- 31 May, 2021
- 0 Comment(s)
- 687 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
‘কাসান্দ্রা’, একটি প্রবন্ধের নাম। প্রকাশকালঃ ১৮৫২। তখনও রচয়িতা যিনি, তিনি আন্তর্জাতিক মহলে সেভাবে সমাদৃত হয়ে ওঠেননি। অবশ্য লেখিকা হিসেবে তাঁর সেই সমাদর বোধহয় আজ এতদিনেও সেভাবে জুটেছে বলে মনে হয় না। অথচ, এই ‘কাসান্দ্রা’কে ব্রিটিশ নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল হিসেবে গবেষকেরা বিবেচনা করেন। এই প্রবন্ধটিতে, লেখিকা তখনকার দিনের নারীসমাজের অন্তঃসারশূন্য এক অস্তিত্বের কথা নিজের সাবলীল গদ্যে তুলে ধরেছিলেন। ব্যাখ্যা করেছিলেন একজন নারীর জীবনের অনন্ত শূন্যতার কথা। যা তিনি তাঁর নিজের মায়ের জীবন দিয়ে, নিজের দিদির জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। সেই সমস্ত ইংরেজ পুরনারীদের জীবনের কথাই তাঁর রচনাতে উঠে এসেছিল, যাঁদের সময়ের কোনও মূল্য নেই – শিক্ষা অথবা অর্জিত মেধারও কোনও প্রয়োগ নেই। কেবল সংসার ও মাতৃত্ব – এতেই তাঁদের জীবনের চরম সার্থকতা। সরাসরি এই ভাষাতেই লেখিকা তাঁর বক্তব্যকে, সেই প্রবন্ধে তুলে ধরেছিলেন। এর পরের ঘটনাতেও তাই আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই নেই। ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট দার্শনিক ও সমাজ-সংস্কারক জন স্টুয়ার্ট মিল যখন, নারীদের ভোটাধিকার বিষয়ে সাফ্রেজ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন – তখন সেই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেত্রী হিসেবে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন ‘কাসান্দ্রা’র লেখিকাকে, সেই দায়িত্বভার গ্রহণ করতে।
১৯১৮তে সাফ্রেজ আন্দোলন প্রথম সাফল্য পেয়েছিল। ১৯২৮এ ইংল্যান্ডে সর্বস্তরে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। অথচ ততদিনে ১৩ই আগষ্ট, ১৯১০ - ‘কাসান্দ্রা’র লেখিকা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তাঁর দেখিয়ে যাওয়া পথেই আমরা আজও এগিয়ে চলেছি। কেবল ‘কাসান্দ্রা’র দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে নয়, আরও এক বিশাল দিগন্তকে তিনি উন্মোচিত করেছিলেন। তাঁর জন্মদিন, ১২ই মে, (১৮২০) পালিত হয় আন্তর্জাতিক নার্স দিবস বা ইন্টারন্যাশনাল ডে অব নার্সেস হিসেবে। এই অতিমারির মুহূর্তে যাঁকে, যাঁর আদর্শকে আমরা প্রতিনিয়তই স্মরণ করে চলেছি – তিনিই ‘কাসান্দ্রা’র কথা লিখেছিলেন। বিশেষজ্ঞেরা অনেকেই, মেরি উলস্টোনক্র্যাফট এবং ভার্জিনিয়া উলফের মধ্যবর্তী সময়কালের জন্য, তাঁকেই নারীমুক্তি ও নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। নয় দশকের বর্ণময় জীবনে যিনি আমাদের অনুপ্রেরণা, সন্দেহাতীত ভাবেই।
ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে তাঁর জন্ম, তাই নাম ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। পিতা উইলিয়াম এডোয়ার্ড নাইটিঙ্গেল ছিলেন ‘এ্যাবলিশনিস্ট’ আন্দোলনের সদস্য। ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় দাসপ্রথা নিবারণের জন্য এই ‘এ্যাবলিশনিস্ট’ গোষ্ঠীর সদস্যেরা তাঁদের বক্তব্য প্রচার করতেন। কাজেই ছোটবেলায় এমন একটি প্রগতিশীল পরিমণ্ডলেই ফ্লোরেন্সের জীবন কেটেছিল। যদিও, তাঁর মা এবং দিদিরা অতটাও মনের দিকে থেকে অগ্রসর হতে পারেননি বলেই, সাতাশ বছর বয়স অবধি তিনি যে অবিবাহিত থেকে সেবাব্রতে জীবন উৎসর্গ করবেন – সেই কথাটি ফ্লোরেন্স প্রকাশ্যে আনতে পারেননি। তাঁর মাও শেষ অবধি ফ্লোরেন্সের এই সিদ্ধান্তকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। ব্যক্তিগত জীবনে ফ্লোরেন্স ঈশ্বর-বিশ্বাসী ছিলেন। অন্তিম জীবনে এসে তিনি ঐশ্বরিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইতে তাঁর বক্তব্য, অনুভূতিকেও প্রকাশ করেছেন। যৌবনে ইজিপ্ট ভ্রমণের সময়, আবু সিম্বেল অথবা থেবেসের বিশালাকৃতি সমস্ত স্থাপত্যের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অনুভব করেছেন। সে কথা তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্র থেকে জানা গেছে। অথচ পেশাদার নার্সিং জীবনে তিনি যে মেধা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা, তার সঙ্গে যুক্তিবোধের পরিচয় দিয়েছেন – তাতে বোধকরি তাঁর চরিত্রের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং উজ্জ্বলতম দিকগুলিই প্রস্ফূটিত হয়েছে। নারীর সঙ্গে পুরুষের বিরোধ, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বিরোধ, বিজ্ঞানের সঙ্গে শিল্প অথবা ঈশ্বরের বিরোধ – এগুলি সবই আসলে আমাদের মনগড়া বিলাসিতা অথবা বিকৃতবুদ্ধির অহম ব্যতীত আর কিছুই নয়। সুন্দরের প্রকাশ উৎকর্ষে – এবং এর উলটো বক্তব্যটিও সমান ভাবে সত্যি।
১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ফ্লোরেন্সের আলাপ হয় রাজনীতিক ও প্রশাসক সিডনি হার্বার্টের সঙ্গে। এই বন্ধুত্ব আজীবন অটুট থাকবে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় যখনই ফ্লোরেন্সের তরফে কোনও প্রশাসনিক সহায়তার প্রয়োজন হয়েছে, ইংল্যান্ডের প্রাক্তন যুদ্ধসচিব হিসেবে সিডনি হার্বার্ট সেই সহায়তা পাইয়ে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর দ্য কেয়ার অব সিক জেন্টলউওম্যান হাসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। সেই বছরেরই অক্টোবর মাসে ক্রিমিয়া যুদ্ধের সূচনা হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, রাশিয়া এবং ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডও সেই যুদ্ধে যোগদান করে। কনস্ট্যানটিনোপল, অধুনা ইস্তানবুলের কাছে স্কুটারি যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনীর হাসপাতালের করুণ পরিণতির কথা ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছয়। এই সময়ে, ফ্লোরেন্স এবং তাঁর পারিবারিক বন্ধু মেরি ক্লার্কের নেতৃত্বে আটত্রিশ জন স্বেচ্ছাসেবক নার্স এবং পনেরো জন ক্যাথলিক নার্সের একটি যৌথ দলকে স্কুটারিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত রূপায়ণের পিছনে সিডনি হার্বার্টেরও সহায়তা ছিল। আটত্রিশ জনের দলটি ইস্তানবুল ছাড়িয়ে আরও দূরে, কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত একটি ব্রিটিশ সেনাছাউনির দায়িত্ব নেয়। ফ্লোরেন্স সহ বাকিরা স্কুটারির হাসপাতালেই তাঁদের কাজ শুরু করেন।
স্কুটারির যুদ্ধক্ষেত্রে এসে ফ্লোরেন্স প্রথমেই যে বিষয়টিকে অনুধাবন করেন সেটি হল, যুদ্ধে – অস্ত্রের আঘাতে সে সময়ে যত না সেনামৃত্যু ঘটেছে, তার চেয়ে অন্তত দশগুণ বেশি পরিমাণে সেনামৃত্যুর কারণ হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সেনাশিবিরগুলিতে সেই সময় যে চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় থাকতো, নিকাশি বা পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার কোনও ঠিক-ঠিকানা অবধি থাকতো না – সেই পরিবেশে টাইফুস, টাইফয়েড, কলেরা ও ডিসেন্ট্রির মতো ভয়াবহ রোগ নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত। স্কুটারিতে স্বাস্থ্যবিধির প্রয়োগ, নিকাশি ও পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার উন্নতি এবং তার মাধ্যমে স্বচ্ছ নির্মল পরিবেশকে নিশ্চিত করা – স্রেফ এইটুকু করতে পেরেছিলেন বলেই, ফ্লোরেন্সের তত্ত্বাবধানে সামান্য কিছু সময়ের ব্যবধানেই স্কুটারি ছাউনিতে সেনামৃত্যু পরিসংখ্যান ৪২% থেকে ২%এ নেমে আসে। হাতে একটি ছোট্ট প্রদীপ নিয়ে অসুস্থ রোগীদের শিয়রে শিয়রে ঘুরে বেড়ানো ফ্লোরেন্সের সেই বিখ্যাত ছবিটিও এই ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে মনে রেখেই চিত্রিত হয়েছিল। ক্রিমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই তাই ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ কিংবদন্তীর জন্ম। স্বাস্থ্যবিধি এবং সেবা – এই দুটি বিষয়কেই আশ্চর্য দক্ষতায় বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিতে আধুনিক পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব তাই নাইটিঙ্গেল এবং তাঁর ক্রিমিয়া যুদ্ধে অংশ নেওয়া সহকারী সেবাব্রতীদের উপরেই বর্তায়। কেন বিশেষ করে ‘বৈজ্ঞানিক’ - এই বিশেষণটিকে নিয়ে এলাম ?
কারণ, স্বাস্থ্যবিধি এবং হাসপাতালের অন্যান্য নিয়মকানুন কি হওয়া উচিত – তা কেবল একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানীর পক্ষেই বলা সম্ভব, এবং এহ বাহ্য – আমরা অনেকেই আশ্চর্য হয়ে যাবো এটি শুনলে যে, সংখ্যাতত্ত্ব এবং রাশিবিজ্ঞান বা স্ট্যাটিসটিক্সের মতো বিষয় নিয়ে ফ্লোরেন্সের ব্যুৎপত্তি ছিল। সেই কারণেই কোনও একেকটি হাসপাতালে বা লোকালয়ে, স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে কিভাবে রোগ ছড়াচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হলেই বা কিভাবে সেই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এসমস্ত বিষয়গুলিকে মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য ফ্লোরেন্স রীতিমতো গাণিতিক চার্ট, সারণী, এমনকি পাই-চিত্রেরও ব্যবহার করতেন। এমন বিষয়ে এধরনের গাণিতিক পদ্ধতির ব্যবহার এর আগে দেখা যায়নি। এমনকি, পোলার এরিয়া ডায়াগ্রাম নামে বিশেষ এক ধরনের একটি পাইচিত্র – বা যেটিকে অনেকটা গোলাকৃতি হিস্টোগ্রাম বা বারচিত্রের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে – সেই বিশেষ চিত্রের ব্যবহারও প্রথম ফ্লোরেন্সই শুরু করেন। পোলার এরিয়া ডায়াগ্রামের আবিষ্কর্ত্রী হিসেবেও তাই তাঁর নাম প্রণিধানযোগ্য। প্রথম মহিলা হিসেবে তিনি ১৮৫৯ সালে রয়্যাল স্ট্যাটিসটিশিয়ান সোসাইটির সাম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেন। ১৮৭৪এ তিনি আমেরিকান স্ট্যাটিসটিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনেরও সদস্য হন। নাইটিঙ্গেল মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপরিচ্ছন্ন নিকাশি বা পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, অপুষ্টিকর খাবার এবং দূষিত বদ্ধ বাতাস – এগুলির কারণেই সেনাছাউনি অথবা সেনা হাসপাতালগুলিতে এত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এই বিষয়গুলিতে জোর দেবার ফলেই, শান্তির সময়েও ব্রিটিশ সেনাছাউনি বা সেনা হাসপাতালগুলিতে মৃত্যুর হার লক্ষণীয় ভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে।
স্কুটারিতে থাকাকালীন নাইটিঙ্গেল সেই সেনাহাসপাতালটির অর্থসাহায্যের জন্য একটি ফান্ড তৈরী করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হলে পরে, স্বদেশে ফিরে এসে সেই ফান্ডের অর্থেই ১৮৬০ সালের জুলাই মাসে তিনি লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে একটি নার্সিং স্কুলের সূচনা করেন। বর্তমানে সেটি কিংস কলেজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। লন্ডন তথা ইংল্যান্ডের শহরগুলিতে নিকাশি বা পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার উন্নতি সম্পর্কে তিনি আন্দোলন করেন। এমনকি ভারতবর্ষে অবস্থিত ব্রিটিশ সেনাছাউনিগুলির দুর্দশা সম্পর্কে তিনি অবহিত হলে পরে, সেখানকার অবস্থার উন্নতির বিষয়ে তিনি সুপরামর্শ দেন। সামগ্রিক ভাবে ভারতের নিকাশি বা পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার উন্নতি নিয়েও তিনি বক্তব্য রাখেন। ১৮৫৮ এবং ১৮৫৯ সালে ধারাবাহিক ভাবে তিনি রয়্যাল কমিশনের কাছে ভারতবর্ষের সেনাছাউনিগুলির বিষয়ে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন এবং তাঁর সুপারিশগুলিকে কার্যকর করে ভারতীয় সেনাছাউনিগুলিতে সেনামৃত্যুর হার ৬৯% থেকে ১৮%এ নামিয়ে আনতে প্রশাসকেরা সক্ষম হন। ১৮৭০ সালে সরাসরি তাঁর ছাত্রী হিসেবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ট্রেনিংপ্রাপ্তা নার্স হিসেবে কুমারী লিন্ডা রিচার্ডস, তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল অব নার্সিং থেকেই উত্তীর্ণ হন। প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত, ফ্লোরেন্স কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই নার্সিং স্কুলটি ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত প্রথম এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেটি কোনও ধর্মীয় সংগঠনের আওতাভুক্ত ছিল না। নার্সিংয়ের পৃথিবীতে বিজ্ঞান ভিন্ন আর কোনও কিছুই ফ্লোরেন্সের কাছে মান্যতা পায়নি। আধুনিক নার্সিং ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত সেই নিয়ে তিনি ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে নোটস অন নার্সিং বলে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটি আজও নার্সিং বিদ্যার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রাথমিক একটি পাঠ্য হিসেবে সারা পৃথিবীতে বিবেচিত হয়। নাইটিঙ্গেলের কাজ আমেরিকান মুক্তি যুদ্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্সদের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। নিকাশি বা পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার উন্নতি সম্পর্কে তাঁর দীর্ঘমেয়াদী প্রচারের কারণেই ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্রিটিশ নাগরিকদের গড় আয়ু কুড়ি বছরেরও বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পায় বলে বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন। এমনই ছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
মৃত্যুর পরে তাঁকে ওয়েস্টমিনিস্টার এ্যাবেতে সমাধিস্থ করার বিষয়ে কথা হলেও, তাঁর শেষ ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে হ্যাম্পশায়ারের সেন্ট মার্গারেটস চার্চ-চত্বরেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ১৮৪২এ চার্লস ডিকেন্স তাঁর ‘মার্টিন চুজলউইট’ নামের উপন্যাসটিতে সারা গ্যাম্প বলে একটি চরিত্রকে দেখিয়েছিলেন। পেশায় নার্স হলেও, রোগীদের দেখভালের চাইতে সময়ে সময়ে ওয়াইনের গেলাসে চুমুক দিয়ে বুঁদ হয়ে থাকাটাই তার একমাত্র কাজ ছিল। সেসময়ে ইংল্যান্ডের অধিকাংশ হাসপাতালে রোগীদেরকে মেঝেতে খড়ের বিছানা করে ফেলে রাখা হতো। রক্ত শুষে নিতে খড় ছিল উপকারী, এমনটাই ছিল চিকিৎসাব্যবস্থার হকিকত। সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন ফ্লোরেন্স। বাকিটা ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছে।
নারীমুক্তির বিষয়ে সেই বিশেষ প্রবন্ধটির শিরোনাম দিতে গিয়ে ফ্লোরেন্স লিখেছিলেন ‘কাসান্দ্রা’। কেন এই ‘কাসান্দ্রা’ ? গ্রিক পুরাণ অনুসারে এই কাসান্দ্রা হলেন এক ট্রোজান পুরোহিত, দেবতা এ্যাপোলোর পূজারিণী। ঈশ্বর তাঁকে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করবার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে কাসান্দ্রার ভবিষ্যদ্বাণীগুলি সত্যি হলেও মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করবে না। ফ্লোরেন্সও তাই ভেবেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, যতই তিনি নারীমুক্তির, তৎকালীন নারীদের জীবনে শূন্যতার বিষয়ে লিখুন না কেন – তাঁর নারীমুক্তির ডাকে বাকি আর কেউই সাড়া দিতে এগিয়ে আসবে না। এক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যে প্রমাণিত হতে হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর কুড়ি বছরের মধ্যেই ইংল্যান্ডে নারীর সার্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। আজও নার্সিং বিষয়ে তাঁর আদর্শ, তাঁর বিচারকেই ধ্রুবতারা হিসেবে বিশ্বের চিকিৎসক সমাজ অনুধাবন করেন। শুধু তাইই নয়, চিকিৎসকদের যেমন ডিগ্রি লাভের সময় হিপোক্র্যাটিক শপথ উচ্চারণ করতে হয়, তেমনই নার্সদের ক্ষেত্রেও তাঁদের পাঠ শেষ হলে পরে যে শপথবাক্যটিকে ডিগ্রি লাভের সময়ে উচ্চারণ করতে হয় – সেটির রচয়িতা আর কেউই নন, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্বয়ং। তাঁকে আমরা কাসান্দ্রা হতে দিইনি। আমরা তাঁকে মনে রেখেছি। এমন মানুষদেরকে যে কাসান্দ্রা হতে দেওয়া চলে না।
সূত্রঃ
[১] মার্ক বসট্রিজ, ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল – দ্য উওম্যান এ্যান্ড হার লেজেন্ড’, ভাইকিং, লন্ডন, ২০০৮
[২] লিটন স্ট্র্যাচি, ‘এমিনেন্ট ভিক্টোরিয়ানস’, লন্ডন, ১৯১৮
[৩] মার্টিন পুঘ, ‘দ্য মার্চ অব দ্য উওম্যান – এ রিভিশনিস্ট এ্যানালিসিস অব দ্য ক্যাম্পেন ফর উওম্যান সাফ্রেজ, ১৮৬৬-১৯১৪’, অক্সফোর্ড, ২০০০
[৪] সেসিল উডহ্যাম স্মিথ, ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল’, ১৯৫১
[৫] সিরিল জে. ডেভিড, ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’, লুটারওয়ার্থ প্রেস, ১৯৫৮
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের ছবি : সংগৃহীত
লেখক : প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষক, প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment