মা (প্রথম কিস্তি)

  • 30 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 278 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
এমন সামান্য কয়েকটি বিষয় আছে যেখানে বুর্জোয়া সমাজ আরও বেশি করে ভণ্ডামি প্রকাশ করে। যেমন গর্ভপাত হল একটি ঘৃণ্য অপরাধ, স্পষ্ট করে যার উল্লেখ পর্যন্ত অশোভন। একজন গর্ভবতী মহিলার আনন্দ ও যন্ত্রণার বর্ণনা যখন একজন পুরুষ লেখক করেন, তখন তা যথাযথ। যেই তিনি তেমন একজন মহিলার বিষয়ে কথা বলেন যিনি গর্ভপাত করিয়েছেন, তখন তাকে দোষারোপ করা হয় জঞ্জাল ঘাঁটা এবং ঘৃণ্য আলোয় মানবতাকে বর্ণনা করার জন্য। ফ্রান্সে তবুও প্রতি বছরে যত সন্তানের জন্ম হয়, তত সংখ্যকই গর্ভপাত হয়।

মাতৃত্বের মাধ্যমেই একজন নারী সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন করেন তাঁর শারীরবৃত্তীয় নিয়তি। এটাই তাঁর ‘স্বাভাবিক’ বৃত্তি--যেহেতু তাঁর সমস্ত গঠনই মানবপ্রজাতিকে চিরস্থায়ী করার অভিমুখী। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি যে, মানব সমাজ কখনোই প্রকৃতির কাছে পরিত্যক্ত নয়। বিশেষ করে প্রায় এক শতাব্দী ধরে, প্রজনন কার্য আর একমাত্র জৈবিক সুযোগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। এটি নিয়ন্ত্রিত হয় ইচ্ছার দ্বারা। বেশ কিছু দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জন্ম-নিয়ন্ত্রণ’-এর সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। ক্যাথলিক ধর্মের প্রভাবাধীন দেশগুলিতে এই কাজটি চলে গোপনে। সেখানে পুরুষরা হয় কোইটাস ইন্টারাপ্টাস[1] অনুশীলন করেন, নাহলে মহিলারা প্রেম-কার্য করার পর নিজেদের শরীর থেকে শুক্রাণু বের করে দেন। প্রায়শই দেখা যায় যে, বিষয়টি প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরক্তির উৎস হিসাবে কাজ করে। নিজের আনন্দকে দমন করার জন্য পুরুষেরা বিরক্ত হন। এদিকে, প্রত্যেক দিনের ধোয়ার কাজ[2] মহিলারাও পছন্দ করেন না। স্ত্রীর খুব উর্বর গর্ভের জন্যও আবার স্বামী রুষ্ট হন। অন্যদিকে স্ত্রী ভয় পান এইসব জীবন্ত জীবাণুকে যা তাঁর মধ্যে তাঁর স্বামীর দ্বারা খসে পড়ার ঝুঁকি থাকে। তাঁদের দু-জনের কাছেই এটা আতঙ্কের--যখন সতর্কতা সত্ত্বেও একজন মহিলা ‘অন্তঃসত্ত্বা’ হয়ে যান। যে-সমস্ত দেশে গর্ভনিরোধক পদ্ধতিগুলি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, সেই সমস্ত দেশে বিষয়টি আকছার ঘটে। ফলত, বিপরীত বিষয়টিও একটি বিশেষ গুরুতর রূপ ধারণ করে : সেটি গর্ভপাত। ‘জন্ম-নিয়ন্ত্রণ’-এর অনুমতি দেয় এমন দেশগুলিতেও গর্ভপাত নিষিদ্ধ বলে এর সুযোগ সেখানে অনেক কম। যদিও, ফ্রান্সে অনেক মহিলাকে এই অপারেশন করানোর জন্য কোণঠাসা করে দেওয়া হয়-- যা তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগেরই প্রেমজীবনকে  তাড়িত তাড়িত করে তোলে। 

এমন সামান্য কয়েকটি বিষয় আছে যেখানে বুর্জোয়া সমাজ আরও বেশি করে ভণ্ডামি প্রকাশ করে। যেমন গর্ভপাত হল একটি ঘৃণ্য অপরাধ, স্পষ্ট করে যার উল্লেখ পর্যন্ত অশোভন। একজন গর্ভবতী মহিলার আনন্দ ও যন্ত্রণার বর্ণনা যখন একজন পুরুষ লেখক করেন, তখন তা যথাযথ। যেই গর্ভপাত করিয়েছেন এমন একজন মহিলার বিষয়ে তিনি কথা বলেন, তখন তাঁকে দোষারোপ করা হয় জঞ্জাল ঘাঁটা এবং নিকৃষ্ট আলোয় মানবতাকে বর্ণনা করার জন্য। ফ্রান্সে তবুও প্রতি বছরে যত সন্তানের জন্ম হয়, তত সংখ্যকই গর্ভপাত হয়। এই ঘটনা এতটাই বিস্তৃত যে মহিলাদের অবস্থার সঙ্গে জড়িত ঝুঁকিগুলির মধ্যে একটি হিসাবে গর্ভপাতকে বিবেচনা করা উচিত। যদিও, আইনের বইয়ের নিয়মাবলি গর্ভপাতকে অপরাধ হিসাবে স্থির করার বিষয়ে একগুঁয়ে। ফলত, গর্ভপাতের এই সূক্ষ্ম কাজটি গোপনেই কার্যশীল করা প্রয়োজন। গর্ভপাত আইনের বিরুদ্ধতার জন্য আবাহন-করা যুক্তির চেয়ে অযৌক্তিক আর কিছুই হতে পারে না। যদিও এই হস্তক্ষেপকে বিপজ্জনক বলে দাবি করা হয়। কিন্তু সৎ চিকিত্সকরা ডক্টর ম্যাগনাস হিরশফেল্ডের[3] সঙ্গে স্বীকার করেছেন যে : “একজন সত্যিকারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের হাতে একটি ক্লিনিকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষামূলক ব্যবস্থাসহ গর্ভপাত করানো হলে সেই সব গুরুতর বিপদ থাকে না যার অস্তিত্বকে জোরের সঙ্গে ঘোষণা করে পেনাল কোড"। বিপরীতে বরং বর্তমান অবস্থাই মহিলাদের একটি বড়ো বিপদ বা ঝুঁকির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ‘দেবদূত নির্মাতাদের’[4] দক্ষতার অভাব এবং যে-পরিস্থিতির মধ্যে তাঁরা কাজ করেন তাই-ই বরং অনেক দুর্ঘটনার জন্ম দেয়, কখনো-সখনো তা প্রাণঘাতীও হয়ে ওঠে। জোরপূর্বক-মাতৃত্ব শেষ পর্যন্ত হাড়-জিরজিরে, অসুস্থ শিশুদেরকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করে, যে-সমস্ত শিশুকে তাদের বাবা-মায়েরা খাওয়াতে অক্ষম হবেন অথবা হাসপাতাল প্রশাসনের কল্যাণমূলক পরিষেবা বা ‘শিশু শহীদ’-এর শিকার হবে যারা। এটাও উল্লেখ করা উচিত, যে-সমাজ ভ্রূণের অধিকার রক্ষায় এতটাই নিরলস, সেই সমাজই বাচ্চার জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চাদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পাবলিক অ্যাসিস্টান্স নামক এই কলঙ্কিত প্রতিষ্ঠানের সংস্কার সাধনের পরিবর্তে আমরা বরং গর্ভপাতকারীদেরই অভিযুক্ত করি। শিশুদেরকে তাদের নির্যাতনকারীদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য যারা দায়ী, তাদেরকেই উলটে স্বাধীনভাবে থাকতে দেওয়া হয়। শিশু-জল্লাদরা শিশুদের ‘আতুরাশ্রম’ বা ব্যক্তিগত পালক ঘরে শিশুদের ওপর যে ভয়ংকর অত্যাচার চালান, সেদিকে আমরা চোখ বুজে থাকি। আর এটা যদি স্বীকার করা না-হয় যে, ভ্রূণটি হল সেই মহিলার যিনি সেটিকে বহন করছেন, তবে এই বিষয়ে আমরা একমত যে শিশুটি তার পিতামাতার জিনিস। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা সম্প্রতি একজন শল্যচিকিৎসককে আত্মহত্যা করতে দেখেছি যেহেতু তিনি গর্ভপাতের অনুশীলনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। আর এমন একজন পিতাকেও দেখেছি যিনি তাঁর ছেলেকে পিটিয়ে প্রায় মেরে ফেললেও তাঁকে তিন মাসের জেল দেওয়া হয়েছে। যদিও তাঁর সাজা স্থগিত রয়েছে। সম্প্রতি একজন বাবা তাঁর ছেলেকে যত্নের অভাবে ক্রুপ[5] রোগে মারা যেতে দিয়েছেন। ঐশ্বরিক ইচ্ছার প্রতি নিজের নিঃশর্ত সমর্পণের খাতিরে একজন মা তাঁর মেয়ের জন্য ডাক্তার ডাকতে অস্বীকার করেছিলেন। করবস্থানে শিশুরা তাঁকে পাথর ছুঁড়েছে। কিন্তু যখন কিছু সাংবাদিক তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তখন বেশ কিছু সৎ ব্যক্তি প্রতিবাদ করে বলেন যে শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের। ফলত বাইরে থেকে কোনোরকম হস্তক্ষেপই গ্রহণযোগ্য নয়। আজকের দিনে ‘দশ লক্ষ শিশু বিপদে আছে’--এমনটাই জানিয়েছে এই সন্ধ্যা[6]পত্রিকা। সান্ধ্য-ফ্রান্স[7] ছাপিয়েছে :  “পাঁচ লক্ষ শিশুর শারীরিক বা নৈতিক বিপদে রয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ”। উত্তর আফ্রিকায় আরব মহিলাদের নিজেদের গর্ভপাত করানোর কোনো উপায় নেই। তাঁদের জন্ম দেওয়া দশটি সন্তানের মধ্যে সাত জন বা আট জন সন্তানই মারা যায়। কেউ এ ব্যাপারে উদ্‌বেগও প্রকাশ করেন না, যেহেতু এই বেদনাদায়ক এবং মাতৃত্বের অযৌক্তিক আধিক্য হত্যা করে ফেলেছে মাতৃ-অনুভূতিকে। এই সবই যদি নৈতিকতার পক্ষে থাকে, তাহলে এটা কী ধরনের নৈতিকতা? অবশ্যই বলা উচিত যে, ভ্রূণ জীবনের প্রতি সবচেয়ে শ্রদ্ধাশীল পুরুষরাই আবার প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুর জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে ইতস্তত বোধ করেন না।

 

 

[1]এটি জন্ম-নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি যেখানে যৌন মিলনের সময় বীর্যপাতের আগে একজন পুরুষ একজন মহিলার যোনি থেকে তাঁর লিঙ্গ প্রত্যাহ্যার করে নেন গর্ভধারণ আটকানোর জন্য।

[2]ধোয়ার কাজ বলতে এখানে ‘vaginal douche’-এর কথা বলা হয়েছে।

[3]জার্মান চিকিৎসক ও সেক্সোলজিস্ট।

[4]একজন দেবদূত নির্মাতা হলেন একজন মহিলা (সাধারণত ডাক্তার নন) যিনি স্বেচ্ছায় অন্য মহিলার অবাঞ্ছিত গর্ভাবস্থা বন্ধ করার জন্য কাজ করেন।

 

[5]ভাইরাস-সৃষ্ট এক ধরনের রোগ যেখানে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ হয়।

[6]ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি ফরাসি দৈনিক। পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ ১৯৩৭ সালের ১ মার্চ।

[7]১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি ফরাসি পত্রিকা।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment