বিবাহিত নারী (২৫)

  • 05 May, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 352 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
আসল ব্যাপার হল সুবিবেচনার সঙ্গে ছাড় দিতে জানা। স্বামী যদি ‘চুক্তিপত্রে কয়েকবার ছোরাও চালান’ তাহলেও চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে। কিন্তু অন্যান্য মুহূর্তে চোখ বড়ো করে খোলা রাখতে হবে। নির্দিষ্ট করে বললে, একজন বিবাহিত মহিলা অবিশ্বাস করেন অল্পবয়সি মেয়েদের যারা, তাঁর মতে খুবই খুশি হবে, তাঁর ‘অবস্থান’ কেড়ে নিতে। একজন উদ্‌বেগজনক প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে স্বামীকে ছিনিয়ে আনার জন্য স্ত্রী তাঁকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন, স্বামীর মন ঘোরানোর চেষ্টা করবেন।

আসল ব্যাপার হল সুবিবেচনার সঙ্গে ছাড় দিতে জানা। স্বামী যদি ‘চুক্তিপত্রে কয়েকবার ছোরাও চালান’ তাহলেও চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে। কিন্তু অন্যান্য মুহূর্তে চোখ বড়ো করে খোলা রাখতে হবে। নির্দিষ্ট করে বললে, একজন বিবাহিত মহিলা অবিশ্বাস করেন অল্পবয়সি মেয়েদের যারা, তাঁর মতে খুবই খুশি হবে, তাঁর ‘অবস্থান’ কেড়ে নিতে। একজন উদ্‌বেগজনক প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে স্বামীকে ছিনিয়ে আনার জন্য স্ত্রী তাঁকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন, স্বামীর মন ঘোরানোর চেষ্টা করবেন। প্রয়োজন পড়লে মাদাম দ্য পম্পাদুর-এর মডেল বা ছাঁচ গ্রহণ করবেন--অর্থাৎ, তিনি কম বিপজ্জনক একজন প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করবেন। কিছুই যদি সফল না-হয়, তাহলে কান্নাকাটি, নার্ভাস ব্রেকডাউন, আত্মহত্যার চেষ্টা ইত্যাদি পথ অনুসরণ করবেন। কিন্তু অতিরিক্ত ক্ষোভ এবং অভিযোগ স্বামীকেই ঘর থেকে বের করে দেবে। মহিলারা সেই মুহূর্তেই নিজেদের অসহনীয় করে তোলেন যখন স্বামীকে প্রলুব্ধ করার প্রয়োজন সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়ে। আর এইক্ষেত্রে স্ত্রী যদি জিততে চান, তাহলে তিনি দক্ষতার সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন স্পর্শকাতর অশ্রু এবং বীরত্বপূর্ণ হাসি, কালো হুমকি এবং প্রণয়-ভান। গোপন করা, কৌশল করা, ঘৃণা করা এবং নীরবে ভয় করা, স্বামীর দেমাক এবং দুর্বলতার ওপর বাজি ধরা, তাঁকে চালাকিতে টেক্কা দেওয়া, তাঁকে খেলানো, তাঁকে গুলিয়ে দেওয়া--এগুলি অত্যন্ত দুঃখজনক শিক্ষা। স্ত্রীর বড়ো অজুহাত হল যে, বিবাহের মধ্যে তাঁর সমগ্রভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে : তাঁর কোনো পেশা নেই, কোনো যোগ্যতা নেই, কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই, তাঁর নিজের পদবিও আর তাঁর থাকে না, স্বামীর ‘অর্ধেক’ ব্যতীত তিনি আর কিছুই নন। স্বামী যদি তাঁকে পরিত্যাগ করেন, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি নিজের মধ্যে এবং নিজের বাইরে কোথা থেকেও কোনো সাহায্য পাবেন না। A. de Monzie এবং Montherlant-এর মতো করে সোফি টলস্টয়কে দোষারোপ করা সহজ। কিন্তু যদি তিনি বৈবাহিক জীবনের ভণ্ডামিকে প্রত্যাখ্যান করতেন, তাহলে তিনি কোথায় যেতেন? কোন্‌ নিয়তি তাঁর জন্য অপেক্ষা করতো? এটা ঠিকই যে, তাঁকে একজন ঘৃণ্য কুচুটে মিথ্যেবাদী বলেই মনে হয় : কিন্তু তাই বলে কি আমরা তাঁকে বলতে পারি তাঁর অত্যাচারীকে ভালোবাসতে এবং তাঁর দাসত্বকে আশীর্বাদ করতে? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আনুগত্য এবং বন্ধুত্ব থাকার অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হল তাঁরা উভয়েই একে অপরের বিষয়ে স্বাধীন এবং দৃঢ়ভাবে সমান হবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত পুরুষই একা অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী থাকেন এবং আইন বা রীতিপ্রথার সাহায্যে পৌরুষ তাঁকে যে বিশেষাধিকার দেয় তা তিনি ধরে রাখেন, তখন এটা স্বাভাবিক যে, তিনি প্রায়শই একজন অত্যাচারী হিসাবেই আবির্ভূত হবেন, যা নারীকে প্ররোচিত করবে বিদ্রোহ করতে এবং ফন্দিফিকির আঁটতে।

