- 18 February, 2023
- 0 Comment(s)
- 222 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
“যে কি না রাঁধে, সে চুলও বাঁধে”, বাংলার প্রবাদ। কিন্তু বহু শতাব্দী পূর্বে খাস মেক্সিকোর এক অধিবাসিনী বলে উঠেছিলেন, “যে কি না রাঁধে, সে কিন্তু চাইলে পরে দর্শনতত্ত্বের বিষয়েও গভীর আলোচনা করতে পারে!” পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সেদিনের সেই উচ্চারণ কালগর্ভে ঢাকা পড়তে চাইলেও, আমরা কৃতজ্ঞ থাকব নোবেলজয়ী আরেক মেক্সিকান সাহিত্যিক অক্তাভিও পাজের কাছে – যিনি কি না ইতিহাস ঘেঁটে আবারও স্মৃতির আলোয় তুলে এনেছিলেন প্রথম যুগের সেই নারীবাদী রমণীকে। নারীবাদের মূলগত ধারণা সৃষ্টিরও অনেক আগেই যিনি কি না মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে কথা বলে এসেছিলেন। সময়টা ১৬৪৮ থেকে ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ। মেরি উলস্টোনক্র্যাফট, ভার্জিনিয়া উলফ অথবা সিমন দ্য বোভোয়ারও আত্মপ্রকাশ ঘটতে অনেক দেরি আছে তখন।
তাঁর নাম ছিল ইনেস। যদিও এই নামে তাঁকে অধিকাংশ কেউ চিনে উঠতে পারেনি। এই নাম ছিল কেবল তাঁর জন্মের সময়ে ও শৈশব কৈশোরে বেড়ে ওঠার সম্পত্তি। তাঁকে পৃথিবী চেনে সর হুয়ানা (ইনেস) দ্য লা ক্রুজ, এই নামেই। ইংরেজিতে Sor Juana Inés de la Cruz, স্প্যানিশ উচ্চারণবিধি অনুযায়ী ইংরেজি ‘J’ অক্ষর ‘হ’এর মতো শোনায়, তাই আমি হুয়ানা বলেই আলোচ্য সন্ন্যাসিনীকে এই প্রবন্ধে উল্লেখ করব। ‘সর’ অর্থে ‘সন্ন্যাসিনী’, ‘সান’ অর্থে ‘সন্ন্যাসী’। আমার স্প্যানিশের দৌড় এখানেই সমাপ্ত। এবারে বরং সর হুয়ানার কথায় ফিরি।
হুয়ানা, ওরফে ইনেসের জন্ম ১২ নভেম্বর ১৬৪৮, মেক্সিকো শহরে, কোনও এক স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক কর্মচারীর অবৈধ সন্তান হিসেবে। মেক্সিকো শহর তখন ‘নয়া স্পেন’এর রাজধানী, প্রায় সমস্ত লাতিন আমেরিকাই তখন স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তর্গত। এই সমস্ত উপনিবেশে জন্মগ্রহণ করা মানুষদের, যাঁদের কি না অভিভাবকদের কোনও একজন কোনও ভাবে স্পেনীয় রক্তের অধিকারী, তাদেরকে ‘ক্রিওলা’ বলে অভিহিত করা হতো। ইনেসের দাদু ছিলেন বিপুল পরিমাণে ভূসম্পত্তির অধিকারী। তাই বাবার মুখ কোনও দিন না দেখলেও, মা ও দাদুর কল্যাণে মোটামুটি সচ্ছল ভাবেই ইনেসের শৈশব কাটে। দাদুর জমিদারিতে যে বিশাল গির্জা ও লাইব্রেরি ছিল, সেখান থেকেই পড়াশোনার প্রতি ইনেসের অনুরাগ তৈরি হয়। শোনা যায় মাত্র তিন বছর বয়সের মধ্যেই নাকি ইনেস লাতিন পড়তে ও লিখতে পারঙ্গম হয়ে ওঠে। পাঁচ বছর বয়সেই অঙ্কের হিসেবনিকেশে তুখোড় হয়ে ওঠে ইনেস। আট বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখে সে, তাও আবার গির্জার অনুষ্ঠানে সেটি গান হিসেবে গাওয়ারও উপযোগী ছিল। বয়ঃসন্ধি এসে পড়তে না পড়তেই ততদিনে ইনেস শিখে ফেলেছে গ্রিক লজিক, সমবয়সীদের সে দিচ্ছে লাতিনের পাঠ, এবং তারই সঙ্গে আয়ত্ত করে ফেলেছে প্রাচীন আজটেক ভাষারও অনেকটাই।
পুরুষের ছদ্মবেশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছিল ইনেস। সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি তার। কিছুদিন অভিজাত এক পরিবারে গৃহকর্ত্রীর সহচরী হিসেবে সে কাজ করে। সেই সময়েই পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষা, দর্শনের বিষয়ে আরও খানিক পোক্ত হয়ে ওঠে সে। কাব্য, সঙ্গীত এবং বিজ্ঞান – এই সবকটি বিষয়েই তার পারদর্শীতার খবর ‘নয়া স্পেন’এর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই সময়েই একাধিক বিবাহের প্রস্তাব আসে তার। সপ্তদশী ইনেস, সেই সমস্ত প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে কেবল মাত্র নারী হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করবে এবং জারি রাখবে পড়াশোনার ধারাটুকুই, এই অঙ্গীকার করে। সেই কারণেই ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাসিনী হিসেবে মেক্সিকোর সাধু জোসেফের মঠে সে নিজেকে নথিভুক্ত করে। পরবর্তীতে অনেক ঐতিহাসিক, সমালোচকেরাই এই কথা বলেছেন – সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকার, নিজের স্বাতন্ত্র ও নিজের পড়াশোনাকে চালিয়ে যেতে চাইলে মেয়েদের কাছে এর চেয়ে ভালো কোনও বিকল্প ছিল না। অনেক মেয়েই নিজেদের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখবে বলে সন্ন্যাসিনী হয়ে উঠতে চাইত। কিন্তু ইনেস, সন্ন্যাস গ্রহণের পর যিনি কিনা সর হুয়ানা নামে পরিচিত হন, তিনি ছিলেন তাদের চেয়েও আরও বেশ কয়েক কদম এগিয়ে।
সর হুয়ানা কবিতা লিখেছিলেন। সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। নাটক নির্মাণ করেছিলেন। দুর্ভাগ্য আমাদের যে তাঁর অধিকাংশ রচনাই সংরক্ষণ করা যায়নি। তার পিছনেও নিহিত রয়েছে ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রেরই আস্ফালন। নভেম্বর ১৬৯০তে পুয়েবলা শহরের বিশপ বেনামে, সর ফিলোতিয়া বা সন্ন্যাসিনী ফিলোতিয়া এই ছদ্মনামে, সর হুয়ানার অনুমতি ছাড়াই তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটি ছিল জনৈক সন্ন্যাসী ফাদার আন্তনিও ভিয়েরার লেখা একটি চল্লিশ বছরের পুরনো নীতিবক্তৃতার বিষয়ে সমালোচনা। যদিও সর হুয়ানা এই সমালোচনাটিকে গঠনমূলক আঙ্গিকেই রচনা করেছিলেন, একতরফা আক্রমণের কোনও উদ্দেশ্যই তাঁর ছিল না – তবুও সমসাময়িক সন্ন্যাসীরা একে গির্জার ধর্মীয় রীতিনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর উপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখতে শুরু করেন। হুয়ানা এই বিতর্কের প্রেক্ষিতে ‘সর ফিলোতিয়াকে জবাব’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ এবারে নিজের উদ্যোগেই প্রকাশ করেন। সেই রচনায় তিনি সরাসরি মেয়েদের শিক্ষা, বরিষ্ঠ সন্ন্যাসিনীদের মাধ্যমে কমবয়সী শিক্ষানবিশ সন্ন্যাসিনীদের শিক্ষালাভের ব্যবস্থা, ইত্যাদি কিছু প্রাথমিক অথচ জরুরি ও সময়োপযোগী বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ইতিপূর্বে সন্ন্যাসিনী ফিলোতিয়ার নামে পূর্বের প্রবন্ধটি প্রকাশের সময়, সেই বিশপ পাদটীকা হিসেবে স্বনামে একটি চিঠি লিখে কাল্পনিক সন্ন্যাসিনী ‘ফিলোতিয়া’কে তাঁর কর্তব্যের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছিলেন। স্পষ্টই বলেছিলেন মেয়েদের এতকিছু বিষয়কে নিয়ে ভাবনাচিন্তা নিষ্প্রয়োজন। সত্যিকারের ফিলোতিয়া অথবা সর হুয়ানার জবাব যেন আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। নিজের নিবন্ধে হুয়ানা সরাসরি মেয়েদের প্রশাসনিক পদাধিকার প্রাপ্তির বিষয়েও সওয়াল করেন। কিন্তু ক্রমশ গির্জার চাপেই একসময়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। ১৬৯৩ সালের পর থেকে আর সেভাবে তাঁর লেখালিখির কথা শোনা যায় না। এমনকি নিজের প্রায় সমস্ত রচনাই পুড়িয়ে দেন তিনি। অন্য একেকটি সূত্র থেকে জানা যায় গির্জাই নাকি তাঁর সমস্ত রচনাকে বাজেয়াপ্ত করে এবং তা পুড়িয়ে দেয়। শতাধিক অপ্রকাশিত লেখার মধ্যে হাতে গোণা কয়েকটি পাণ্ডুলিপি মাত্রই অবশিষ্ট থাকে। সেই থেকেই ইতিহাসের ভস্মাবশেষ থেকে হুয়ানাকে পুনরুদ্ধার করেন অক্তাভিও পাজ। ১৯৮৮ সালে, জন্মের প্রায় ৩৫০ বছর পর পাজের কলমে প্রকাশিত হয় ‘সর হুয়ানা অর দ্য ট্র্যাপস অব ফেইথ’, পুনর্জন্ম ঘটে পৃথিবীর অন্যতম প্রথম এক নারীবাদী কলমের। আভিলা শহরের আরেক সন্ন্যাসিনী তেরেসাকে প্রতিধ্বনিত করে যিনি লিখেছিলেন,
“যে কি না রাঁধে, সে কিন্তু চাইলে পরে দর্শনতত্ত্বের বিষয়েও গভীর আলোচনা করতে পারে!”
... আর গির্জাকে লেখা শেষদিককার চিঠিতে নামসই করতে গিয়ে যিনি দস্তখত করেছিলেন, “আমি, সর হুয়ানা, সমস্ত নারীদের মধ্যে যে কি না ঘৃণ্যতমা!”
উলস্টোনক্র্যাফট, উলফ অথবা আজকের রোকেয়ারা সবাই, সেই হুয়ানারই উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে চলেন।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার
0 Comments
Post Comment