কেবল মেয়ে হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে সমাজকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলবে। আকাশ থেকে আকাশে ছড়িয়ে যাক মেয়েদের নেতৃত্বে – এই সব মানুষেরই আন্দোলন।
0 Comments
Post Comment