দাম্পত্য জীবনের ট্র্যাজেডি বা ক্ষুদ্রতাকে অস্বীকার করার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেন না। তবে বিবাহের সমর্থকরা যা বলেন তা হল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব আসে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার বৈরীভাব থেকে, বৈবাহিক প্রতিষ্ঠান থেকে নয়। অন্যদের মধ্যে টলস্টয়ও ‘যুদ্ধ এবং শান্তি’ উপন্যাসের উপসংহারে আদর্শ দম্পতির বর্ণনা দিয়েছেন। এই আদর্শ দম্পতি হলেন পিয়ের এবং নাতাসা। নাতাসা ছিলেন ছেনালিপূর্ণ এবং একজন রোমান্টিক অল্পবয়সি মেয়ে। বিবাহিত হওয়ার পর তিনি তাঁকে ঘিরে থাকা সকলকে অবাক করে দেন। কারণ : পোশাক-পরিচ্ছদ, জগৎ, সমস্ত চিত্তবিক্ষেপ পরিত্যাগ করেন শুধুমাত্র স্বামী এবং সন্তানদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য। তিনি হয়ে ওঠেন মর্যাদাসম্পন্ন পূর্ণবয়স্ক বিবাহিত মহিলা চরিত্রের প্রতিনিধিস্বরূপ।

এরপর থেকে নাতাসার জীবনে আর সেই দেদীপ্যমান শিখা ছিল না যা আগে তাঁকে মোহনীয় করে তুলেছিল। এখন প্রায়শই তাঁর মুখ আর দেহাবয়বকেই কেবল লক্ষ করা গেছে, তাঁর আত্মাকে আর দেখা যায়নি। কেবল দেখা গেছে একজন শক্তসমর্থ, সুন্দর এবং অনেক সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম একজনস্ত্রীজাতীয় প্রাণীকে।

পিয়েরের প্রতি নিজের প্রতিজ্ঞাপূর্বক ভালোবাসার মতোই একচেটিয়া ভালোবাসা দাবি করেন নাতাসা। স্বামীর প্রতি তিনি ঈর্ষান্বিত। গোটা পরিবারের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য স্বামীও সমস্ত ঘোরা-বেড়ানো, সব বন্ধুত্ব পরিত্যাগ করেন।

তিনি সাহস করতেন না ডিনার করতে ক্লাবে যেতে বা একটি দীর্ঘসময়ের ভ্রমণে উদ্যোগী হতে কেবল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের ব্যাবসা বা কাজ ছাড়া, যে-বিষয়ে কিছু না বুঝেই তাঁর স্ত্রী চরম গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন।

পিয়ের ছিলেন তাঁর স্ত্রীর কর্তৃত্বের অধীনে। কিন্তু অন্যদিকে :

একান্তে নাতাসা কিন্তু নিজেকেই স্বামীর দাস বানিয়েছিলেন। স্বামীর তথাকথিত আদেশ দ্বারাই পুরো বাড়ি পরিচালিত হত। স্বামীর আদেশ--অর্থাৎ, পিয়েরের ইচ্ছা--যা নাতাসা অনুমান করার চেষ্টা করতেন।

বেশ কিছুটা দূরে চলে যাওয়ার পর পিয়ের যখন ফিরে আসেন, তখন নাতাসা পিয়েরকে অধৈর্য হয়ে স্বাগত জানান, কারণ পিয়েরের অনুপস্থিতিজনিত কারণে তিনি ভুগেছেন। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটি বিস্ময়কর ঐকতান কাজ করে। অর্ধেক শব্দ বলামাত্রই তাঁরা একে-অপরকে বুঝতে পারেন। সন্তান, ঘর, প্রিয় ও সম্মাননীয় স্বামীকে নিয়ে নাতাসা একটি নির্ভেজাল আনন্দ উপভোগ করেন।

এই অত্যন্ত সুখী, মনোরম ছবি আরও গভীর অধ্যয়নের দাবি রাখে। টলস্টয় বলেছেন, দেহের মধ্যে আত্মার ন্যায় নাতাসা আর পিয়ের অভিন্ন। কিন্তু আত্মা যখন দেহ ত্যাগ করে, তখন তা একেবারে মৃত্যু। পিয়ের যদি নাতাসাকে ভালোবাসা বন্ধ করে দেন তাহলে কী হবে? পুরুষালি চাপল্যের অনুমানকে প্রত্যাখ্যান করেছেন লরেন্সও। ডন রামন সবসময়ই ভালোবাসবেন ছোটো ভারতীয় তেরেসাকে, যিনি তাঁকে তাঁর হৃদয় অর্পণ করেছেন। যদিও অনন্য, পরম, চিরন্তন প্রেমের অন্যতম প্রবল উত্সাহী সমর্থক অঁন্দ্রে ব্রেতোঁ স্বীকার করতে বাধ্য হন যে অন্তত বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রেমটি তার উদ্দেশ্যকে ধোঁকা দিতে পারে : ভুল করেই হোক বা বিশ্বস্ততার অভাবের জন্যই হোক--মহিলার ক্ষেত্রে ফলটা দাঁড়ায় শেষে একই। তাঁরা পরিত্যক্ত হন। পিয়ের ছিলেন বলিষ্ঠ এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণ। শারীরিকভাবে অন্যান্য মহিলার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হবেন। নাতাসা ঈর্ষান্বিত। শীঘ্রই তাঁদের সম্পর্ক টোকো হয়ে যাবে। অথবা, নাতাসাকে ছেড়ে চলে যাবেন পিয়ের, যা নাতাসার জীবনকে ধ্বংস করে দেবে। অথবা পিয়ের মিথ্যা কথা বলবেন আর বিরক্তি নিয়ে নাতাসাকে সহ্য করে যাবেন, যা নষ্ট করে দেবে পিয়েরের জীবন। অথবা তাঁরা আপস এবং অর্ধেক উদ্যম নিয়ে বাঁচবেন, যা উভয়কেই অসুখী করবে। কেউ আপত্তি করে বলতে পারেন যে, নাতাসার অন্তত সন্তান তো থাকবে। কিন্তু সন্তানরা তখনই কেবল আনন্দের উৎস হতে পারে যখন পরিবারের মধ্যে বজায় থাকে ভারসাম্য বা সাম্যাবস্থা এবং সেই পরিবারের একটি শীর্ষবিন্দু হলেন স্বামী। যদিও অবহেলিত, ঈর্ষান্বিত স্ত্রীদের জন্য সন্তানরা হয়ে ওঠে অকৃতজ্ঞ বোঝা। পিয়েরের ধারণার প্রতি নাতাসার অন্ধ ভক্তির প্রশংসা করেছেন টলস্টয়। কিন্তু আরেকজন পুরুষ, লরেন্স, যিনিও মহিলাদের থেকে অন্ধ আনুগত্য দাবি করেন, তিনি পিয়েরে এবং নাতাসাকে নিয়ে উপহাস করেন। অন্যান্য পুরুষের মতে, একজন পুরুষ তাই মাটির দেবতা হতে পারেন, সত্যিকারের দেবতা নয়। তাঁকে উপাসনা করতে গিয়ে বাঁচার বদলে নিজের জীবনকেই একজন হারিয়ে ফেলেন। কীভাবে তা জানা যায়? পুরুষালি দাবিগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। কর্তৃত্ব আর কোনো ভূমিকা পালন করে না। স্ত্রীদের অবশ্যই বিচার এবং সমালোচনা করতে হবে। দুর্বল প্রতিধ্বনি ছাড়া তাঁরা আর কিছুই হতে জানেন না। তদুপরি, এটাও অপমানজনক যে, স্ত্রীর ওপর সেই সব নীতি বা মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়া যা তিনি তাঁর নিজস্ব স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা মানেন না। যা তিনি পারেন তা হল স্বামীর চিন্তাভাবনা ভাগ করে নিতে, আর তা তিনি করতে পারেন কেবল তাঁর নিজের স্বাধীন বিচারের মাধ্যমে। তাঁর কাছে যা অচেনা, তার অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান--কোনোটিই তাঁর করা উচিত নয়। অস্তিত্বের জন্য অন্য কারোর থেকে তিনি তাঁর নিজস্ব যুক্তি ধার করতে পারেন না।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment